পৃথিবীর–আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন,
জেগে আছি; –বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে,
পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে
চলিতেছে; –কোন এক দূর দেশে –কোন নিরুদ্দেশে
জন্ম তার হয়েছিল, -সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে
কোনো এক দূর নিরুদ্দেশে জন্মেছিলেন তিনি। অলস ক্লান্ত দুপুরেও বয়ে গেছেন সিন্ধু ঢেউয়ের মতন। আর গোধূলি বেলায় পাহাড়ি হাওয়ার মতো একাকীত্বকে সঙ্গী করে ঘরে ফিরেছেন বারবার।
কথা বলবার সময় মুখ থেকে হাসি যেন তার মুছতেই চায় না। নম্রতা, ভদ্রতা আর সৌজন্যবোধ দিয়ে যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন তিনি। খ্যাতি, প্রাপ্তি, মর্যাদা ও সাফল্য, কোনো কিছুরই কমতি নেই তার। মিডিয়াও যেন তাকে নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে।
কখনো মিলিয়ে যাননি লোকচক্ষুর অন্তরালে। ইন্টারভিউগুলোতে অংশ নিচ্ছেন, করছেন নিত্যনতুন ব্লকবাস্টারের প্রমোশন, হাজির হচ্ছেন টক শো আর রেড কার্পেটগুলোতেও। তবুও তিনি কোনো না কোনোভাবে মিডিয়ার সামনে নিজের ব্যক্তিগতজীবন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে গেছেন সবসময়ই।
হাওয়াইয়ান ভাষায় কিয়ানু শব্দটির অর্থ পাহাড়ি শীতল হাওয়া। আর জীবনানন্দ দাশ রচিত অনেক আকাশ কবিতার চরণগুলোর মতোই অদ্ভুত এক জীবন পাড়ি দিয়ে চলেছেন কিয়ানু রিভস।
উত্থান-পতন, সে তো প্রতিটি মানুষের জীবনেই থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু বিশ্বখ্যাত হলিউড তারকা কিয়ানু রিভসের জীবনের গল্পটা হয়তো হার মানাবে বহু সিনেমার গল্পকেও। তার জীবনের পটভূমিতে অন্ধকার ঘনিয়ে কালো মেঘের আনাগোনা যখন শুরু হয়েছিল, তখন তার বয়স মাত্র তিন বছর।
শৈশবেই বাবাকে হারান তিনি!
পেশায় ভূবিজ্ঞানী স্যামুয়েল নওলিন রিভস-এর জন্মটা হয়েছিল হাওয়াইতে। ওদিকে শো-গার্ল ও কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে লেবাননের শোবিজ অঙ্গনে কাজ করা প্যাট্রিসিয়া টেলরের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পুরোপুরি ব্রিটিশ।
প্রণয়কে পরিণয়ে রূপ দিয়ে এ যুগল ঘর বাঁধলেন লেবাননের বৈরুতে। ১৯৬৪ সালে স্যামুয়েল আর প্যাট্রিসিয়ার কোল আলো করে এলো এক পুত্রসন্তান। শখ করে স্যামুয়েল সে সন্তানের নাম রাখলেন কিয়ানু চার্লস রিভস।
বাবা স্যামুয়েলের মাত্রাতিরিক্ত মাদকাসক্তি ও জুয়ায় মনোনিবেশের কারণে ভাঙন ধরলো সংসারে। আর তাই প্যাট্রিসিয়ার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পরিবার ত্যাগ করে যখন তিনি হাওয়াইতে ফিরে গেলেন, কিয়ানু তখন তিন বছরের ছোট্ট শিশু।
জীবিকার টানে সন্তানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পাড়ি জমালেন প্যাট্রিসিয়া। সেখানেই জন্ম নিলো কিয়ানুর সৎ বোন কিম। মাস কয়েক বাদেই সিডনি ছেড়ে তিনজনে চলে এলেন নিউ ইয়র্কে।
সেখানে পল অ্যারন নামের এক মঞ্চ ও চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে পরিচয় হয় প্যাট্রিসিয়ার। একটা পর্যায়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। বিয়ের পর প্যাট্রিসিয়া তার সন্তানদের নিয়ে পলের সাথে টরন্টোতে চলে যান এবং কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় এ দম্পতি বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৭৬ সালে তৃতীয়বারের মতো রবার্ট মিলারকে বিয়ে করেন প্যাট্রিসিয়া। সেই ঘরে জন্ম নেয় কিয়ানুর দ্বিতীয় সৎবোন কারিনা।
আর তারপর রবার্ট মিলারের সাথেও বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টেনে, ১৯৯৪ সালে চতুর্থবারের মতো জ্যাক বন্ডকে বিয়ে করেন প্যাট্রিসিয়া।
১৩ বছর বয়স পর্যন্ত নিজ বাবা স্যামুয়েলের সাথে দেখা করতে হাওয়াই যেতেন কিয়ানু। তারপর শহর থেকে শহরে ছুটোছুটি করতে করতে, পরবর্তী জীবনে বাবার সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
হাইস্কুল ড্রপআউট
পারিবারিক অস্থিতিশীলতা আর ভৌগোলিক অবস্থানের এমন বিক্ষিপ্ত পরিবর্তনের কারণে, কিয়ানু রিভস আর তার বোনদের শৈশবের অধিকাংশ সময়টুকুই কেটেছে বেবি সিটার আর দাদা-দাদীদের কাছে। এমনকি পরপর পাঁচ বছরে চারটি ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে যাবার অভিজ্ঞতাও হয়েছে কিয়ানুর।
শৈশবের সে দিনগুলোর স্মরণে কিয়ানু বলেন,
আমাদের শৈশবটাই কেটেছে এভাবে। মূলত আমরা সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতাম, ফিরতাম একদম রাতে। মজার ছিল দিনগুলো।
নিয়মিত স্কুলে যেতেন তিনি। অবশ্য লেখাপড়ার চেয়ে থিয়েটারে অভিনয় আর আইস হকির প্রতিই আগ্রহটা বেশি ছিল তার। স্কুলের আইস হকি দলের রক্ষণভাগে বিশেষ দক্ষতার কারণে তার নাম ছিল ‘দ্য ওয়াল’। অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ থেকে কানাডার ইটোবিকোক স্কুল অফ দ্য আর্টস-এ অডিশনও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে পড়ার সুযোগ পাননি।
বছর বছর স্কুল পাল্টানো সত্ত্বেও তার আগ্রহে কখনো ভাটা পড়েনি। লেখাপড়ায় অত ভালো না হলেও, স্কুলে যেতে ভালোবাসতেন ছোট্ট কিয়ানু। কিন্তু বিরূপ ভাগ্যের নির্মম শিকার হয়ে তার ধরা পড়লো ডিসলেক্সিয়া।
লেখাপড়া করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। যার ফলস্বরূপ গ্রাজুয়েশন শেষ করার বদলে, কিয়ানু রিভস হয়ে গেলেন একজন হাইস্কুল ড্রপআউট। অবশ্য পরবর্তী জীবনে বই পড়ার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ করেন। অবসরে বই পড়া এখনও তার প্রিয় শখগুলোর মধ্যে অন্যতম।
জীবনকে ভুলে থাকতে খুঁজে নিয়েছেন নিত্য নতুন নেশা!
অদম্য মানসিকতার এ মানুষটির দৃঢ় মনোবলের দেয়ালে বারবার আছড়ে পড়েছে নিষ্ঠুর জীবনের নির্মমতার ঢেউ। ভাঙন ধরাতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু তবুও স্রোতের বিপরীতে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কিয়ানু। তবে, দিনশেষে তিনিও তো একজন মানুষ। মাঝে মধ্যে জীবন ছেড়ে পালাতে চাইতেন তিনিও।
আর এভাবেই নিত্যদিনকার জীবনের সব জটিলতা আর ঝঞ্ঝাট ভুলে থাকতে, কিয়ানু খুঁজে পেলেন এক নতুন নেশা। প্রতিদিন প্রিয় মোটরবাইকে করে বেরিয়ে যেতেন তিনি। ঘুরে বেড়াতেন সমুদ্র উপকূলে। যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়ানোর মাঝেই তিনি খুঁজে পেলেন সুখ। মোটরবাইক চালানোর প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা ও ঝোঁক থেকে শিখে গেলেন বিভিন্ন স্টান্ট।
অবশ্য এসব করতে গিয়ে পাঁজরের হাড়-ভাঙার মতো মারাত্মক সব ইনজুরি ও সার্জারির সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এতকিছুর পরও, মোটরবাইকের প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি তার। বরং ২০১১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন আর্চ মোটরসাইকেল কোম্পানি। এছাড়াও, ব্যক্তিগতভাবে তার আছে বাইকের নিজস্ব কালেকশন। বাইক নিয়ে নিজের ভালোবাসা প্রকাশেও কোনো কার্পন্য করেননি কখনো-
আমি প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে বাইক চালাতে খুব ভালোবাসি। মাঝে মাঝে স্যান্টা মনিকা মাউন্টেনের ওদিকেও যাই। নিজেকে হারানো যায়, রোজকার চিন্তা ও দায়িত্ব ভুলে থাকা যায়, এমন যেকোনো কিছু করতেই পছন্দ করি আমি।
ক্যারিয়ারের সূচনা
স্কুল থিয়েটারে শেক্সপিয়ারের কিছু দৃশ্যে অভিনয় করে বেশ উপভোগ করেছিলেন তিনি। কাজ করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকায়, মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আনুষ্ঠানিকভাবে তার অভিনয় ক্যারিয়ারের সূচনা হয়।
১৯৭৯ সালে লেয়াহ পসলান্স থিয়েটারের মঞ্চে, শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ অভিনয় করেন তিনি। তারপর সিবিসি টেলিভিশনের সিটকম ‘হ্যাঙ্গিং ইন’-এ কাজ করার মধ্য দিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় অভিষেক হয় তার। তবে এসবের কোনোটাই ঠিক পরিকল্পনামাফিক হয়নি।
ছোটবেলায় কখনোই মুভি স্টার হবার স্বপ্ন দেখিনি আমি। আমি স্বপ্ন দেখেছি ফ্লাইং মেশিনে চড়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবার। যদিও আমি অভিনয় করতে ভালোবাসতাম। আর টিনএজে এসে বুঝতে পেরেছিলাম যে, জীবনে এটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই আমি। ১৬ বছর বয়স থেকে অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি আমি। আমার সৎবাবা ছিলেন একজন ডিরেক্টর আর মা ছিলেন কস্টিউম ডিজাইনার। কিন্তু আমি খেলাধুলা করতেই বেশি ভালোবাসতাম। একটা সময় তো খেলাধুলাতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তাও করেছিলাম।
বড় হবার মোটিভেশন পেতে কিয়ানুর শৈশবই যথেষ্ট ছিল। ছন্নছাড়া পারিবারিক জীবন ও বাবাকে ঠিকভাবে কাছে পাওয়ার অভাবই তার মধ্যে- নিজে কিছু হয়ে ওঠার তাড়না সৃষ্টি করেছিল।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ড্রাইভ করে তিনি নিউইয়র্কে আসতেন শুধুমাত্র এইচবি স্টুডিওর অভিনয় ক্লাসে অংশ নিতে। ১৯৮০ সালে তিনি বিখ্যাত কার্বোনেটেড বেভারেজ কোম্পানি কোকাকোলার একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করার সুযোগ পান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শর্ট-ফিল্ম ও মঞ্চেও পারফর্ম করতে থাকেন।
মঞ্চ আর টেলিভিশন শো-তে বেশ কিছু ছোটখাটো রোল করে, ১৯৮৬ সালে কানাডিয়ান সিনেমা ইয়ংব্লাড-এ পার্শ্বচরিত্রে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। আর তারপরই ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেন হলিউডের উদ্দেশ্যে।
মূলত রিভার’স এজ ও অস্কার মনোনীত সিনেমা ডেঞ্জারাস লায়াইসন্স-এ নিজের পারফর্মেন্স দিয়েই আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। একই ধরনের আরও সিনেমায় কাজ করার অফার আসতে থাকলো তার কাছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পার্মানেন্ট রেকর্ড।
১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ব্লকবাস্টার বিল অ্যান্ড টেড’স এক্সিলেন্ট অ্যাডভেঞ্চার-এ টেড লোগান চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি তারকা বনে যান কিয়ানু। ঝড় তুললেন টিন ম্যাগাজিনগুলোয়। ১৯৯১ সালে মুক্তি পেল বিল অ্যান্ড টেড’স এক্সিলেন্ট অ্যাডভেঞ্চার এর সিক্যুয়েল। মিডিয়া তাকে রীতিমতো ‘আইডিয়ালিস্ট টিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে লাগলো। উল্লেখ্য, ব্রিটেনের স্কাই ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে পুরো ১৫ পাতার বিশেষ ফিচার করা হয়েছিল।
হারালেন সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে!
বেশ কয়েকবছর ‘হাইস্কুল টিন’ হিসেবে অভিনয় করার পর এই ধরাবাঁধা ‘টিন’ ইমেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই তিনি অভিনয় করলেন মাই ওউন প্রাইভেট আইডাহো সিনেমায়। এ সিনেমায় সহ-অভিনেতা হিসেবে ছিলেন রিভার ফিনিক্স। সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি, কিয়ানুও সাফল্যের সাথে পেতে শুরু করলেন ভিন্ন ধারার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে পয়েন্ট ব্রেক-এ অভিনয় করে তিনি ‘সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ’ হিসেবে জিতে নেন এমটিভি অ্যাওয়ার্ড। একের পর এক সিরিয়াস রোলে কাজ করে যাওয়া কিয়ানু তারপর অভিনয় করেন ব্রামস্টোকার’স ড্রাকুলা-তে।
হলিউডে কাজ করার সুবাদে ততদিনে নতুন নতুন বহু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে তার। অনেক সাথে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। তবে বন্ধু হিসেবে তার জীবনে আসা মানুষটার নাম রিভার ফিনিক্স। দুজন একসাথে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া আই লাভ ইউ টু ডেথ সিনেমায়।
কিয়ানুর জীবনে সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর একজন ছিলেন রিভার ফিনিক্স। আর তাই তিনি যখন জানতে পারলেন, ওয়েস্ট হলিউডের দ্য ভাইপার রুম নাইট ক্লাবের সামনে সাইডওয়াকে মৃত্যুর মুখে পড়ে আছেন ফিনিক্স, ছুটে গেলেন সাথে সাথে। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না প্রিয় বন্ধুকে।
১৯৯৩ সালের ৩১শে অক্টোবর, মাত্র ২৩ বছর বয়সে ড্রাগ-ওভারডোজে মারা গেলেন উদীয়মান তারকা রিভার ফিনিক্স। বন্ধুর মৃত্যু প্রসঙ্গেও দেখা মিলেছে আবেগ প্রকাশে সংযত ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান জানানো কিয়ানুর-
রিভারের সাথে যা হয়েছে, সেজন্য হলিউডকে দোষ দেয়া যাবে না। বর্তমানের দুনিয়ার সবখানেই বাচ্চারা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ব্যক্তিগত একটা সমস্যা ছিল ওর। কিন্তু ওসব নিয়ে আমি কখনোই মিডিয়ায় আলোচনা করতে চাই না। ওসব ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে যখন কিয়ানু মাই ওউন প্রাইভেট আইডাহো এর স্ক্রিপ্ট পড়লেন, তখনই তার মনে হয়েছিল যে, সিনেমার মিকি চরিত্রটির জন্য রিভার ফিনিক্সের চেয়ে ভালো কেউ হবে না। আর তাই বন্ধুকে রাজি করাতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
প্যান্টের পেছনের পকেটে ছিদ্র করে, সেখানে গাস ভ্যান সান্টের সেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে এক হাজার মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে টরন্টো থেকে ফ্লোরিডায় আসলেন তিনি। বন্ধুকে রাজি করিয়েই ছাড়লেন। আজও সেই সিনেমাটি কিয়ানু রিভস ও রিভার ফিনিক্সের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মাইলফলক হয়ে আছে।
রিভার শুধু একজন অসাধারণ শিল্পীই ছিল না, তার মত মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। প্রত্যেকটা দিন ওকে মিস করি আমি।
সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়ে আবারও এলোমেলো হয়ে গেল কিয়ানু রিভসের জীবন। কিন্তু তাতে ভেঙে পড়েননি তিনি। দৃঢ় চিত্তে চেষ্টা চালিয়ে গেলেন এগিয়ে যাবার। উল্লেখ্য, আসন্ন জোকার চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা জোয়াকিন ফিনিক্স ছিলেন রিভার ফিনিক্সের ভাই। জোয়াকিনও কিয়ানু রিভসের ভালো একজন বন্ধু।
অভিনয় ক্যারিয়ারের উত্থান
ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ ভুলতে ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিয়ানু। অভিনয় করলেন লিটল বুদ্ধ সিনেমায়। ৯০-এর দশকে বার্নার্ডো বার্তালুচির মতো বড় বড় নির্মাতাদের সাথে কাজ করেছেন তিনি। আর কাজের প্রতি আন্তরিকতার কারণে, পরিচালকরাও তার সাথে কাজ করতে পছন্দ করতেন।
পরবর্তী কয়েক বছরে বেশ কিছু নামকরা সিনেমায় অভিনয় করলেন। মূলত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ব্রেকথ্রু তিনি পেয়েছিলেন অ্যাকশন ফিল্ম স্পিড-এ অভিনয় করার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত তারকা স্যান্ড্রা বুলকের বিপরীতে অভিনয় করে অভাবনীয় সাফল্যই তাকে করে তুললো বিগ বাজেট অ্যাকশন স্টার।
এরপর তিনি আরও বেশি এক্সপেরিমেন্টাল রোলে কাজ করতে শুরু করলেন। এমনকি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেও তার কোনো আপত্তি ছিল না। তিনি কেবল খেয়াল করতেন, সিনেমার গল্পে সেই চরিত্রের গুরুত্ব কতখানি।
এ সময় তিনি আ ওয়াক ইন দ্য ক্লাউডস, ফিলিং মিনেসোটা, জনি নেমোনিক, চেইন রিঅ্যাকশন সহ বেশ কিছু প্রশংসিত সিনেমায় কাজ করেন। কিন্তু কোনোটাই স্পিড-এর মতো সাফল্য পায়নি।
আর তারপর ১৯৯৭ সালে দ্য ডেভিল’স অ্যাডভোকেট সিনেমায় অভিনয় করে আবারও সাড়া ফেলে দিলেন কিয়ানু। আল প্যাচিনো, শার্লিজ থেরনের মতো তারকাদের সাথে একই পর্দা ভাগাভাগি করে অভিনয় দিয়ে বাজিমাত করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! সমালোচকরাও তখন কিয়ানুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদিও কেউ কেউ তখনও বিশ্বাস করতেন যে, নিজের সেরাটা দেওয়া তার তখনও বাকি।
জীবনে এলো প্রেম!
ততদিনে কিয়ানু রিভস একজন সফল অভিনেতা। কিন্তু পর্দায় এত সাফল্য পাবার পরও, পর্দার আড়ালে জীবনটা যেন তার সাদা-কালোই রয়ে গিয়েছিল।
আর সেই সাদা কালো জীবন রাঙিয়ে দিতেই তার জীবনে এলো প্রেম। ১৯৯৮ সালে এক পার্টিতে ডেভিড লিঞ্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনিফার সাইমি-র সাথে পরিচয় হয় তার। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা, ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা।
তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলো। জীবনের সেরা সময়টুকু যেন কাটাচ্ছিলেন কিয়ানু। আরও একবার হাসি ফিরে এলো তার জীবনে। কিন্তু সে হাসি মিলিয়ে যেতেও দেরি হলো না।
অনাগত কন্যা সন্তানের মৃত্যু!
ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক অস্থিতিশীলতা দেখে বড় হওয়া কিয়ানু রিভস, তার নতুন প্রেম সাইমিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। বিয়ে না করলেও, ঘর বাঁধার স্বপ্ন থেকেই সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ১৯৯৯ সালে তাদের কোল জুড়ে আসার অপেক্ষায় ছিল এক কন্যা সন্তান।
কিন্তু আরও একবার কিয়ানুর জীবনে নেমে এলো বিষাদের কালো ছায়া। শখ করে জেনিফার আর কিয়ানু তাদের অনাগত কন্যাসন্তানের নাম রেখেছিলেন এভা আর্চার সাইমি-রিভস। দুনিয়ার আলো দেখার আগেই মৃত্যু হয় তার।
সে বছর মুক্তি পেল দ্য ম্যাট্রিক্স। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, উইল স্মিথ ও ব্যাড পিটকে পেছনে ফেলে বিখ্যাত নিও চরিত্রটিতে কাজ করার সুযোগ পান কিয়ানু রিভস। আর বক্স অফিসে কাঁপিয়ে দিয়ে ওয়াচোস্কি ব্রাদার্সের এই সাই-ফাই সিনেমা, যেন আরও একবার তাকে বেঁচে থাকার আশা জোগানোর চেষ্টা করলো।
অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গেলো তার ক্যারিয়ার। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে দ্য ম্যাট্রিক্স ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে দুইটি সিক্যুয়েল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সে দুটিতেও কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।
হারালেন ভালোবাসার মানুষটিকেও!
কন্যাসন্তানের মৃত্যুতে শোক বিহ্বল রিভস-সাইমি দম্পতি সে বছরেরই অক্টোবরে আলাদা হয়ে যান। রেকর্ড এক্সিকিউটিভ অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন সাইমি। ২০০১ সালের ২ এপ্রিল, মেরিলিন ম্যানসনের পার্টি শেষে লস অ্যাঞ্জেলসে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু পথে এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার।
ওদিকে সে বসন্তে দ্য ম্যাট্রিক্স সিক্যুয়েলের শ্যুটিং শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিয়ানু। পুরো ক্যারিয়ার-জুড়ে সবসময়ই ব্যক্তিগত বিষয়ের চেয়ে পেশাদারিত্বকে এগিয়ে রেখেছেন এ অভিনেতা। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে এতটাই ভেঙে পড়েন যে, নিজেকে শান্ত করতে কিছুদিনের জন্য সবকিছু থেকে ছুটি চেয়ে নেন রিভস। পিছিয়ে যায় দ্য ম্যাট্রিক্স রিলোডেড এর কাজ।
কাছের মানুষকে হারানোর দুঃখটাও এতটাই আপন যে, সে আগুনের উষ্ণতাও একটা সময় ভালো লাগতে শুরু করে।
বারবার এত ধাক্কা খেয়েও থেমে যাননি এই অভিনেতা। অভিনয় ক্যারিয়ারে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মধ্য দিয়ে বারবার শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। বিপর্যস্ত ব্যক্তিজীবনের সব দুঃখকে পাশ কাটিয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী-রূপে ফিরে এলেন আরও একবার।
২০০৩ সালে যথাক্রমে মুক্তি পেল দ্য ম্যাট্রিক্স রিলোডেড এবং দ্য ম্যাট্রিক্স রেভোল্যুশন। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাফল্য পেয়ে আরও উঁচুতে পৌঁছে গেলো তার ক্যারিয়ার। ততদিনে কিয়ানু রিভস নিজেকে বৈচিত্র্যময়, মেধাবী ও পরিণত একজন অভিনেতা হিসেবে হলিউডে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।
সমালোচকদের আতশী কাঁচের নিচে এসেছেন বারবার
মাঝখানে দ্য গিফট, দ্য ওয়াচার, দ্য রিপ্লেসমেন্টস, সামথিং’স গটা গিভ, সুইট নভেম্বর-এর মতো চলচ্চিত্রগুলোয় অভিনয় করেছিলেন তিনি। কন্যাসন্তান হারিয়ে বিপর্যস্ত কিয়ানু তখন ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হয়ে সব ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু, এই চলচ্চিত্রগুলো বক্স অফিসে খুব বেশি সফল হয়নি। পাশাপাশি, তার অভিনয়শৈলী নিয়েও হয়েছে যথেষ্ট সমালোচনা। ২০০৩ সালে দ্য ম্যাট্রিক্সের সফল দুই সিক্যুয়েল দিয়ে, বক্স অফিসের ভরাডুবি নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দেন তিনি। পাশাপাশি, ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া হরর থ্রিলার কন্সট্যান্টাইন দিয়ে তার অভিনয়শৈলী নিয়ে প্রশ্ন তোলা সমালোচকদের মুখেও কিয়ানু এঁটে দিলেন কুলুপ।
ছোট বোন আক্রান্ত হলো লিউকেমিয়ায়
কিয়ানু তার মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান হলেও, প্যাট্রিসিয়ার ছিল তিন কন্যা- এমা রিভস, কারিনা মিলার, কিম রিভস। ২০০১ সালে, হঠাৎ করেই এক ডায়াগনোসিসে যখন কিমের লিউকেমিয়া ধরা পড়ল, তার বয়স তখন ৩৮। চিকিৎসা ও প্রবল মানসিক জোরে প্রায় বছর দশেক লড়াই করার পর, অবশেষে সুস্থ হন কিম। অসুস্থতার এই পুরোটা সময়জুড়ে বোনের পাশে ছিলেন কিয়ানু।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সবসময়ই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এসেছেন। দু’হাতে দান করেছেন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায়। কিন্তু, চোখের সামনে নিজের বোনকে মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখে, অর্থের প্রতি লোভহীন এই মানুষটি যেন আবারও নতুন করে মানুষের পাশে থাকার সুযোগ পেলেন।
তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত, প্রতি বছর ব্যক্তিগত উপার্জনের একটি অংশ তিনি লিউকেমিয়া গবেষণায় দান করে থাকেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, তিনি নিজেও একটি ফাউন্ডেশন চালু করেছেন। গোপন এ ফাউন্ডেশনটি ক্যান্সার গবেষণা ও শিশু হাসপাতাল নিয়ে কাজ করে থাকে।
কিন্তু মানুষকে সাহায্য করে জনসম্মুখে বাহবা নেয়ার মানুষ নন তিনি। তাই নিজের ফাউন্ডেশনের সাথে নিজের নামটা জুড়তেও তিনি নারাজ। এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে দ্য লেডিস হোম জার্নালকে তিনি বলেন,
আমি এর সাথে নিজের নাম যুক্ত করতে চাই না। বরং ফাউন্ডেশনটি ঠিকঠাক ভাবে কাজ করতে পারছে কিনা, সেটাই মুখ্য।
এছাড়াও স্পাইনাল ইনজুরি নিয়ে কাজ করা সংস্থা SCORE-সহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই হলিউড আইকন।
ক্যারিয়ারে আবারও জোয়ার আনলো জন উইক
২০০৬ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত কিয়ানু রিভস বিভিন্ন বাজেট ও বিভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাই-ফাই থ্রিলার হলো আ স্ক্যানার ডার্কলি, রোমান্টিক ড্রামা দ্য লেক হাউজ, স্ট্রিট কিংস, দ্য ডে দ্য আর্থ স্টুড স্টিল, দ্য প্রাইভেট লাইভস অফ পিপা লি, হেনরি’স ক্রাইম । এদের মধ্যে কয়েকটি সিনেমা দর্শকদেরকে হতাশ করলেও, বাকিগুলো পায় মাঝারি সাফল্য।
তার বন্ধু, বিখ্যাত স্টান্টম্যান, টাইগার হু চেন-এর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১০ সালে কিয়ানু নির্মাণ করেন ম্যান অফ তাই চি। আর এর মধ্য দিয়েই পরিচালক হিসেবে অভিষেক হয় তার।
ফ্রান্সের বিখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসব ও চীনের বেইজিং চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলে দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা পায় এ সিনেমা। শুধু তা-ই নয়, বেইজিং চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় সেরা সিনেমার পুরস্কারও।
কেমন ছিল পরিচালক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা? জানতে চাইলে কিয়ানু বলেন,
একজন অভিনেতা হিসেবে কাজ করার সময় দায়িত্ব থাকে, শুধু নিজের চরিত্রটুকু ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু একজন পরিচালকের কাঁধে প্রতিটি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব থাকে। ফলে, চিন্তাধারায় বড় রকমের পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে।
২০১১ সালে, ডিজিটাল ক্যামেরা কীভাবে ফটো-কেমিকেল ফিল্ম প্রযুক্তির স্থান কেড়ে নিয়েছে, সে বিষয়ক একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন। সাইড বাই সাইড নামের এ ডকুমেন্টারিতে তিনি ক্রিস্টোফার নোলান, মার্টিন স্করসিসে, জেমস ক্যামেরনের মতো ইন্ডাস্ট্রির বাঘা বাঘা সব পরিচালকদের সাক্ষাৎকার নেন।
একই বছর তিনি ওড টু হ্যাপিনেস নামের একটি বইও লেখেন। পরের দুই বছরে মাঝারি বাজেটের জেনারেশন আম… ও ৪৭ রোনিন-এর মতো সিনেমায় কাজ করেন। বলা যায়, শীর্ষ এই হলিউড তারকার ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বগতিতে তখন কিছুটা ভাটাই পড়েছিল।
অবশেষে, ২০১৪ সালে রিভেঞ্জ অ্যাকশন থ্রিলার জন উইক মুক্তি পাবার সাথে সাথেই আবারও হলিউড মেতে উঠলো কিয়ানু বন্দনায়। বক্স অফিসে সাফল্য ও ক্রিটিকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়ে কিয়ানুর ক্যারিয়ারে আবারও এলো জোয়ার।
জন উইক মুক্তি পাবার পরের বছরগুলোয় নক নক, এক্সপোজড , দ্য হোল ট্রুথ, দ্য নিয়ন ডেমন, দ্য ব্যাড ব্যাচ, ডেসটিনেশন ওয়েডিং, রেপ্লিকাস-এ কাজ করেছেন তিনি। নিশ্চিত সাফল্যের দিকে না ঝুঁকে বারবার বেছে নিয়েছেন বৈচিত্র্যময় চ্যালেঞ্জিং রোল। অ্যাকশনধর্মী কাজে এতটা সফল হওয়া সত্ত্বেও সেখানেই আটকে না থেকে, নিজের ওপর চালিয়ে গেছেন পরীক্ষা। ফলে বরাবরের মতোই বেশ কিছু সিনেমা বক্স অফিসে তেমন সুবিধে করতে পারেনি। আর সবকিছু ছাপিয়ে সর্বশেষ বছরগুলোয় জন উইক হিসেবেই আইকনিক অ্যাকশন ফিগারে পরিণত হয়েছেন কিয়ানু রিভস।
সুখের টানে ছুটে চলা!
সামাজিক মূল্যবোধকে তুলে ধরে, এমন যেকোনো চরিত্রে কাজ করার প্রতিই সবসময় বিশেষ ঝোঁক ছিল তার। এমনকি শুধুমাত্র এই ঝোঁকের কারণে, তিনি ৫.৫ মিলিয়ন ডলারের সিনেমা-প্রস্তাব পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা, সে সিনেমায় রবার্ট ডি নিরো এবং আল প্যাচিনোর সাথে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল তার সামনে। হিট নামের সেই সিনেমায় পরবর্তীকালে কিয়ানুর স্থলাভিষিক্ত হন ভল কিলমার।
ঐ সিনেমায় কাজ করার বদলে তিনি হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, কানাডার ম্যানিটোবা থিয়েটার সেন্টারে। সেখানে তার সাপ্তাহিক সম্মানী ছিল ২ হাজার ডলারেরও কম!
কিন্তু সম্মানী বা খ্যাতির তারতম্য নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা তো ছিলই না, বরং হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছেন বলেই তিনি বেশি খুশি ছিলেন।
১৯৯৯ সালের বিখ্যাত অ্যাকশন সিনেমা দ্য ম্যাট্রিক্স ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে তিনি আয় করেন প্রায় ১১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু দ্য ম্যাট্রিক্স-এর সাফল্যের পর পরবর্তী দুই সিক্যুয়েলে স্পেশাল ইফেক্টস ও কস্টিউম ডিজাইনার টিম যেন আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে, তাই নিজের পারিশ্রমিক থেকে কিয়ানু তাদেরকে ৮০ মিলিয়ন ডলার উপহার দেন।
কিয়ানু মনে করেন, তাদের কারণেই দ্য ম্যাট্রিক্স এত ভালোভাবে বানানো সম্ভব হয়েছে। তাই এ সম্মাননাটুকু তাদেরই প্রাপ্য।
এছাড়াও, দ্য ম্যাট্রিক্স সিনেমায় স্টান্ট স্টাফদেরকে হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেল উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে, সিয়াটল পোস্ট-ইন্টেলিজেন্সারকে কিয়ানু বলেন,
সিনেমায় সবকিছু আমরা একসাথেই করতাম। আমরা একসাথে ট্রেনিংও নিয়েছিলাম। আর সেজন্যই, আমাকে কাজটা করতে সাহায্য করা মানুষগুলোকে একটু ভালোভাবে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, সিনেমা ইতিহাসের সেরা ফাইট সিনগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই মার্শাল-আর্ট দৃশ্যে ছিল পাঁচ শতাধিক মুভ। শ্যুটিং শেষে কিয়ানু ও স্টান্টম্যানদের বিশেষ ট্রিটমেন্ট পর্যন্ত নিতে হয়েছিল। ঐতিহাসিক সে দৃশ্য আজও ফ্যানদের প্রিয় অ্যাকশন সিকোয়েন্স তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে।
দ্য ডেভিল’স অ্যাডভোকেট সিনেমায় আল প্যাচিনোর সাথে অভিনয় করার কথা ছিল তার। কিন্তু হলিউডের তারকা অভিনেতা আল প্যাচিনোকে নিতে টান পড়েছিল সিনেমার কাস্টিং বাজেটে।
আর তাই, সিনেমাটির নির্মাণ যেন বাধার মুখে না পড়ে, সেজন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কিয়ানু। নিজের দিক থেকে কমিয়ে মাত্র এক মিলিয়ন ডলার সম্মানী নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর এরই মাধ্যমে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন সিনেমাটির নির্মাতারা।
ঠিক একই কাজ তিনি করেছিলেন দ্য রিপ্লেসমেন্টস সিনেমায়। আর সে বার আল প্যাচিনোর জায়গায় মানুষটি ছিলেন জিন হ্যাকম্যান। অর্থের প্রতি সব রকম টানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবারও নিজের সম্মানীর ৯০% ছেড়ে দিয়ে সে সিনেমায় হলিউড তারকা জিন হ্যাকম্যানকে নেয়ার সুযোগ করে দেন কিয়ানু।
অর্থ আমার কাছে সবসময়ই মূল্যহীন। জীবনে বহু অর্থ উপার্জন করেছি আমি। কিন্তু আমি জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই। ব্যাংক ব্যালেন্স বৃদ্ধি করার জন্য ছুটে নিজের সুখ নষ্ট করতে চাই না। আর আমি দান করতেও পছন্দ করি। পছন্দ করি সাধারণ জীবনযাপন করতে। অধিকাংশ সময় হোটেলের স্যুটকেস থেকেই দেই। আর সুস্বাস্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না।
সবসময়ই নিজের পছন্দ ও সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। এমনকি বিশাল পারিশ্রমিক পাবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, অতি সাধারণ কারণে একাধিক সিনেমা ফিরিয়ে দিয়েছেন খুঁতখুঁতে স্বভাবের এ অভিনেতা।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি সিনেমা হলো প্লাটুন ও স্পিড রেসার। প্লাটুন সিনেমায় প্রাইভেট ক্রিস টেইলর চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পেছনে কারণ ছিল সিনেমাটির মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা। তার বদলে অভিনয় করেন চার্লি শিন। এছাড়াও স্পিড রেসার সিনেমায় একজন রেসার এক্স চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, কিয়ানু রিভস তার ক্যারিয়ারের অন্যতম প্রধান মাইলফলক স্পিড সিনেমার সিক্যুয়েলে কাজ করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু অ্যাকশন-থ্রিলারটির দ্বিতীয় কিস্তির গল্প পছন্দ না হওয়ায় কাজ করতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি এক টিভি অনুষ্ঠানে কিয়ানু স্বীকার করেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে কাছের মানুষকে হারানোর কষ্টকর অভিজ্ঞতাই ছিল, তার জন উইক-এ অভিনয় করার পেছনে অন্যতম কারণ। রিভেঞ্জ থ্রিলার সিরিজটির কেন্দ্রীয় চরিত্র জন উইক হয়তো আর কেউই এতটা ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না!
কাজের প্রতি বিশেষ আন্তরিকতা দেখানোর পাশাপাশি সবসময়ই পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে এসেছেন মেথড অ্যাক্টিংয়ে বিশ্বাসী এ অভিনেতা। সবসময় নতুন কিছু শেখার চেষ্টা ও আগ্রহ তাকে করে তুলেছে অনন্য।
দ্য ম্যাট্রিক্সের প্রোডাকশন শুরু হবার আগে প্রায় চার মাস মার্শাল-আর্ট ও স্টান্ট ওয়ার্ক শিখেছিলেন তিনি। জন উইক-এর আগেও প্রায় তিন মাস কাজ করেছেন স্টান্ট ওয়ার্ক নিয়ে। ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া পয়েন্ট ব্রেক সিনেমায় অভিনয়কালে চরিত্রের প্রয়োজনে সার্ফিংও শিখেছিলেন তিনি।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কীভাবে একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে যাচ্ছেন তিনি। এতটাই দ্রুত ও নিখুঁতভাবে তিনি অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছিলেন যে, তাকে নেভি সিলদের সাথে তুলনা করেছেন অনেকে।
সিনেমার শ্যুটিংয়েও স্টান্ট ডাবলের চেয়ে স্টান্টগুলো নিজে করার দিকে বেশি চেষ্টা থাকে তার। এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে দ্য টেলিগ্রাফকে তিনি বলেছিলেন,
না। আমি নিজেই কাজগুলো করতে চাই। আর ঠিক এই ব্যাপারটাই দর্শকদের মধ্যে বাড়তি টান সৃষ্টি করে। আর কোনো স্টান্ট ডাবল ব্যবহার না করে, কাজটা যখন আমি নিজেই করি, সেটা আর স্টান্ট থাকে না। তখন সেটাই বাস্তবতা।
সব্যসাচী কিয়ানুর সুরের প্রতি ভালোবাসা
জীবনের সুর কেটে গেছে বহুবার। তবুও হার না মানা অদম্য যোদ্ধা কিয়ানু রিভস কখনো থেমে যাননি। জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে গেছেন অবিরাম।
সুরের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল তার। এমনকি ডগস্টার অ্যান্ড বেকি নামে তার নিজের একটি ব্যান্ডও ছিল। গিটার বাজাতে পছন্দ করতেন তিনি। ব্যান্ডের বাকিরা হলেন রবার্ট মেইলহাউজ (ড্রামস), পাউলি কস্টা (গিটার), রেবেকা লর্ড (ভোকাল)। ১৯৯৫ সালে তিনি তার ব্যান্ডদল নিয়ে একটি গ্রীষ্মকালীন ট্যুরও করেছিলেন।
সব্যসাচী কিয়ানু মূলত বামহাতি হলেও, ব্যান্ডে সবসময়ই ডান হাতে বেজ গিটার বাজাতেন। এছাড়া, আগ্নেয়াস্ত্রও তিনি ডানহাতেই ব্যবহার করেন।
ঘোড়ায় চড়া, বলরুমে নাচা আর সার্ফিং করা তার পছন্দের শখগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য কতকিছুই না করেছেন তিনি! কিন্তু দিনশেষে সুখ খুঁজে ফিরেছেন পরিবার ও কাছের মানুষগুলোর কাছেই।
কারো আলিঙ্গনে রাত কাটানো, বাইক নিয়ে ঘোরা, খেলাধুলা করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, কথা বলা, নতুন কিছু শেখা, মাটির কাছাকাছি থাকা, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে উদরপূর্তি করা সবই ভালো লাগে। আমি মরুভূমিতে থাকতে পছন্দ করি, প্রকৃতির সান্নিধ্য পছন্দ করি, সেটা হতে পারে গহীন প্রত্যন্ত কোনো জায়গা, হতে পারে গাছে চূড়া কিংবা ধুলোমাখা ভূমি। পছন্দ করি পরিবার ও বোনদের সাথে সময় কাটাতে।
গুজব পিছু নিয়েছিল তার
অদ্ভুত সব গুজব কখনোই পিছু ছাড়েনি শীর্ষ হলিউডের তারকাদের। ব্যতিক্রম নয় কিয়ানু রিভসও। ২০০৯ সালে কিয়ানুর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আদালতের শরণাপন্ন হন ক্যারেন সালা নামের এক মহিলা।
তার অভিযোগ ছিল, কিয়ানু তাকে ‘হিপনোটাইজ’, অর্থাৎ সম্মোহিত করে তার স্বামীর বেশ ধরে, তাকে গর্ভবতী করেছে। শাস্তিস্বরূপ সে ‘স্পাউজাল সাপোর্ট’ হিসেবে মাসে ৩ মিলিয়ন ডলার ও ‘রেট্রো চাইল্ড সাপোর্ট’ হিসেবে মাসে ১.৫ মিলিয়ন ডলার দাবি করে। কিন্তু পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্ট করে, তার সাথে কিংবা তার সন্তানদের সাথে কিয়ানু রিভসের কোনো সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও, হুট করেই একবার মিডিয়া পাড়ায় তার নামে সমকামিতার গুজব রটে। গুজবটি এমন ছিল যে, তিনি বিখ্যাত আমেরিকান বিলিয়নিয়ার ডেভিড গিফিনের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছেন।
কিয়ানু অবশ্য গুজবে কখনোই পাত্তা দেননি। বরং সবসময়ই এসব গুজবকে খ্যাতির বিড়ম্বনা হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে গেছেন আপন গতিতে।
বর্তমানে কেমন আছেন তিনি?
প্রায় তিন দশকের দীর্ঘ শো-বিজ ক্যারিয়ারে, কানাডিয়ান এ হলিউড সুপারস্টার অভিনয় করেছেন অন্তত ৬৯ টি সিনেমায়। জিতে নিয়েছেন এমটিভি মুভি অ্যাওয়ার্ড, ব্লকবাস্টার এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, টিন চয়েস অ্যাওয়ার্ড, ওয়াক অফ ফেম, ওয়ার্ল্ড স্টান্ট অ্যাওয়ার্ডসহ একগাদা পুরস্কার।
সিনেমায় অভিনয় করার পাশাপাশি পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন। কাজ করেছেন ডকুমেন্টারি নিয়েও। এছাড়া ভয়েস-ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন বেশ কিছু অ্যানিমেটেড ফিল্মে। সম্প্রতি গেমিং দুনিয়ায় ঝড় তোলে তার ভয়েস-ওভার করা চরিত্র নিয়ে বানানো ভিডিও গেম সাইবারপাংক ২০৭৭।
তবে তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মাইলফলক হয়ে থাকবে মধ্যে অন্যতম দ্য ম্যাট্রিক্স ট্রিলজি, স্পিড, দ্য ডেভিল’স অ্যাডভোকেট, কন্সট্যান্টাইন, পয়েন্ট ব্রেক ইত্যাদি। আর সাম্প্রতিক সময়ের অ্যাকশন থ্রিলার ফ্র্যাঞ্চাইজি জন উইক-এর নাম বিশেষ ভাবে না নিলেই নয়।
২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া জন উইক বক্স অফিসে ঝড় তোলার পর মুক্তি পায় জন উইক ফ্র্যাঞ্চাইজির দুই সিকুয়েল জন উইক: চ্যাপ্টার টু ও জন উইক: চ্যাপ্টার থ্রি – প্যারাবেলাম। দুইটি সিনেমাই অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য পায়।
দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা ও ভালোবাসায় সিক্ত জন উইক ফ্র্যাঞ্চাইজির পরবর্তী মুভিটি আসতে চলেছে ২০২১ সালের গ্রীষ্মে। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির হাত ধরেই আবারও আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন কিয়ানু রিভস। আয় করেছেন বিশাল অংকের পারিশ্রমিক।
সেলেব্রিটি নেট ওর্থের সমীক্ষা অনুসারে, এই সফল হলিউড তারকার বর্তমান সম্পর্দের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে কখনোই নিজের অতীত ভুলে যাননি কিয়ানু রিভস। বরং বিলাসবহুল জীবনযাপনের চেয়ে অতি সাধারণ জীবনেই যেন তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান।
এমনকি বহু বছর নিজের জন্য বাড়ি কেনা তো দূরে থাক, বাড়ি ভাড়া নিয়েও দিনের পর দিন থেকেছেন হোটেলে। ভবঘুরে স্বভাবের কিয়ানু সবসময়ই ঝঞ্ঝাটমুক্তভাবে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন।
কোনো একটি জায়গায় পাকাপোক্তভাবে থাকাটা আমার জন্য অস্বস্তিকর। আমি অনেকটা ভবঘুরে স্বভাবের। আগেও আমি বাড়ি ভাড়া নিয়ে, হোটেলে থেকেছি। ‘৯০র দশকের শুরুর দিকে আমি প্রায় চার বছর হোটেলে কাটিয়েছি। কিন্তু দিনশেষে পথই হয়েছে আমার আপন ঠিকানা।
২০০৩ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে বাড়ি কেনার আগ পর্যন্ত ভাড়া বাসা আর হোটেলেই রাত কাটাতেন এই অভিনেতা। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করেন তিনি। ব্যস্ত সন্ধ্যায় কিংবা ক্লান্ত দুপুরে লোকাল সাবওয়েতেও দেখা মেলে তার।
একবার এক ভক্তের ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, সাবওয়েতে যাত্রারত কিয়ানু তার সিটটি ছেড়ে দিচ্ছেন দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার জন্য। ভিডিওটি মুহূর্তেই ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়। তাতেও এতটুকু পরিবর্তন আসেনি তার এমন জীবনধারায়। অন্যান্য সেলেব্রিটিদের থেকে ব্যতিক্রম কিয়ানু সাধারণত কখনোই বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করেন না।
বরং একবার ভক্তদের লুকানো ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়, তিনি রাস্তায় বসে এক গৃহহীনের সাথে গল্প করছেন। তাদের ড্রিংকস আর সিগারেট শেয়ার করে গল্পের একপর্যায়ে মনোযোগী শ্রোতা কিয়ানু আয়েশ করে মাটিতে শুয়েও পড়েন।
শ্রেণী, পেশা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে যেকারো সাথে গল্পে মশগুল হয়ে যান সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি। তাকে দেখলে আদতে একজন সুখী মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু যন্ত্রণা আর কষ্ট ভুলে থাকার অভ্যাসটা রপ্ত করে নিতে পারলেই বুঝি কেবল এতটা পরিণত, সাবলীল আর মাটির মানুষ হয়ে থাকা সম্ভব।
স্যাড কিয়ানু মিম
২০১০ সালের কথা। একটি প্রজেক্টের পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ করছিলেন কিয়ানু। কাজের বিরতিতে, নিউ ইয়র্কের একটি পার্কের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। পাপারাজ্জিদের ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই মুহূর্তের ছবি রীতিমতো ঝড় তুললো ইন্টারনেটে।
ছবিতে দেখা যায়, বেঞ্চে বসা কিয়ানুর হাতে স্যান্ডউইচের টুকরো। পায়ের কাছে ঘুরছে একটা কবুতর। আর কিয়ানুর মুখে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট। ইন্টারনেটে আলোড়ন তোলা এই ছবিটির নাম স্যাড কিয়ানু।
হাস্যরসের যোগান দেওয়ার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা মেসেজ তুলে ধরতে পারে, এমন ছবিকেই সাধারণত মিম বলে সম্বোধন করা হয়। আর কিয়ানুর এই ছবিটি নিয়ে স্যাড কিয়ানু মিম তৈরিতে মেতে উঠলো ইন্টারনেটবাসীরা।
এডিট করে তৈরি হলো অসংখ্য মিম। অবশ্য অন্যান্য সেলেব্রিটি ইস্যুর মতো ব্যঙ্গ করার বদলে অনেকটা সহমর্মিতা আর ভালোবাসা থেকেই এই বিষয়টি ট্রেন্ডিং হয়। সত্যিকার অর্থেই, মন থেকে সবসময় ‘হ্যাপি কিয়ানু’কে দেখতে চান দর্শকেরা। কারণ, দুঃখ তো তাকে কম পেতে হয়নি জীবনে!
এমনকি স্যাড কিয়ানু টপিক আলোড়ন তোলার পর উৎসুক ইন্টারনেটবাসী ১৫ জুনকে ‘কিয়ানু দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিও তোলে। এখনও বহু সাক্ষাৎকারে স্যাড কিয়ানু মিম নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন কিয়ানু।
৫৪ বছর বয়সী এ অভিনেতার জীবনে এত বেশি ট্র্যাজেডি থাকতে পারে, তা হয়তো কেউ কখনো ভাবতেও পারেনি। জীবনের নিষ্ঠুর আঘাত সামলে নিয়ে বারবার উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। হাসিমুখে এগিয়ে গেছেন। পর্দায় এবং পর্দার বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই নিজেকে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে দুঃখী কিনা জানতে চাইলে বলেন,
দুঃখ কেবলই রূপ বদলায়, কখনো ফুরিয়ে যায় না। আর দুঃখ আমাদেরকে যে শিক্ষা দেয়, তার সাথে আর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না।
দুই দশকের অব্যক্ত প্রেম!
আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। আমার জীবনে কেউ নেই। …আশা করি, কখনো আমার জীবনেও আসবে প্রেম।
প্রেমের চেয়ে কিয়ানু রিভসের জীবনে কষ্টই এসেছে বেশি। বারবার আঘাত পেতে পেতে, স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে স্বপ্নভঙ্গ হওয়া দেখতে দেখতে, হয়তো নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি হালও ছেড়ে দিয়েছেন।
আর এই বয়সে নতুন করে সংসার কিংবা সন্তান নেয়ার ব্যাপারে উচ্চাভিলাষী হতেও ভয় পান তিনি। অবশ্যই এর পেছনে তার জীবনের হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রবাহের অবদান কম নয়। কিয়ানুর মতে,
বয়স হয়ে গেছে… বেশ দেরিও হয়ে গেল। আর সুযোগ নেই। বয়স এখন ৫৪। আমার হয়তো আর সন্তানও নেওয়া হবে না।
কারো সাথে সেভাবে কোনো সম্পর্কেও জড়াননি তিনি। কাউকে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানোর মতো মানসিক শক্তিটাও হয়তো আর নেই তার।
কাউকে ভালোবাসা, আর কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
তাই হয়তো ভালোবাসার মানুষটিকে হারানো কিয়ানু কখনোই আর কাউকে ভালোবাসার সে স্থানটি দিতে পারবেন না। কিন্তু, কিয়ানু ভক্তদের প্রার্থনা একটাই। সুখী রিভস পরিবার দেখতে চান তারা।
আর সে কারণেই সম্প্রতি কিয়ানু রিভসের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্যান্ড্রা বুলকের প্রতি ভক্তদের আহ্বান আসতে থাকে। কিন্তু এত মানুষ থাকতে স্যান্ড্রা বুলক কেন?
উত্তরটা জানতে হলে, আবারও একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। বিশ্ববাসীকে ধুন্ধুমার অ্যাকশন আর টান টান উত্তেজনার এক জাম্প্যাকড থ্রিলার উপহার দিয়েছিলেন অভিষিক্ত পরিচালক জন ডি বন্ট। কিন্তু, সম্প্রতি দ্য অ্যালেন ডিজেনারাস শো-তে এক আলাপচারিতায় স্যান্ড্রা বুলক স্বীকার করেন যে, একসাথে স্পিড-এ কাজ করার সময়ই তিনি কিয়ানুর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তাদের মাঝে ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় এবং দুজনের জীবনেই বিভিন্ন মোড় আসায় কখনোই আর কথাটি জানানো হয়নি।
পরবর্তীতে কিয়ানু রিভসও স্বীকার করেন যে, স্পিড সিনেমায় একসাথে কাজ করার সময় তিনিও স্যান্ড্রা বুলককে পছন্দ করতেন।
১৯৯৪ সালে যখন তারা একসাথে কাজ করেন, কিয়ানু তখনও একজন ‘টিন ড্রিম-বয়’। ওদিকে স্যান্ড্রা বুলক ততদিনে একাধিক তারকা পুরুষ অভিনেতার সাথে কাজ করে ফেলেছেন। কিন্তু তবুও কিয়ানুর প্রতি তার বিশেষ ভালো লাগা কাজ করতো। কেন? স্যান্ড্রার ভাষায়,
কারণ, ও তো কিয়ানু। ওকে ভালো লাগার যথেষ্ট কারণ আছে। ও সত্যিই খুব ভালো একজন মানুষ। দারুণ একজন মানুষ।
সে সময় স্পিড-এর সেট থেকে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিয়ানু বলেছিলেন, “জানি না, আমি আসলে ওর সঙ্গ বেশ উপভোগ করি।” কথা বলতে বলতেই, পেছন থেকে স্যান্ড্রা বুলক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে। বাধ্য হয়ে কিয়ানু বলেছিলেন, “কিছু মনে করবেন না।”
সে সময়, তাদের দুজনকে নিয়ে প্রেম করার গুজব উঠলেও, অস্বীকার করে গেছেন তারা। খ্যাতি পেয়েছেন নিজ নিজ ক্যারিয়ারে। ভালো বন্ধু হয়েই এগিয়ে গেছেন। কিন্তু কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়েই গিয়েছিল।
কিন্তু তারা দুজনেই ভালো লাগার কথা জানাতে দেরি করে ফেলেছেন ২৫টি বছর। নইলে হয়তো এতদিনে সন্তানসন্ততি নিয়ে কিয়ানু-স্যান্ড্রা দম্পতির সুখের সংসারও থাকতে পারতো। তবুও হাল ছেড়ে দেয়নি ভক্তরা। এখনও দুজনকে একসাথে দেখার অপেক্ষায় আছেন তারা।
কে জানে, জীবন থেকে বারবার ভালোবাসা হারানো কিয়ানুকে হয়তো এবার সত্যিই সুখী হবার একটা সুযোগ দিয়েছেন ভাগ্যবিধাতা! আর তা যদি হয়, অবশেষে ‘স্যাড কিয়ানু’র পর ‘হ্যাপি কিয়ানু’ দেখে উৎফুল্ল হতে পারবেন কিয়ানু ভক্তরা।
অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে হাজারও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়া এ মানুষটির জীবনের গল্প যতটা না সাফল্যের, তার চাইতেও বেশি হার না মানা অদম্য মানসিকতার। তাই তো, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম কিয়ানু। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের প্রার্থনা একটাই। ভালো থাকুক কিয়ানু রিভস।