Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন ‘ব্যাটবাগীশ’ কিংবা ডি ককের গল্প

তিনি ঠিক তেমন কেউ নন, সাংবাদিক হিসেবে আপনি যার মুখোমুখি বসতে চাইবেন। মুখে কথার ফুলঝুরি ছোটে না তো! ‘অনুভূতি কেমন’ প্রশ্নের জবাবে যার ভালোর বাইরে ‘ভালো নয়’ বলতেও ঘোর আপত্তি। একটি শব্দ বেশি খরচা হয়ে যায় যে! এজন্যই ‘বাক্যবাগীশ’ বলে তেমন সুনাম তার নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকান সাংবাদিকদের অনেকেই তাই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ড্যানিয়েল গালানকে। যেনতেন কথা তো নয়, ভদ্রলোকের দাবি, ডি কককে তিনি ইন্টারভিউ টেবিলে বসিয়েছিলেন পাক্কা দুই ঘণ্টা! সেই দাবিকে সত্যি প্রমাণ করতেই যেন ‘দ্য ক্রিকেট মান্থলি’ ম্যাগাজিনের জন্যে ওই ক্রিকেট লিখিয়ে লিখে ফেললেন সেই ইন্টারভিউ টেবিলের গল্প

সেই গল্পের সাথে আরও কিছু অংশ যোগ করে এবং কিছু অংশ ছেঁটে ফেলে এই লেখক যাকে বানিয়ে ফেললেন ‘একজন কুইন্টন ডি ককের গল্প’।

আ স্টার ইজ কামিং, কুইন্টন ডি কক; Image credit: Getty Images 

১.

শুরুটা আর দশজন সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটারের যেভাবে হয়, ঠিক সেভাবেই, স্কুল ক্রিকেটের হাত ধরে। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের আদি-অন্ত খোঁজখবর রাখলে কিং এডওয়ার্ড সেভেন স্কুল নামটা আপনিও জানেন। গ্রায়েম স্মিথ, নিল ম্যাকেঞ্জি কিংবা আলী বাখেররা তো উঠে এসেছিলেন এই স্কুল থেকেই।

ডানপিটে স্বভাবের কারণেই হোক কিংবা খেলাধুলার প্রতি ঝোঁকের কারণে, পড়াশোনাটা তার কখনোই তেমন ভালো লাগেনি। পাঠ্যপুস্তকের বিদ্যার্জনের চেয়ে ডি ককের কাছে স্কুলের গুরুত্ব তাই হয়ে গিয়েছিল ‘খেলোয়াড়ি জ্ঞান অর্জন’। নানা সময়েই নানা শিক্ষক যে অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ডি ককের ‘চক্ষুশূল’ হতে তাদের সময় লাগেনি মোটেই।

বেশ খানিকটা সময় এমন করে পড়াশোনা আর খেলাধুলার মাঝে দোটানায় কাটানোর পর সমাধান নিয়ে এলেন হাইভেল্ড স্ট্রাইকার্সের কোচ গ্র‍্যান্ট মরগান, ডি কককে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন ক্রিকেটকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার জন্য। বলা বাহুল্য, ডি কক এক পায়ে খাড়াই ছিলেন।

২.

কৈশোরে, প্রিয় শটে, ক্যামেরাম্যানের ফ্রেমে;  Image credit: Getty Images 

কিন্তু সিদ্ধান্তটা তো আর ডি ককের একার ছিল না, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল পরিবার আর স্কুল কর্তৃপক্ষও। তাদের রাজি করাতে ডি কককে ক্রিকেট মাঠে প্রতিভার কিছু না কিছু প্রমাণ রাখতেই হতো। সুযোগটাও পেয়ে গিয়েছিলেন খুব দ্রুতই। ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকার তিনদিনের ম্যাচের প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে রান করেছিলেন ৬৫ গড়ে, স্ট্রাইকরেট শুরু দিন হতেই একশ ছাড়ান। যদিও শুরুটা করেছিলেন নয়-ছয়ে (প্রথম ম্যাচের দুই ইনিংসে রান করেছিলেন যথাক্রমে ৯ আর ৬)।

এমন পারফরম্যান্সের পরেই গ্র‍্যান্ট মরগানের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন ডি ককের পরিবার। ডি ককের পড়াশোনার পাট তাই চুকেছিল স্কুল পেরোনোর আগেই।

৩.

২০০৯ সালে যুব টুর্নামেন্টে অমন পারফরম্যান্সের পুরষ্কারস্বরূপ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জায়গা পেয়েছিলেন গটেংয়ের দলে। পরবর্তীতে ২০১০-১১ মৌসুমের জন্যে ডাক পেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টিম লায়নসে, যারা আদতে হাইভেল্ড স্ট্রাইকার্সেরই সিনিয়র দল। প্রথম মৌসুম ভালো-মন্দে মিশিয়ে কাটলেও সেটাই ছিল যথেষ্ট। তড়তড়িয়ে বেয়ে চলা সিঁড়ির পরের ধাপ ২০১২ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, যে আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। এক সেঞ্চুরি আর দুই ফিফটিতে সেবারের আসরের সেরা চার রানসংগ্রাহকের একজন ছিলেন ডি কক।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ রাঙিয়ে;  Image credit: ICC 

যুব বিশ্বকাপ থেকে ফিরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে, লায়নসের পাঁচ বছরের শিরোপা খরা ঘোচানোতে রেখেছিলেন বড় ভূমিকা। ব্যাটিংয়ের সাথে আলোচনায় এসেছিলেন কিপিংয়ের কারণেও, জাতীয় দলে পা রাখার আগেই বাতাসে গুঞ্জন উঠেছিল, ‘নতুন গিলি আসছেন!’

নটে গাছটি মুড়ালো, গিলির অপেক্ষা ফুরালো; Image credit: Reuters 

এমন একজনকে জাতীয় দলে পরখ করে দেখতে চাইবেন যেকোনো দেশের নির্বাচকরাই। এবি ডি ভিলিয়ার্সকে বিশ্রাম দিয়ে সুযোগটা নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান নির্বাচকরাও। ২০১৩ সাল তখনও দূর ভবিষ্যৎ।

৪.

টি-টোয়েন্টি সিরিজে নিজের পছন্দের ওপেনিং পজিশনে ব্যাটিং করতে পারেননি, যা পেরেছিলেন নিজের খেলা ২য় ওয়ানডেতে। আর সুযোগটা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন চতুর্থ ওয়ানডেতে, ভারতের বিপক্ষে।

২০১৩ সালের সে সিরিজটা ভারতীয় বোলাররা ভুলেই যেতে চাইবেন, বিশ বছরের এক আনকোরা তরুণের কাছে নাকানিচুবানি খাওয়ার স্মৃতি কে-ই বা মনে রাখতে চায়!

সিরিজে টানা তিন সেঞ্চুরি, ৩৬ চারের সাথে সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেটটা পেয়েছিলেন পূর্বসূরী গিবসের কাছ থেকে,

‘ওর মাঝে আমি নিজের ছায়া খুঁজে পাই!’

প্রিয় প্রতিপক্ষ? ভারত হতে বাধ্য; Image credit: BCCI

সে সিরিজের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষেও করা এক সেঞ্চুরিতে বছর শেষ করেছিলেন ৭৪১ রান নিয়ে। অভিষিক্ত এক ক্রিকেটারের জন্যে রীতিমতো স্বপ্নের বছর কাটিয়ে ফেললেন ডি কক।

৫.

এমন পারফরম্যান্সের পুরষ্কার পেতেও দেরি হয়নি। ২০১৪ সালের শুরুতেই, দেশের হয়ে সাদা পোশাকে প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন এই বাঁহাতি। প্রথমবার টেস্ট খেলার রোমাঞ্চেই বোধহয় দুই ইনিংস মিলিয়ে করতে পারেননি ৪১ রানের বেশি। সামলে নিয়েছিলেন পরের ম্যাচেই, শ্রীলংকার বিপক্ষে তুলে নিয়েছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি। সাথে সে বছরের শেষ নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ষষ্ঠ ওডিআই শতক তুলে নিয়ে নিজেকে বানিয়ে ফেলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বড় ভরসা।

৬.

মুদ্রার ওপিঠ দেখতেও সময় লাগেনি খুব বেশি। ২০১৫ সালের শুরুর ম্যাচে রান করেছিলেন মোটে চার, যে ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপেও। মাত্র এক ফিফটিতে নিজের প্রথম বিশ্বকাপে সংগ্রহ করেছিলেন মোটে ১৪৫।

পড়তি ফর্মের এ ধারা টেনেছিলেন বিশ্বকাপের পরও। সাথে যোগ হয়েছিল আচরণজনিত সমস্যা। ফলাফল, টেস্ট দলে জায়গা হারিয়েছিলেন ড্যান ভিলাসের কাছে, আর ওয়ানডে দলে তার বদলি হয়ে এসেছিলেন ভ্যান উইক।

ধ্বংস, নিঃশেষ, সর্বস্বান্ত; Image credit: Getty Images

৭.

তামিম ইকবালকে ধাক্কা দিয়ে সেবার জরিমানা গুণেছিলেন ম্যাচ ফি’র ৭৫ শতাংশ। ডি ককের বিরুদ্ধে অবশ্য এমন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আগেও এসেছিল, এমনকি এসেছিল এর পরেও।

শোনা যায়, যখন বয়সভিত্তিক দলে খেলতেন, তখন তার বাকবিতণ্ডা হয়েছিল খোদ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচের সঙ্গে। তামিমের সঙ্গে ওই ঘটনার পরে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গেও। মাঠে চলা কথার লড়াই গড়িয়েছিল মাঠের বাইরেও। কেপটাউনের সেই ‘টানেল কেলেঙ্কারি’ নিয়ে কথা হয় এখনও।

ডি কক অবশ্য সেই কথার লড়াই নিয়ে অনুতপ্ত নন। এমনকি তার খুব কাছে মানুষ কিংবা শুরুর দিকের কোচরাও রাজি নন, ডি ককের মাঝেমাঝেই এমন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়াকে সমস্যা বলতে। ডি ককের বেড়ে ওঠা খুব কাছে থেকে দেখেছেন যিনি, সেই প্যাডি আপটনের মতে,

‘যখন কেউ একজন ডি ককের মতো অসামান্য প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তখন কোনো কিছু তার মনমতো না হলে এমনভাবে ক্ষোভের উদগীরণ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক!’

৮.

জাতীয় দলে জায়গা হারানোর ব্যাপারটিকে ডি কক অবশ্য স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। সে সময়ে তার মনের অবস্থা কেমন ছিল, তা জানা যায় তার এমন কথা থেকে,

‘আমি খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, যেন প্রথমবারের মতো প্রেমিকা আমার সঙ্গে প্রতারণা করল!’

বিশ্বকাপ এলেই কী হয়ে যায়? Image credit: Getty Images 

রাগে-দুঃখে ক্রিকেটকে বিদায় দিলেন কয়েকদিনের জন্যে। সে ক’দিন মাছ ধরে বেড়ালেন, জঙ্গলে চষে বেড়ালেন, ট্যাটু করালেন ডান বাহুতে। জাম্বেজিতে টাইগার ফিশের সঙ্গে রেসলিং লড়লেন, একমাত্র মিচেল জনসনের বাউন্সার মোকাবেলাই যে লড়াইয়ের ধারেকাছে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ডি কক।

ক্রিকেট থেকে দূরে গিয়েই যেন ফিরে এল ক্রিকেটের হারানো ফর্ম। সাথে নিজের আচরণ শুধরে নেয়ার কাজটাও করেছিলেন এই সময়ে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের পরিবর্তিত রূপ দেখিয়ে দুই ফরম্যাটের জাতীয় দলেই ফিরেছিলেন এক সিরিজ বাদে। ফিরে প্রথম ওয়ানডে সিরিজেই ভারতের বিপক্ষে দুই সেঞ্চুরিতে জানিয়েছিলেন, তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দলে ফিরে জানিয়েছিলেন, তার বদলি কেউ হতে পারেনি।

৯.

ডি ককের হারানো ফর্মে সুযোগ পাওয়া ড্যান ভিলাসকে থেমে যেতে হয়েছিল ৬ ম্যাচেই, মাত্র ১১ গড় নিয়ে কত দূরই বা যাওয়া যাবে! ডি কককেও তাই ফেরাতে হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে। আগেই সিরিজ খোয়ানো দক্ষিণ আফ্রিকার মান বেঁচেছিল শেষ টেস্টে ডি ককের ১২৯ রানের ইনিংসে। যার বদৌলতে ১ উইকেটে ২৩৭ থেকে চোখের পলকে ৫ উইকেটে ২৭৩ রানে পরিণত হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংস থেমেছিলো ৪৭৫ রানে। লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে রান-বলের পাল্লা দেয়া যে ইনিংস দেখে ইএসপিএনক্রিকইনফো শিরোনাম করেছিল, ‘South Africa’s wonder kid grows up’!

সেই ইনিংসের পর দক্ষিণ আফ্রিকা আর তাকে বাদ দেবার স্পর্ধা দেখায়নি। বলা ভালো, দেখাবার সুযোগ পায়নি।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে মাঝের সময়টায় ডি কক ওয়ানডেতে রান করেছেন ৩,০৩৯। রান করার চেয়েও বেশি চোখ কেড়েছেন রান করার ধরনে। এবি ডি ভিলিয়ার্সের অবসর-উত্তর যুগে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের মুখ হয়ে উঠেছেন এই বাঁহাতি। জেসন রয়ের চেয়ে তিনি কিছুটা ধীর খেললেও কিংবা বাউন্ডারি আদায় করতে বেয়ারেস্টোর চাইতে তার দুই বল বেশি লাগলেও স্বীয় উইকেটের মূল্য দিয়েছেন তিনিই সবচেয়ে বেশি। প্রতি ডিসমিসালের আগে বল খেলেছেন গড়ে ৭২টি। দুই বিশ্বকাপের মাঝের সময়টায় পাওয়ারপ্লে’তে ডি কক রান তুলেছেন ৬৫.৩৮ গড়ে। শুরুর দশ ওভারে তিনি রান করেছেন ৪২.২৯ শতাংশ বলে, এক ডেভিড ওয়ার্নারই যেখানে আছেন তার চেয়ে ভালো অবস্থানে।

ডি কক, ক্যারিয়ারের সায়াহ্ন আসতে আসতে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন, এই প্রত্যাশা তো করাই যায়; Image credit: Getty Images 

ক্যারিয়ারের ১৪ সেঞ্চুরির আটটি আর ২৪ অর্ধশতকের ১৯টিই এসেছে ২০১৫ বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে। টেস্টের ডি-কক যেন আরও পরিণত হয়েছেন এই সময়টায়। প্রতি ম্যাচেই লেজের দিককার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে এনে দিয়েছেন কার্যকর কিছু রান, ম্যাচশেষে যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাগ্য নিয়ন্তা। টেস্ট ক্রিকেটে তার ৭৩ ছাড়ান স্ট্রাইকরেট সর্বকালের সপ্তম সর্বোচ্চ। ক্যারিয়ারশেষেও তা এমনই থাকে কি না, তা-ই দেখবার অপেক্ষা।

অবশ্য অপেক্ষাটা যত দীর্ঘ হয়, ততই ভালো। মুখে কথার তুবড়ি না ছুটলেও এমন ‘ব্যাটবাগীশ’ একজনকে দেখাটাও তো দর্শক হিসেবে আপনার চরম সৌভাগ্য!

This article is in Bangla language. Quinton De Kock is one of the leading young cricketers right now. This article is going to depict his effortless genius. Necessary hyperlinks are inserted inside.

Featured image © Getty Images   

Related Articles