কোমল পানীয়ের বাজারে পেপসিকে দ্বিতীয় হয়েই কাটাতে হয়েছে সবসময়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কোকাকোলার সাথে টক্কর দিতে তারা নানা কৌশল প্রয়োগ করেছে। কিন্তু কোনটিই চূড়ান্ত বিজয় এনে দিতে পারেনি। ১৯৮৯ সালের দিকে তারা ‘পেপসি এ.এম’ নামের নতুন পানীয় বাজারে এনেছিল। সাধারণ পেপসির তুলনায় এতে আটাশ শতাংশ বেশি ক্যাফেইন ছিল। কফির প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে এটিকে দাঁড় করাতে চেয়েছিল তারা। ব্যর্থ হয় সে প্রচেষ্টা। একই বছরে পেপসি চেয়েছিল বিজ্ঞাপনের জন্যে পপ-স্টার ম্যাডোনাকে নিয়োগ দিতে। ঝামেলা বাঁধায় তার ‘লাইক অ্যা প্রেয়ার’ গানের ভিডিওটি নিয়ে ওঠা বিতর্ক। সেজন্যে ম্যাডোনাকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার পরও, তার করা বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল।
এত সব ঝামেলার মাঝে লটারির আইডিয়াকে ঝুঁকিমুক্তই মনে হয়েছিল তাদের। পেপসির বোতলের ক্যাপে বিভিন্ন সংখ্যা লিখে দেওয়া হবে। সেখান থেকে বাছাই করা কিছু সংখ্যা জিতবে পুরষ্কার। গ্রাহকরা বোতলের ক্যাপ দেখিয়ে সে পুরষ্কার সংগ্রহ করতে পারবেন। পুরষ্কারের লোভে মানুষজন ঝুঁকবে পেপসির দিকে। এমনটাই ছিল স্বাভাবিক হিসাব-নিকাশ। সে হিসেবেই ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নাম্বার ফিভার’ নাম দিয়ে এ ক্যাম্পেইন চালাতে শুরু করে পেপসি। পেপসি ছাড়াও পেপসিকোর অন্যান্য পানীয়- সেভেন-আপ, মিরিন্ডা ও মাউন্টেন ডিউর ক্ষেত্রেও চলছিল এটি।
এ ক্যাম্পেইনের জন্যে তারা বেছে নেয় ফিলিপাইনকে। দেশটি তখন কোমল পানীয়ের দ্বাদশ বৃহত্তম বাজার। সেখানেও কোকাকোলার চেয়ে বহুদূর পিছিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে পেপসি। ফিলিপাইনের অর্থনীতি তখন সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না। দারিদ্র্য বিস্তৃত ছিল দেশটিতে। এমতাবস্থায় পেপসি ঘোষণা দেয়, স্রেফ একটি পানীয় কিনেই এক মিলিয়ন পেসো (প্রায় চল্লিশ হাজার ডলার) জেতা সম্ভব। যদিও অধিকাংশ পুরষ্কারই ছিল একশ পেসোর। কিন্তু এক মিলিয়ন পেসোর আশা কে ছাড়তে পারে! যে কারো জীবন বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল এতে।
প্রথমদিকে কৌশলটি ভালোই কাজে লেগেছিল। অল্প দিনে প্রায় চল্লিশ শতাংশ বিক্রি বেড়ে যায় পেপসির। ২৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার চলে আসে তাদের দখলে। ফেব্রুয়ারি-মে মাসের মধ্যে ৫১,০০০ ব্যক্তি ১০০ পেসো করে লটারি জেতেন। সতেরজন বাগিয়ে নেন এক মিলিয়ন পেসোর সর্বোচ্চ পুরষ্কার।
লটারির জয়ী সংখ্যাগুলো নির্ণয়ের জন্যে ডি.জি কনসালটরস নামে একটি মেক্সিকান ফার্মকে নিয়োগ দেয় পেপসি। তারা একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে বাছাই করতো সংখ্যাগুলো। এরপর তা সংরক্ষণ করা হতো ম্যানিলার একটি সেফ ডিপোজিট বক্সে। সে অনুসারে সংখ্যার তালিকা চলে যেতো বোতল তৈরির ফ্যাক্টরিতে, বোতলের ক্যাপে পড়তো সংখ্যার ছাপ। এরপর প্রতি রাতে টেলিভিশনে আসতো বিজয়ী সংখ্যার ঘোষণা। সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছিল, অন্তত ২৫শে মে-এর আগ পর্যন্ত।
সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যায় ১৯৯২ সালের ২৫শে মে-তে এসে। অন্যান্য দিনের মতো এদিনেও টিভি পর্দায় ঘোষণা করা হয় নাম্বার-ফিভারে বিজয়ী সংখ্যাগুলো। এদিনে সর্বোচ্চ পুরষ্কার বিজয়ী সংখ্যাটি ছিল-৩৪৯। টিভি-পর্দায় সংখ্যাটি দেখে লক্ষ লক্ষ ফিলিপাইনবাসী যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজেদের ভাগ্যকে। তাদের অধিকাংশের কাছেই আছে বিজয়ী সংখ্যা অঙ্কিত ক্যাপটি। পরবর্তী সকালে ম্যানিলার পেপসি প্ল্যান্টে হাজারো মানুষের ঢল নামে। প্রত্যেকের হাতেই ৩৪৯ সংখ্যা অঙ্কিত ক্যাপ। সবাই আশা করছেন বহুল কাঙ্ক্ষিত এক মিলিয়ন পেসোর।
সেদিন পেপসির পরিকল্পনা ছিল কেবল দুটি গ্র্যান্ড-প্রাইজ দেওয়ার। কিন্তু কোনোভাবে হিসাব নিকাশে ভুল হয়ে যায়। তারা বিজয়ী সংখ্যা অঙ্কিত আট লক্ষ ক্যাপ তৈরি করে ফেলেছিল। যদিও এর মধ্যে দুটি ক্যাপ ছাড়া অন্য কোনটিতেই বিশেষ সিকিউরিটি কোড ছিল না, যেটি প্রমাণ করতো যে ক্যাপটি আসলেই পেপসির। কিন্তু এত বৃত্তান্ত বুঝতে চাইছিলেন না গ্রাহকরা। তারা দেখেছেন তাদের ক্যাপটির সংখ্যাটি বিজয়ী হয়েছে, তারা এখন পুরষ্কার চাইছেন। প্রায় ৪৮৬,১৭০ জন গ্রাহক হাজির হন এ দাবি নিয়ে।
অতিসত্বর পেপসির স্থানীয় কর্মকর্তাদের জরুরী সভা ডাকা হয়। সবার দাবি অনুসারে পুরষ্কার দেওয়া প্রায় অসম্ভব বিষয় ছিল। এর জন্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার গুনতে হতো পেপসির। এর বদলে তারা এটিকে একটি কম্পিউটার-ত্রুটি হিসেবে আখ্যা দেয় এবং বিজয়ীদের শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে বিশ ডলারের মতো দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এত মানুষকে এ স্বল্প পরিমাণ অর্থ দিতে গিয়েও পেপসির ব্যয় হতো বাজেটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু অল্প ক’জন বিজয়ী ব্যতীত, অধিকাংশ জনই রাজি হননি এ প্রস্তাবে। পেপসির ভুল বা আর্থিক ক্ষতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। পেপসির মতো একটি বিশালাকায় কোম্পানির তাদের প্রাপ্য পুরষ্কার দিয়ে দেওয়াই উচিৎ বলে মনে করছিলেন তারা। পেপসি অস্বীকার করে তাদের দাবি মেনে নিতে। উপায় না দেখে বিক্ষোভ আন্দোলনের ডাক দেন গ্রাহকরা।
পেপসির বিরুদ্ধে লেখা প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানে ছেয়ে যেতে শুরু করে ফিলিপাইনের রাজপথ। এ আন্দোলন খুব বেশিদিন অহিংস থাকেনি, অচিরেই তীব্র সহিংস রূপ নিয়ে হাজির হয় এটি। প্রথমেই তাদের রোষের শিকার হয় পেপসির ট্রাকগুলো। পেপসির ট্রাক আগুন ধরিয়ে কিংবা ভাঙচুর করে নিজেদের রোষ প্রকাশ করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। এরপরের ধাপে পেপসি অফিসের আঙ্গিনায় ও জানালায় এসে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে হাতবোমা ও মলোটভ ককটেল।
এমনই একটি হাতবোমা ছোড়া হয়েছিল একটি পেপসি ট্রাককে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে সেটি এক স্কুল শিক্ষিকার সামনে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। মৃত্যুবরণ করেন শিক্ষিকা ও পাঁচ বছর বয়েসী এক ছাত্র, আহত হন আরো ছয় জন। পেপসির এক গুদামে বোমা হামলায় নিহত হন পেপসির তিনজন কর্মী।
পেপসি অধিকাংশ বিদেশী কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনে ফিলিপাইন থেকে। বাকীরা দিন কাটাতে থাকেন মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত হয়ে। অনেকেই বাধ্য হন দেহরক্ষী নিয়োগ দিতে। পেপসির পরিবহণগুলোতে বসাতে হয় অস্ত্রসজ্জিত পাহারা। এদিকে বিক্ষোভকারীরাও দ্রুত সংগঠিত হয়ে উঠছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত ছিল ‘কোয়ালিশন-থ্রি ফোরটি নাইন’ নামের একটি দল। পেপসিকে বয়কট করার জন্যে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন তারা।
এ দলের পাসিয়েন্সিয়া সালেম নামের একজন বৃদ্ধ নারীর বক্তব্য সেসময় বেশ উজ্জীবিত করেছিল বিক্ষোভকারীদের। পেপসি-বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েই তার স্বামী হৃদযন্ত্রের বৈকল্যে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সালেম বলেছিলেন, “ভুলটা তাদের ছিল, আমাদের নয়। এখন তারা আমাদের অর্থ দিতে অস্বীকার করছে। এর জন্যে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। আমি মারা গেলে, আমার আত্মা এসে লড়বে পেপসির বিরুদ্ধে।”
এ বিক্ষুব্ধ আন্দোলনের মুখে পেপসি বেশ নীরবেই ছিল। আন্দোলনকারীদের চাওয়াকে ‘অন্যায় দাবি’ আখ্যা দিয়ে চুপচাপ বসেছিল তারা। এদিকে কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা জমা হচ্ছিল। ফিলিপাইন সরকারকেও তাই সক্রিয় হতে হয় বিষয়টির দফারফা করার জন্যে। কিন্তু সহজে এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কোনো সুরাহা করতে পারেননি তারা।
পরের বছরের ডিসেম্বরে, ঘটনাপ্রবাহে এক চমক নিয়ে হাজির হন একজন তদন্ত কর্মকর্তা। তার প্রতিবেদন অনুসারে এ আন্দোলনে যেসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছিল তার পেছনে ছিল খোদ পেপসির হাত। আন্দোলনকারীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে তারা ভাড়াটে লোক দিয়ে এসব ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়েছে। এ নিয়ে বেশ হৈ-চৈ হলেও শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি তার তদন্ত প্রতিবেদনটি।
এভাবে সময় গড়াতে থাকে। আর বিক্ষুব্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্রে সময় গড়ালে সাধারণত যা হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আন্দোলনের পেছনে ব্যয় করার মতো সময় ও শক্তি ফুরিয়ে আসতে থাকে বিক্ষোভকারীদের। কিন্তু পেপসি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে অটল থাকে ফিলিপাইনের বাজারে।
আদালতেও একের পর এক খারিজ হতে থাকে পেপসির বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো। পেপসি-বিরোধী আবেগও স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করে। ১৯৯৪ সাল নাগাদ এসে পেপসির শেয়ারের রেখাচিত্রেও উন্নতি চোখে পড়ে। এ নাটকের যবনিকাপাত ঘটে ২০০৬ সালে এসে। ফিলিপাইনের সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত জানায়, পেপসি এ লটারি ‘বিজয়ীদের’ পুরষ্কার দিতে বাধ্য নয়।