Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কার্লোস কাইজার: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজ ফুটবলার

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল– এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। ফুটবল অনেকগুলো আবেগঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে আমাদের, যেগুলো নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের সাথে স্মৃতিচারণ করা হবে। ফুটবলীয় আবেগ আমাদের জীবনবাস্তবতার অনেকখানিই দখল করে আছে, এ কথা বলা বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। ফুটবলই তো যোগান দিচ্ছে কতো হাজার মানুষের জীবিকার জ্বালানি!

ফুটবলারদের জনপ্রিয়তা আঁচ করতে খুব বেশি কিছু করতে হয় না। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পত্রিকা – সবখানেই ফুটবলারদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দেখতে পাই আমরা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ফুটবলার নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন। অনেকগুলো ধাপ পার হওয়ার পর মূল দলে জায়গা পেতে হয়। আবার পড়তি ফর্ম মুহূর্তেই দল থেকে ছিটকে দেবে, সে ভাবনাও মাথায় রাখতে হয়। মূল কথা, ফুটবলাররা আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন, কিন্তু তা অর্জন করতে কিংবা ধরে রাখতেও বেশ খানিকটা পরিশ্রমী হতে হয়।

Image Credit: THESUN.CO.UK

জনপ্রিয় ফুটবলাররা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি দক্ষ, গড়পড়তা ফুটবলারদের চেয়ে। স্টেডিয়ামের সবুজ সবুজ ঘাসের ওপরে তাদের শৈলী দর্শকদের মন কাড়ে, আনন্দের খোরাক যোগায়। ডারউইনের ‘সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট থিওরি’ এখানেও খাটে। দর্শকদের সামনে যিনি সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেন, দর্শক তাদেরকেই মনে রাখে। বাকিরা একদম হারিয়ে না গেলেও লাইমলাইটের বাইরেই থেকে যান।

কিন্তু যদি এমন হয়, কোনো ফুটবলার ফুটবলীয় দক্ষতা প্রদর্শন তো দূরের কথা, কোনো ম্যাচ না খেলেই স্রেফ নিজের ধোঁকাবাজি আর কূটবুদ্ধির জেরে জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছেন আকাশসমান? 

আজকের গল্পটা কার্লোস হেনরিক র‍্যাপোসো নামের একজন ‘ফুটবলার’-এর। নাহ, তিনি প্রতিযোগিতামূলক কোনো ম্যাচে গোল কিংবা অ্যাসিস্ট তো দূরের কথা, খেলতেই নামেননি। তবে জমিয়ে গল্প বলার মতো একটা ফুটবল ক্যারিয়ার গড়ে ফেলেছেন। বেকেনবাওয়ারের সাথে কিঞ্চিৎ সামঞ্জস্য থাকায় ‘কার্লোস কাইজার’ নামে পরিচিতও হয়ে গিয়েছিলেন। চলুন তবে, গল্প শুরু করা যাক।  

হচজবকবকবজ
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের একটি ছবি (মাঝের মানুষটি কার্লোস কাইজার); Image source: Carlos Henrique Raposo

কার্লোস কাইজার জানতেন, তার আসলে ফুটবলীয় দক্ষতা বলতে কিছুই নেই। সেরাদের কাতারে নিজেকে দেখতে হলে মাঠে গ্যালারিভরা দর্শকের সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ক্লাব ফুটবলের দুনিয়ায় স্ট্রাইকারদের নিয়মিত গোল করতে হয়, ম্যাচ জেতানো পারফর্ম করতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করেন। কাইজারের দ্বারা আসলে ম্যাচ জেতানো পারফর্ম তো দূরে থাক, ম্যাচে খেলার জন্য ন্যূনতম যে বিষয়গুলি একজন ফুটবলারের মাঝে থাকার দরকার, সেগুলোই ছিল না। তাই তাকে বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়েছে; আর বিকল্প পথটি আসলে ধোঁকাবাজি, ছলচাতুরি ছাড়া কিছুই নয়।

দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকার একটি-দু’টি নয়, নয়-নয়টি ক্লাব তাকে দলে ভিড়িয়েছিল। এসব ক্লাবের মধ্যে ব্রাজিলের নামকরা চারটি ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো, ফ্লুমিনেন্স, ভাস্কো দা গামা ও বাঙ্গু আছে। মেক্সিকান জায়ান্ট পুয়েবলা’ও তাকে দলে ভিড়িয়েছিল তার ‘মিথ্যা’ প্রশংসা শুনে। আমেরিকার ‘এল পাসো সিক্স শুটার্স’ কিংবা ফ্রেঞ্চ ক্লাব ‘গ্যাজেলেক এ্যাজাচ্চিও’ ক্লাবেও তিনি এসেছিলেন। কোনো ক্লাবেই তিনি লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি করেননি, পাছে তার ধোঁকাবাজি ধরা পড়ে যায়!

সহসহহসহস
এরকম পোজে ছবি তুললেও কখনো গ্যালারিভরা দর্শকের সামনে মাঠে নামেননি; Image source: Carlos Henrique Raposo

কার্লোস কাইজারের ওঠাবসা ছিল ব্রাজিলের সেই সময়ের কিংবদন্তি ফুটবলার যেমন কার্লোস আলবার্তো তোরেস, রেনাতো গাউচো’র সাথে। কার্লোস সহজেই মিশে যেতে পারতেন যে কারও সাথে। ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলারদের সাথে বন্ধুত্ব করে তার বেশ লাভ হয়েছিল। অন্যান্য ক্লাবে যোগ দিতে এসব সেলিব্রেটি ফুটবলারদের সুপারিশ প্রচণ্ড কাজে দিত।

শুধু বিখ্যাত ফুটবলারই নয়, কার্লোসের বন্ধুতালিকায় ছিল ব্রাজিলের নামকরা ক্রীড়া-সাংবাদিকরাও। কার্লোস তার সম্পর্কে মিথ্যা প্রশংসামূলক আর্টিকেল ছাপিয়ে নিতেন এদের মাধ্যমে। যার ফলে ক্লাবগুলো তার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করতো, আর সুযোগ বুঝে তিনি চুক্তি করে ফেলতেন। কার্লোস ফ্রান্সে মাত্র কয়েক মাস কাটিয়েছিলেন, অথচ তার একজন সাংবাদিক বন্ধু একটি আর্টিকেলে লিখেছিল, তিনি ফ্রান্সে আট বছর দুর্দান্ত খেলে দেশে ফিরে এসেছেন। মেক্সিকো থেকে ফেরার পর একটি আর্টিকেলে তার আরেক সাংবাদিক বন্ধু লিখেছিলেন, তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে মেক্সিকোর নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। এসব তথ্য ছিল ডাহা মিথ্যা।

নসনসনসহ
ছবিতে রেনাতো ও গাউচোর সাথে কাইজার; Image source: A KALEIDOSCOPE HANDOUT PICTURE

কার্লোস কাইজার তার মোবাইল ফোনে ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের মিথ্যা বার্তা আদান-প্রদান দেখাতেন। সেসব কথোপকথনে দেখানো হতো তার সাথে বিভিন্ন ক্লাব মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করতে চায়, কিন্তু তিনি সেসব চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বিদেশি ভাষার কথোপকথন ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারত না, বিশ্বাস করে নিত।

কোনো ক্লাবের সাথে চুক্তির পর তিনি কোচের কাছ থেকে বেশ বড় পরিসরের একটি সময় চেয়ে নিতেন নিজেকে নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর কথা বলে। এরপর ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ে কোচদের গতি ও ফিটনেসের মাধ্যমে মুগ্ধ করতেন। আসলে এটি তার একটি চাল ছিল। ফিটনেসের দিক থেকে নিজেকে ঠিক রাখতেন, যাতে কোচের সন্দেহের তীর তার দিকে না আসে।

ইনজুরি ছিল কার্লোসের ধোঁকাবাজি ঢাকার মূল অস্ত্র। জুনিয়র খেলোয়াড়দের টাকা দিতেন, যাতে তারা প্র্যাকটিসের সময় তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাজে ট্যাকল দেয়। ট্যাকলের পর আঘাত যা-ই পেতেন না কেন, ‘গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত’ হওয়ার অভিনয় করতেন। ফলাফল হিসেবে কয়েক মাস মাঠের বাইরে চলে যেতেন, যেটি তিনি মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতেন।

ইনজুরি ছিল কাইজারের ধোঁকাবাজি ঢাকার মূল অস্ত্র; Image Credit: Lars Leetaru

একবার এক ম্যাচে কোচ তাকে নামাবেনই। ডাগআউটের পাশে ওয়ার্মআপ করার নির্দেশ দিলেন। কার্লোস প্রমাদ গুনলেন। তিনি যে ফুটবলের মাঠে আমড়া কাঠের ঢেঁকি, সেটি প্রকাশ হয়ে গেলে তো সমস্যা! এবার নতুন ফন্দি আঁটলেন। মাঠে নামার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রতিপক্ষের এক দর্শককে বেদম মার লাগালেন। রেফারি মাঠে নামার আগেই লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন। আর কার্লোসও এটিই চাচ্ছিলেন। এ যাত্রায়ও বেঁচে গেলেন।

ফরাসি ক্লাব গ্যাজেলেক এ্যাজাচ্চিওতে ভক্তদের সাথে পরিচিত করে দেয়ার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলো। স্টেডিয়ামের আয়তন খুব বড় ছিল না, কিন্তু কার্লোসকে দেখার জন্য কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। একজন সহকারী কোচ অনেকগুলো ফুটবল নিয়ে আসলেন, ভক্তদের সামনে কাইজারকে বিভিন্ন স্কিল দেখাতে অনুরোধ করলেন। কাইজার স্কিলের কিছুই জানতেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রতিটা ফুটবল দর্শকদের উদ্দেশ্যে উপহার হিসেবে ছুড়ে মারলেন, ক্লাবের জার্সিতে বারবার চুমু খেলেন। এবারও কোনোমতে বেঁচে গেলেন।

দুই যুগ ধরে এভাবেই এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাবে গিয়েছেন নিজের কুটিল বুদ্ধির জোরে। ফুটবলারের ক্যারিয়ার গড়েছেন কোনো ম্যাচ খেলা ছাড়াই। ফুটবলীয় দক্ষতা না থাকলেও কুটিলতার দক্ষতায় পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজ ফুটবলার বললে কি খুব বেশি হয়ে যাবে? 

Related Articles