পৌলস্ত্য রাজাধিরাজ সমস্ত দাক্ষিণাত্যের শাসক। তার পরাজয় সমস্ত মানবজাতির পরাজয়। চন্দ্রহাস পারত সেই পরাজয়কে রুখে দিতে, কিন্তু মহামতি পৌলস্ত্য এই শক্তিশেল ব্যবহার করেননি।
উয়ারী বটেশ্বরে খননকার্য চালিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল একটি তামার বাক্স। কী ছিল তাতে? আহামরি কিছু না। পুঁতির মালা, ব্রোঞ্জের লকেটের পাশাপাশি বিচিত্র গড়নের এক বই। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের চিহ্ন বহনকারী, সোনার পাতের মলাটে মোড়ানো এই বই মূলত আলোচিত উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট। কেননা প্রাচীন ত্রেতা যুগের (হিন্দুধর্ম মতে, চার যুগের দ্বিতীয় যুগ) অজানা সব অধ্যায় নতুন করে উন্মোচনের জন্য তিন খণ্ডে বিন্যস্ত ‘দশগ্রীব’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বই।
প্রকৃতপক্ষে; দশগ্রীবে আবর্তিত হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার ধারার উপন্যাস, দশগ্রীবের পুরো কাহিনী। বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে রাবণ তথা দশগ্রীবের জীবনের বিস্ময়কর সব গল্প। রামায়ণের চিরায়ত আখ্যানকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তুলে ধরার চমৎকার একটি প্রয়াসের নাম সিদ্দিক আহমেদের ‘দশগ্রীব’।
দশগ্রীব সম্পর্কে কতটুকু জানি? দশগ্রীব ছিল অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী। মহাদেব খুশি হয়ে তাকে নিজের তলোয়ার, চন্দ্রহাস দান করেছিলেন। দশগ্রীব পেয়েছিল নতুন একটি নাম, রাবণ। ঘটনার ধারাবাহিকতায়; রাবণ পরিণত হয় ইতিহাসের কুখ্যাত এক ব্যক্তিত্বে। সীতা অপহরণের কালিমায় বিলীন হয় সমস্ত গৌরবগাঁথা। কিন্তু আদতে কেমন ছিল এই রাবণ? খুব খারাপ?
প্রসঙ্গত; রাবণের পরাজয় তথা রামায়ণের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও অক্ষত রয়ে যায় চন্দ্রহাস। তারপর? তারপর মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থেই লুকিয়ে ফেলা হয় বিধ্বংসী এই শস্ত্র, সন্ধান থেকে যায় তিন খণ্ডের ‘দশগ্রীব’ গ্রন্থে। তারপর কলিঙ্গ জয়ের মধ্য দিয়ে চন্দ্রহাস এসে পড়ে মৌর্য সম্রাট, অশোকের হাতে। কিন্তু সত্যিই কি চন্দ্রহাস নামক কোনোকিছু ছিল? নাকি সবটাই বানোয়াট গল্প?
অস্তিত্ব থাকুক আর নাই থাকুক; ভুলে গেলে চলবে না— ‘দশগ্রীব’ গ্রন্থে লেখা আছে চন্দ্রহাসের সন্ধান। নিঃসন্দেহে এই গ্রন্থের প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য সাংঘাতিক। তাই তো কামরুল শরিফের মতো বিদ্বান ব্যক্তিত্ব যেমন এই গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করছেন; একইভাবে সন্ত্রাসী জহিরও হন্যে হয়ে খোঁজ করছে দশগ্রীবের। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার এই বিচিত্র অভিযান নিয়েই রহস্য-রোমাঞ্চ ধারার উপন্যাস, ‘দশগ্রীব’-এর আবির্ভাব।
দশগ্রীব! দশগ্রীব সেই গ্রন্থ, যেখানে চিরায়ত রামায়ণের আখ্যান ধরা দিয়েছে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। চেনাজানা পৌরাণিক চরিত্র, রাবণকে আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়ার এক বিচিত্র যাত্রার নাম দশগ্রীব। এটাই সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থ, যার পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে পরম আকাঙ্ক্ষিত চন্দ্রহাসের সন্ধান। যাহোক; দশগ্রীব গ্রন্থকে কেন্দ্র করে তিন তিনটে জলজ্যান্ত মানুষ একেবারে খুন হয়ে গেল!
প্রথমজন, কামরুল শরিফ স্যার। উয়ারী বটেশ্বর থেকে ‘দশগ্রীব’ গ্রন্থের একটি খণ্ড উদ্ধার করেছিলেন ভদ্রলোক, যার কারণে অজানা আততায়ীর হাতে খুন হতে হয় তাকে। ঠিক একই কারণে খুন হয় কামরুল শরিফ স্যারের পিএস জাহাঙ্গির এবং এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী, আসলাম।
প্রিয় শিক্ষক, কামরুল শরিফ স্যারের মৃত্যু রহস্যের তদন্তের কাজে বেরিয়ে পড়ে রাশাদ আর জয়িতা। এক্ষেত্রে মৃত্যু রহস্যের জট খুলতে না খুলতেই গজিয়ে উঠে আরেক রহস্য। দশগ্রীবের রহস্য।
পৃথিবীতে সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান খুবই অল্প। কে কোন পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
দশগ্রীব আর চন্দ্রহাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পুরাণের চেনাজানা গল্পগুলো নতুন করে ধরা দেয় রাশাদ আর জয়িতার কাছে। এই রহস্যের শেষ কিনারায় পৌঁছানোর জন্য তারা পাড়ি জমায় শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে।
এদিকে সবসময়ের সঙ্গী, আসলামের মৃত্যু প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায় সন্ত্রাসী জহিরের মনে। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে উঠে জহির, খুঁজে মরে সঙ্গীর হত্যাকারীকে। অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা সিক্রেট অর্গানাইজেশন, নব সংঘ এই আখ্যানে হাজির হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার এক উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে; কোথায় গিয়ে সমাপ্তি অর্জন করবে প্রাচীন পুরাণের এই আখ্যান? কী হবে চন্দ্রহাসের শেষ পরিণতি?
দশগ্রীব একটি আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার ধারার উপন্যাস; যার মূল ভিত্তি দশগ্রীব স্বয়ং। দশগ্রীবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বইয়ের পুরো কাহিনী; যার বাঁকে বাঁকে মিশেছে পুরাণ এবং ইতিহাসের বিচিত্র সব গল্প। তথ্যসমৃদ্ধ এই গল্পগুলো লেখক সিদ্দিক আহমেদ দারুণ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। পুরাণ এবং ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থাকায় পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
কাহিনীর নির্মাণ এক কথায় দুর্দান্ত। একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে শুরু। সেখানে এসে মিশেছে ত্রেতা যুগের রামায়ণের গাঁথা, সম্রাট অশোকের প্রতিপত্তি, গুপ্ত সংঘের কূটনীতিক চালসহ আরও অনেক কিছু। প্রত্যেকটি ঘটনাকে এত সুন্দরভাবে একটি সুতোয় গেঁথে ফেলেছেন লেখক; যার ফলে কাহিনীর ব্যাপকতা কোথাও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়নি। যদিও অতিমাত্রায় রেফারেন্স টানার কারণে মাঝেমধ্যে কাহিনীর ফ্লো খানিকটা কমে এসেছিল, তবে পাঠকের পড়ার গতিতে সেটা তেমন প্রভাব ফেলবে না।
প্রচলিত কিছু চিন্তাধারা বা দর্শনকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার একটি প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যায় দশগ্রীব উপন্যাসে। প্রসঙ্গত; আবহমান কাল ধরে চলে আসা বিশ্বাসে ফাটল ধরলেও ধরতে পারে। কেননা যুক্তি খণ্ডনের কাজটুকু লেখক যথেষ্ট রেফারেন্স টেনেই করেছেন। এক্ষেত্রে দশগ্রীব যেহেতু কোনো কাঠখোট্টা ঘরানার বই নয়; কাজেই বইটিকে ফিকশন হিসেবেই ধরে বিবেচনা করে পড়লে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হবে।
দশগ্রীব উপন্যাসের চরিত্রায়ণের ব্যাপারটা বেশ ভালো। পছন্দের চরিত্র হিসেবে সবার ওপরে থাকবে কুখ্যাত সন্ত্রাসী, জহিরের নাম। জীবন যেভাবে এই লোকের কাছে এসে ধরা দেয়, সেটা ভাবনার নতুন খোরাক যোগায়। জহিরের পর আসবে নব সংঘের ক্রিয়াকলাপ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকা নব সংঘের মতো একটি সিক্রেট অর্গানাইজেশনের নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় প্রক্রিয়া যথেষ্ট আগ্রহ জাগানিয়া। তবে বুদ্ধি কিংবা সক্ষমতার তুলনায় তাদের দ্বারা সংগঠিত পদক্ষেপগুলো কেমন যেন বোকা বোকা! যাহোক; বাকি থাকল রাশাদ আর জয়িতা। মূলত এই দুটো চরিত্রের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারটা তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক। দুজনেই আগামী দিনের প্রতিনিধি, শুদ্ধ চিত্তের অধিকারী।
ক্ষমতা, দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক উঠা-নামাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার ধারার উপন্যাস দশগ্রীব পড়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। কাহিনীর বর্তমান অংশের ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রে লেখকের সহজবোধ্য উপস্থাপন দেখতে পাওয়া যায়। আবার অতীত অংশের বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত সম্ভ্রমের প্রকাশ করেছেন লেখক, যার ফলে প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে বইয়ের কাহিনীর। সবমিলিয়ে; দশগ্রীব পড়ে যথেষ্ট সুখপাঠ্য লেগেছে। কিন্তু পড়ার সময় নিজের সংবেদনশীল মনোভাব যত বেশি দূরে রাখা যাবে, তত বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে এই বই। এখন এর সিক্যুয়েলের জন্য অপেক্ষায় আছি।
বই: দশগ্রীব
লেখক: সিদ্দিক আহমেদ
ধরন: আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার
প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী