ব্যাটল অব ইয়ো জিমা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সংঘটিত অন্যতম রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ। আমেরিকান নেতৃবৃন্দ ভেবেছিল, তারা মাত্র দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই জাপানের আগ্নেয়দ্বীপ ইয়ো জিমা দখল করে নিতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। জাপানীদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে টানা পাঁচ সপ্তাহ স্থায়ী হয় সেই যুদ্ধ। প্রাণ হারায় অসংখ্য মার্কিন সেনা।
আজকের লেখায় সময়ের গাড়িতে চড়ে আমরা ঘুরে আসবো ইয়ো জিমায় সংঘঠিত সেই রক্তক্ষয়ী দিনগুলো থেকে।
১৯৪৪ সালের দিকে মিত্রবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল মুক্ত করার লক্ষ্যে জাপানী সেনাবাহিনীর সাথে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। একসময় লড়াই ছড়িয়ে পড়ে ইয়ো জিমা দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত মারিয়ানা আইল্যান্ডে।
সেখানে অবস্থিত জাপানী সেনা ক্যাম্পে হামলা চালায় আমেরিকা। আমেরিকানদের তীব্র আক্রমণে মারিয়ানা আইল্যান্ড থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় জাপানি সৈন্যরা।
মারিয়ানা আইল্যান্ডে আমেরিকা তাদের নতুন অত্যাধুনিক বিমান B-29 সুপারফোরট্রেসের উড্ডয়নের জন্য একটি নতুন বিমান ঘাঁটি তৈরি করে। কারণ, এর আগে জাপানের মূল ভূখন্ডের কাছাকাছি কোনো বিমান ঘাঁটি ছিল না আমেরিকার।
পরবর্তীতে এই B-29 বিমানই জাপানীদের জন্য এক বিভীষিকার নাম হয়ে দাঁড়ায়। টোকিওসহ জাপানের অন্যান্য শহরে আক্রমণের জন্য মারিয়ানা আইল্যান্ডের বিমান ঘাঁটি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যেতো একেকটি B-29।
অবশ্য জাপানিরা বসে ছিল না। মার্কিন বিমান হামলা ঠেকানোর জন্য তারা জাপানের মূল ভূখণ্ড এবং মারিয়ানা আইল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত ইয়ো জিমা দ্বীপে অপর একটি বিমান ঘাঁটি গড়ে তোলে।
আমেরিকান বিমানগুলো যখনই ইয়ো জিমা অতিক্রম করে জাপানের মূল ভূখণ্ডে যেতে চাইতো, তখনই সেখানকার বিমান ঘাঁটি থেকে জাপানি ফাইটার-জেটগুলো পিছু নিতো তাদের। এভাবে বেশ কিছু B-29 বিমান বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয় জাপানি বাহিনী।
ইয়ো জিমায় জাপানের সাফল্য চিন্তার ভাঁজ ফেলে আমেরিকান নেতাদের কপালে। তারা যেকোনো মূল্যে দ্বীপটি দখলে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। কারণ জাপানে সাফল্য পেতে হলে ইয়ো জিমা দখলের কোনো বিকল্প ছিল না!
১৯৪৪ সালের ৩ অক্টোবর আমেরিকান নৌ-বাহিনীকে ইয়ো জিমা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই অপারেশনের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন ডিটাচমেন্ট’।
১৯ শে ফেব্রুয়ারি ভোর হওয়ার আগেই ৩০ হাজার মার্কিন নৌ সেনা ইয়ো জিমার সৈকতে অবতরণ করে। এর প্রায় ২০ মিনিট পরে আরও ৪০ হাজার জন মেরিন সদস্য সেখানে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ ইয়ো জিমাতে সর্বমোট ৭০ হাজার সেনা পাঠানো হয় সেখানে অবস্থানরত প্রায় ২০ হাজারের মতো জাপানি সৈন্যের মোকাবেলায়!
জাপানের চেয়ে অভিজ্ঞতা, অস্ত্র, সেনা সংখ্যা ইত্যাদি সব দিক দিয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তারপরও যুদ্ধের ময়দানে যা ঘটতে যাচ্ছিল, তা হয়তো দূরতম কল্পনাতেও ভাবেনি কোনো মার্কিন সেনাই।
ইয়ো জিমাতে পা রেখেই মেরিন সেনারা বিপদ আঁচ করতে পারেন। কারণ, সেখানকার কালো রঙের নরম বালির মধ্য দিয়ে তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র টেনে নিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে দাঁড়ায়, যখন তারা জাপানীদের তীব্র বোমা বর্ষণের মুখে পড়েন।
ইয়ো জিমার প্রবেশপথেই জাপানী বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কচুকাটা করতে থাকে আমেরিকান সৈন্যদের। ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আমেরিকান বাহিনী।
সন্ধ্যার দিকে যখন জাপানীদের আক্রমণ বন্ধ হয়, ততক্ষণে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মার্কিন সৈনিক প্রাণ হারিয়েছে, নয়তো বাজেভাবে আহত হয়েছে। এ দফায় আমেরিকানরা বুঝতে পারে যে, প্রতিপক্ষ এবার যথেষ্ট আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে।
ইয়ো জিমায় জাপানি বাহিনীর যাবতীয় রণকৌশল সাজিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল তাদামিচি কুরিবায়াসি। তিনি দ্বীপটিতে জাপানী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন।
পূর্বে অশ্বারোহী বাহিনীতে কাজ করা কুরিবায়াসি, ইয়ো জিমাতে জাপানের বিখ্যাত আত্মঘাতী আক্রমণ পন্থা– বানজাই চার্জ গ্রহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। জাপান এই ধরনের আত্মঘাতী আক্রমণ ‘ব্যাটল অব সাইপান’– এ আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে হেরে গিয়েছিল। তাই কুরিবায়াসি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
এর পরিবর্তে তিনি তার অধীনস্থ বাহিনীকে সমস্ত দ্বীপ জুড়ে বেশ কিছু গোপন বাঙ্কার তৈরির নির্দেশ দেন, যেখান থেকে শত্রুর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করা যাবে। এছাড়াও বাঙ্কারগুলোর মধ্যে সহজে যোগাযোগের জন্য তারই নির্দেশে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়।
কৌশলের অংশ হিসেবে দ্বীপটিতে অবস্থিত ৫৫৪ ফুট উঁচু ‘সারিবাচি’ পাহাড়ের ওপর সাত তলার সমান উঁচু একটি দুর্গ গড়ে তোলে জাপানীরা। সেখানে অস্ত্র, রসদ এবং যোগাযোগের যাবতীয় সরঞ্জাম মজুদ করা হয়। কুরিবায়াসির অসাধারণ কৌশলের গুণেই যুদ্ধের প্রথম দিন ব্যাপক পরিমাণ আমেরিকান সৈন্য হতাহত হয়।
কিন্তু সারিবাচি পাহাড়ের ঢালে অবস্থানরত জাপানী সৈন্যদের একটি ভুলের কারণে দ্রুতই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, তারা যেন কোনোক্রমেই দিনের আলোয় আমেরিকানদের ওপর গুলি বর্ষণ না করে।
কিন্তু সৈকতের নিকটে আমেরিকানদের পর্যুদস্ত হতে দেখে তারা আর লোভ সামলাতে পারেনি। অন্যান্যদের সাথে তারাও গুলি করা শুরু করে। ফলে তাদের গোপন অবস্থান প্রকাশ হয়ে যায় শত্রুপক্ষের কাছে।
আমেরিকান বাহিনী সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে। তারা জাপানীদের ভুলের সুযোগ নিয়ে পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ করে পাহাড়টির ওপর এবং চারদিন প্রাণপণ যুদ্ধ করে সারিবাচি পাহাড় থেকে হটিয়ে দেয় জাপানীদের।
সারিবাচিতে প্রত্যেক জাপানী সেনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। সমস্ত গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে হাতের কাছে থাকা ছোট ছোট পাথর দিয়ে পর্যন্ত শেষ চেষ্টা করে গেছেন তারা। কিন্তু আত্মসমর্পণ করেননি!
একসময় অবশ্য তাদের হার মানতেই হয়। চারদিনের ভয়াবহ যুদ্ধ শেষে আমেরিকান মেরিন সেনারা পাহাড় চূড়ায় তাদের পতাকা উত্তোলনে সক্ষম হন।
সেই পতাকা তোলার একটি ছবি পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে প্রচারিত ছবিতে পরিণত হয়। ইয়ো জিমার যুদ্ধে এটিই ছিল আমেরিকান বাহিনীর প্রথম সাফল্য।
এরপর তারা মনোনিবেশ করে দ্বীপের উত্তরাংশ জয়ের দিকে। ফলে আরও দীর্ঘায়িত হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের বাকিটা সময় জাপানীরা বাঙ্কারের ভেতরে থেকেই লড়াই করে গিয়েছে এবং রাতের আধাঁরে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিদ্রামগ্ন আমেরিকানদের ওপর।
সারিবাচি পাহাড়ের মাত্র আড়াই হাজার গজ দূরেই ছিল ইয়ো জিমার শেষ সীমা। অথচ এটুকু জায়গা দখল করতে আমেরিকানদের লেগে গিয়েছিল আরও ত্রিশটি দিন। অর্থাৎ দিনে মাত্র আশি গজ করে অগ্রগতি হয়েছিল মেরিন সেনাদের! এ থেকেই বোঝা যায়, কুরিবায়াসির যুদ্ধকৌশল কতটা সফল ছিল।
জাপানীদের তীব্র প্রতিরোধে একসময় নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় আমেরিকান নেতৃত্ব। তারা গতানুগতিক যুদ্ধ কৌশলের বাইরে গিয়ে জাপানী বাঙ্কারগুলো খুঁজে বের করে সেখানে আগুন এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করা শুরু করে।
বেশ কয়েকবার যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করা আমেরিকান অফিসার জেনারেল স্মিথ পরবর্তীতে বলেন,
ইয়ো জিমার যুদ্ধ ছিল নিঃসন্দেহে আমেরিকান মেরিন ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও ভয়াবহতম যুদ্ধ।
আমেরিকান সেনারা ধীরে ধীরে দ্বীপের শেষ সীমার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় আমেরিকান বিমান বাহিনী।
আমেরিকান ট্যাঙ্ক ও ভারী আর্টিলারির সাথে যোগ হওয়া তীব্র বিমান হামলা এবং দ্বীপটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা আমেরিকান ফাইটার জাহাজগুলোর ক্রমাগত বোমাবর্ষণে একসময় ভেঙে পড়ে জাপানীদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
এক তারবার্তায় কুরিবায়াসি বলেন,
স্থল-যুদ্ধ নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কিন্তু এই নৌ এবং বিমান হামলার কোনো উত্তর আমার জানা নেই।
একসময় জাপানীদের সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে তারা। ফলে ওপর মহলের নির্দেশ আর মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা থাকলো না।
উপায়ন্তর না দেখে জাপানী সৈন্যরা বেছে নেয় তাদের চিরায়ত রণকৌশল– বানজাই চার্জ। ওপর মহলের নির্দেশ না পৌঁছানোয় কুরিবায়াসির নিষেধ সত্ত্বেও তারা প্রায় খালি হাতেই যুদ্ধের ময়দানে শেষবারের মতো শত্রুর মুখোমুখি হয় এবং পরিণত হয় আমেরিকান মেশিনগানের সহজ শিকারে।
১৪ ই মার্চ জাপানে পাঠানো এক তারবার্তায় কুরিবায়াসি বলেন, “লড়াই আর খুব বেশি বাকি নেই। ছেলেদের আত্মত্যাগ দেখে স্বয়ং ঈশ্বরও কাঁদবেন।”
এর এক সপ্তাহ পরে তার পাঠানো শেষ তার বার্তায় তিনি বলেন, “আমাদের আর মাত্র চারশ’ সেনা অবশিষ্ট আছে। শত্রুপক্ষ আমাদের তিনশ’ মিটারের মধ্যে চলে এসেছে। লাউড স্পিকারে তারা আমাদের আত্মসমর্পণের আহবান করছে। তা শুনে আমার সেনারা শুধু হেসেছে।”
১৪ মার্চ আমেরিকান মেরিন সেনারা উত্তর দিকের উপকূল কিটানো পয়েন্টে পৌঁছে যায়। সেখানে ১২ দিনের তীব্র যুদ্ধ শেষে অবশেষে ২৬ শে মার্চ নিজেদের পতাকা উত্তোলনে সক্ষম হন তারা। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ– ব্যাটল অব ইয়ো জিমার।
২৬ শে মার্চ থেকে কুরিবায়াসির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি সম্ভবত সম্মানজনক মৃত্যু হিসেবে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে অসংখ্য লাশের ভিড়ে তার লাশ আর আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্রতি স্কয়ার ফুটে এত বোমা বর্ষণ আর কোথাও বা কখনো হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যতটা হয়েছে ইয়ো জিমায়। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আমেরিকা বিজয়ী হলেও এর জন্য তাদের যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিল। ৩০ হাজার আমেরিকান সৈন্য হতাহতের বিপরীতে ১৯ হাজার জাপানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিল এই যুদ্ধে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে এটিই হয়ে যায় প্রথম লড়াই, যেখানে জাপানের চেয়ে আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক অনেক বেশি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে গল্প সংকলন