পুরাণ জনজীবনে প্রভাব বিস্তার শুরু করলে পৌরাণিক দেব-দেবীগণ মানুষের সামাজিক, ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে সরাসরি ভূমিকা পালন করা শুরু করেন। বেদের অত্যধিক আনুষ্ঠানিকতার প্রকোপ থেকে মানুষ পুরাণে নিস্তার খোঁজা শুরু করে। পুরাণ মূলত তিনজন দেবতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, যারা জন্ম, যাত্রা ও মৃত্যুর প্রতীকীতে পরিণত হন। বেদের নিরাকার ব্রহ্মের ধারণাকে অটুট রেখেই ঋষিগণ ত্রিমূর্তির ধারণার প্রবর্তন করেন।
বলা হয়, নিরাকার পরম ব্রহ্ম বিশ্বসংসারকে সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের জন্য তিনটি রূপে প্রকটিত হয়েছেন। সংসারের সব শক্তি তার থেকেই। সবকিছু তাতেই বিলীন হয়। তার সাথে মিশতে পারলেই মোক্ষলাভ হয় বা নির্বাণ মেলে। তবুও, বস্তুবাদী এবং আধ্যাত্মিকতার নিম্নস্তরে অবস্থানকারী মানুষদের মাঝে ত্রিমূর্তির ধারণাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। হাজার হাজার শ্লোক, পুঁথি, চিত্র, নথি, মূর্তি এই তিন বিধাতাকে কেন্দ্র করে সৃজিত হয়।
তিন বিধাতা সৃষ্টির তিনটি কাজের সাথে যুক্ত। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন বা রক্ষা করেন আর শিব ধ্বংস করেন। অনেকেই তিন বিধাতার সাথে তিন গুণ স্বতঃ, রজঃ ও তমঃ-কে সংযুক্ত করেন। আবার, তিন বিধাতাকে তিনটি সত্তা পৃথিবী, জল ও অগ্নির সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়। ব্রহ্মা পৃথিবী, বিষ্ণু জল এবং শিব অগ্নির প্রতীক। এখন কথা হচ্ছে, বিশ্বসংসারে কোন কাজটি আগে হয়েছে বা ত্রিমূর্তির কার আবির্ভাব কীভাবে বা কখন হয়েছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
ব্রহ্মার ভক্তেরা ব্রহ্মাকেই সবকিছুর কেন্দ্রে মনে করে। বিষ্ণুর উপাসনাকারী বৈষ্ণবেরা বিষ্ণুকে ত্রিমূর্তির জন্মদাতা বা জগতের শ্রেষ্ঠ স্বামী মনে করে। আর, শিবভক্ত শৈবগণ শিবকে পরম ভগবান বলে দাবি করেন। একেক পুরাণে একেক ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। বিষ্ণু পুরাণে বিষ্ণুর, শিব মহাপুরাণে শিবের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী একেশ্বরবাদীরা ত্রিমূর্তির প্রকোপ, বেশভুষা, আবেগ উদ্রেককারী কাহিনীগুলোর চেয়ে তাদের রূপকার্থ প্রদানকারী আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোতেই অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সৃষ্টিকারী ব্রহ্মা
এবার ত্রিমূর্তিকে নিয়ে পুরাণের গল্পগুলোর দিকে যাওয়া যাক। একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের ভেতর থেকে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার জন্ম হয়। চোখ খোলার পরে তিনি নিজেকে একটি সহস্রদল পদ্মের মাঝে আবিষ্কার করেন। তিনি চারদিকে কাউকে দেখতে পেলেন না। এক মহাশূন্যে বসে থাকতে থাকতে তার মনে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন জাগা শুরু হয়। ‘কীভাবে আমার জন্ম হলো?’ ‘কে আমার জন্মদাতা? ‘আমার দায়িত্ব কী?’ ‘আমার শুরু হলে শেষ কোথায়?’ প্রভৃতি।
হঠাৎ তার মনে হয় যে পদ্মের উপর তিনি বসে রয়েছেন, সেটির মৃণাল বা ডাঁটি ধরে নিচে নেমে দেখা উচিত- পদ্মের গোড়া কোথায়। তিনি কয়েকশো বছর নিচের দিকে গেলেও কোনো গোড়ার সন্ধান পান না। পদ্মের ভেতর ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি আবার কয়েকশো বছর উপরের দিকে গিয়েও প্রস্ফুটিত পদ্মটি আর খুঁজে পান না। এসময় একটি দৈববাণী হয়,
“জগতের পালনকারী বিষ্ণুকে একমনে স্মরণ করো। তবেই সব দ্বিধা দূর হবে তোমার।”
ব্রহ্মা বিষ্ণুর স্তব করা শুরু করেন। দীর্ঘকাল কেটে যায়। একদিন বিষ্ণু ব্রহ্মার সামনে প্রকটিত হয়ে তার সব দ্বিধা দূর করেন। ব্রহ্মা জানতে পারেন, পদ্মটি বিষ্ণুর নাভি থেকে বের হয়ে শূন্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বিষ্ণু মহাসমুদ্রে শুয়ে যোগনিদ্রায় থাকাকালীন এ ঘটনা ঘটে। এখন প্রশ্ন ওঠে, কে শ্রেষ্ঠ। দু’জনই দাবি করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ। হঠাৎ, তারা উভয়ই একটি কালো বৃহৎ শিলা দেখতে পান। আবার দৈববাণী হয়,
“তোমরা দুজন শিলার দু’দিকে যাও। যে আগে এর প্রান্তে পৌঁছতে পারবে, সে-ই শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।”
দুজন দু’দিকে কয়েক হাজার বছর যাওয়ার পরেও কোনো ফল হয় না। তারা ফিরে যাওয়া শুরু করেন। এদিকে ব্রহ্মার মাঝে মিথ্যাবাদিতা ভর করে। ব্রহ্মা একটি চিহ্ন সৃষ্টি করে সেটি নিয়ে বিষ্ণুকে দেখিয়ে বলেন, তিনি এর কিনারার সন্ধান পেয়েছেন। এতে একটি প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হয়। শিলা ভেদ করে এক পরমপুরুষ বেরিয়ে এসে সাক্ষ্য দেন, ব্রহ্মা মিথ্যা কথা বলছেন। তিনি নিজের পরিচয় দেন- শিব। তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে তাদের ব্যাপারে বলেন। শিব তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন করেন। শিব বললেন,
“আমরা তিনজনই এক পরম ব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট। আমাদের সত্তা এক, কর্ম ভিন্ন। ব্রহ্মা সৃষ্টি করবেন, বিষ্ণু পালন করবেন, শিব ধ্বংস করবেন। এভাবেই চলতে থাকবে।”
শিবের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে ব্রহ্মা সৃষ্টির কাজে হাত দিলেন। তখন তার মাঝে সত্ত্বঃ গুণ ভর করল। তিনি সংযমী ও কর্মপ্রত্যয়ী হলেন। ব্রহ্মা জল থেকে মণ্ড সৃষ্টি করেন। সে মণ্ডে নিজে ঢুকে সেটি দু’ভাগ করে তিনি আকাশ ও ভূমিতে বিভক্ত করেন। মণ্ড থেকে ব্রহ্মা পুরো মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন বলে এ সংসারকে বলা হয় ‘ব্রহ্মাণ্ড’। ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্য শুরু করলে বিষ্ণু ধ্যানমগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কর্মপ্রত্যয় বাড়াতেন। এসময় বিষ্ণুর কর্ণকুহর থেকে মধু ও কৈটভ নামক দুটো রাক্ষসের জন্ম হয়। তারা ব্রহ্মাকে গিয়ে আক্রমণ করে। ব্রহ্মা ও সৃষ্টিকে রক্ষা করতে বিষ্ণু যোগ ছেড়ে উঠে আসেন। বিষ্ণু একা দুটো রাক্ষসের সাথে পাঁচ হাজার বছর লড়াই করেন। কেউই চূড়ান্তভাবে জিততে পারে না। বিষ্ণুর লড়াইয়ের নৈপুণ্য দেখে মধু ও কৈটভ মুগ্ধ হয়ে তাকে একটি বর দিলে তিনি বলেন, “তোমরা আমার দ্বারা বধ হও”। তখন মধু-কৈটভ বিষ্ণুকে বলেন,
“তাই হবো। তবে এমন জায়গায় নিয়ে আমাদের বধ করো, যেখানে জল নেই।”
বিষ্ণু তাদের নিজের উরুর উপরে নিয়ে বধ করলে রাক্ষসদ্বয়ের শরীরের মেদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ব্রহ্মা সেই মেদ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করেন। মেদ থেকে সৃষ্টি হওয়ার কারণে পৃথিবীর আরেক নাম ‘মেদিনী’। আর, বিষ্ণু মধু নামক রাক্ষকে সূদন বা হত্যা করেছিলেন বলে তার নাম হয় মধুসূদন। মহাভারতে কৃষ্ণকে অর্জুন প্রায়ই এ নামে ডাকতেন। কারণ, কৃষ্ণকে বিষ্ণুর একটি অবতার মনে করা হয়।
ব্রহ্মা ভূমি-আকাশ, লোক-পরলোক সৃষ্টির পরে সপ্তঋষি, নারদ, দক্ষ ও চার কুমারকে সৃষ্টি করেন। এরা সবাই ব্রহ্মার মন থেকে জন্মেছেন, তাই এদের বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। তাদের প্রত্যেককেই ব্রহ্মা বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দেন। কেউ পান সংসারধর্ম, কেউ পান রাজধর্ম পালনের দায়িত্ব, কেউ পান যাগ-যজ্ঞের দায়িত্ব, কেউ পান জগতকে জ্ঞানদানের দায়িত্ব।
সপ্তর্ষির প্রথম ঋষি মরীচি, কাশ্যপ নামক এক পুত্রের জন্ম দেন। কাশ্যপের সাথে প্রজাপতি দক্ষের তেরো কন্যার বিয়ে হয়। দক্ষের মোট কন্যা ছিল ষাটজন। তেরো কন্যার গর্ভ থেকে তেরোটি প্রজাতির জন্ম হয়। ব্রহ্মা প্রথম মানব ও মানবীরূপে মনু ও শতরূপাকে সৃষ্টি করেন। মনু ও শতরূপা ইন্দ্রের মতো পদস্বরূপ। একেক মনুর যুগের শুরু থেকে শেষকে বলা হয় মন্বন্তর। ব্রহ্মা সবাইকে বংশবিস্তারের মাধ্যমে সৃষ্টিকে ভরিয়ে তুলতে আদেশ দেন।
সৃষ্টির একপর্যায়ে ব্রহ্মা অহংকারী হয়ে ওঠেন। তমসা তাকে ঘিরে ফেলে। এতে সৃষ্টিতে হাহাকার তৈরি হয়। তখন শিব এসে ব্রহ্মার পাঁচটি মাথায় ভেতর যেটি অহংকারের প্রতীক, সেটি কেটে ফেলে ব্রহ্মাকে নিরহংকার করেন। সবাই এতে ধন্য ধন্য করলেও দক্ষ শিবের উপর চটে যান। প্রতিশোধস্বরূপ শিবকে তিনি তার মহাযজ্ঞে আমন্ত্রণ দেন না এবং শিবের অপমান করেন। ব্রহ্মার শরীর গাঢ় রক্তবর্ণ। বাহন শ্বেতহংস। ব্রহ্মার চারটি মাথা, চারটি হাত। চারহাতে তিনি কমণ্ডলু, জপমালা, পদ্ম ও পুস্তক ধারণ করেন। পুরাণে এই চিহ্নগুলোর তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে।
সচরাচর ব্রহ্মার পূজা করা হয় না। এর কারণস্বরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো, সৃষ্টির আদিতে মিথ্যা বলার জন্য ও সৃষ্টির মধ্যে অহংকারী হওয়ার জন্য শিবের অভিশাপ এবং নিজপত্নী দেবী সরস্বতীর অভিশাপ। বেদে সরাসরি ‘ব্রহ্মা’ শব্দটি নেই। তবে ব্রহ্মার ন্যায় সৃষ্টিকর্তাকে ‘হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রহ্মার সৃষ্টি করা সংসারকে বিষ্ণু পালন করেন। বিষ্ণুর কাছে সকল মানুষ আশ্রয় পায়। তাই তাকে বলা হয় নারায়ণ। সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য বিষ্ণুকে বিভিন্ন রূপে অবতারিত হতে দেখা যায়। অনন্ত নাগের উপর শুয়ে পত্নী লক্ষ্মীর সাথে বিষ্ণু সমস্ত সৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করেন। বিষ্ণুর চারটি হাত। চার হাতে তিনি কৌমদকী গদা, সুদর্শন চক্র, পাঞ্চজন্য শঙ্খ ও পদ্ম ধারণ করে থাকেন। পদ্ম বিষ্ণুর জ্ঞানের প্রতীক, চক্র ধর্মের প্রতীক, শঙ্খ যুদ্ধের প্রতীক এবং গদা অশুভ শক্তি নাশের প্রতীক। বিষ্ণুর বাহন গরুড়। তিনি গরুড়পাখিতে চড়ে উড়ে বেড়ান।
পুরাণবিদ ও ইতিহাসবিদগণের কেউ কেউ ত্রিমূর্তির শেষ সদস্য শিবকে অনার্যদের দেবতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকেই এখানকার আদিবাসীরা শিবের উপাসনা করত। শিবের ভেতর বিষ্ণু ও ব্রহ্মার মতো কুলীনতা ও আনুষ্ঠানিকতার ঘনঘটা দেখা যায় না। গলায় সাপ পেঁচিয়ে, গায় ছাই-ভস্ম মেখে, রুদ্রাক্ষের মালা জড়িয়ে শিব তপস্যারত থাকেন। শিবকে বলা হয় দেবাধিদেব মহাদেব। সকল দেবের দেব এবং সকলের আদি তিনি। শিব অল্পেই তুষ্ট, আবার অল্পেই রুষ্ট হন বলে তাকে বলা হয় ভোলানাথ। যা কেউ গ্রহণ করে না, তা গ্রহণ করেন শিব। বাঘের ছাল, রুদ্রাক্ষমালা শিবের ভূষণ। সকল ভূত-পিশাচ-প্রেত-গণ শিবের অনুচর।
শিবকে একদিকে যোগী, অন্যদিকে সংসারী হিসেবে দেখানো হয়েছে পুরাণে। তিনি প্রথমে দক্ষ প্রজাপতির মেয়ে সতীকে বিয়ে করেন। দক্ষের কুবচন শুনে সতী প্রাণত্যাগ করলে শিব ও তার অনুচরেরা তাণ্ডবলীলা শুরু করে। সতীর দেহকে কোলে নিয়ে শিব তাণ্ডব শুরু করলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডন করেন। সতীর দেহের ৫১টি অংশ পৃথিবীর ৫১ জায়গায় পতিত হলে সে জায়গাগুলোতে সতীপীঠ গড়ে ওঠে।
শিব পরে হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করেন। তাদের কার্তিক ও গণেশ নামক দুই পুত্র ও অশোকসুন্দরী নামক এক কন্যার জন্ম হয়। চিরকুমার কার্তিক দেবতাদের সেনাপতি নিযুক্ত হয়। শিব গণেশকে নিজের গণ নামক অনুচরদের প্রধান নিযুক্ত করলে গণেশের নাম হয় গণপতি বা গণদেবতা। শিবের মাথা পাঁচটি। নেত্র তিনটি। শিবের বাহন নন্দী নামক এক ষাঁড়। শিবই পুরাণে বর্ণিত একমাত্র দেবতা, যার লিঙ্গ পূজিত হয়। ডমরু, ত্রিশূল, অর্ধচন্দ্র, জটা শিবের প্রতীক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।