গল্পটা যুক্তরাষ্ট্রের এক অভিনয় স্কুল থেকে শুরু করে যাক। কর্মজীবী শ্রেণীর মানুষ যারা শখের বশে অভিনয় শিখতে চান, তাদের জন্য এরকম দু’চারটা স্কুল নিউ ইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখানে একদম তরুণ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেকেও অভিনয় শেখেন। ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী অভিনয় গুরু ছাত্রদের অভিনয়ের তালিম দেন। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে হাস্যরসাত্মক বিভিন্ন অনুশীলনও করা হয়ে থাকে। তেমন একটি রসাত্মক অনুশীলনের ক্লাসে প্রশিক্ষক সবাইকে জড়ো করে ঘোষণা করলেন, সবাইকে এক মিনিট শিকারি কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে হবে। তার কথামতো ছাত্ররা মুহূর্তের মধ্যে ঘেউ ঘেউ করে ক্লাসের চার দেয়াল প্রকম্পিত করে ফেললো। এক মিনিট পর ঘেউ ঘেউ পর্ব শেষে সবাই হাসির রোলে ক্লাস মাতিয়ে তুললো। প্রশিক্ষক এবার হাসি থামিয়ে সবাইকে বললেন, “ধরো তোমরা একেকজন হচ্ছো ডিম পাড়া মুরগি। নিশ্চিন্ত মনে দানা খেয়ে দিন কাটাচ্ছো। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠলো। এবার মুরগির প্রতিক্রিয়া অভিনয় করে দেখাও।”
প্রশিক্ষকের কথামতো একজন বাদে ক্লাসের সবাই একদম আসল মুরগির মতো ডানা ঝাপ্টে ‘কুক্কুরু’ ধ্বনিতে লাফাতে থাকলো। তাদের অভিনয় দেখে খোদ মুরগি লজ্জা পেয়ে যাবে এমন অবস্থা। প্রশিক্ষক কিন্তু এই ত্রস্ত মুরগিদের দিকে নজর দিচ্ছেন না। তার কৌতূহলী দৃষ্টি গিয়ে পতিত হলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা তরুণের দিকে। তিনি প্রশ্ন করলেন তরুণকে সে কেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে? তরুণ অবাক হয়ে খানিকটা সময় প্রশিক্ষকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হাসতে হাসতে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আমি কেন সাইরেনের শব্দে লাফাবো? আমিতো মুরগি। মুরগি সাইরেনের ব্যাপারে কী-ই বা এমন জানে?” তার কথায় পুরো ক্লাস হাসির শব্দে ফেটে পড়লো। পাঠক আপনারাই বলুন, তার কথায় কি কোনো ভুল আছে? একদম না। সেই নীরব দাঁড়িয়ে থাকা সেদিনের মুরগি অভিনেতা কালের বিবর্তে হয়ে উঠলেন অভিনয় জগতের প্রবাদপুরুষ। আর এই প্রবাদপুরুষের নাম মার্লোন ব্র্যান্ডো।
জন্ম এবং বাল্যকাল
মার্লোন ব্র্যান্ডো মানেই বিশেষ কিছু। সিনেমাপ্রেমীদের সামনে এই নাম নিলেই চোখের সামনে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে কালজয়ী ডন ভিটো কর্লিওনির তেজোদ্দীপ্ত প্রতিচ্ছবি। সিনেমাজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া সেই চরিত্র শুধু অভিনয়শিল্পকেই বদলে দেয়নি, নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছিল ‘নিখুঁত’ শব্দটিকে। বিখ্যাত অভিনেতা মার্টিন শিনের মতে,
“ব্র্যান্ডো এককথায় সিনেমার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আমার মনে হয় এতটুকু বললে কম হয়ে যাবে। তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রজন্মের কাছে মোজার্ট বা বেটোফেনের মতো।”
জীবনীকার প্যাট্রিসিয়া বসওয়ার্থের মতে, “মার্লোন ছিলেন একজন সাক্ষাৎ দানব; কিন্তু একজন বন্দনীয় দানব।” সিনেমার রূপালি পর্দায় আমরা মার্লোন ব্র্যান্ডোর বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছি। স্ট্যানলি কোয়ালস্কি, ট্যারি ম্যালয়, ভিটো কর্লিওনি, কর্নেল ওয়াল্টার কার্টজ প্রভৃতির চরিত্রের মাঝে ফুটে উঠেছে হলিউডের একচ্ছত্র প্রবাদ পুরুষের বর্ণাঢ্য গল্পসমগ্র। কিন্তু ক্যামেরার লেন্সটুকু সরিয়ে ফেললে আমাদের সামনে উপস্থিত হবেন এক ভিন্ন ব্র্যান্ডো। এই ব্র্যান্ডোর শৈশব ছিল দুঃসহ, যার প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে আছে সমালোচনা ও বিতর্ক। এই ব্র্যান্ডোকে পত্রিকার পাতায় পাওয়া যেত মদ্যপ, বিশৃঙ্খল এবং ‘ব্যাড বয়’ হিসেবে। কিন্তু এসবের স্পর্শ তার কীর্তিকে মুহূর্তের জন্যেও মলিন করে দিতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার ওমাহায় ১৯২৪ সালের ৩ এপ্রিল জন্ম হয় মার্লোন ব্র্যান্ডোর। পিতার নামও মার্লোন ব্র্যান্ডো হওয়ায় তাকে মার্লোন ব্র্যান্ডো জুনিয়র হিসেবে ডাকা হতো। তার পিতা ছিলেন দোকানি এবং মা স্থানীয় মঞ্চে শখের বশে অভিনয় করতেন মাঝে মাঝে। ব্র্যান্ডো পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল ছিল না। তার উপর তার পিতামাতা দুজনেই ছিলেন মদ্যপ। তাদের ঝগড়াটে ব্যবহার শিশু মার্লোনের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। তিনি নিজেও তাদের সাথে ঝগড়া করা শুরু করেন। প্রায়ই বাবার হাতে পিটুনির শিকার হতেন তিনি। পারিবারিক বৈরিতায় প্রভাবিত মার্লোন স্কুলে গিয়েও সহপাঠীদের সাথে হাতাহাতি, সংঘর্ষে লিপ্ত হতেন। স্কুল থেকে নালিশ পাঠানো হতো বাসায় যে, মার্লোন স্কুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বা একে-ওকে মেরেছে। তাকে নিয়ে গুরুজনরা ভালো কিছু আশা করতেন না। একদম বখে যাওয়া ছেলে হিসেবে অগ্রাহ্য করা হতো তাকে। তার সবচেয়ে বড় শত্রু এই পরিবারের একজন অবশ্য তাকে বেশ আদর করতেন। তিনি ছিলেন তার বড় বোন। তার কাছে মার্লোন একটুকু স্নেহের জন্য আশ্রয় নিতো।
দেখতে দেখতে ১৭ বছর বয়সে পা দিলেন তিনি। তখন তাকে শাসন করার জন্য শাটক মিলিটারি একাডেমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। সেখানেও পুরোনো মার্লোন সবার সাথে মারামারি করে দিন কাটাতো। একাডেমির আইন অনুযায়ী তাকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়। এরই মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারার ব্যর্থতা তাকে বাকিটা জীবন কষ্ট দিয়েছিল। একাডেমির পাঠদানে তিনি অমনোযোগী থাকলেও একটি ক্লাসে তাকে বেশ নিয়মিত দেখা যেত। সেটি ছিল থিয়েটার ক্লাস। পারিবারিক ক্রোধের সবটুকু তিনি অভিনয়শিল্পে প্রয়োগ করতেন। তাই একাডেমি থেকে বের হয়ে তিনি ক’দিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিউ ইয়র্ক চলে যান অভিনয় শিখতে। সেখানে ইতোমধ্যে অবস্থান করছিলেন তার প্রিয় বড় বোন।
অভিনয় শিক্ষার হাতেখড়ি
নিউ ইয়র্কে মার্লোন ব্র্যান্ডো ভর্তি হলেন স্টেলা এডলারের অভিনয় স্টুডিওতে। স্কুল এবং একাডেমি জীবনের ভাঙা ভাঙা অভিনয় প্রতিভাকে দক্ষ প্রশিক্ষকের সান্নিধ্যে জোড়া লাগাতে থাকেন তিনি। তৎকালীন অভিনয় স্কুলগুলোতে পুরনো ধাঁচের অভিনয় তালিম দেয়া হতো। এখানে অভিনেতারা বিভিন্ন পরিস্থিতির বাচন-ভঙ্গি, যেমন- কান্না, হাসি, ক্রোধ ইত্যাদি অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের অভিনয় চর্চা করতেন। কিন্তু এই পদ্ধতি তার ক্ষেত্রে কাজে দিলো না। তাই তিনি শুরু করলেন হাল আমলের বিখ্যাত ‘মেথড অ্যাক্টিং’ পদ্ধতি। মার্লোন ব্র্যান্ডো কোনো চরিত্র অভিনয় করতেন না, বরং তিনি নিজেই সেই চরিত্র বনে যেতেন। তাই অভিনয়কালীন আবেগ, বাচন-ভঙ্গি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে বহিঃপ্রকাশ পেত তার। আর তাকে এই পদ্ধতিতে সিদ্ধহস্ত করে তুলতে প্রশিক্ষক এডলারের ভূমিকা মুখ্য হয়ে আছে। পরবর্তীতে তিনি বারবার তার গুরুর অবদান সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
অভিনয় তালিম শেষে তার প্রথম অভিনয় অভিষেক হয় ১৯৪৪ সালে। ‘আই রিমেম্বার মামা’ নামক ব্রডওয়ে থিয়েটারের মাধ্যমে তিনি তার নতুন অধ্যায় শুরু করেন। সেদিনের পর তার আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পত্রিকার পাতায় সংস্কৃতি পাতায় সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসায় ভাসলেন তরুণ অভিনেতা ব্র্যান্ডো। একের পর এক ব্রডওয়েতে অভিনয়ের পর তিনি ১৯৪৭ সালে তার সেরা ব্রডওয়ে অভিনয় উপহার দেন ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ নামক নাটকে। স্ট্যানলি কোয়ালস্কি চরিত্রে অভিনয় করে তিনি এক ভবিষ্যৎ তারকার আগমনের অগ্রিম বার্তা দিয়ে দেন অভিনয় জগতে।
হলিউডে পদার্পণ
ব্রডওয়েতে সাড়া ফেলে দেয়া ব্র্যান্ডো তার পরবর্তী অধ্যায় সূচনা করেন হলিউডে অভিনয়ের মাধ্যমে। এক যুদ্ধফেরত যুবকের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি আবির্ভূত হন ‘দ্য ম্যান’ নামক সিনেমায়। ১৯৫০ সালে হলিউডে মুক্তি পায় সিনেমাটি। সিনেমা মুক্তির পর সমালোচকগণ এই নবীন অভিনেতার প্রশংসা না করে পারলেন না। পরবর্তী বছর তিনি তার ব্রডওয়ে অভিনীত নাটক ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর সিনেমা সংস্করণে অভিনয় করেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি প্রধান চরিত্র স্ট্যানলি কোয়ালস্কির চরিত্রে অভিনয় করেন। ব্রডওয়ে নাটকটি যদি ব্র্যান্ডোর প্রতিভার ঝলক প্রকাশ করে থাকে, তাহলে এই সিনেমাটি হবে তার পরিপক্কতার সাহসী ঘোষণা।
এই সিনেমার পর চারদিকে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল একদম। সবাই মার্লোন ব্র্যান্ডোকে নিজের সিনেমায় নাম লিখিয়ে নিতে চায়। একটি চরিত্রের সংলাপ পড়ে পরিচালকরা যে নিখুঁত অভিনয়ের চিত্র মনে মনে আঁকেন, একমাত্র ব্র্যান্ডোই সেটাকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবে প্রতিফলিত করতে পারতেন। তাই তিনি পরিচালকদের চোখের মণি হয়ে উঠলেন। এরপর তিনি উপহার দিলেন একের পর এক হিট সিনেমা ‘ভিভা জাপাতা! (১৯৫২)’, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট (১৯৫৪)’, ‘গাইজ এণ্ড ডলস (১৯৫৫)’, ‘দ্য ইয়াং লায়ন্স (১৯৫৮)’। বিশেষ করে বলতে হয় অন দ্য ওয়াটারফ্রন্টের কথা। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি ‘সেরা অভিনেতা’ বিভাগে সিনেমা জগতের সর্বোচ্চ পুরষ্কার অস্কার লাভ করেছিলেন।
ব্যাডবয়ের আবির্ভাব
এতক্ষণ পড়লেন মার্লোন ব্র্যান্ডোর সফলতার কড়চা। যখন মনে হচ্ছিলো ব্যক্তিগত জীবনের গঞ্জনা পেছনে ফেলে বুঝি মার্লোন ব্র্যান্ডো নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন, ঠিক তখনি কোথায় যেন হিসাব তালগোল পাকিয়ে গেল। ‘৫০-এর সবচেয়ে বড় তারকা ব্র্যান্ডো পুনরায় রগচটা এবং বেখেয়ালি জীবনযাপন শুরু করেন। তিনি খাবার-দাবার এবং নারীসঙ্গের দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন। তার দেহের ওজন বেড়ে যেতে থাকে। তিনি কারো কথা শুনতে পছন্দ করতেন না। এমনকি অভিনয় সেটে পরিচালক এবং সহকর্মীদের সাথে তিনি ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়া শুরু করেন। পাপারাজ্জিদের ক্যামেরায় তার এসব কার্যকলাপ ধরা পড়তে থাকে। ম্যাগাজিনগুলোয় তাকে নিয়ে বড় ফিচার ছাপা হয়। সাংবাদিকরা তাকে ডাকতে থাকে ‘ব্যাডবয়’ হিসেবে।
এতকিছুর মাঝেও তিনি বেশ ব্যয়বহুল সিনেমা ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি’তে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তার বিশৃঙ্খল জীবনযাপন এই সিনেমার দফারফা করে দিল। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি বক্স অফিসে ব্যাপক ভরাডুবির মুখে পড়ে। বড় লোকসান দেখে অনেক পরিচালক তার সমালোচনায় মেতে ওঠেন। পরবর্তী এক দশক পর্যন্ত তার সফল ক্যারিয়ারে ভাঁটা পড়ে। একটি সিনেমাও ব্যবসাসফল করতে ব্যর্থ হন তিনি।
ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার গডফাদার অনুসন্ধান
মার্লোন ব্র্যান্ডো এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, হারলেন এবং হারিয়ে গেলেন। বহুদিন ধরে তিনি পরিচালকদের অবহেলার মাঝে পড়ে আছেন। সবাই আশা ছেড়ে দিল তাকে নিয়ে। “নাহ! মার্লোন ব্র্যান্ডো শেষ। তাকে নিয়ে আর কিছু হবে না।” মালহল্যান্ড ড্রাইভে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে অলস দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক তখন হলিউডে চলছে গডফাদার অনুসন্ধান। কালজয়ী পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা তখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন ভিটো কর্লিওনি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একজন যুতসই অভিনেতাকে। কিন্তু কাউকেই মনে ধরছিল না তার। তাই উপায় না দেখে তিনি মুখ ফেরান গত দশকের প্রতিভাবান অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোর দিকে। প্রথমে প্রযোজকরা রাজি হননি। আর যা-ই করা হোক, একজন মদ্যপকে দিয়ে গডফাদার করানো যাবে না। শেষপর্যন্ত তারা তিন শর্তে রাজি হন- প্রথমত, মার্লোন ব্র্যান্ডোকে বিনা বেতনে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এক মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করতে হবে, যাতে ব্র্যান্ডোর কোনো কাজের জন্য বাজেটের বেশি টাকা খরচ না হয়। আর শেষ শর্ত ছিল, তাকে অন্যান্য অভিনেতাদের মতো পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হবে। সব শর্ত মেনে নিয়ে কপোলা পাড়ি জমালেন মালহল্যান্ড ড্রাইভে।
কপোলা যখন দরজার কড়া নাড়েন, তখনও ব্র্যান্ডো ঘুম থেকে ওঠেননি। তিনি ঘুমন্ত চোখে টলতে টলতে এসে দরজা খোলেন। সোনালি লম্বা চুলের ব্র্যান্ডোকে দেখেই কপোলা নিশ্চিত ছিলেন, তিনি ভিটো কর্লিওনির জন্য মানানসই। কপোলার কথামতো সব শর্ত মেনে সেদিন মার্লোন ব্র্যান্ডো গডফাদার সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন। শর্ত অনুযায়ী তিনি স্ক্রিন টেস্টও দিয়েছিলেন। টেস্ট চলাকালীন সময় তার একটি ফোনকল এসেছিল। ব্র্যান্ডো অভিনয় না থামিয়ে একদম গডফাদার কায়দায় ফোন ধরেছিলেন যেটা স্টুডিওর সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলো। এরপরের গল্পটুকু ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। মার্লোন ব্র্যান্ডোর অনবদ্য অভিনয়শৈলীতে জীবন্ত হয়ে ওঠে মারিও পুজোর উপন্যাসের তেজস্বী ভিটো কর্লিওনি। সিনেমাটি বক্স অফিস সফলতা ছাড়াও সমালোচকদের দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমার তালিকায় স্থান পেয়েছে। পুরষ্কারের মঞ্চে সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক এবং সেরা অভিনেতা বিভাগে তিনটি অস্কার জিতে নেয়। পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা একবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন,
“মার্লোন সেটে এসে চারদিক ভালো করে দেখে নিলো। মুহূর্তের মধ্যেই যেন সে বুঝে গেলো কী হচ্ছে এখানে। এমনকি আমি কী ধরনের অভিনয় চাই, সবই ছিল তার জানা। সে জুতা পালিশ করলো, কালো স্যুট গায়ে জড়ালো। এরপর কিছু ক্লিনেক্স এবং তুলা মুখের ভেতর গুঁজে দিয়ে সে শুরু করলো অভিনয়।”
অস্কার বনাম ব্র্যান্ডো
সিনেমাজগতের সবচেয়ে বড় সম্মাননা অস্কার। এই পুরষ্কার পাওয়ার জন্য অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র কলাকুশলীদের সাধনার অন্ত নেই। মার্লোন ব্র্যান্ডো তার জীবদ্দশায় মোট আটবার এই পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এবং দুবার জিতেছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু সেবার তিনি পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই যখন বিজেতা হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়, তার বদলে মঞ্চে উপস্থিত হন এক রেড ইন্ডিয়ান নারী। তিনি জানান, স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে সরকারের বৈরী আচরণের কারণে মার্লোন ব্র্যান্ডো সেবার অস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ঘটনায় হতবাক হয়ে যায় সবাই। সমালোচকদের তরফ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার শিকার হন তিনি।
অস্কারের সাথে তার দ্বৈরথ অবশ্য সেদিন থেকে শুরু হয়নি। ১৯৭০ সালে তিনি একাডেমি বরাবর চিঠি লিখে আবেদন করেন যেন তাকে নতুন একটি অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয়। কারণ, ১৯৫৪ সালের জেতা অস্কার পুরষ্কারটি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি এতদিন নাকি সেটি দরজার খিল হিসেবে ব্যবহার করছিলেন! এমন পত্র পেয়ে নিশ্চয়ই একাডেমি কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি ভালোভাবে নেয়নি। এখানে তাদের দ্বৈরথ থেমে গেলেও হতো। ১৯৯৪ সালে তিনি পুনরায় চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, তিনি মত বদলেছেন। তাকে যেন দ্য গডফাদারের অস্কারটি পাঠিয়ে দেয়া হয়! অবশ্য তাকে পুরষ্কারটি আর দেয়া হয়নি।
অস্কার পরবর্তী অভিনয় জীবন
দ্য গডফাদার পরবর্তী মার্লোন ব্র্যান্ডোর অভিনয় জীবন সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সমালোচকগণ। তিনি এরপর ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ সিনেমায় অভিনয় করেন। বিতর্কিত হলেও অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম হন তিনি। পুনরায় পরিচালকরা তার দিকে নজর দেয়া শুরু করে। তার আয় উপার্জনও বেড়ে যায়। এমনকি ছোটখাট চরিত্রের জন্য উঁচু সম্মানী পেতেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার সাথে পুনরায় সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। কর্নেল কার্টজ চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন অন্যতম সেরা যুদ্ধবিষয়ক সিনেমা ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’-এ। তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছিলেন তিনি এই সিনেমায়।
১৯৮৯ সালে ‘আ ড্রাই হোয়াইট সিজন’ সিনেমার জন্য তিনি পার্শ্বচরিত্র হিসেবে পুনরায় অস্কার মনোনয়ন পান। এরপর বেশ কয়েকটি সফল সিনেমায় অভিনয়ের পর তিনি ‘দ্য আইল্যাণ্ড অফ ড. মরো (১৯৯৬)’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় পুনরায় সমালোচনায় পড়েন। এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি পত্রিকায় খবর আসলো, মার্লোন ব্র্যান্ডো কানে ইয়ারপিস ব্যবহার করে সংলাপ শুনে শুনে অভিনয় করছেন। এই সংবাদের উত্তরে তার সহকর্মী ডেভিড থিউলিস পত্রিকায় জানান,
“যে যা-ই বলুক, মার্লোন যখন সেটে প্রবেশ করেন অভিনয়ের জন্য, আপনি অনুভব করবেন কিছু একটা হচ্ছে। মার্লোন ব্র্যান্ডো কিছু একটা করছেন।”
বিশৃঙ্খল ব্যক্তিগত জীবন
শৈশবের বিশৃঙ্খল এবং ভীতিকর পারিবারিক জীবন আজীবন তাড়া করেছে মার্লোন ব্র্যান্ডোকে। তার নিজের পারিবারিক জীবনেও সেই শৈশবের ত্রাস বিদ্যমান ছিল। তিনি বেশ কয়েকবার বিয়ে করে সংসার স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং প্রতিবারই ব্যর্থ হন। এমনকি তার এক ছেলে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাভোগ করেছিল যা তার জন্য অসহনীয় ছিল। তার বড় মেয়ে বিষণ্ণতার শিকার হয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। এসব ঘটনা তার সংসার করার অভিলাষকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
তিনি নিজে এসব কারণে বিষণ্ণ থাকতেন। শেষদিকে পুনরায় খাবার এবং নারীর মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এর ফলে দ্রুত নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এই শক্তিমান অভিনেতা।
শেষ প্রহর
নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার কারণে শেষ জীবনে তার দেহের ওজন বেড়ে প্রায় ৩০০ পাউন্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। পাকস্থলী সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি লস এঞ্জেলসের একটি হাসপাতালে ২০০৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮০। এভাবে অবসান ঘটে অভিনয় জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ তারকার বিচিত্র পথচলার।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যতই ব্যর্থ হন না কেন, সত্যিকারের সিনেমাপ্রেমীরা কখনই এর সাথে তার অভিনয় কীর্তিকে মিলিয়ে ফেলবে না। তার একেকটা চরিত্র সিনেমার ইতিহাসে পরবর্তী হাজার বছর পর্যন্ত এক ইতিহাস হয়ে থাকবে। তিনি তার শক্তিমান অভিব্যক্তিকে রচনা করেছেন এক নতুন বিপ্লব। সেই বিপ্লব তার ব্যক্তিজীবনের কারণে এক বিন্দুও কলঙ্কিত হবে না।
বিনোদন জগতের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/