সালটা ছিল ১৯৯৩। স্থান- ম্যাসরি এন্ড ভিটিটো ল ফার্ম। কোনো একটা রিয়েল এস্টেট মামলার কাজ চলছিল তখন। প্যাসিফিক গ্যাস অ্যান্ড ইলেকট্রনিক (পিজিএন্ডই)-এর কাগজপত্রসহ মামলার জরুরি নথি গুছাচ্ছিলেন ফার্মেরই এক কর্মচারি এরিন ব্রকোভিচ।
কাজ করতে করতে হঠাৎ এরিনের চোখ আটকে গেলো একটি কাগজে। কাগজটি মূলত ছিল রক্তের নমুনা সম্পর্কিত একটি দলিল, যেখানে লেখা ছিল- হিংক্লিবাসীর রক্তের শ্বেত-কণিকা কমে যাচ্ছে!
কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে, এরিন বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখার আবেদন নিয়ে গেলেন তার প্রতিষ্ঠানের মালিক, এডওয়ার্ড ম্যাসরির কাছে। ভাগ্যক্রমে মিলেও যায় অনুমতি। সরেজমিনে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ক্যালিফোর্নিয়ার সেই পরিত্যক্ত শহর হিংক্লিতে চলে যান তিনি।
দেখতে পেলেন, শহরটির সকলেই একটি অদ্ভুত চর্মরোগে আক্রান্ত। সেই রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, হিংক্লির পানিতে রয়েছে অতিমাত্রায় হেক্সাভেইলেন্ট ক্রোমিয়াম। ক্ষতিকর এই রাসায়নিকই বা সেখানকার পানিতে মিশলো কীভাবে?
১৯৫২ সালে হিংক্লিতে প্যাসিফিক গ্যাস অ্যান্ড ইলেকট্রনিক-এর কম্প্রেশন স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়াবাসীকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতো এই কোম্পানি। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে হিংক্লির বড় বড় ভবনগুলোতে যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন লেগে না যায়, সেই লক্ষ্যে ১৪ বছর যাবত কুলিং সিস্টেমও সরবরাহ করতো তারা। আর এই কুলিং সিস্টেমে ব্যবহার করা হতো হেক্সাভেইলেল্ট ক্রোমিয়াম।
কুলিং সিস্টেম থেকে কিছু বর্জ্য-তরল নিঃসৃত হতো, যেগুলো ফেলা হতো শহরের অদূরের জলাশয়ে। সেখান থেকে হেক্সাভেইলেন্ট ক্রোমিয়াম মিশে যেতো ভূগর্ভের পানির সাথে। এভাবে ধীরে ধীরে হিংক্লির একাংশ অতিরিক্ত হেক্সাভেইলেন্ট ক্রোমিয়ামযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যায় পাওয়া। তারপর একটা সময় এই দূষিত পানির ব্যাপকতা পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
কেউ পান করেছেন, কেউ-বা তাতে গোসল করেছেন- ফলে হিংক্লিবাসীর মধ্যেও দূষিত পানির প্রভাবে দেখা দিলো চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে হিংক্লির ছয় শতাধিক বাসিন্দা প্যাসিফিক গ্যাস ও ইলেকট্রনিক কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু প্রভাবের কারণে পিজিঅ্যান্ডই মামলাটা জিতে যায়।
এরিন যে কাগজটি হাতে পেয়েছিলেন, সেখানে লেখা ছিল, হেক্সাভেইলেন্ট ক্রোমিমিয়ামযুক্ত পানির ব্যাপারে কোম্পানিটি অবগত, তবুও তারা এই বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ করছেন না।
এরিন প্যাটের জীবনী
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এরিন প্যাট। উৎপাদন-শিল্প প্রকৌশলী বাবা ও সাংবাদিক মায়ের ৪ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। ১৯৬০ সালের ২২ জুন ক্যানসাসের লরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এই ছোট্ট মেয়েটি ছোট্ট একটা রোগ নিয়ে জন্মান। যার নাম ডিসলেক্সিয়া।
এই রোগে আক্রান্তদের লেখাপড়া করতে অসুবিধা হয়, শিখতে কিছুটা বেশি সময় নেয় তারা। যদিও ব্যক্তিভেদে ডিসলেক্সিয়ার ধরন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন, কারো ধ্বনিগত ডিসলেক্সিয়া থাকে, কারো থাকে দর্শনগত ডিসলেক্সিয়া, আবার কারো নামগত। আবার বয়সভেদেও একজন ডিসলেক্সিকের আচরণ একেক রকম হয়।
যাই হোক, ডিসলেক্সিয়ার কারণে এরিন লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো করতে পারতেন না। কিন্তু লেখাপড়া কখনো থামিয়েও রাখেননি তিনি। ১৯৭৮ সালে হাইস্কুল পাস করে তিনি ভর্তি হন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন লেখাপড়া করেননি। অল্প কিছুদিন পরেই তিনি বদলি হন টেক্সাস রাজ্যের ড্যালাস শহরের মিস ওয়েড’স ফ্যাশন মারচেস্টাইজিং কলেজ-এ।
১৯৮০ সালে এখান থেকেই অ্যাপ্লায়েড আর্টস বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। তারপর শুরু হয় এরিনের সংগ্রামী জীবন। চাকরির আশায় ক্যালিফোর্নিয়ার নিউ পোর্ট বিচে এক বন্ধুর কাছে যান তিনি। কেমার্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন ১ বছর।
১৯৮১ সালে চাকরি ছেড়ে নাম লেখান মিস প্যাসিফিক কোস্ট বিউটি পেজেন্টে। এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা তার জীবনে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রথম পুরস্কারের সাথে সাথে এ প্রতিযোগিতা এরিনকে উপহার দিয়েছে তার ভালোবাসা মানুষ, শন ব্রাউনকে। ১৯৮২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শন ও এরিন।
বিয়ের পরের কয়েক বছর বেশ ভালোই কাটে তাদের। পুরো দেশ চষে বেড়ান তারা। তাদের এই যাযাবর জীবনে আসে দুই সন্তান ম্যাথিউ এবং কেটি। দুর্ভাগ্যবশত, দুই সন্তান নিয়ে শন ও এরিনের এই ছোট্ট সংসারের মেয়াদ ছিল ৫ বছর। ১৯৮৭ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।
নিজের থেকে সন্তানদের আলাদা হতে দেননি এরিন। সংসার চালানোর জন্য এরিন নেভ্যাডার রিনো শহরের এক ব্রোকারেজ ফার্মে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তার পরিচয় হয় স্টিভ ব্রকোভিচের সাথে। ১৯৮৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। তখন থেকেই এরিন প্যাট হন ‘এরিন ব্রকোভিচ’। এক বছর অন্তরে এরিন গর্ভে ধরেন তার তৃতীয় সন্তান, এলিজাবেথকে। মেয়েটা গর্ভে আসার কয়েকদিন পরে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে স্টিভ ও এরিনের।
এই বিচ্ছেদই এরিন ব্রকোভিচের জীবনে দুঃসময়ের খামে-মোড়া সুসময় এনে দেয়। বিচ্ছেদের পরে সন্তানদের নিয়ে রিড থেকে চলে আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসের স্যান ফারন্যান্ডো ভ্যালিতে। কয়েকদিন বাদে একটি গুরুতর কার দুর্ঘটনার শিকার হন এরিন। ফলে ঘাড়ের একটি অপারেশন করতে হয় তার।
এই দুর্ঘটনা নিয়ে এরিনের মতামত, “তিনি সাবধানতার সাথেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন এমন সময় একটি গাড়ি এসে তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়”। তাই সেই গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। পক্ষে মামলা লড়ার জন্য এরিন যোগাযোগ করেন ম্যাসরি এন্ড ভিটিটো ল ফার্মে। অনেক টাকা ব্যয় হয় এরিনের, কিন্তু মামলা জিততে পারেন না তিনি।
মামলার পিছে টাকাকড়ি উজাড়ের পর এরিন যখন চাকরির জন্য এখানে-ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, তখন এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দেন ম্যাসরি এন্ড ভিটিটো ল ফার্মে চাকরির জন্য যোগাযোগ করতে। সেখান থেকেই আবেদন, তারপর চাকরি। এই ফার্মে তিনি যা আয় করতেন, তাতে তার সংসার কোনোমতে চলছিল।
এরিনের সংসারের টানাপোড়েন দেখে তার মালিক ম্যাসরি সহানুভূতিশীল হয়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। ১৯৯২ সালে এরিন ম্যাসরি অ্যান্ড ভেটিটো ল ফার্মের কেরাণী পদে নিযুক্ত করেন। অবশেষে তার জীবনে সুখ ও স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।
আইনে লেখাপড়া না করেই এরিন যেভাবে ভোক্তা আইনজীবী হলেন
হিংক্লিবাসীর করা সে মামলায় প্রথমবারে পিজিঅ্যান্ডই প্রভাব খাটিয়ে জিতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু এরিন তার অনুসন্ধানী মন নিয়ে নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন। পেয়ে গেলেন মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সেই সঙ্গে মামলাটি পুনরায় শুরুর আবেদনও করে বসলেন আদালতে।
ওদিকে নামীদামী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে একজন কেরাণীর ‘অতি-উৎসাহ’ দেখানোটা স্বাভাবিকভাবে নিলো না ল ফার্মটির মালিকপক্ষ। খানিকটা ভীত হয়েই তারা এরিনকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়।
কিন্তু ঈশ্বর ছিলেন তার সহায়। এরিনকে ছাঁটাই করবার কিছুদিন পর মালিক ম্যাসরি নিজে থেকেই তাকে জানান, “পিজিঅ্যান্ডই-এর কেসটা পুনরায় শুরু হতে যাচ্ছে এবং ম্যাসরি এন্ড ভিটিটো ল ফার্মকে সেটা দেওয়া হচ্ছে।”
যেহেতু এরিনের বদৌলতেই এত বড় মামলা লড়বার সুযোগ পেয়েছে ম্যাসরি অ্যান্ড ভিটিটো ল ফার্ম, সেহেতু মোটা অঙ্কের বেতন দিয়েই ম্যাসরি ফিরিয়ে আনলেন আবারও এরিনকে। যথারীতি ভিটিটোর হয়ে এরিনই লড়লেন মামলা। সহযোগী আইনজীবী হিসেবে ছিলেন ম্যাসরি। এরিনের শ্রম আর একাগ্রতা বৃথা গেলো না।
১৯৯৬ সালে ৩৩৩ মিলিয়ন ডলার জরিমানা নিয়ে প্যাসিফিক গ্যাস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকের বিরুদ্ধে জিতে যায় ম্যাসরি এন্ড ভিটিটো ল ফার্ম। পিজিঅ্যান্ডই কোম্পানির এই হারই বদলে দেয় এরিনের জীবন। আমেরিকাতে এত মোটা অঙ্কের জরিমানা এর আগে কখনো কাউকে গুনতে হয়নি।
এই অভাবনীয় সাফল্যেই ঘুরে যায় এরিনের গল্পের মোড়। পরবর্তীকালে তাকে ভোক্তা আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৯৯ সালে আরেকবার বিয়ে করেন এরিন। তার তৃতীয় স্বামীর নাম এরিক এলেস। প্রায় এক যুগ একসাথে ঘর করার পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বর্তমানে এরিন ৪ সন্তানের জননী।
২০০০ সালে তার জীবনী নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি করেন ড্যানি ডেভিটো, নাম Erin Brockovich. দর্শকের মাঝে অতুলনীয় সাড়া ফেলা ব্যবসাসফল এই ছবির আয় ২৫০ মিলিয়ন ডলার।
এই ছবির মাধ্যমে বিশ্ব আরও ভালোভাবে জানতে পারে এরিনের গল্প। বাস্তবতার সাথে যথাসম্ভব মিল রেখে ছবিটি বানানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক ড্যানি। এরিন ব্রকোভিচের চরিত্রে অভিনয় করা জুলিয়া রবার্টস সেবছর সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। এছাড়াও এই সিনেমা ঝুলিতে ভরেছে বেশ কিছু পুরস্কার।
২০০১ সালে এরিন ব্রকোভিচ তার জীবনীগ্রন্থ লেখেন, যার নাম- Take It from Me: Life’s a Struggle But You Can Win. বইটি নিউইয়র্কের বেস্ট সেলার বইগুলোর একটি। এছাড়াও এরিনকে নিয়ে বেশ কিছু ডক্যুমেন্টারি ফিল্মও বানানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি একজন ভোক্তা আইনজীবী, সমাজকর্মী এবং একজন আন্তর্জাতিক বক্তা হিসেবে কর্মরত।