মশা কাকে বলে এবং এর ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা বর্তমানে হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছে বাংলাদেশের আমজনতা। মশার খপ্পর থেকে কোনোকালেই রেহাই ছিল না আমাদের। তবে এবার এডিস মশার অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ডেঙ্গু যে হারে বাড়ছে, তা একেবারেই অসহনীয়। এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি। ইতোমধ্যে নেত্রকোনা বাদে বাকি ৬৩টি জেলাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা গেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। না মশা কমার আশা দেখা যাচ্ছে, না ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য মোতাবেক, এবছর ৫০ জনেরও বেশি লোক ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। এই উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় ডেঙ্গুকে আয়ত্ত্বে আনতে এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর তা হলো লন্ডন থেকে ‘ভদ্র মশা’ আমদানি করা। এরই মাঝে খবরটি নিয়ে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদিকে হাসি-ঠাট্টায় উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে খবরটিকে। আর অন্যদিকে এই পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে আছে অনেকে। নাম শুনে ঠাট্টা মনে হলেও পদ্ধতিটি বেশ ভালোই।
আগে একটু বলে নেওয়া যাক, এই ‘ভদ্র মশা’ বলতে আসলে কোন ধরনের বা কোন মশাকে বোঝানো হচ্ছে। মূলত গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ এডিস মশায় ‘ওলবাচিয়া’ নামক ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করা হলে সেই মশা স্ত্রী এডিস মশার সাথে প্রজননের মাধ্যমে যে মশার জন্ম দেয়, তা ডেঙ্গুবাহী মশা হয় না। অর্থাৎ এই মশা কামড় দিলে ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এ ধরনের মশার কামড়ে কোনো রোগবালাই ছড়ায় না বা এদের কারণে পরবর্তী প্রজন্মের মশাও রোগ ছড়াতে অক্ষম হয়। স্ত্রী এডিস মশা হলেও কোনো প্রকার রোগ ছড়াবে না। এটি অবশ্যই সাধারণ স্ত্রী এডিস মশার আচরণ নয়। বংশের রুক্ষ বা বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে এক প্রকার সাদাসিধে ও অহিংস মশায় পরিণত হওয়ায় এদেরকে ‘ভদ্র মশা’ বলা হয়।
এখন এই ‘ওলবাচিয়া’ নামক ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে জানা যাক, যার কারণে ‘ভদ্র মশা’র প্রসার সম্ভব হচ্ছে।
ওলবাচিয়া
ওলবাচিয়া একধরনের ব্যাকটেরিয়া যা প্রাকৃতিক নিয়মেই পোকামাকড় জাতীয় জীবে পাওয়া যায়। শতকরা ৬০ ভাগ পোকামাকড় প্রজাতিতে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এমনকি কয়েক প্রকার মশার দেহেও এর অস্তিত্ব মেলে। তবে এডিস ইজিপ্টাইয়ে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। উল্লেখ্য যে, এডিস ইজিপ্টাই মশা জিকা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং হলুদ জ্বরের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া কোনো মশার দেহে থাকলে তা কোনো প্রকার মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে না৷ তাই তারা বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে যায় যেন এডিস ইজিপ্টাই মশার মধ্যে কোনোভাবে এই ব্যাকটেরিয়া ঢোকানো যায়। মূলত স্ত্রী এডিস মশার দংশনের ফলেই এসব রোগ ছড়ায়। যদি ওলবাচিয়া বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে এসব মশকীর দেহে প্রবেশ করে কিংবা এই ব্যাকটেরিয়া আছে এমন মশার সাথে প্রজনন ঘটায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের মশায় আর এসব রোগ সৃষ্টিকারী ফ্যাক্টর বা ভাইরাসগুলো থাকবে না৷ এতে করে ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস ছড়াতে পারবে না।
কীভাবে ওলবাচিয়ার ব্যবহার শুরু হয়?
অস্ট্রেলিয়ার এক দল গবেষক সর্বপ্রথম ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে যে জিকা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও হলুদ জ্বরের ভাইরাস দমন করার পদ্ধতি কার্যকর হয়, তা খুঁজে বের করেন। ২০১১ সালে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবারের মতো ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়াসম্পন্ন মশা দিয়ে এসব ভাইরাসযুক্ত মশা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলানো হয়। আর এতে সফলতাও লাভ করে তারা। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের টাউনসভিল শহরের কথা বলা যায়। এই শহরে মশাবাহিত রোগ অত্যন্ত সাধারণ একটি বিষয় হলেও ওলবাচিয়াযুক্ত মশা ছড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে ঐ শহরে মশাবাহিত কোনো রোগ দেখা যায়নি। এই পদ্ধতি অবলম্বন করার পূর্বে প্রতি বছরই শহরটিতে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করত। এই পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দিয়ে মশাবাহিত রোগ দমনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার এই গবেষকের দল। তাই তারা ‘ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম’ নামক একটি প্রজেক্ট শুরু করেন।
বর্তমানে ১২টি দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কলাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভিয়েতনাম, কিরিবাতি, ফিজি, ভানুয়াতু, নিউ ক্যালেডোনিয়া এবং মেক্সিকো। এই প্রোগ্রাম সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য দুটি আঞ্চলিক হাবও রয়েছে। ভিয়েতনামের ‘এশিয়া হাব’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘ওশেনিয়া হাব’।
ওলবাচিয়া কীভাবে মশার দেহে প্রয়োগ করা হয়?
এতক্ষণে একটা ব্যাপার খুব ভালোমতোই বোঝা যাচ্ছে, এডিস মশার দেহে ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানোর মূল পদ্ধতি একটাই। আর তা হলো পুরুষ এবং স্ত্রী এডিস মশার মিলন৷ ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া আছে এমন পুরুষ এডিস মশা, যদি এই ব্যাকটেরিয়া নেই এমন কোনো স্ত্রী এডিস মশার সাথে মিলিত হয়, তাহলে তাদের বংশধরের মধ্যে মা মশার রোগ ছড়ানোর ভাইরাসগুলো থাকবে না৷ তবে মিলিত হওয়ার পরও স্ত্রী এডিস মশার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না। অর্থাৎ পরিবর্তন আনা যাবে পরবর্তী প্রজন্মে। মূলত মশার দেহে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মশার দেহে খারাপ বৈশিষ্ট্য তথা বিভিন্ন রোগের ভাইরাস দূর করাই এর মূল লক্ষ্য। একটা বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওলবাচিয়া কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র পুরুষ এডিস মশার শরীরেই প্রবেশ করানো সম্ভব, স্ত্রী এডিসের দেহে নয়। অবশ্য বর্তমানে স্ত্রী এডিস মশার দেহেও এটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উক্ত প্রক্রিয়াটি প্রথমদিকে বেশি একটা কার্যকর মনে না হলেও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য এটাই একটি সফল পদ্ধতি। প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় সাইটোপ্লাজমিক ইনকম্প্যাটিবিলিটি।
ওলবাচিয়া কীভাবে কাজ করে?
একটি মশার ভেতরে সাধারণত দু’ভাবে এই ব্যাকটেরিয়া কাজ করে থাকে। প্রথমত এটি মশার প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে সহায়তা করে থাকে, যাতে করে এই মশা ডেঙ্গু, জিকা বা চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বহন করতে না পারে বা ছড়াতে না পারে। যদি মশায় কোনো রোগের ভাইরাসই না থাকে, তাহলে তা দংশনে অবশ্যই কোনো রোগ ছড়াতে পারবে না।
আরেকটি পদ্ধতি হলো ভাইরাসের বৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া। ওলবাচিয়া এবং বিভিন্ন রোগের ভাইরাসকে মশার দেহে বেঁচে থাকার জন্য কোলেস্টেরলের প্রয়োজন হয়। এই উপাদান ছাড়া এদের বৃদ্ধিই সম্ভব নয়। ওলবাচিয়া মশার শরীরে থাকলে তা নিজের বৃদ্ধির তাগিদে বেশি পরিমাণে কোলেস্টেরলের অণু খেয়ে ফেলে। আর ফলে, ভাইরাস নিজেদের বংশবৃদ্ধি করার মতো পরিবেশ পায় না। এতে করে মশার দেহেই ভাইরাস থাকতে পারে না, আর তাই মশা কামড়ালেও মানুষের শরীরে কোনো ভাইরাস প্রবেশ করার তো প্রশ্নই আসে না।
ওলবাচিয়া কি নিরাপদ?
ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের নাম শুনলেই মনে হয়, এগুলোর জন্ম মানুষের কোনো ক্ষতি করার জন্যই হয়েছে। তবে সবক্ষেত্রে ব্যাপারটি একেবারেই সত্য নয়। ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া হওয়া সত্ত্বেও তা মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীদের উপর ইতিবাচক প্রভাবই ফেলছে। ‘ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম’-এর গবেষণা এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই তথ্যগুলো ফুটে ওঠে। প্রকৃতির উপরও এর কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা যায় না। এই ব্যাকটেরিয়াসম্পন্ন মশার দংশন সাধারণ কোনো মশার দংশনের মতোই। কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু কাজে। তাছাড়া বাস্তুতন্ত্রের কোনো ক্ষতি সাধনও করে না এই ওলবাচিয়া। অন্তত এখন পর্যন্ত এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন লক্ষ্য করা যায়নি।
আমাদের দেশে ডেঙ্গু যে মহামারী আকার ধারণ করছে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। আর এজন্য ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের বুদ্ধিটা বেশ ভালোই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর তাগিদে সুদূর লন্ডন থেকে ‘ভদ্র মশা’ তথা ‘ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়াসম্পন্ন মশা’ আমদানি করার কথাও বলেছেন। এখন দেখা যাক, আমাদের দেশেও ‘ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম’ চালু করা হয় নাকি।