সিনেমা বা টিভির পর্দায় বড় বড় নগর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমরা বহুবার দেখেছি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী ৮০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে এ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ১০টি নগরী। “নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ” জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ম্যাথু হওয়ার সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার আশঙ্কাজনক পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনায় জানিয়েছেন ভয়াবহ এসব তথ্য!
১. মায়ামি
২০১০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মুখোমুখি হবে ৬ ফুট উঁচু সমুদ্রপৃষ্ঠ। যার মধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আমেরিকার ফ্লোরিডায় অবস্থিত মায়ামি-ডেড ও ব্রোওয়ার্ড কাউন্টির বাসিন্দা।
এখন পর্যন্ত মায়ামি কোনোভাবেই এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রস্তুত না।
২. নিউ অরলিন্স
হওয়ারের সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘আসন্ন বিপর্যয়গুলোতে হারিয়ে যাবে’ এমন শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আমেরিকান শহর নিউ অরলিন্স। প্রায় ১০০,০০০ মানুষের আবাসস্থল এ শহরটির বন্যা দুর্গত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর মাত্র ৩ ফুট বৃদ্ধি পেলেই হারিয়ে যাবে এ শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাসিন্দা।
আর বন্যার সঙ্গী হয়ে ধেয়ে আসা অন্যান্য দুর্যোগের ফলে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যাটা যে নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
৩. শিকাগো
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের জলবায়ু বিজ্ঞানী রিচার্ড রুডের মতে, শিকাগো আমেরিকার সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলগুলোর একটি।
১৯৯৫ সালে, “আমেরিকার কসাইখানা” নামে পরিচিত এ শহরটিতে ভয়াবহ এক হিট ওয়েভে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৭০০ মানুষ। সে সময় অঞ্চলটির তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচারে যা কিনা ছিল ৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। উল্লেখ্য, ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়ালেই সাধারণত মৃত্যু হয় একজন স্বাভাবিক মানুষের।
নিকট ভবিষ্যতে আবারও একই রকম কিংবা আরও ভয়ানক মাত্রার হিট ওয়েভ আঘাত হানতে পারে শিকাগো শহরে।
৪. দুবাই
২০১৫ সালে এমআইটি গবেষকদের করা এক সমীক্ষায় আরব সাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগকে ঐ অঞ্চলের উষ্ণতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেখানকার জলবায়ু পরিবর্তন প্রাণঘাতী হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
২০৭০ সাল নাগাদ গ্রীষ্মকালীন সময়ে দুবাই ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর তাপমাত্রা ১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যেতে পারে। একই সাথে, প্রতি এক থেকে দুই দশক পরপর ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যাবার মতো ভয়ানক ঘটনার সম্ভাবনাও দেখছেন তারা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নিউজ ওয়েবসাইট নিউজ.কম.এইউ তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেয়া সাক্ষাৎকারে দুবাই বাসিন্দারা বলেন, বর্তমান সময়েই তারা জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণত চেষ্টা করেন ঘর থেকে বাইরে বের না হবার। “এয়ার-কন্ডিশনড রুম থেকে বাইরে বের হলেই মনে হয় যেন, খুব কাছ থেকে ওভেনের দরজা খুলছি। হুট করেই গরম বাতাসের ধাক্কা এসে লাগে।”
৫. আবুধাবি
তালিকার অন্যান্য শহরগুলোর মতো, ২০৭০ সাল নাগাদ আবুধাবিতেও তাপমাত্রা পৌঁছে যাবে অসহনীয় পর্যায়ে।
এমআইটির সেই সমীক্ষার দেয়া তালিকায় আরও আছে মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত শহর আবুধাবি। তাদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আবুধাবিতে রেকর্ড হওয়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখা যাবে অন্তত একাধিকবার। এখন পর্যন্ত আবুধাবিতে রেকর্ড হওয়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১২৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এর চেয়েও আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, ২০৭০ সালের পর, নিয়মিত বিরতিতে আঘাত হানবে এই প্রাণঘাতী তাপমাত্রা।
৬. সাংহাই
চীনের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। ২০১৮ সালে নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এই অঞ্চলে আঘাত করতে চলেছে ভয়াবহ হিট-ওয়েভ! আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকিতে থাকা শহরটির নাম সাংহাই।
২০৭০ থেকে ২১০০ সালের মাঝে অন্তত পাঁচবার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে সাংহাইয়ের তাপমাত্রা। যেখানে ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার হবে ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
৭. বেইজিং
সাংহাইয়ের মতো বেইজিংও চীনের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। চীনে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপন্ন করা শহরগুলোর মধ্যেও অন্যতম শহর এটি। বায়ু দূষণ এখানে এতটাই তীব্র যে, মাঝে মধ্যে এখানে তৈরি হওয়া বিষাক্ত গ্যাসের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনেও মাস্ক পরতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।
বিশ্বের সকল যুদ্ধ ও সংঘাতে নিহতদের চেয়েও ১৫ গুণ বেশি মৃত্যুর কারণ এই ‘নীরব ঘাতক’ বায়ু দূষণ।
২০১৫ সালে, শুধুমাত্র দূষণজনিত রোগে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৯ মিলিয়ন। যা কিনা সে বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণ হারানো মানুষের প্রায় ১৬ শতাংশ।
৮. ঢাকা
ঠিক তা-ই, আপনি ভুল দেখছেন না। তালিকায় এর পরের শহরটি হলো, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শহরগুলোর নাম বলতে গেলে বাংলাদেশের রাজধানীর নাম আসবে না, তা কি হয়?
সাম্প্রতিক সময়ে নাতিশীতোষ্ণ দেশটির জলবায়ুতে উচ্চমাত্রার হিট ওয়েভ আঘাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পাশাপাশি, বিধ্বংসী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত তো আছেই। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে, বন্যা কবলিত হয়ে ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। ১৪০ জনের মৃত্যু হবার পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ৭ লক্ষ বাসস্থান। এছাড়াও হারিয়ে গেছে মূল্যবান আবাদি জমি।
বাংলাদেশে প্রতিবছর নদী-ভাঙনে প্রায় ২ লক্ষ লোক ভিটেমাটি হারায়। আইপিসিসি এর হিসেব মতে, সমুদ্র-সমতলের উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট বৃদ্ধি পেলেই প্রায় ২০% শতাংশেরও বেশি স্থল-সম্পদ হারাবে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ঠ দুর্যোগে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষজন ছুটে আসছে ঢাকায়। বসবাসের অযোগ্য তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা, জনসংখ্যার চাপে মুমূর্ষু এ শহরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই এখন এখানকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৯. দিল্লি
বেইজিং ও সাংহাইয়ের সাথে দিল্লির অতি উষ্ণ তাপমাত্রার সামঞ্জস্য রয়েছে। কালো ধোয়ায় ঢাকা বাতাসের কারণে স্কিন র্যাশ, নশিয়া, মাথা ব্যথাসহ নানান রকম শারীরিক সমস্যা এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনকার সমস্যা। এছাড়াও, নিয়মিত হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণের মতো ঘটনা তো আছেই।
২০১৭ সালের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দিল্লির মতো দক্ষিণ এশীয় শহরগুলোতে ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার ছাড়িয়ে যেতে পারে ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত! যার অর্থ ২১০০ সাল নাগাদ প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করবে আধুনিক এই শহরগুলো।
সাধারণত, প্রতি ২৫ বছরে মাত্র একবার এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, ভারতীয় জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচারে ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে অবস্থান করছে। আর ২১০০ সাল নাগাদ, এ সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেতে পারে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।
১০. লাগোস
বর্তমানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া শহরগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়ান শহর লাগোস অন্যতম। জনসংখ্যার পাশাপাশি সমুদ্র পৃষ্ঠেরউচ্চতাও বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিনিয়ত আরও বড় হুমকির মুখে পড়ছে শহরটি।
বিজ্ঞানী হওয়ারের মতে, ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় লাগোস কিছুটা নিম্ন উচ্চতার অঞ্চলে অবস্থান করার কারণে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনের সম্ভাবনা এখানে খুবই বেশি। এছাড়াও পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২৬০,০০০ মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে তিনি ২০১৬ সালে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রুড বলেন, “লাগোসের মতো শহর এ ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি হলে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে ওঠা মোটেই সহজ হবে না।“
কিন্তু, এখন থেকেই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের এমন ভয়াবহ আঘাত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকা তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রতিটি শহরেরই নিজস্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকা উচিত।
ক্রমশ অন্ধকার ও মৃত্যুর তীর্থভূমি হতে চলা এ গ্রহের বুকে মনুষ্যের আগ্রাসী পথচলায় প্রকৃতির মৃত্যু হয়েছে বারবার। তবুও, নীরবে সকল আঘাত সহ্য করে পরম যত্নে নিজ কোলে আমাদেরকে লালন পালন করে যাচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু, ভুলে গেলে চলবে না যে, সীমা অতিক্রম করার ফল চিরকালই পেয়েছে এ গ্রহ। তখনই প্রকৃতির নির্মম আঘাতে হারিয়ে গেছে অসংখ্য জাতি, অসংখ্য নগরী!
আর তাই, ধরণী মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না জানলেও, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়ার প্রয়াস অন্তত থাকা উচিত আমাদের সকলের!