বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানাকে হারানোর শোককে শক্তি বানিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। পোর্ট অব স্পেনে ২০০৭ সালে নড়াইল এক্সপ্রেসের শোকের আগুনেই পুড়েছিল ভারত। শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়দের মতো কিংবদন্তিরা খসে পড়েছিলেন সেই ধাক্কায়। মাশরাফির সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাকরা বাক্সবন্দী করে দিয়েছিলেন ভারতের পরাক্রমশালী ব্যাটিং লাইনআপ।
স্কোরবোর্ডে রানটা বড় ছিল না। বল হাতে বাংলাদেশকে সব চেষ্টাই করেছেন জহির খানরা। কিন্তু তাদেরকে পাল্টা আক্রমণে চিড়েচ্যাপ্টা করেছিলেন সেই সময়ের ১৭ বছরের যুবক তামিম ইকবাল। ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়েও ভারতীয়দের মনোবল গুড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নামা তামিম। জহির খান, মুনাফ প্যাটেল, অজিত আগারকারদের বেধড়ক পিটিয়ে ভারতকে ম্যাচ থেকেই ছিটকে দেন তিনি। ডাউন দ্য উইকেট এসে অসীম সাহসিকতায় জহির খানকে ছক্কা মেরেছেন তামিম।
৫৩ বলে ৫১ রানের (৭ চার, ২ ছয়) ওই ইনিংসেই তামিমের ব্যাটের অগ্নিমূর্তি দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব, চিনেছিল নতুন তারকাকে। বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজের জাত তুলে ধরা তামিম এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় আসন্ন বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ দলে আছেন সাত তরুণ তুর্কি। সবকিছু ঠিক থাকলে এটাই হবে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ, যার রোমাঞ্চ ছুঁয়ে যাচ্ছে সবাইকে। লিটন কুমার দাস, মোহাম্মদ মিঠুন, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মুস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও আবু জায়েদ রাহীরা প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
২০০৭ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই বাজিমাত করা তামিম বলছেন, এসব তরুণরাই ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের বড় ভরসা হতে পারে। বিশ্বকাপ তাদের জন্য বড় একটা সুযোগ। বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে চেনানোর জন্য এর চেয়ে ভালো মঞ্চ আর হতে পারে না। এখানে পারফর্ম করে রীতিমতো ‘সুপারস্টার’ বনে যেতে পারেন যে কেউ।
প্রথমবার বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়া সাত তরুণের উদ্দেশ্যে অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘অবশ্যই বিশ্বকাপ এমন একটা মঞ্চ। সবাই জানি যে, ক্রিকেট বিশ্বে এটা সবচেয়ে বড় মঞ্চ। এই একটা টুর্নামেন্ট, যেখানে তারকারা জন্ম নেয়। বিশ্বকাপে ভালো করলে আপনি এক রাতেই হয়তো সুপারস্টার বনে যাবেন। এটা সব তরুণ ক্রিকেটারের জন্যই বড় সুযোগ, তারা কতটা ভালো সেটা দেখানোর জন্য। অবশ্যই আমাদের দলে এমন বেশ কিছু প্লেয়ার আছে, যারা তাদের প্রতিভা দেখাবে, আর এখানে প্রতিভা দেখানোর জন্য বিশ্বকাপের চেয়ে ভালো মঞ্চ হতে পারে না।’
সতীর্থ, অগ্রজ তামিমের প্রেরণাদায়ী বক্তব্য মুস্তাফিজ-লিটনরা শুনতে পেয়েছেন কি না, বলা কঠিন। তবে এটুকু সত্য, এসব তরুণদের সামর্থ্য আছে নিজেদের প্রতিভাকে মেলে ধরে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ রাঙিয়ে দেয়ার।
লিটন কুমার দাস
আলোচনায় থাকলেও ২০১৫ বিশ্বকাপে তার জায়গা হয়নি। বিশ্বকাপের পরপরই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। এবার বিশ্বকাপে ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এই ওপেনার। বাংলাদেশের হয়ে এখন পর্যন্ত ১৫ টেস্ট, ২৭ ওয়ানডে, ১৮ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। সেঞ্চুরি মাত্র একটি, সেটি গত বছর (২০১৮) এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে। ফাইনালের চাপের মঞ্চে খেলা ১২১ রানের ওই ইনিংসটাই তাকে বিশ্বকাপের টিকিট এনে দিয়েছে।
মোহাম্মদ মিঠুন
প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে ‘অভিজ্ঞ’ ক্রিকেটার তিনি। ২০১৪ সালে অভিষেকের পর জাতীয় দলে আসা-যাওয়ার মাঝেই ছিলেন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জমিন খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এশিয়া কাপ, নিউ জিল্যান্ড সফরে ব্যাটিং-দৃঢ়তাই সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর মতো পোক্ত ব্যাটসম্যানদের নিয়ে গড়া মিডল অর্ডারেও জায়গা করে দিয়েছে মিঠুনকে। পাঁচ টেস্ট, ১৫ ওয়ানডে, ১৩ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি।
বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ২৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘এটি তো অবশ্যই অন্যরকম একটি অনুভূতি। অনুভূতি তো আর বলে প্রকাশ করা যায় না। সেটা ভেতরেই থাকে।’
বিশ্বকাপে দলের চাওয়া পূরণেই নিয়োজিত থাকবেন মিঠুন। বলছিলেন,
‘অবশ্যই দলের প্রয়োজন পূরণ করা আমার প্রথম লক্ষ্য। দল আমার কাছে কী চায়, সেটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর অবশ্যই যদি আমি দলের সেরা পারফরমার হতে পারি, এর থেকে ভালো কিছু তো হতে পারে না আমার জন্য। চেষ্টা করবো যে, আমি যে পজিশনে খেলবো, সুযোগ পেলে আমার সেরাটা দেয়ার।’
মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত
২০১৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয় ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের জোয়ার বইয়ে দেয়া মোসাদ্দেকের। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি স্পিনটা করতে পারেন বলে জাতীয় দলেও বেশ কদর পেয়েছেন। কিন্তু ফর্মহীনতা, ইনজুরির কারণে বাদ পড়েছিলেন। সর্বশেষ নিউ জিল্যান্ড সফরের দলেও ছিলেন না তিনি। তারপরও বিশ্বকাপের সমীকরণে টিকে থাকলেন ২৩ বছর বয়সী মোসাদ্দেক। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়ে লোয়ার মিডল অর্ডারে দারুণ ব্যাটিং ও কার্যকর অফ স্পিন বোলিংয়ে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছেন তিনি। দুই টেস্ট, ২৪ ওয়ানডে, আট টি-টোয়েন্টি খেলা মোসাদ্দেক খুশি বিশ্বকাপ স্বপ্নপূরণ হচ্ছে বলে।
তিনি বলেছেন,
‘যখন থেকে খেলা শুরু করি, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখি বিশ্বকাপে খেলব। সব বড় টুর্নামেন্টের দিকেই সবসময় ফোকাস থাকে। আমিও সেইভাবে চিন্তা করেছি যে বিশ্বকাপে খেলব, বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করব। আমি ১৫ জনের দলে আছি, আমি চেষ্টা করব সুযোগ পেলে ভালো কিছু করার।’
মুস্তাফিজুর রহমান
২০১৫ সালে ক্রিকেট দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল মুস্তাফিজের। স্লোয়ার-কাটারে ঘরের মাঠে ভারতকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলেন ১৯ বছরের ওই তরুণ। এক সিরিজ না যেতেই ‘কাটার মাস্টার’ উপাধি পাওয়া মুস্তাফিজ এখন আরও পরিণত বোলার। আসন্ন বিশ্বকাপে সন্দেহাতীতভাবেই তার বোলিং হবে বাংলাদেশের বড় ভরসা। ১৩ টেস্ট, ৪৩ ওয়ানডে, ৩০ টি-টোয়েন্টি খেলে এই বাঁহাতি পেসারও খুশি বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়ে।
মুস্তাফিজ বলছিলেন,
‘খুব ভালো লাগছে। যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন থেকেই স্বপ্ন দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলবো। দলে সুযোগ পেয়ে ভালো লাগছে। অবশ্যই এটা স্বপ্নপূরণ।’
মেহেদী হাসান মিরাজ
যুব দলে তার পারফরম্যান্স ও নেতৃত্ব প্রশংসা পেয়েছিল। জাতীয় দলে এসেও বাজিমাত করেছেন, তবে সেটা বল হাতে এবং টেস্ট ক্রিকেটে। ২০১৬ সালে সাদা পোশাকের ওই ঈর্ষণীয় পারফরম্যান্সই তাকে ওয়ানডে দলে জায়গা করে দেয়। মূলত বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনার হিসেবেই এখন মিরাজকে দলে রাখা হয়। তবে দলের প্রয়োজনে ব্যাটিংয়েও অবদান রাখতে পারেন তিনি। ২১ বছর বয়সী মিরাজ ১৯ টেস্ট, ২৫ ওয়ানডে, ১৩ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে। তবে বিশ্বকাপে কন্ডিশন বিবেচনায় অনেক ম্যাচে সাইডবেঞ্চেও বসে থাকতে হতে পারে মিরাজকে।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন
অনেক প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণ অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন। ২০১৭ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয়, কিন্তু নিজের কার্যকারিতা তুলে ধরতে পারেননি। লম্বা বিরতির পর গত বছরের শেষ দিকে আবার জাতীয় দলে ফেরেন। সেখানেই নিজের বোলিং সামর্থ্যের ঝলক দেখিয়েছেন। ব্যাটিংয়েও অবদান রাখার মতো সামর্থ্য আছে তার। জাতীয় দলের হেড কোচ স্টিভ রোডসেরও এই অলরাউন্ডারকে নিয়ে রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। অনেক সময় রুবেল হোসেনকে বসিয়ে রেখে সাইফউদ্দিনকে তৃতীয় পেসার হিসেবেও খেলাতে চান রোডস। ২২ বছর বয়সী এই তরুণ বিপিএল, প্রিমিয়ার লিগেও ভালো করেছেন। ১০ ওয়ানডে, ৯ টি-টোয়েন্টি খেলা সাইফউদ্দিনের জন্য বড় পরীক্ষা হবে বিশ্বকাপ। টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান তিনি কতটা দিতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয় হবে।
আবু জায়েদ রাহী
ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফরমার থেকেই ২০১৮ সালে জাতীয় দলে অভিষেক। শুরুটা চমক-জাগানিয়া না হলেও তার বোলিং সামর্থ্য সবার নজর কেড়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউ জিল্যান্ড সফরে নিজেকে মেলে ধরেছেন ডানহাতি এই পেসার। বল হাতে দুই দিকেই সুইং করাতে পারেন, আর এই দক্ষতার কারণেই বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছেন রাহী। তাও তাসকিনের মতো দ্রুতগতির পেসারকে পেছনে ফেলে বেছে নেয়া হয় ডানহাতি এই পেসারকে। ২৫ বছর বয়সী রাহী পাঁচ টেস্ট ও ৩ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে।