Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি: নিউ জিল্যান্ডের দিনবদলের নায়ক

নিউ জিল্যান্ড, ক্রিকেটবিশ্বে বেশ শক্তিশালী একটি দেশ। শুধুমাত্র ক্রিকেট দিয়ে তাদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত লোকজন চিনে থাকে। বর্তমানে তাদের ক্রিকেটের মশাল কেন উইলিয়ামসনের হাতে। কেন উইলিয়ামসনের হাতে আসার আগে এটি পালাক্রমে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, স্টিফেন ফ্লেমিংদের হাতে ছিল। প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। মশাল জ্বালিয়েছে কে? কার হাতে হয়েছিল এর সূচনা? উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে গত শতকে। সেসময় ক্রিকেটে নিউ জিল্যান্ডের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। ক্রিকেট বিশ্বের ভয়ংকর পেসারদের নাম উচ্চারণে সময় তার নাম উপরের দিকেই থাকবে। তার হাত ধরেই নিউ জিল্যান্ড বড় দল গুলোর বিপক্ষে জয়ের মুখ দেখেছিল। এবার তার বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

পিতার দেখানো পথে পুত্রের পথচলা

১৯৫১ সালের ৩ জুলাই ক্রাইস্টচার্চের সেন্ট আলবানস এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তার বাবা ওয়াল্টার আর্নল্ড হ্যাডলিও ছিলেন নিউ জিল্যান্ডের স্বনামধন্য ক্রিকেটার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময় ধ্বংস না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে দিতে পারতেন আরও অনেককিছু। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১টি টেস্ট ম্যাচ খেলে তিনি ৩০.১৬ ব্যাটিং গড়ে ৫৪৩ রান করেছিলেন।

ওয়াল্টার হ্যাডলি; Source – PA Photos

রিচার্ড হ্যাডলির বাবার পাশাপাশি তার দুই ভাই ব্যারি হ্যাডলি এবং ডেইল হ্যাডলিও নিউ জিল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছিলেন। ব্যারি হ্যাডলির চেয়ে ডেইল হ্যাডলির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বাবা আর দুই ভাই তো নিউ জিল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেনই, তার সহধর্মিনী ক্যারেন হ্যাডলিও ১৯৭৮ সালে নিউজিল্যান্ড নারী ক্রিকেট দলের হয়ে একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ১৯৭১ সালে ক্যান্টারবারির হয়ে প্রথম প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন। দুই বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পর ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে টেস্ট এবং ক্রাইস্টচার্চে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে রিচার্ড হ্যাডলির।

অভিষেকের পর সাদামাটা পথচলা

১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিচার্ড হ্যাডলির আগমন ঘটলেও তার নিজের জাত চেনাতে সময় লেগেছে পাঁচ বছর। এর আগে তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ার ছিল গড়পড়তা। একদিনের ক্রিকেটেও একই অবস্থা। ক্যারিয়ারের প্রথম আট বছরে খুব বেশি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ৩৪টি একদিনের ম্যাচে শিকার করেছিলেন ৩৮টি উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ১৭ ম্যাচে শিকার করেছিলেন ৬১টি উইকেট, যা তার মতো গ্রেট বোলারের পুরো ক্যারিয়ার বিবেচনায় খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না। উইকেট প্রতি তিনি খরচ করেছিলেন প্রায় ৩৬ রান।

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি তার ক্যারিয়ারে একাই অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন। নিজের গড়পড়তা সময়েও নিউ জিল্যান্ডকে টেস্ট ম্যাচ জেতান তিনি। ১৯৭৬ সালে ওয়েলিংটন টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে জয় পায় নিউজিল্যান্ড। তৎকালীন ভারতীয় দল বেশ শক্তিশালী ছিল। সুনীল গাভাস্কার, দিলিপ ভেংসরকার, মহিন্দর আমারনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথদের নিয়ে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ বরাবরের মতো শক্তিশালী ছিল। স্যার রিচার্ড হ্যাডলির বিধ্বংসী বোলিংয়ে ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮২ রানে গুটিয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে সাত উইকেট সহ ম্যাচে ১১ উইকেট শিকার করেন তিনি।

রিচার্ড হ্যাডলি থেকে স্যার রিচার্ড হ্যাডলি হয়ে ওঠার গল্প

রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন লম্বা, শক্তিশালী, আক্রমণাত্মক। তার আত্মবিশ্বাস দেখেই ব্যাটসম্যানরা বিভ্রান্ত হয়ে যেতেন। তার বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিল ইন সুইংগার, সেই সাথে হঠাৎ লাফিয়ে উঠা বাউন্সার এবং ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করতেন। তিনি একাই নিউ জিল্যান্ডকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন।

এক

১৯৭৮ সাল থেকে রিচার্ড হ্যাডলির স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই রিচার্ড হ্যাডলি থেকে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির বেড়ে ওঠা। ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটন টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক তিনি। ৪৮ বারের প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের দেখা পায় নিউ জিল্যান্ড। হ্যাডলি প্রথম ইনিংসে চার উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় উইকেট শিকার করেন। নিউ জিল্যান্ডের দেওয়া মাত্র ১৩৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ড রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং তোপের মুখে মাত্র ৬৪ রানেই গুটিয়ে যায়।

দুই

গত শতকের ‘৭০ এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল ছিল অপ্রতিরোধ্য। তারা ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দুটি বিশ্বকাপই নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছিল। টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৮০ সালে নিউ জিল্যান্ড সফরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্লাইভ লয়েড, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংদের নিয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল যেকোনো দলকে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো।

সবাইকে অবাক করে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টে জয় তুলে নেয় নিউ জিল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ১০৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে এক উইকেটের জয় পায় তারা। এই জয়ের মূল নায়ক স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় উইকেট শিকার করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ১০৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা নিউজিল্যান্ড মাত্র ৫৪ রানে সাত উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। সেখান থেকে ১৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী এক ইনিংস খেলেন হ্যাডলি। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে রিচার্ড হ্যাডলি তার টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতক হাঁকান। মাত্র ৯২ বলে ১০৩ রান করেন তিনি, যার সুবাদে দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হয়। শেষ টেস্টেও ড্র করে সিরিজ নিজেদের করে নেয় ব্ল্যাক ক্যাপসরা।

তিন

১৯৮৩ সালের ২৮ জুলাই লিডসে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচে ইংল্যান্ডকে পাঁচ উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত করে নিউ জিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটিই নিউ জিল্যান্ডের প্রথম জয়। এই ম্যাচে একেবারে নিষ্প্রভ ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। ম্যাচে ৮৯ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শূন্য। তবে পুরো সিরিজে ব্যাটে এবং বলে দুই বিভাগেই নিউ জিল্যান্ডের সেরা পারফর্মার ছিলেন তিনি। ফিরতি সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড পরের বছর নিউ জিল্যান্ড সফরে আসে। এই সিরিজেই প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়লাভ করে নিউ জিল্যান্ড। সিরিজের প্রথম টেস্ট ড্র হওয়ার পর ক্রাইস্টচার্চে দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডকে দাঁড়াতেই দেয়নি নিউ জিল্যান্ড, যার পুরো কৃতিত্ব রিচার্ড হ্যাডলির।

প্রথমে ব্যাট করে নিউ জিল্যান্ড ৩০৭ রান জমা করে স্কোর বোর্ডে। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৯৯ রান করেন সাত নাম্বারে ব্যাট করা হ্যাডলি। বাইশ গজে বল হাতে ঝড় তোলার পাশাপাশি বাঁহাতে ব্যাট করা রিচার্ড হ্যাডলি ব্যাটহাতেও তাণ্ডব চালাতেন। সেদিন মাত্র ৮১ বলে ১৮টি চারের মারে ৯৯ রান করেছিলেন তিনি। জবাবে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৮২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৩ রানে অল আউট হয়ে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে ইনিংস ও ১৩২ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়। ব্যাট হাতে দলীয় সর্বোচ্চ ৯৯ রান করার পাশাপাশি বল হাতে আট উইকেট শিকার করে নিউ জিল্যান্ডের বড় জয় নিশ্চিত করেন রিচার্ড হ্যাডলি।

চার

নিউ জিল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়া তাদের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কোনো ম্যাচ খেলেনি। এরপর থেকে নিয়মিত খেললেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জেতা হয়ে ওঠেনি নিউজিল্যান্ডের। রিচার্ড হ্যাডলির কল্যাণে প্রথমবারের মতো ট্রান্স-তাসমানিয়া ট্রফি জেতে নিউ জিল্যান্ড।

ব্রিসবেনে ম্যাচে ১৫ উইকেট শিকার করে অজিদের ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দেন রিচার্ড হ্যাডলি ; Source – Getty Images

সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্রিসবেনে টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং তোপের মুখে পড়ে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আট ব্যাটসম্যানকেই সাজঘরে ফেরত পাঠান হ্যাডলি। শেষপর্যন্ত রিচার্ড হ্যাডলি ২৩.৪ ওভার বল করে ৫২ রান দিয়ে নয় উইকেট শিকার করেন। তাতেই অস্ট্রেলিয়া ১৭৯ রানে গুটিয়ে যায়। জবাবে মার্টিন ক্রোর ১৮৮ এবং রেইডের ১০৮ রানের ইনিংসের পাশাপাশি রিচার্ড হ্যাডলির ৪৫ বলে ৫৪ রানের ঝড়ো ইনিংসের উপর ভর করে নিউ জিল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৫৫৩ রান করে।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের অপরাজিত ১৫২* রানের ইনিংসের পরেও অস্ট্রেলিয়া ব্রিসবেন টেস্ট ইনিংস ও ৪১ রানের ব্যবধানে পরাজিত হয়। দ্বিতীয় ইনিংসেও ছয় উইকেট শিকার করেন রিচার্ড হ্যাডলি। ম্যাচে ১৫ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দেন তিনি। অজি অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার ম্যাচ সম্পর্কে বেশি কিছু বলেননি। তিনি বলেছিলেন, আমরা প্রথম ইনিংসে একপর্যায়ে মাত্র এক উইকেটে ৭০ রান সংগ্রহ করেছিলাম। ওয়েসলেস এবং ডেভিড বুন বেশ ভালো ব্যাট করছিলেন। সেখান থেকে ৩০০ এর আশেপাশে রান করা উচিৎ ছিল আমাদের। কিন্তু রিচার্ড আমাদের মিডল এবং লোয়ার মিডল অর্ডার ধসিয়ে দেন, যা দুর্দান্ত বোলিং নৈপুণ্যের উদাহরণ।

সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জয় পেলেও হ্যাডলি সাত উইকেট শিকার করেন। সিরিজ শেষ এবং তৃতীয় টেস্টে রিচার্ড হ্যাডলি ১১ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিউ জিল্যান্ডের ঐতিহাসিক সিরিজ জয় নিশ্চিত করেন। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে রিচার্ড হ্যাডলি একাই ৩৩ উইকেট শিকার করেন।

ব্যাটসম্যান হ্যাডলি

১৯৮৭ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা সফরে যায় নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট দল। কলোম্বোতে সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে হেরে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ব্রেন্ডন কুরুপ্পুর দ্বি-শতকের উপর ভর করে ৩৯৭ রান করে। রিচার্ড হ্যাডলি চার শ্রীলঙ্কা ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠান। তবে এই ম্যাচে বোলার হ্যাডলিকে ছাপিয়ে ব্যাটসম্যান হ্যাডলি সবার মধ্যমণি ছিলেন। শ্রীলঙ্কার ৩৯৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা নিউ জিল্যান্ড মাত্র ১৬০ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসে। সেখান থেকে দলের হাল ধরেন রিচার্ড হ্যাডলি এবং অধিনায়ক জেফ ক্রো। দুজনে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে অবিচ্ছিন্ন ২৪৬ রানের জুটি গড়েন। রিচার্ড হ্যাডলি তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শতক হাঁকিয়ে ২৪০ বলে ১৫১* রান করেন। তার শতকের উপর ভর করে নিউ জিল্যান্ড ম্যাচটি ড্র করে। প্রথম টেস্ট শেষ হওয়ার পর নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট দলের অবস্থানরত হোটেলের পাশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে সিরিজের বাকি ম্যাচগুলো না খেলেই শ্রীলঙ্কা ত্যাগ করে তারা।

ব্যাট হাতেও দলের প্রয়োজনে জ্বলে উঠতেন হ্যাডলি, টেস্ট ক্রিকেটে দুটি শতকও হাঁকিয়েছেন ; Source – Pinterest

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রিচার্ড হ্যাডলি ব্যাট হাতে খুব একটা সফল ছিলেন না। ক্যারিয়ারের প্রথম ৪০টি টেস্টে ২১.৬৬ ব্যাটিং গড়ে ১,৩০০ রান করেছিলেন। আর ক্যারিয়ারের শেষ ৪৬টি টেস্টে ৩৩.১৬ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ১,৮২৪ রান।

গ্রেটনেসের সূচক

১৯৯০ সালে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সঞ্জয় মাঞ্জেকারের উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে প্রথম বোলার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে চারশ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। গত শতকের সেরা চারজন অলরাউন্ডারের একজন রিচার্ড হ্যাডলি। এছাড়া ইয়ান বোথাম, ইমরান খান এবং কপিল দেবকেও সেই সময়কার সেরা অলরাউন্ডার হিসাবে গণ্য করা হতো। বাকি তিনজনের চেয়ে রিচার্ড হ্যাডলি ব্যাটিংয়ের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। কিন্তু বোলিংয়ের দিক দিয়ে তাদের থেকে অনেক এগিয়েই আছেন তিনি।

২০০২ সালে উইজডেন রিচার্ড হ্যাডলিকে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা বোলার হিসাবে ঘোষণা করে। রিচার্ড হ্যাডলি নিউ জিল্যান্ডের হয়ে ৮৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। তারমধ্যে নিউ জিল্যান্ড ২২টিতে জয় পেয়েছিল। এই ২২ ম্যাচে হ্যাডলি ১৭৩টি উইকেট শিকার করেছেন। উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন মাত্র ১৩.০৬ রান। ম্যাচপ্রতি প্রায় আটটি করে উইকেট শুধুমাত্র তার ঝুলিতেই জমা হয়েছিল। এই ২২ ম্যাচে ১৭ বার ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক এবং আটবার ম্যাচে দশ বা ততোধিক উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। নিজ দলের হয়ে জয় পাওয়া ম্যাচগুলোতে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট শিকার করা বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বোলিং গড়ের রেকর্ড রিচার্ড হ্যাডলির দখলে, মাত্র ১৩.০৬!

আম্পায়ারের কাছে এরকম জোরালো আবেদন নিয়মিতই করতেন হ্যাডলি; Source – Pinterest

রিচার্ড হ্যাডলি ৮৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৪৩১টি উইকেট শিকার করেছিলেন। সেসময় পুরো নিউ জিল্যান্ড দল প্রতিপক্ষের ১,২০৭টি উইকেট নিতে পেরেছিল। তার মানে রিচার্ড হ্যাডলি একাই ৩৫.৭১% উইকেট নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও তার পারফরমেন্স ছিল অসাধারণ। অজিদের বিপক্ষে ২৩ টেস্টে ২০.৫৬ গড়ে ১৩০ উইকেট শিকার করেছিলেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট ১৪বার এবং ম্যাচে দশ উইকেট তিনবার শিকার করেছিলেন। গত শতকের আশির দশকে রিচার্ড হ্যাডলির পাশাপাশি আরও অনেক ভয়ংকর পেসার বাইশ গজ কাঁপিয়ে গিয়েছিলেন। ইমরান খান, ইয়ান বোথাম, ডেনিস লিলি, বব উইলিস, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল এবং কপিল দেবের পেস বোলিংয়ের সামনে ব্যাটসম্যানের আত্মা কেঁপে উঠতো। নিখুঁত লাইন লেংথের সাহায্যে ব্যাটসম্যানদের কাবু করতেন তারা।

১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় সেরা বোলিং গড় রিচার্ড হ্যাডলির। তিনি ৬০ ম্যাচে ১৯.৫৭ ব্যাটিং গড়ে ৩৩০ উইকেট শিকার করেছিলেন। ৩২ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং ৮ বার ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছিলেন। সবচেয়ে কম বোলিং গড়ের দিক দিয়ে সবার উপর থাকা ইমরান খান ৫৮ ম্যাচে ১৯.৩৯ বোলিং গড়ে শিকার করেছিলেন ২৭২টি উইকেট। হ্যাডলির চেয়ে দুই ম্যাচ কম খেলে ৫৮টি উইকেট কম শিকার করেছেন। সবদিক বিবেচনায় তার সময়কার সেরা বোলার তিনিই ছিলেন। ক্রিকেট বিশ্বে নিউ জিল্যান্ডের মশাল তিনিই জ্বালিয়েছিলেন।

একজন পেসারের কাছে সবচেয়ে মধুর দৃশ্য; Source – Pinterest

উপমহাদেশের বাইরের বোলারদের উপমহাদেশে এসে সুবিধা আদায় করে নেয়ার ঘটনা খুব একটা বেশি নেই। পেসারদের জন্য উপমহাদেশের মাটিতে স্পিনারদের চেয়ে কম সুবিধা থাকে, সেটা কমবেশি সবারই জানা। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি উপমহাদেশের মাটিতেও সফল ছিলেন। তিনি ১৩ ম্যাচে ২১.৫৮ বোলিং গড়ে ৬৮টি উইকেট শিকার করছিলেন। ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছিলেন দুবার। উপমহাদেশের বাইরের পেসারদের মধ্যে উপমহাদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন সাউথ আফ্রিকান পেসার ডেল স্টেইন। তিনি ২০ ম্যাচে ২২.৬৬ বোলিং গড়ে ৯০ উইকেট শিকার করেছেন। রিচার্ড হ্যাডলির চেয়ে উইকেট প্রতি এক রান বেশি খরচ করেছেন তিনি।

টেস্ট ক্রিকেটের পাশাপাশি একদিনের ক্রিকেটেও সফল বোলার ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। তিনি ১১৫টি একদিনের ম্যাচ খেলে ১৫৮টি উইকেট শিকার করেছেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন পাঁচবার। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে একশো উইকেট শিকার করা বোলারদের মধ্যে হ্যাডলির বোলিং গড় চতুর্থ সর্বনিম্ন। তিনি প্রতি উইকেটের পিছনে খরচ করেছেন ২১.৫৬ রান! নিখুঁত লাইন লেংথ বজায় রেখে বল করার কারণে তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৩.৩০! নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন ১৯৮৩ সালে। ঐ বিশ্বকাপে তিনি ১৩ ম্যাচে ২২ উইকেট শিকার করেছিলেন ১৯.১৩ গড়ে এবং মাত্র ২.৮৮ ইকোনমি রেটে। ১৩ ম্যাচে শুধুমাত্র মেইডেন ওভার করেছেন ৩৮টি!

হ্যাডলির কাউন্টি ক্যারিয়ার

আইপিএলের দশম আসর শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে ভারতের বিপক্ষে একটি টি-টুয়েন্টি দুর্দান্ত বোলিং করার সুবাদে ইংলিশ পেসার টাইমাল মিলসকে বেশ চড়া দামে কিনে নিয়েছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। কারণ আর কিছুই নয়, ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে ভারতের মাটিতে দুর্দান্ত বোলিং। কিছুদিন আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো খেলার সুবাদে তামিম ইকবালও ন্যাটওয়েস্ট টি-টুয়েন্টি ব্লাস্টে খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। এর আগে আরও একবার তামিম ইকবাল কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছিলেন।

২০১১ সালে প্রথমবারের মতো কাউন্টিতে খেলেন তিনি। কারণ আর কিছুই নয়। ২০১০ সালে লর্ডস এবং ম্যানচেস্টারে দুর্দান্ত দুটি শতক। স্যার রিচার্ড হ্যাডলির কাউন্টিতে অভিষেক ঘটার ঘটনাও একইরকম। ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের দরুন সে বছরেই কাউন্টি ক্রিকেটের নামকরা দল নটিংহ্যামশায়ারের কাছ থেকে প্রস্তাব পান তিনি। তারপর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত নটিংহ্যামশায়ারের সাথেই ছিলেন। ইনজুরি এবং জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করার কারণে মাত্র তিন মৌসুমে পুরো আসর খেলতে পেরেছিলেন তিনি।

নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে তিনি ৩৮.৭৬ ব্যাটিং গড়ে ৫,৮৫৪ রান করেছিলেন ১১টি শতকের সাহায্যে। সেই সাথে মাত্র ১৪.৫১ বোলিং গড়ে ৬২২ উইকেট শিকার করেছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে এক মৌসুমে এক সহস্রাধিক রান এবং এক শতাধিক উইকেটের শিকারের কীর্তি গড়েছিলেন। ঐ মৌসুমে ৫১.২৬ ব্যাটিং গড়ে ১,১৭৯ রান করার পাশাপাশি ১৪.০৬ বোলিং গড়ে ১১৭ উইকেট শিকার করেছিলেন। নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে তার ব্যক্তিগত শেষ মৌসুমেও দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছিলেন। মাত্র ১১.৮৯ বোলিং গড়ে ৯৭ উইকেট শিকারের পাশাপাশি এক সহস্রাধিক রান করেছিলেন। রিচার্ড হ্যাডলি ১৯৮১ সালেও কাউন্টির পুরো মৌসুম খেলেছিলেন। সে আসরেও তিনি ১০৫ উইকেট শিকার করে প্রদীপের সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন।

বাইশ গজ থেকে হ্যাডলির বিদায়

১৯৯০ সালের ৫ জুলাই, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বার্মিংহ্যাম টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন রিচার্ড হ্যাডলি। নিজের শেষ টেস্টেও আগুন জ্বলানো বোলিং করেছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যারিয়ারের ৩৬তম পাঁচ বা ততোধিক উইকেট শিকার করেছিলেন। ক্যারিয়ারের শেষ বলেও তিনি উইকেট শিকার করেছিলেন। দেড় যুগের ক্রিকেট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি ৮৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২৭.১৬ ব্যাটিং গড়ে ৩,১২৪ রান করেছেন দুটি শতক এবং ১৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে। তৎকালীন টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি রিচার্ড হ্যাডলি ২২.২৯ বোলিং গড়ে ৪৩১ উইকেট শিকার করেছিলেন।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে এক সহস্রাধিক রান এবং একশো উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করা রিচার্ড হ্যাডলি ১১৫টি একদিনের ম্যাচে ২১.৬১ ব্যাটিং গড়ে ১,৭৫১ রান এবং ২১.৫৬ বোলিং গড়ে ১৫৮ উইকেট শিকার করেছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩৪২ ম্যাচে ৩১.৭১ ব্যাটিং গড়ে ১২,০৫২ রান করেছিলেন। ক্যারিয়ারে ১৪টি শতক এবং ৫৯টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। তার ঝুলিতে জমা পড়েছিল ১,৪৯০ উইকেট। ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন ১০২ বার এবং ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছিলেন ১৮ বার! লিস্ট-এ ক্যারিয়ারে ৩১৭ ম্যাচে ৪৫৪ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ৫,২৪১ রান করেছিলেন তিনি।

সম্মাননা

২০০৯ সালে আইসিসির হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্তি ঘটে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ; Source – Getty Images

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি তার বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ার চলাকালীন অনেক অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। সবচেয়ে বড় সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন ২০০৯ আইসিসির ‘হল অব ফেমে’ জায়গা করে নিয়ে। এছাড়া তিনি তার ক্যারিয়ারে বেশকিছু অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,

১. উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার, ১৯৮২ সাল
২. নাইটহুড ফর সার্ভিস ইন ক্রিকেট, ১৯৯০ সাল
৩. নিউ জিল্যান্ড স্পোর্টস পার্সন অব দ্য ইয়ার, ১৯৮০, ১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সাল
৪. গত শতকের আশির দশকে নিউ জিল্যান্ডের সেরা স্পোর্টস পার্সন – ১৯৮৯ সাল
৫. M.B.E ফর সার্ভিসেস টু নিউ জিল্যান্ড স্পোর্ট, ১৯৮১ সাল
৬. উইন্সর কাপের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন ১৩ বার

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি এছাড়াও আরও অনেক অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সুবাদে। নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট দলের দিন বদলের নায়ক তো তিনিই। তার হাতেই বিজয়ের পতাকা উড্ডয়ন হয়েছিল, যা এখন হাত ঘুরে কেন উইলিয়ামসনদের হাতে।

ফিচার ইমেজ- Getty Images

Related Articles