কোনো মেঘলা দিনে কখনো মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল কি? গুনগুন করে হয়তো গাইলেন শ্রীকান্তের গাওয়া দুইটি বিখ্যাত লাইন, “কুচবরণ কন্যা তোমার মেঘবরণ চুল / দুলে কানে গজমতির মালা, কানে ঝুমকো দুল”! অথবা কোলাহলমুখর জীবনের কোনো এক ছুটির দিন, ধরুন পহেলা বৈশাখ নাহয় ফাল্গুনে, এক দৃষ্টিনন্দন বঙ্গনারীর চুলের খোঁপার মাঝে আপনার মনোযোগ গিয়েছিল আটকে, সেই খোঁপার মাঝে শোভা পাচ্ছিল আপনার পছন্দের রঙিন ফুল… বলেছিলেন মনে মনে, ‘দিল ওহি মেরা ফাঁস গায়ী’! এমনও হতে পারে, দৃশ্যপটের বঙ্গকন্যাটিই হলেন আপনি!
‘চুল তার কবেকার’ জীবনানন্দ দাশের সেই বনলতা সেন; অথবা সুন্দরী সেই রাজকন্যা, যাকে রাক্ষসীর হাত থেকে বাঁচাতে রাজকুমার উঁচু পাহাড়ে উঠেছিল কন্যার দীর্ঘ সোনালী চুল বেয়ে – এভাবে কখনো গল্প, কখনো ইতিহাস, কখনো বা শিল্পীর নিপুণ তুলি আঁচড়ে বাংলার মেয়েদের কেশসজ্জা আমাদের মনকে রাঙিয়েছে দিনের পর দিন। আজ আমাদের গল্প হবে ‘খোঁপা’র; চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির খোঁপা, গ্রামবাংলার নারীর ঐতিহ্যের খোঁপা, আর সে গল্পের মাঝে অল্প করে অন্য রঙ যোগ করবে দৃষ্টিন্দন চুলের বেণী। মৈমনসিংহ গীতিকার দ্বিজ ঈশান রচিত ‘কমলা’ চরিত্রটিতে লেখকের বর্ণনা দিয়ে আমরা শুরু করি-
“কখন খোঁপা বান্ধে কন্যা কখন বান্ধে বেনি।
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী।।”
খোঁপার ইতিবৃত্ত?
ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে, ‘খোঁপা’ শব্দটির উদ্ভব সংস্কৃত শব্দ ‘ক্ষম্পেক’ থেকে, যার অর্থ এঁটেসেটে যা রাখা যায়। আবার, ছত্রাকের সংস্কৃত আভিধানিক রূপ হলো ‘ক্ষপ’, যা থেকে ‘ঝোপ’ শব্দটির উদ্ভব, এর সাথেও খোঁপা শব্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিষ্টস্বাদের জিলিপির সাথে খোঁপার ধরন অনেকটা মেলে বলে ‘জিলিপি রকমের খোঁপা’ বলে একটা কথা বাংলায় প্রচলিত আছে।
হরেক রকমের খোঁপার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই হাজার বছর আগে বাংলার নারীরা চুল রাখতেন লম্বা করে, সেই সাথে পুরুষেরাও। সেকালে নারী-পুরুষ সবাই সেলাইবিহীন কাপড় পরতো, তাই লম্বা চুল কিছুটা পোশাকেরও কাজ করতো। অনেকে ঘাড়ের পাশ দিয়ে চুল ছেড়েও রাখতেন। খোঁপা অবশ্য মেয়েরাই বাঁধতেন, আর খোঁপা করার সময় ব্যবহার করতেন বিভিন্ন রঙের ফুল, ফুলের মালা। সবচেয়ে প্রাচীন দু’টি খোঁপার নাম ‘কূরীর’ ও ‘কুম্ব’, যা সেই প্রাচীন বৈদিক যুগের নারীরা অনুসরণ করতেন।
যুগের প্রয়োজনে খোঁপার বিবর্তনের ইতিহাসটাও অনেক বেশি প্রাণচাঞ্চল্যকর। সামাজিক রূপরেখার ধরনের সাথে বাংলার অনবদ্য ঐতিহ্য শাড়ির সাজে পরিবর্তন ঘটতে থাকলে, তার সাথে বিবর্তনের সুর মেলালো খোঁপার শৈলী, এমনকি চুল বাঁধার ধরনও। যুক্ত হলো হাতে রেশমি চুড়ি, কানে ঝুমকো দুল। তার কয়েক শতক পরে চুলের ক্লিপ, প্লাস্টিকের ফ্যাশনেবল কাঁটা। অন্যদিকে পোশাকে যুক্ত হতে থাকল নিত্যনতুন সাজ। বাংলায় এলো মধ্যযুগ, তারপর আধুনিক যুগ। এদিকে বিলেতি শাসন, অন্যদিকে বিলেতফেরত কর্তাদের ঘরে ঘরে নতুন সাজসামগ্রীর সমারোহ। এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতার ফ্যাশনগুলো মিশে নতুন এক রূপ ধারণ করতে থাকলো বাংলার পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায়।
‘খোঁপায় তারার ফুল’
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এইতো বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও গ্রামবাংলার নারীদের ‘পরিপাটি’ চুল আর ‘খোঁপ করা’ চুল এ দুইয়ের মধ্যে অর্থের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। তখন একেক খোঁপার সাজ ছিল একেক রকম। বড় বড় খোঁপা মানে ছিল নারীর শৈলী ও মননে রুচিশীলতার ছাপ। “যত বড় খোঁপা, তত বেশি ভাব”- এরকম একটি কথাও প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে অমৃতিপাক, লোটন, পান, টালি, খেজুরছড়ি, এলোকেশী, বিনোদবেণী, প্রজাপতি ইত্যাদি খোঁপার নামের সন্ধান পাওয়া যায়। বিখ্যাত ছিল ‘শান্তিপুর’ নামের একটি খোঁপার স্টাইল। অনেকে আবার ভারতের বাঘনাপাড়ার খোঁপা বাঁধার ধরন পছন্দ করতেন। “উলার মেয়ের কলকলানি/ শান্তিপুরের চোপা/ গুপ্তিপাড়ার হাতনাড়া আর/ বাঘনাপাড়ার খোঁপা”। গ্রামে-গঞ্জে এরকম অনেক মজার মজার কথা শুনতে পাওয়া যায়। এগুলো অনেকদিন ধরেই প্রচলিত ছিল বাংলায়। আবার খেয়াল করুন, ‘বিনোদবেণী’ একটি খোঁপার নাম, যে খোঁপায় মুগ্ধ হয়ে নজরুল গেয়েছিলেন –
“সই ভালো ক’রে বিনোদ–বেণী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী–ফাঁদে।”
যতীন্দ্রকুমার সেন তার ‘কামিনী-কুন্তল’ (১৩২৬ আশ্বিন, ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকা) রম্যরচনায় বিংশ শতাব্দীর ট্রেন্ডে উঠে আসা খোঁপার অনন্য বিবরণ দিয়েছেন। তার মতে, হিন্দুস্তানি মেয়েরা তখন বাঁধতো খোট্টা খোঁপা, তবলার বিঁড়ের মতো ছিল বিঁড়ে খোঁপা, বণিকবাড়ির মেয়েরা কেশসজ্জায় স্থান দিত বেনে খোঁপা, মাথার মাঝখানে বাঁধতে হতো ব্রহ্মচূড় ও বৈষ্ণবচূড়, সন্ন্যাসিনীর মতো ছিল ভৈরবী খোঁপা। সময় না থাকলে দ্রুত চুল বাঁধতে ‘গোঁজ খোঁপা’র প্রচলন ছিল; আর মাথার যেকোনো জায়গায় খোঁপার অবস্থান থাকলে তাকে বলা হতো ‘খেয়াল খোঁপা’। শুরু আর শেষ যে কোথায়, তা বোঝা যেত না ‘গোলকধাঁধা খোঁপা’য়; আবার সামান্য হাটাঁচলায় সহজে খসে পড়লে, তার নাম হলো ‘সোহাগী খোঁপা’। ছিল মৌচাকের মতো কুশন খোঁপা, দোল খেতে থাকা দোলন খোঁপা। এরকম আরো ছিল স্বামীভোলানো, চ্যাটাই, হেঁটোভাঙ্গা, আঁটাসাঁটা, ডায়মন কাঁটা ইত্যাদি।
যে খোঁপা ইতিহাসের কথা বলে
কিছু খোঁপার নাম খেয়াল করলে বাংলায় বিদেশীদের আগমনের কথা জানতে পারা যায়। যেমন- ফিরিঙ্গি খোঁপা, বিবি গোঁজ, টায়রা খোঁপা (যেখানে ঘড়ি লাগানো সম্ভব ছিল!), অ্যারোপ্লেন খোঁপা এরকম।কিছু খোঁপার অবশ্য নামটাই পরিবর্তন হয়েছে, এরকই একটি হল অ্যারোপ্লেন খোঁপা, এর পূর্বনাম ছিল প্রজাপতি খোঁপা। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে কামানের ব্যবহার অথবা ব্রিটিশদের কামানের ব্যবহারে তিতুমীর বাঁশের কেল্লার খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার গল্প আমরা সবাই জানি। এরকম কামানের আদলে বুনতে হতো ‘তোপ খোঁপা’।
খোঁপা নিয়ে তখন বসে ছিলেন না নব্য ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকা বাঙালি শিক্ষিতরাও। প্রাথমিক ইংরেজি জ্ঞান অর্জন করতে থাকা মেয়েদের পড়তে হতো ‘সেঞ্চুরি প্রাইমার’, বিজ্ঞান পড়ার সময় ‘বিজ্ঞান রিডার’ ছিল ম্যাট্রিকুলেশন, বিএ ফেল, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ ইত্যাদি নামের খোঁপা। আবার বিএ পাশ করার পরও একটা খোঁপা পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতো বঙ্গনারীরা, নামটা অনুমেয়, ‘বিএ পাশ খোঁপা’!
বেণীর আবর্তন, খোঁপার বিবর্তন
খোঁপা অবশ্য আজকাল আলাদাভাবে বিক্রি করতেও দেখা যায়। চুল নিয়ে আজও যতটুকু পরিচর্যার প্রচলন রয়েছে, তাতে প্রবীণ কেউ যদি বলেন খোঁপা বাঁধা নিয়ে আগেকার যুগে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত তখন, তাতে খুব বেশি অবাক হবার কিছু নেই। চুলের খোঁপা নিয়ে অবশ্য এখনো প্রতিযোগিতা চলে, তবে সেটা গ্রামে-গঞ্জে, নগণ্যপ্রায়। শুধু খোঁপা নিয়ে গল্প করলে কাজটা হয়তো ঠিক হবে না; কেননা সুন্দরী ললনার চুলের বেণীর বিনুনিও ছিল সৌন্দর্যপিয়াসী বাঙালি সমাজের অনেক পছন্দসই একটা ব্যাপার। নাহলে রবি গুহ মজুমদারের কথায় শচীন দেব বর্মণ গাইতেন না, “তোমার সাপের বেণী দুলে না/দুলে না হাওয়ার বাঁশি শুনে”; তারও অনেক আগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ভালোবেসে বলে গিয়েছিলেন-
“বিননিয়া বিনোদিণী বেণীর শোভায়।
সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়।।”
তবুও কেন জানি, ইতিহাস, সাহিত্য তথা গ্রন্থে বাঙালি চুলের বেণীর আলাদা তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। আজকাল চুলের বেণীর স্টাইলগুলোই খুব মানাচ্ছে নতুন নতুন ফ্যাশনগুলোর সাথে; কেননা হাল আমলের ডিজাইন করা পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে চুলের বেণীর সাজসজ্জাটাই এ যুগের ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে আজ আবার নতুন করে ‘ট্র্যাডিশনাল’ খোঁপা নিয়ে ভাবছেন বাংলার ফ্যাশনপ্রেমীরা। আবার, এই একবিংশ শতাব্দীতে, এইতো দিনকয়েক আগে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে খোঁপায় প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘গাঁ ঘেষে দাঁড়াবেন না’ লিখা খোঁপার কাঁটা।
এভাবে শতাব্দীকাল ধরে বাঙালি নারীর চুলের সাজ এবং তার সাথে ঐতিহ্যবাহী সাজসামগ্রী হয়ে থাকুক বঙ্গকন্যাদের সৌন্দর্য ও অস্তিত্বের অনন্য প্রতীক। আজ এটুকুই। ভালো থাকুন, বাংলাকে ভালোবাসুন।