সম্পর্ক শুধু রক্তেরই হয় না, সম্পর্ক হয় হৃদয়ের। আর এ আপ্ত বাক্যকেই উপজীব্য করে সহস্র শিল্পী সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য শিল্প। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ছোটগল্প অতসী মামির প্লটও তৈরি হয়েছে এ ধারণাকে উপজীব্য করেই। এক ব্যক্তির বাঁশি বাজানোর প্রশংসা শুনে তাকে দেখার আগ্রহ এবং পরবর্তী সময় স্বর্গীয় এক সম্পর্কের শ্রদ্ধায় মনের টান থেকে তৈরী নতুন সম্পর্ককে ঘিরে গল্পের আবর্তন। সেখানে আছে ভালোবাসার অনুরণন, আছে বিচ্ছেদের ব্যথা, আছে হারিয়েও খুঁজে পাওয়া সম্পর্কে পীড়নের আনন্দ।
একজন শিল্পপ্রেমী ও শখের বশে বাঁশিবাদক সুরেশ তার মামার মাধ্যমে একজন বাঁশিপ্রেমীর কথা জানতে পারেন। নিতান্ত দুর্মুখ ব্যক্তিকেও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখে সাক্ষাতে তার বাঁশি শোনার আগ্রহ বেড়ে যায় আরো বহুগুণ। বাঁশি বাজানোর মতো শখ পোষা একজনকে সুরেশ যেভাবে ভেবে রেখেছিল, ঠিকানায় গিয়ে মোটামুটি তার ভিন্ন দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয় সে। বাড়ি ও বাড়ির কর্তার মাঝের এ পার্থক্যকে লেখক লিখেছেন- ভারী সুন্দর একটা ছবিকে কে যেন অতি বিশ্রী একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিয়েছে। তবে আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। মামার বন্ধু সে দিক থেকে মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় আপনা থেকেই। বাকি যে মনের টান, তা ঘটাতে আর কিছুটা সাহায্য করেছে যতীন মামার স্ত্রী অতসী মামি।
এ সম্পর্কের গাঢ়তা বুঝতে কোন দিব্য শক্তির প্রয়োজন নেই। কেবল প্রয়োজন খানিকক্ষণ দেখার ইচ্ছে। সেখানে আছে ভালোবাসার স্বস্তি, আছে সম্পর্কের মধুরতা, আছে বিচ্ছেদের পীড়ন, আছে জীবনের গভীরতর সম্পদ হারিয়েও খুঁজে পাওয়ার সুখ। সে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সে সম্পর্কে আছে খুনসুটি, আছে আবেগঘন ভালোবাসা। বিয়ে করার ঘটনা ও তার পরবর্তী অভিজ্ঞতার কথা খুনসুটিতে তারা বলেন-
-তখন কি জানি মদ খায়! তাহলে কখখনো আসতাম না।
-তখন কী জানি তুমি মাথার রতন হয়ে আঠার মতো লেপ্টে থাকবে! তাহলে কখখনো উদ্ধার করতাম না।
১৯২৮ সালে মানিকের প্রথম মুদ্রিত গল্প অতসী মামী। তার বয়স সবে মাত্র কুড়ি। অথচ এত কম বয়সেও লিখার মাঝে তুলে ধরেছেন গভীর জীবনদর্শন। না তাতে আছে ভারি শব্দের আদিখ্যেতা, না কঠিন কথার ঝংকার। সহজেই তুলে ধরেছেন নিজের ভাবনা ও চাওয়ার মাঝের দ্বন্দ্ব। লিখেছেন-
“কেবলই মনে হয়, নেশাকে মানুষ এত বড়ো দাম দেয় কেন। লাভ কী? এই যে যতীন মামা পলে পলে জীবন উৎসর্গ করে সুরের জাল বুনবার নেশায় মেতে যান, মানি তাতে আনন্দ আছে। যে সৃষ্টি করে তারও, যে শোনে তারও। কিন্তু এত চড়া মূল্য দিয়ে কী সেই আনন্দ কিনতে হবে? এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি, এ তো ক্ষনিকের। যতক্ষণ সৃষ্টি করা যায় শুধু ততক্ষণ এর স্থিতি। তারপর বাস্তবের কঠোরতার মাঝে এ স্বপ্নের চিহ্নও তো খুঁজে পাওয়া যায় না। এ নিরর্থক মায়া সৃষ্টি করে নিজেকে ভোলাবার প্রয়াস কেন? মানুষের মন কী বিচিত্র। আমারও ইচ্ছে করে যতীন মামার মতো সুরের আলোয় ভুবন ছেয়ে ফেলে, সুরের আগুন গগনে বেয়ে তুলে পলে পলে নিজেকে শেষ করে আনি! লাভ নেই? নাই বা রইল।”
গুরুগম্ভীর বাক্যালাপ ছাড়াই তুলে ধরেছেন ভালোবাসার ছন্দ। প্রাণটা যেতে বসলেও যে বাঁশি যতীন ছাড়েননি, টাইফয়েডে অসুস্থ স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে সেই বাঁশিকেই ছেড়ে দিয়েছেন এক বাক্যে। বলছেন- তুমি ভালো হয়ে ওঠো, আমি আর বাঁশি ছোঁব না।
আর সেই বাক্যের যথার্থতার সাক্ষীও হয়েছে সুরেশ। সহজ এক বাক্যে সেই প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা সম্পর্কে বলেছেন বাঁশি বাজাবার জন্যে মন উন্মাদ হয়ে উঠলেও যতীন মামা আর বাঁশি ছোঁবেন না।
এত এত আনন্দের মাঝে ভাগ্য যে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দর্শাবে মানিকের সাহিত্যে, তা আর নতুন কী? দুঃখ-দৈন্য-দুর্দশাকে না মানুষ ঠেকাতে পেরেছে, না পারবে। সম্পর্কের নতুন মোড় নেবার নিত্যতাকে উপলব্ধি করে লিখেছেন-
“মানুষের স্বভাবই এই যখন যে দুঃখটা পায় তখন সেই দুঃখটাকেই সকলের বড়ো করে দেখে। নইলে কে ভেবেছিল যে যতীন মামা আর অতসী মামির বিচ্ছেদে একুশ বছর বয়সে আমার দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল সেই যতীন মামা আর অতসী মামি একদিন আমার মনের এক কোণে সংসারের সহস্র আবর্জনার তলে চাপা পড়ে যাবেন।”
অসুস্থ স্ত্রীকে সুস্থ করতে বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে যতীন মামা ও অতসী মামি বাংলায় ফিরে আসার অনেক বছর পর সুরেশের মনের ভাবনা ছিল কথাগুলো। তারপর কেটে যায় বছর সাতেক। শ্বশুর বাড়ি থেকে বোনকে আনতে গিয়ে ফিরে আসার সময় মুখ ঢাকা এক নারীকে দেখে ভাবনাতেও আসে না যে, এ সেই অতসী মামি। বিস্ময়ের রেশ কাটতেই চার বছর আগের সংশয় ভরা ভয়কে সত্যি হতে দেখে সুরেশ। ঢাকা মেল কলিশনে প্রাণ গেছে যতীন মামার। এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছেন, সে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় রেখে বাঁশিতে সুর দেন মামি। বহু বছর আগের সেই সুর বেজে ওঠে মামির হাতে। সুরেশ ভাবে-পাকা গুণীর হাতের স্পর্শ পেয়ে বাঁশি যেন প্রাণ পেয়ে অপূর্ব বেদনাময় সুরের জাল বুনে চলল।
সেদিন সতেরোই অঘ্রাণ। চার বছর আগের সেই দুর্ঘটনায় এই দিনই প্রাণ হারিয়েছিলেন যতীন মামা। অতসী মামি ছুটেছেন তারই কাছে। প্রতি বছর সেখানে যান তিনি। জীবনের প্রিয়তম মানুষটার শেষ নিঃশ্বাসের জায়গাটা তার কাছে তীর্থ। অতসী মামি যাচ্ছেন তীর্থদর্শনে। ভাগ্নে যেতে চাইলে মামি বলেন- সেই নির্জন মাঠে সমস্ত রাত আমি তাঁর সঙ্গ অনুভব করি, সেখানে কি কাউকে নিয়ে যাওয়া যায়! ওইখানের বাতাসে যে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস রয়েছে।
সাথে নিয়ে যান সেই বাঁশি- যা এককালে প্রিয় সঙ্গী, পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় শত্রু আর আজ প্রিয়তমের অবর্তমানে তার একমাত্র স্মৃতি। বাঁশিতে অতসী মামি তার একচ্ছত্র দাবি নিয়ে বলেন- এটা নিয়ে গেলাম ভাগনে! এটার ওপর তোমার চেয়ে আমার দাবি বেশি।
তিন দশক ধরে ৪০টির মতো উপন্যাস ৩০০র মতো গল্প লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই লিখেন বলে দাবি ছিল তার। আর তার বাস্তব প্রতিফলনই আমরা দেখি অতসী মামি গল্পে। ছোটগল্প নিয়ে ১৯৫৬ সালের এক সাক্ষাৎকারে মানিক বলেছিলেন-
“ছোটগল্প রচনায় রোমাঞ্চ আছে। এতে গভীর মনঃসংযোগ করতে হয়। এত দ্রুত তালের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে চলতে হয় বলেই মন কখনো বিশ্রাম পায় না। ছোটগল্প লেখার সময়ে প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চ বোধ করি।”
বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে বোঝা অসম্ভব। একজন লেখকের প্রথম রচনা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাকে ও তার লেখাকে জানার জন্যে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনটি প্রযোজ্য মানিকের ক্ষেত্রেও। চলতি ভাষায় লেখা জীবনের প্রথম এ গল্পটি লিখেছিলেন বন্ধুদের সাথে চ্যালেঞ্জ ধরে। গল্পটি প্রকাশিতও হয় তৎকালীন সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘বিচিত্রা’য়। শুধু লেখার জন্য নয়, বরং পরবর্তী সময় বাংলা সাহিত্যের শীর্ষ সাহিত্যিকদের কাতারে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্যেই যে তিনি লেখা শুরু করেছেন- সে প্রত্যয়ই ব্যক্ত হয়েছে অতসী মামি গল্পে।