সূর্যের চেয়ে বালি গরম। প্রবাদ আছে না একটা? আমাদের আজকের গল্পগুলোও অনেকটা সেরকম।
আমাদের চট্টগ্রামে আঞ্চলিক প্রবাদ প্রচলিত আছে একটা, ডেকচির চেয়ে ছেনি গরম। মানে ডেকচি থেকে তার ঢাকনাটা গরম বেশি। উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দু থেকে উত্তাপের কেন্দ্র থেকে দূরের বিন্দুটাই যেন তাপে-উত্তাপে হয়ে ওঠে বেশি উত্তপ্ত।
ফাইনালের চেয়ে সেমিফাইনালের উত্তাপ বেশি। ইতিহাস বলে, ফাইনালটাই চূড়ান্ত হলেও ফাইনালের আগে সেমিফাইনালের রোমাঞ্চ-উত্তেজনা ছাপিয়ে যায় সবকিছুকেই। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের হাতেগোনা ক’টি ম্যাচ বাছাই করতে গেলেই ঠেলাঠেলি করে ভিড় জমাবে বেশ কয়েকটি সেমিফাইনাল। যেগুলোর কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখবেন, পড়ে যাবেন মহাসমস্যায়!
অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার টাই ম্যাচটাই যেমন! আবার নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মহাকাব্যিক ইডেন পার্কও নিয়েছিল নিশ্চয় আপনার স্নায়ুতন্ত্রের ভীষণ পরীক্ষা! দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড ম্যাচটাকেই বা কী বলবেন আপনি? হাস্যকর? দুঃখজনক? হৃদয়বিদারক? নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যে শব্দটা সবচেয়ে ভালো যায়, দুর্ভাগ্য? সেই বিশ্বকাপেরই আরেক সেমিফাইনাল পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা দেখে অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল চোখ দুটো? তাহলে ইডেন গার্ডেনের ভারত-শ্রীলংকার ম্যাচটা দেখে কেমন লেগেছিল? গ্যালারির আগুন, ম্যাচ শেষ হতে না পারা, নন্দন কাননটার অমন কুৎসিত রূপ?
সেবারেরই অন্য সেমি’র কথাও অবশ্যই অজানা নয় আপনার। অস্ট্রেলিয়া-উইন্ডিজ যেখানে দেখিয়েছিল অনিশ্চয়তার অদ্ভুতুড়ে মঞ্চায়ন। জানেন নিশ্চয়ই, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম সেমিফাইনালটার কথা? লো স্কোরিং ম্যাচে এক অস্ট্রেলিয়ানের একক বীরত্ব? ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচে সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে ভারতের সেমিফাইনাল বিজয়, সেও অজানা নয় নিশ্চয়ই!
এক নিঃশ্বাসে কত ম্যাচ চলে আসে আলাপের প্রারম্ভে। ফাইনাল নিয়ে তেমনটা কি হয়? ১১টা ফাইনাল থেকে কয়টা ম্যাচ আপনি রাখবেন স্মরণীয় ম্যাচের তালিকায়?
যাকগে সে আলোচনা। আমরা বরং আজ সূর্যের বদলে ‘বালি’ নিয়েই থাকি। বালির উত্তাপের গল্পেই রোমাঞ্চিত হই। সূর্য, সে তো স্বমহিমায় ভাস্বর। তাকে নিয়ে আলোচনার আর কী! ফাইনাল তো ফাইনালই, সেমিফাইনাল হলো ফাইনালের আগের পর্যায়, ফাইনালে যাওয়ার চূড়ান্ত ধাপ। সেই ধাপের ধুন্ধুমার কয়েকটি লড়াইয়ের গল্পেই সাজানো হোক আমাদের আজকের আলেখ্য।
নন্দন উদ্যানে আবেগ-আক্ষেপ আর রোমাঞ্চ মিলেমিশে একাকার
এবি ডি ভিলিয়ার্সের দিকে তাকানোর উপায় নেই। ভদ্রলোক কী করেননি? ব্যাটিংয়ে ঝড় তুল দলকে দিয়েছেন পর্যাপ্ত সংগ্রহ, মরিয়া হয়ে ফিল্ডিং করেছেন, বোলিংয়ে এসেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বস্ব উজার করা নেতার মতো। তারপরও স্বদেশকে সেমিফাইনালের পরের পর্যায়ে নিতে পারেননি। ওহ, স্টেইন! হতাশায় মুষড়ে পড়ে শুয়ে পড়েন পিচেই। তাকে টেনে তুলেন আরেক ‘দক্ষিণ আফ্রিকান’ গ্র্যান্ট ইলিয়ট, যার ব্যাটে সেদিনকার অকল্যান্ডে উন্মাতাল হর্ষধ্বনি। পুরো নিউ জিল্যান্ডে অদ্ভুত শিহরণ জাগানিয়া আনন্দ। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের দিকে তাকাবেন, সে উপায় নেই। হর্ষ-বিষাদ মিলেমিশে একাকার। নিউ জিল্যান্ডের আনন্দে উদ্বেলিত হবেন, তো হৃদয়টা কেঁপে উঠবে হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকানদের টলটল চোখ দেখে। এমন কঠিনতর যুগলানুভূতির মধ্য দিয়েও মানুষের যেতে হয়?
এ তো গেল কেবল অনুভূতি। ম্যাচটারই কত রঙ, ক্ষণে ক্ষণে কত বদল। একবার এদিক হেলে, তো আবার ওদিকে। বোল্টের শুরুর ঝড়ে দিশেহারা দক্ষিণ আফ্রিকার দিশা মেলে ডু প্লেসি আর রাইলি রশোর ব্যাটে, পরে ডি ভিলিয়ার্স আর মিলারের বেধড়ক পিটুনিতে তো নিউ জিল্যান্ডই হয়ে পড়ে দিশাহীন। ৪৩ ওভারে ২৮১ রানের টোটালটা ডি/এল মেথডে গিয়ে নিউ জিল্যান্ডের জন্য হয়ে দাঁড়ায় ২৯৯, ঐ ৪৩ ওভারেই। সেখানে ম্যাককালামের খুনে ব্যাটে ঝরে স্টেইন-ফিলান্ডারদের রক্ত।
সেবারের চির পরিচিত দৃশ্য। তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ-প্রিয় ম্যাককালাম বলের ছাল নয় শুধু, বুঝি উঠিয়ে নেবেন বোলারদের পিঠের ছালও। ম্যাককালামের বিদায়ের পর ঝড়ের পর শান্ত প্রকৃতির মতো নেতিয়ে পড়ে নিউ জিল্যান্ড ব্যাটিং। উইলিয়ামসন-গাপটিল-টেইলর ফেরেন ধীরে ধীরে। তারপর আবার অ্যান্ডারসন আর এলিয়টের ব্যাটে পথ খুঁজে পায় স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাচ মিস, রান আউট মিস, হতাশা-আক্ষেপ, আবেগ-উত্তেজনা, রোমাঞ্চ-শিহরণ… অকল্যান্ডের নন্দন উদ্যানের কান ফাটানো গর্জন। মাত্র এক বল বাকি থাকতে ইলিয়টের ওই ছয়… আহ! সে এক দৃশ্য বটে! সে এক ম্যাচ বটে!
নাতি-নাতনির কাছে বুড়ো বয়সে গল্প করার দারুণ রসদ ইডেন পার্কের নওজোয়ান দর্শকদের। এলিয়টের হাত বাড়িয়ে দেওয়া নেতিয়ে পড়া স্টেইনের দিকে, শুয়ে পড়া স্টেইনের সেই হাত ধরে উঠে বসা… ক্রিকেটের তো বটেই, খেলার জগতে সহানুভূতির সর্বোত্তম দৃশ্যের একটি হয়ে গেছে!
দ্য গ্রেটেস্ট ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ম্যাচ বললে কেউ প্রতিবাদ করবে না, অত্যুক্তি হবে না মোটেও। ‘বাগাড়ম্বর’ বলে তেড়ে আসবে না কেউ। বরং নিশ্চুপ সমর্থনে জানাবে সায়, হয়তো অবাক নির্বাকতায় মেতে উঠবে স্মৃতিচারণায়, ফিরে যাবে ক্ষণিকের জন্য সেদিনের এজবাস্টনে।
ডোনাল্ডের চোখে-মুখে অবিশ্বাস। নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। দৌঁড়টা দিয়েছিলেন কেন? ক্লুজনার, অনেকটা পথ সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে আসা ক্লান্ত এক যোদ্ধা যেন! দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা কী করবেন, কেন করবেন, কাঁদবেন, নাকি করবেন আক্ষেপ, হতাশ হবেন, নাকি জানাবেন রাগ; বুঝতেই পারছেন না, সময় এখন কী করার! অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়ান শিবিরে কেবলই আনন্দ। বাঁধনহারা, লাগামছাড়া। প্রায় ফসকে যাওয়া ম্যাচটা তারা হারতে হারতে হারেননি। ঐদিকে প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচটা দক্ষিণ আফ্রিকা জিততে জিততেও জেতেনি। কী অদ্ভুত, কী অবিশ্বাস্য! কী রুদ্ধশ্বাস পরিসমাপ্তি!
গৌরবময় অনিশ্চয়তার সুন্দরতম মঞ্চায়ন।
৬৮ রানে ৪ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া স্টিভ ওয়াহ আর মাইকেল বেভানের ব্যাটে কক্ষপথে ফিরলেও পোলকের আঘাতে ভারসাম্য রাখতে পারে না পথচলায়। ডোনাল্ডও আছেন আবার, বেভান-স্টিভের দারুণ লড়াই সত্ত্বেও পোলক-ডোনাল্ডে অস্ট্রেলিয়া থেমে যায় ২১৩ রানে। জবাবে ওয়ার্নের ক্ষণিকের ম্যাজিক, গিবসকে করা স্বপ্নের ডেলিভারি, ৪৮-০ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ৬১-৪। সেখান থেকে ক্যালিস-রোডসের প্রতিরোধ। শেষদিকে ক্লুজনারের ‘ওয়ান ম্যান শো’, একা হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের তরী প্রায় ভিড়িয়েই ফেলেছিলেন। কিন্তু ক্লুজনারের আচমকা দৌঁড়, ডোনাল্ডের দিগ্বিদিকশূণ্য দৌঁড়, আর ঠান্ডা মাথায় মার্ক ওয়াহ-ফ্লেমিং-গিলক্রিস্টত্রয়ীর যৌথ প্রচেষ্টায় স্ট্যাম্প ভেঙে দেয়া… তারপর হলদে রঙের ওড়াউড়ি কেবল, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গী একরাশ দীর্ঘশ্বাস!
কলকাতার নন্দনে জ্বলছে শোকের আগুন, অন্যদিকে নিভছে ক্যারিবিয়ান গৌরবের সোনালী প্রদীপ
রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-ক্রোধ-বিরক্তি অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলে আনে বিপত্তি। যেমনটা এনেছিল নন্দন কাননে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আয়োজনে। হতাশায় ক্রোধে উন্মত্ত দর্শক-জনতা জ্বালাল আগুন, বোতলবৃষ্টিতে বিশ্রী অবস্থার অবতারণা করল কলকাতার সুবিখ্যাত ক্রিকেট ফুলেল উদ্যানে। খেলা আর শেষ হওয়ারই উপায় রইলো না। দুই দলের ক্রিকেটাররা মাঠ ছাড়লেন পুলিশবন্দী হয়ে, ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েডের সিদ্ধান্ত অনুসারে ম্যাচ গেল শ্রীলংকার পক্ষে। ভারতের জন্য পড়ে রইল পরাজয়, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট আর লাঞ্চনা-অপমান।
স্বপ্নরথের মহাসারথী শচীনের বিদায়ের পর ৯৮-১ থেকে জাদুকরের কোনো জাদুমন্ত্রের মতো ধুম করে ১২০-৮ হয়ে যাওয়া, আর নিতে পারেনি কলকাতার প্রায় লাখ ছুঁইছুঁই দর্শক। তাই তো অমন ক্ষেপে যাওয়া। ক্ষোভানল উগরে দিতে বোতলে বোতলে সয়লাব করে তোলা মাঠের সবুজ প্রান্তর। আগুন জ্বালিয়ে যেন শোধবোধ করতে চাওয়া রাগের আগুন। তারও আগে অরবিন্দ ডি সিলভার ৪৭ বলে ৬৬ রানের স্ট্রোকঝলমলে ইনিংসে শ্রীলংকার জোটে আড়াইশ’র ভিত। সেখানটায় দাঁড়িয়ে বোলারদের অমন চেপে বসা।
ভারতের মিডল অর্ডার আর সামলে উঠতে পারেনি। আবেগ সামাল দিতে পারেনি ফাইনালের বিজয় উল্লাস করতে আসা দর্শকও, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি নিজেদের। তাই শেষটা ছিল বড্ড অযাচিত, অনভিপ্রেত। আর বিনোদ কাম্বলির কান্নাটা… হয়তো সুযোগ পেলে একটা মিরাকল ঘটানোর চেষ্টা চালাতেন!
অতি আবেগী দর্শককুল সে সময় দিলে তো!
সেই বিশ্বকাপেরই আরেক সেমিফাইনালে আরেক নাটকের মঞ্চায়ন। অস্ট্রেলিয়া-উইন্ডিজ সেমিফাইনাল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালী অতীত মিলিয়ে গেছে, রেখে গেছে কিছু অবশেষ। সেই অবশেষ থেকেই ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে রিচি রিচার্ডসনের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অস্তপ্রায় সুমধুর অতীত-সূর্যটা শেষবারের মতো যেন উজ্জ্বল লালিমা ছড়াতে ব্যস্ত। অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ২০৭ রানের জবাবে স্কোরবোর্ডে উঠে গেছে ১৬৫, উইকেট আছে আরো আটটি। চতুর্থবারের মতো ফাইনালে ওঠাও সময়ের ব্যাপার। তারপর কী হলো সেখানে?
তার আগে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসটা দেখা যাক একটু। বিশপ-অ্যামব্রোসে টালমাটাল হয়ে ১৫ রানে নেই অস্ট্রেলিয়ার চার উইকেট। ওয়াহ’রা দুই ভাই, পন্টিং, টেইলর ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। সেখান থেকে টানলেন স্টুয়ার্ট ল’ আর মাইকেল বেভান। এই দু’জনে ভর দিয়ে অস্ট্রেলিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে পার করে দুইশ। সেই রানই স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করতে করতেই হঠাৎ হোঁচট উইন্ডিজের। ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রার যুগল আক্রমণে খেই হারায় ক্যারিবিয়ান মিডল-অর্ডার। একপ্রান্তে অধিনায়ক রিচি ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়া দেখলেন শুধু। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৫ কদম দূরে থাকতে শেষ উইন্ডিজ ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় ফাইনালে পদার্পণের সঙ্গে শেষ ক্যারিবিয়ান প্রদীপের দপ করে জ্বলে উঠার স্থায়িত্বও।
একপ্রান্তে দুর্ভাগ্য কিংবা পরিহাস, অন্যপ্রান্তে একজন ছোকরার ইতিহাস
রসিকতা করারও তো সীমা-পরিসীমা থাকে একটা, সম্পর্কটা যেমনই হোক। আবার রসিকতার মতো কিছু একটা যদি সিরিয়াস মুখ করে বলা হয়, উহু! এটা মোটেও রসিকতা নয়। বাস্তবতা! কেমন লাগে তখন?
যেমনই লাগুক, তা তো আর করা হয়ে ওঠে না, সেটা উচিৎও নয়। শেষ পর্যন্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী আর? দক্ষিণ আফ্রিকার সেদিনকার প্রতিটি ক্রিকেটার তীব্র অবিশ্বাস আর জলভরা চোখে মেনে নিয়েছিলেন এক নির্মম রসিকতা। ১৩ বলে ২২ লক্ষ্যটা বৃষ্টি-বাঁধা শেষে হয়ে দাঁড়ায় ১ বলে ২২! কেন? সময় বাড়ানোর উপায় নেই ব্রডকাস্টিং চুক্তি অনুসারে। অতএব, সময়ের সাথে বলও কমে গেল ১২টা। কিন্তু রান তেমনই রইলো, ২২! কী নিষ্ঠুর পরিহাস, কী নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজাল, আইনের কাঠিন্য!
অথচ ২২ বছরের নির্বাসনশেষে ক্রিকেটে ফিরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে ঘটেছিল মুক্তি। কে জানতো, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা আফ্রিকার দক্ষিণবাসীদের অভিশাপটা তাড়িয়ে নেবে তখনও? দুর্দান্ত ফিল্ডিং, নিপুণ শৃঙ্খলা, ব্যাটিং-বোলিংয়ে দারুণ ভারসাম্য সেবারের দক্ষিণ আফ্রিকা দলটাকে ধর্তব্যে না আনলেও টুর্নামেন্টে চমৎকার প্রদর্শনী ছিল তাদের। ভাগ্যের অমন নির্মমতা না হলে ফাইনালে যাওয়াটাও অসম্ভব ছিল না, তাহলে ইমরান খানের বদলে সোনারাঙা ট্রফিটায় চুমুর মালিক কেপলার ওয়েসেলসও হতে পারতেন হয়তো! নিয়তি, দুর্ভাগ্য!
গ্রায়েম হিকের ব্যাটে ভর দিয়ে ইংল্যান্ডের আড়াইশ’র জবাবটা ভালোই দিচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। হাডসন-কুইপার-ক্রনিয়ে-রোডস সমবেত শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ম্যাচে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাকমিলান আর রিচার্ডসনের জুটিটাও মন্দ এগোচ্ছিল না। কিন্তু বৃষ্টি সবটাতে আক্ষরিক অর্থেই ঢেলে দিয়েছিল জল। সেই যে ফাইনালে ওঠা হলো না, তারপর আরো গুণে গুণে সাত-সাতটি বিশ্বকাপ চলে গেলেও আর ফাইনালে উঠা হয়নি। এরপর তিনবার সেমিও খেলা হয়ে গেছে, কিন্তু ঐ চূড়ান্ত লড়াইয়ের ময়দানে আর যাওয়া হয়নি!
দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যের এমন করুণ সর্বনাশা সময়ে পাকিস্তানকে বুঝি পেয়েছিল পৌষ মাস। সৌভাগ্যের চাদর গায়ে আলতো ছায়া ফেললে, তা পুরোদমে ব্যবহারের সে কী মুন্সিয়ানা! সবচেয়ে দারুণ উপস্থাপনা ছিল হয়তো নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে, সেমিফাইনালে। মার্টিন ক্রো’র দুরন্ত ৯১, অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে তোলে নির্ভার-নিশ্চিন্তের আনন্দ ঢেউ। নিউজিল্যান্ডের ২৬২ স্কোরটা অনেকটা নিরাপদই মনে হয়। কিন্তু অনিশ্চয়তার বাকি তখনো অনেকটা। সৌন্দর্য্যের ডানা মেলার বাকি পুরোটা।
সেলিম মালিকের বিদায়ে মধ্যমাঠে আগমণ হয় ঝাঁকড়া চুলের গাট্টাগোট্টা একজন নক্ষত্রের। তখনও তিনি ক্রিকেটাকাশে উদিত হয়েছেন মাত্র; থাকবেন না খসে পড়বেন, সে বলার সময় হয়নি। ১৫ ওভারে ১২৩ রান দরকার তখনও। সেই দুর্গম-দুরূহ পথটা পাড়ি দিতে সুগম রাস্তার খোঁজে তিনি চালালেন ৩৭ বলে ৬০ রানের এক ঝড়, যা ইডেন পার্ককে নিস্তব্ধ করে দেয়! ঝড়টার পুরোভাগে ছিলেন একজন ইনজামাম-উল হক।
রঙ-বেরঙের গল্প শেষে এবার ইতি টানার পালা
হ্যাঁ, কী বলছেন? এত তাড়াতাড়ি ইতি কেন? গিলমোরের গল্পটা শুনতে চান? একক বীরত্বের গল্পটা? সে হবে আরেকদিন। আমরা তো এখানে সেমির আবেগ-আক্ষেপ আর দুঃখ-বিরহের বিচিত্র আর বিস্ময় গল্পের আসর বসিয়েছিলাম, একক কৃতিত্বের কোনো স্তুতিগাঁথা নয়।
অদ্ভুত আনন্দ কিংবা ভীষণ বিস্বাদ, মন খারাপের গল্প অথবা হৃদয়ে রেখে যাওয়া অতলস্পর্শী অনুভূতি; বিশ্বকাপের সেমি’র রঙের যেন শেষ নেই! এখানে আবেগের বেগ খুব দ্রুত খেলে, আক্ষেপের গল্পরা আসর জমায়, দুর্ভাগ্য দলবেঁধে দাঁড়ায় কাতারে, রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা তো চলে হাত ধরাধরি করে। কখনো কুৎসিত রঙটাও চোখে পড়ে, দেখা হয় কদাকার রূপটাও। আবার কখনও আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য মিলেমিশে হয় একাকার।
আমরা তেমনই মহাকাব্যের খোঁজে থাকি, তেমনই মহাকাব্যের আশায় থাকি। আমাদের আনন্দ-বেদনার যুগলানুভূতির পরীক্ষা হোক আবার। প্রিয় পাঠক, সেই পরীক্ষায় আপনাকে স্বাগতম!