Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০২০: বিশ্ব রাজনীতির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা (পর্ব–১)

২০২০ সালকে যদি একটি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করতে বলা হয়, সেই শব্দটি হবে ‘বিপর্যয়’। বস্তুত একটি ঘটনা ২০২০ সালের পরিচায়ক হয়ে থাকবে, আর সেটি হলো কোভিড–১৯ বা করোনাভাইরাস মহামারীর বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব। যদিও ২০১৯ সালের শেষদিকেই এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল, কিন্তু ২০২০ সালেই এই মহামারী পরিপূর্ণ তীব্রতার সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করেছে, এবং এখন পর্যন্ত এই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির বিদায় নেয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে, এমনকি হিমশীতল ও জনবিরল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও এই মহামারীর বিস্তার ঘটেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী মোট ৮,২৭,৪৫,৩২৪ জন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, এবং তাদের মধ্যে ১৮,০৫,৫২১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। এমতাবস্থায় ২০২০ সালকে ‘বিপর্যয়ের বছর’ না বলে কোনো উপায় নেই।

কেবল বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েই এই মহামারী ক্ষান্ত হয়নি। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, বিশ্বের প্রায় সর্বত্র বিভিন্ন মেয়াদে লকডাউন আরোপ করা হয়েছে, সামাজিক–রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, এবং ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দার পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বিভাজন এই মহামারীর সময়ে আরো প্রকট হয়েছে।

একদিকে মহামারী নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে আরোপিত লকডাউনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করেছে, অন্যদিকে মহামারীর সময়ে বিশ্বজুড়ে বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ আরো ফুলেফেঁপে উঠেছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিংহভাগ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা জনকল্যাণমুখী খাতগুলোর প্রতি রাষ্ট্রগুলোর চরম অবহেলাকে নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। সর্বোপরি, কোভিড–১৯ এর ভ্যাক্সিন নিয়েও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নগ্ন বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে, এবং ভ্যাক্সিন লাভের ক্ষেত্রেও ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

২০২০ সালের মার্চে ইতালিতে মহামারী মোকাবিলায় সহায়তার জন্য রুশরা একদল সামরিক ডাক্তার প্রেরণ করে; Source: BBC

এটা তো গেল মহামারীর কথা, কিন্তু মহামারীর এই ভয়াবহ তাণ্ডবের মধ্যেও অবশ্য মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক কার্যক্রম থেমে থাকেনি। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বরাবরের মতোই স্বার্থের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। বরং ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী আগে থেকে চলমান সংঘাতগুলোর তো বিস্তার ঘটেছেই, তদুপরি নতুন নতুন সংঘাতের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। মহামারীর ভয়াবহতার মধ্যেই যুদ্ধ চলেছে, সীমান্ত সংঘাত হয়েছে, ধর্মীয় দাঙ্গা হয়েছে, জাতিগত নিধন ঘটেছে, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেখা গেছে নতুন নতুন টুইস্ট।

বছরের শুরুতেই ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর অন্তর্গত কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানি এবং ইরাকের ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস’–এর উপপ্রধান আবু মাহদি আল–মুহান্দিস নিহত হন। ইরানি অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ারের মাস্টারমাইন্ড সুলেইমানির মৃত্যু বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ফেলে এবং ইরানের অভ্যন্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর ফলে ইতোমধ্যে নিম্নতম স্তরে থাকা মার্কিন–ইরানি সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে, এবং মধ্যপ্রাচ্য নতুন একটি বড়মাত্রার যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়।

অবশ্য ইরান হিসেবি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ৮ জানুয়ারি ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর মিসাইল আক্রমণ চালায়, যার ফলে ১১০ জন মার্কিন সৈন্য আহত হয়, কিন্তু অন্তত অফিসিয়ালি একজন মার্কিন সৈন্যও প্রাণ হারায়নি। একই দিনে ইরানি মিসাইল ফোর্স ভুলক্রমে ইরানি আকাশসীমায় একটি ইউক্রেনীয় যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে, এবং এর ফলে ১৭৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। কিন্তু ইরান দ্রুত এই ঘটনার জন্য ইউক্রেনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে, এবং ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সঙ্কটের অবসান ঘটায়। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো বৃহৎ যুদ্ধ শুরু হয়নি।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইরাকে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি; Source: Global Village Space

এদিকে ৫ জানুয়ারি তুরস্ক ২০১৯ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়ায় ত্রিপোলিভিত্তিক গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) এবং পূর্ব লিবিয়াভিত্তিক লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। রাশিয়া, ফ্রান্স, মিসর, ইমারাত ও সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র এলএনএকে সমর্থন করছে। মজার ব্যাপার হলো, লিবিয়ায় তুর্কি হস্তক্ষেপের মধ্যেই ৮ জানুয়ারি রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ও তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান রাশিয়া থেকে তুরস্কে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী ‘তুর্কস্ট্রিম’ পাইপলাইনের উদ্বোধন করেছেন। তুর্কি সৈন্য, সামরিক উপদেষ্টা ও ড্রোন অপারেটর এবং তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মার্সেনারিদের সক্রিয় সহায়তায় কয়েক মাসব্যাপী যুদ্ধের পর জিএনএ এলএনএকে ত্রিপোলি থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে এবং এলএনএ–নিয়ন্ত্রিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়।

কিন্তু জুনে জিএনএ সৈন্যরা এলএনএ–নিয়ন্ত্রিত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিরত শহরের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে রাশিয়া সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে এবং জিএনএ ও তুর্কি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মিসর সিরতকে ‘রেড লাইন’ ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় জিএনএর সিরত অভিযান ব্যর্থ হয়। ২৬ জুন রুশ মার্সেনারিরা লিবিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, ৪ জুলাই ফরাসি/ইমারাতি যুদ্ধবিমান তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত আল–ওয়াতিয়া বিমানঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং ২২ জুলাই মিসর মিসরীয়–লিবীয় সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন আরম্ভ করে। ফলে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং অবশেষে ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। কিন্তু সম্প্রতি এলএনএ কর্তৃক লিবিয়া অভিমুখী একটি তুর্কি জাহাজ আটকের ফলে এলএনএ ও তুরস্কের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।

৩১ জানুয়ারি ব্রিটেন ও ব্রিটেন–নিয়ন্ত্রিত জিব্রাল্টার আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ (‘British exit’/Brexit) করে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো সদস্য রাষ্ট্র জোটটি পরিত্যাগ করল। এর মধ্য দিয়ে এতদিন যাবৎ ইউরোপকে একত্রিত করার যে প্রক্রিয়া চলে আসছিল, সেটি প্রথমবারের মতো গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হলো। অবশ্য ডিসেম্বরে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এবং এর মধ্যে দিয়ে ব্রিটেন ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনের অন্তর্গত স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের জনসাধারণের অংশবিশেষ ব্রেক্সিট নিয়ে আদৌ সন্তুষ্ট নয়, এবং এজন্য ভবিষ্যতে ব্রিটেনের অভ্যন্তরে বিরূপ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে সংঘটিত দাঙ্গার পরবর্তী চিত্র; Source: Mint

২৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়াদিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরকালে ভয়াবহ ধর্মীয় দাঙ্গা সংঘটিত হয়, এবং এর ফলে কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত, দুই শতাধিক আহত ও দুই হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়। ভারতীয় মুসলিমরা একে দাঙ্গা নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করে। বস্তুত উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ভারতের শাসনক্ষমতা লাভের পর থেকে তাদের গৃহীত নীতির কারণে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, এই দাঙ্গা ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ।

এদিকে ২০১৯ সাল থেকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় রুশ ও ইরানি–সমর্থিত সিরীয় সরকারি বাহিনী তুর্কি–সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ প্রদেশ ইদলিব দখলের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারি ইদলিবের বালিউন গ্রামে রুশ ও সিরীয় এয়ারস্ট্রাইকে ৩৪–১০০ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়। তুরস্ক এই ঘটনার জন্য সিরিয়াকে দায়ী করে, তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী সিরীয় সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ড’ পরিচালনা করে এবং এই অভিযানে সিরীয় সরকারি বাহিনীর কয়েক শত সৈন্য হতাহত ও প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ন্যাটো যাতে তুরস্ককে সহায়তা করতে বাধ্য হয়, এজন্য তুরস্কে তুর্কি–গ্রিক সীমান্ত খুলে দেয় এবং তুরস্কে অবস্থানরত লক্ষ লক্ষ সিরীয় শরণার্থীকে ইউরোপে প্রেরণ করার হুমকি দেয়। কিন্তু ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এই হুমকি উপেক্ষা করে এবং মৌখিক সহানুভূতি ছাড়া তুরস্ককে কোনো সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকে।

এমতাবস্থায় রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে ৫ মার্চ তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান রাশিয়া সফর করেন এবং রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে ইদলিবে সিরীয় সরকারি বাহিনীর অভিযান বন্ধ হয়, কিন্তু তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল হস্তগত করে এবং রুশ সামরিক পুলিশ ও তুর্কি সৈন্যরা অঞ্চলটিতে টহল দিতে শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে ইদলিবের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়, কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বজায় থাকে।

শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ এবং তালিবান নেতা মোল্লা আব্দুল গণি করমর্দন করছেন; Source: Anadolu Agency/Getty Images via New York Post

এদিকে ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবানের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং তালিবান চুক্তির শর্তাবলি মেনে চললে চুক্তি স্বাক্ষরের ১৪ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে সম্মত হয়। কিন্তু চুক্তির পর একদিকে আফগান সরকার ও বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে তালিবানদের আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন আইনসভা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প যাতে পুরোপুরি সৈন্য প্রত্যাহার করতে না পারেন, সেই মর্মে আইন প্রণয়ন করেছে। অবশ্য আগামী বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা আরম্ভ হবে বলে জানা গেছে।

৮ মার্চ জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ে বিশ্বের অন্যতম দুই বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক রাষ্ট্র সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, এবং এর ফলে তেলের মূল্য বহুলাংশে হ্রাস পায়। এই ‘তেল যুদ্ধে’র ফলে রাশিয়া ও ‘অর্গানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ’–এর (ওপেক) মধ্যে যে ‘ওপেকপ্লাস’ সমঝোতা স্থাপিত হয়েছিল, সেটি ভেঙে যায়। এর ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে এবং স্টক মার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। অবশ্য পরবর্তীতে রাশিয়া ও সৌদি আরব এই ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে।

১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে কোভিড–১৯ কে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। এই গুরুতর পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বব্যাপী একটি ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’র আহ্বান জানান। ২৬ মার্চ সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ফিলিপাইনের বিবদমান পক্ষগুলো এই আহ্বানে সাড়া দেয়, মার্কিন–সমর্থিত কলম্বিয়া ও রুশ–চীনা সমর্থনপুষ্ট ভেনেজুয়েলা মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য আলোচনায় সম্মত হয়, এবং মহামারীতে বিপর্যস্ত ইরানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইমারাত বিমানযোগে সহায়তা প্রেরণ করে। কৌতূহলের বিষয় এই যে, মিয়ানমারের বিদ্রোহী দলগুলো কোভিড–১৯ উপলক্ষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও দেশটির সরকারি বাহিনী এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি, এবং তারা যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কি জাহাজ; Source: BBC

২৭ মার্চ দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র উত্তর মেসিডোনিয়া মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০–এ পৌঁছায়। বস্তুত রুশ বিরোধিতা উপেক্ষা করে ন্যাটো দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে, এবং এর ফলে রুশ–পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাত্রা আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে, ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে গুরুতর দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, এবং এর ফলে জোটটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আংশিক সংশয় দেখা দিয়েছে। ন্যাটো সদস্য তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে ন্যাটোর ওপর দুই সদস্য গ্রিস ও ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে, এবং এখন পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান হয়নি। এর ফলে তুরস্ক ও গ্রিস উভয়েই ব্যাপক সামরিকায়ন আরম্ভ করেছে।

৬ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী ও ইহুদিবিদ্বেষী আধা–সামরিক সংগঠন ‘রাশান ইম্পেরিয়াল মুভমেন্ট’কে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বারের মতো কোনো বর্ণবাদী সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করল। কিন্তু যেহেতু রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একটি তীব্র ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত এবং যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র রুশ জাতীয়তাবাদকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ যতটা না বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন বর্ণবাদী সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেনি।

২৫ এপ্রিল ইয়েমেনে চলমান যুদ্ধে ইমারাতি–সমর্থিত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি) ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে ঘোষণা করে, এবং এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধের জটিল সমীকরণের নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়। অবশ্য পরবর্তীতে সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় সৌদি–সমর্থিত ইয়েমেনের সরকার ও এসটিসির মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, এবং এসটিসি আপাতত তাদের স্বশাসনের দাবি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু ইয়েমেনে যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে এবং এই যুদ্ধ সহসা সমাপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে বন্দি মার্কিন মার্সেনারি; Source: The Sun Post

৩–৪ মে ভেনেজুয়েলায় চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে একটি নতুন ঘটনা সংযোজিত হয়েছে। মার্কিন–সমর্থিত ভেনেজুয়েলার বিরোধী দল মার্কিন মার্সেনারি গ্রুপ ‘সিলভারকোর ইউএসএ’র সহায়তায় ভেনেজুয়েলার ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির শাসনক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কয়েকজন মার্কিন মার্সেনারি ভেনেজুয়েলার সরকার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন–ভেনেজুয়েলান সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়ে ওঠে।

এদিকে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে অবস্থিত জর্দান উপত্যকা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের প্রতি মৌন সমর্থন প্রদান করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পশ্চিম তীরভিত্তিক ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’ ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু ইসরায়েল পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়ায়নি।

২৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশি নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামক একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে ২৬ মে এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়, এবং এটি ‘জর্জ ফ্লয়েড বিক্ষোভ’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। ক্রমে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এবং ধারণা করা হয়, ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ে ‘জর্জ ফ্লয়েড বিক্ষোভ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কার্যত এখন পর্যন্ত এই বিক্ষোভের অবসান ঘটেনি।

জার্মানির বার্লিনে জর্জ ফ্লয়েড বিক্ষোভ; Source: Sean Gallup/Getty Images via The New York Times

মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই ভারতের লাদাখ অঞ্চলে চীনা–ভারতীয় সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়। এটি ছিল ১৯৭৫ সালের পর চীন ও ভারতের মধ্যে প্রথম রক্তাক্ত সংঘাত। এই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত, ৭৬ জন আহত ও ১০ জন বন্দি হয়, এবং গালওয়ান উপত্যকার অংশবিশেষ চীনাদের হস্তগত হয়, যদিও ভারতীয় সরকার এই বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এই সংঘর্ষে চীনাদের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। এই সংঘর্ষের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। ভারতীয় নেতারা জনসাধারণকে চীনা পণ্য বর্জনের আহ্বান করেছে, কিন্তু জনসাধারণের সিংহভাগ এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি, যার মধ্যে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মধ্যেকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, এই সংঘর্ষের পর ভারত স্পষ্টত কৌশলগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো নিকটবর্তী হয়েছে। রাশিয়া উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত চীনা–ভারতীয় সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

গালওয়ান উপত্যকায় যেদিন সংঘর্ষ হয়, একই দিনে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাক–নিয়ন্ত্রিত কিন্তু কার্যত স্বাধীন ‘ইরাকি কুর্দিস্তান’ অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করে। ‘অপারেশন ঈগল ক্ল’ এবং ‘অপারেশন টাইগার ক্ল’ নামক এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থিত তুর্কি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘পিকেকে’র ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা। এই অভিযানে তুরস্ক ও ইরান পরস্পরকে সহায়তা করে, এবং ইরান ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানরত ইরানি ও তুর্কি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত হওয়া এই অভিযানে পিকেকের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সক্ষম হয়নি।

এদিকে কোরীয় উপদ্বীপে দুই কোরিয়ার মধ্যে পুনরায় উত্তেজনা দেখা দেয়, এবং ১৬ জুন উত্তর কোরীয় সরকার কায়েসং শহরে অবস্থিত ‘আন্তঃকোরীয় লিয়াজোঁ অফিস’ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে, এবং এই বিষয়ে তাদের ছাড় দেয়ার কোনো ইচ্ছে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ৩০ জুন চীন ‘হংকং জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করেছে, এবং এর মধ্য দিয়ে হংকংয়ে চলমান অস্থিরতায় বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধ ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য একটি টালমাটাল অধ্যায়।

This is a Bengali review article about world politics in 2020.

Source of the featured image: The Economic Times

Related Articles