১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের অনুরোধে দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করে। আফগান জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের নিকট কমিউনিজম ও আফগান সরকার কর্তৃক গৃহীত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারগুলোর অগ্রহণযোগ্যতা, আফগান সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, ইরান ও চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক আফগান মিলিট্যান্টদের ব্যাপক সমর্থন প্রদান, এবং সর্বোপরি ইউরোপীয় বা চীনা সমভূমিতে বৃহৎ মাত্রার উচ্চ প্রযুক্তিগত যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোভিয়েত সৈন্যদের পার্বত্য অঞ্চলে গেরিলাবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা- এসব কারণে সোভিয়েত সৈন্যরা আফগান মিলিট্যান্টদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়।
১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফগান যুদ্ধ (Афганский война) ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাপের যুদ্ধ। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্যরা বা আফগান মিলিট্যান্টরা একে অপরকে পরাজিত করতে পারেনি, অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে একটি অচলাবস্থা (stalemate) বিরাজ করছিল, কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়।
যেকোনো যুদ্ধের মতো আফগান যুদ্ধ নিয়েও প্রচুর প্রোপাগান্ডা (propaganda) চালানো হয়েছে এবং এর মধ্যে একটি অন্যতম প্রোপাগান্ডা ছিল – আফগানিস্তানে সোভিয়েত ‘নাস্তিক’/’খ্রিস্টান’ সৈন্যরা আফগান মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সেসময় পশ্চিমা ও অন্যান্য সোভিয়েতবিরোধী গণমাধ্যমে এই ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব মুসলিম জনমতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধী করে তোলা। কিন্তু আফগান যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের ৮০% থেকে ৯০%–ই ছিল মুসলিম! এই সৈন্যরা এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলো থেকে।
আফগানিস্তানে প্রাথমিকভাবে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের সিংহভাগই ছিল জাতিগত উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন, কাজাখ ও কিরগিজ। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ৩৫% ছিল জাতিগত তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেন। এসময় আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ এবং এদের মধ্যে ৪০ লক্ষ ছিল জাতিগত তাজিক, ১৫ লক্ষ উজবেক আর ১১ লক্ষ তুর্কমেন। এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত পশতুন ছিল প্রায় ৯০ লক্ষ। ক্রেমলিনের ধারণা ছিল, আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যরা যেহেতু জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে আফগানিস্তানের জনসাধারণের বড় একটি অংশের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, সেহেতু আফগান জনসাধারণ সোভিয়েত সৈন্যদেরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে।
ক্রেমলিনের উদ্দেশ্য শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আফগান তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেন জনসাধারণের একাংশ সোভিয়েত সৈন্যদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু আফগান পশতুনদের বৃহদাংশ আফগানিস্তানে আগত সোভিয়েত সৈন্যদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক জাতিগত তাজিক ও উজবেকদের দেখে উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত পশতুনদের সঙ্গে তাজিক ও উজবেকদের ঐতিহাসিক শত্রুতার সম্পর্ক ছিল এবং পশতুনরা ধারণা করছিল যে মস্কো আফগানিস্তানে পশতুনদের এতদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক আধিপত্যকে শেষ করে তাজিক ও উজবেকদের ক্ষমতায়ন করবে। এর ফলে আফগান যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে মস্কো আফগানিস্তানে মধ্য এশীয় সৈন্যদের পরিবর্তে স্লাভিক, বাল্টিক ও ককেশীয় সৈন্যদের প্রেরণ করতে শুরু করে।
আফগান যুদ্ধের প্রথমদিকে মস্কো আফগানিস্তানে যেসব মুসলিম সৈন্যকে মোতায়েন করেছিল, তাদের সিংহভাগই ছিল সাধারণ সৈন্য। কিন্তু এদের ছাড়াও মস্কো আফগানিস্তানে দুই ব্যাটালিয়ন মুসলিম সৈন্য মোতায়েন করেছিল, যারা ছিল স্পেৎসনাজ (Спецназ)। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং বর্তমান রাশিয়ায় যেকোনো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদলকেই ‘স্পেৎসনাজ’ বলা হয়। আফগানিস্তানে মস্কো যে দুটি মুসলিম স্পেৎসনাজ সৈন্যদল প্রেরণ করেছিল, তারা পরিচিতি লাভ করে ‘মুসলিম ব্যাটালিয়ন’ (Мусульманский батальон) নামে।
১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল আফগান সেনাবাহিনীর একদল সোভিয়েত–প্রশিক্ষিত মার্ক্সবাদী কর্মকর্তা এবং আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট দল ‘আফগানিস্তান জনগণতান্ত্রিক দল’ (People’s Democratic Party of Afghanistan, ‘PDPA’) আফগান রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ দাউদ খানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। পিডিপিএ–এর মহাসচিব নূর মুহাম্মদ তারাকী আফগানিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এবং তার নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশটিতে বৈপ্লবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। আফগান জনসাধারণের সিংহভাগ এসব কর্মসূচির বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তান, ইরান, চীন, পশ্চিমা বিশ্ব ও উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় সহযোগিতায় আফগান ইসলামপন্থীরা দেশজুড়ে বিদ্রোহ করে। আফগানিস্তানের ৮০% ভূমি আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
১৯৭৯ সালের মার্চে হেরাত শহরের জনসাধারণ ও শহরটিতে মোতায়েনকৃত আফগান সৈন্যদল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শহরটিতে সরকারি দলের সদস্য ও সমর্থকদের ওপর গণহত্যা চালায়। আফগান গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এই বিদ্রোহে ইরানের ইন্ধন ছিল এবং ইরানি ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (Islamic Revolutionary Guards Corps, ‘IRGC’) সদস্যরা ছদ্মবেশে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল, যদিও ইরান এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
এমতাবস্থায় আফগান নেতৃবৃন্দের মনে আফগান সশস্ত্রবাহিনীর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয় এবং ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ তারাকী সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনকে সোভিয়েত তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেন সৈন্যদের আফগান সশস্ত্রবাহিনীর উর্দি পরিয়ে আফগান সৈন্যদের ছদ্মবেশে দেশটিতে প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানান। মস্কো কাবুলের এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু আফগান রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সোভিয়েত মুসলিম সৈন্যদের একটি ব্যাটালিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেয়।
১৯৭৯ সালের ২৬ এপ্রিল সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ ডিরেক্টিভ নম্বর ৩১৪/২/০০৬১ জারি করে এবং এতে সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘মূল গোয়েন্দা বিভাগ’ বা ‘গ্রু’ (Главное разведывательной управление, ГРУ)–এর কর্মকর্তা মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সের্গেই কজলভ, যার ছদ্মনাম ছিল ‘কোলেসনিক’, এই বাহিনীটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন কাবুলে গ্রু–এর সিনিয়র প্রতিনিধি।
প্রথম যে ‘মুসলিম ব্যাটালিয়ন’টি গঠন করা হয় সেটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ১৫৪ তম পৃথক স্পেশাল–পার্পাস ডিটাচমেন্ট (154-й отдельный отряд специального назначения)। এটি ‘১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন’ নামে সমধিক পরিচিত। এই বাহিনীটি গঠনের জন্য সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর ‘তুর্কিস্তান সামরিক জেলা’র (Туркестанский военный округ, ТуркВО) ৫,০০০ সেরা সৈন্যকে বাছাই করা হয়, যাদের সকলেই ছিল জাতিগত তাজিক, উজবেক বা তুর্কমেন। এদের মধ্য থেকে সেরা ৫৩৮ জন সৈন্যকে মুসলিম স্পেৎসনাজ গঠনের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। অর্থাৎ, ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের জন্য বাছাইকৃত সৈন্যরা ছিল সেরাদের মধ্যেও সেরা।
এই সৈন্যদের মধ্যে ট্যাঙ্কম্যান, মোটরবাহী রাইফেল ইউনিটের সৈন্য, সীমান্তরক্ষী, প্যারাট্রুপার– সব ধরনের সৈন্যই ছিল। ৫৩৮ জন বাছাইকৃত সৈন্যের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিল জাতিগত রুশ, যাকে একটি বিমান–বিধ্বংসী অস্ত্র চালানোর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। ব্যাটালিয়নের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর হাবিব খালবায়েভ, যিনি ছিলেন একজন জাতিগত উজবেক।
১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন বিভক্ত ছিল ৪টি কোম্পানি এবং ৩টি অতিরিক্ত প্লাটুনে। ১ম কোম্পানির সৈন্যরা ট্র্যাকযুক্ত ‘বিএমপি–১’ সাঁজোয়া যান এবং ২য় ও ৩য় কোম্পানির সৈন্যরা চাকাযুক্ত ‘বিটিআর–৬০পিবি’ সাঁজোয়া যান ব্যবহার করত, অর্থাৎ এই তিনটি কোম্পানি ছিল আর্মার্ড ইউনিট। ৪র্থ কোম্পানি ছিল একটি ওয়েপন্স ইউনিট; এটির অংশ ছিল এক প্লাটুন ‘এজিএস–১৭’ স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চারধারী সৈন্য, এক প্লাটুন ‘লিঙ্কস আরপিও’ ফ্লেমথ্রোয়ারধারী সৈন্য এবং এক প্লাটুন স্যাপার (sapper)। এছাড়া ব্যাটালিয়নটিতে যে অতিরিক্ত তিনটি প্লাটুন ছিল তার একটি ছিল সিগন্যাল প্লাটুন, একটি ছিল ‘জেডএসইউ ২৩–৪ শিল্কা’ বিমান–বিধ্বংসী প্লাটুন এবং একটি ছিল যানবাহন ও বস্তুগত সহায়তা প্লাটুন। ব্যাটালিয়নটিতে একটি চলমান ফিল্ড ড্রেসিং স্টেশনও ছিল, যেটিতে একজন অ্যানিস্থিসিয়া (anesthesia) বিষয়ক ডাক্তার ও একজন সার্জন ছিলেন।
তদুপরি, প্রতিটি কোম্পানিতে একজন করে সামরিক দোভাষী নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রয়োজন ছিল না, কারণ ব্যাটালিয়নটির জাতিগত তাজিক সৈন্যদের সকলেই, উজবেক সৈন্যদের প্রায় অর্ধাংশ এবং তুর্কমেন সৈন্যদের একাংশ ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ছিল, যেটি আফগানিস্তানের প্রধান দুই ভাষার একটি।
আগেই বলা হয়েছে, ‘তুর্কিস্তান সামরিক জেলা’র সেরা সৈনিকদের নিয়ে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়েছিল। ব্যাটালিয়নটি সৃষ্টির পর সৈন্যদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদেরকে প্যারাট্রুপার হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হয় এবং দালান, বিমানঘাঁটি ও পার্বত্য গিরিপথ দখল করা ও শহরাঞ্চলে যুদ্ধ চালানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি সৈন্যকে সাম্বো (самбо) বা সোভিয়েত মার্শাল আর্টে বিশেষভাবে দক্ষ করে তোলা হয় এবং দৌড়ানো অবস্থায় গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া যেসব সৈন্য গ্রেনেড লঞ্চার চালাতো, তাদেরকে ধোঁয়ার মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে ব্যাটালিয়নটির সৈন্যদের আফগান সেনাবাহিনীর উর্দি পরানো হয় এবং তাদের জন্য জাল আফগান পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। অবশ্য পরিচয়পত্রে তাদের আসল নামই দেয়া ছিল, কারণ তাদের নামগুলো ছিল আফগানিস্তানে প্রচলিত। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে মস্কো ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন–সহ আরো ৭টি স্পেৎসনাজ সৈন্যদল আফগানিস্তানে প্রেরণের জন্য গঠন করে, এবং ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন ছিল এই সৈন্যদলগুলোর প্রোটোটাইপ (prototype)।
১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়েছিল আফগান রাষ্ট্রপতি তারাকীর ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য। কিন্তু বাহিনীটিকে আফগানিস্তানে মোতায়েন করার আগেই আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ইসলামপন্থী মিলিট্যান্টরা নয়, নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীরাই তারাকীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আফগান প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরবর্তীতে তারাকীকে হত্যা করা হয়।
আমিনের গৃহীত নৃশংস নীতি আফগান গৃহযুদ্ধকে আরো উস্কে দেয় এবং আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’র ধারণা ছিল যে, আমিন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’র সদস্য। এই সন্দেহের কারণ ছিল– আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছিলেন এবং সেসময় সিআইএ তাকে অর্থসাহায্য করেছিল; এছাড়া আমিন কর্তৃক মস্কোপন্থী তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও পরবর্তীতে মস্কোর অনুরোধ উপেক্ষা করে তাকে হত্যা করা, মস্কোর পরামর্শ উপেক্ষা করে আফগান ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা– এসব বিবেচনা করে কেজিবি প্রধান ইউরি আন্দ্রোপভ সিদ্ধান্ত নেন, আমিন একজন সিআইএ এজেন্ট, যদিও এটি কখনোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।
সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, আমিনকে সরিয়ে তার জায়গায় কম নিষ্ঠুর ও সমঝোতায় আগ্রহী কাউকে কাবুলের ক্ষমতায় বসাতে হবে। এদিকে আমিন বারবার মস্কোকে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন দেশটিতে সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন করার জন্য; তার সম্পর্কে মস্কোর বিতৃষ্ণা তার কতটুকু জানা ছিল সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। এমতাবস্থায় ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পাল্টে যায়। আফগান রাষ্ট্রপতিকে সুরক্ষা দেয়ার পরিবর্তে হত্যা করার জন্য তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা বিমানযোগে আফগানিস্তানের সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত বাগরাম বিমানঘাঁটিতে পৌঁছে। সেখান থেকে তাদেরকে কাবুলে প্রেরণ করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর ৮০,০০০ সোভিয়েত সৈন্য আমুদরিয়া নদী পেরিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ২৭ ডিসেম্বর কেজিবি একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে, যার সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘শ্তর্ম–৩৩৩’ (Шторм–333) বা ‘ঝড়–৩৩৩’। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল আফগান রাষ্ট্রপতি আমিনকে খুন করা।
আমিন তৎকালীন আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নিবাস তাজবেগ প্রাসাদে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। আমিনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী, আফগান জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও আফগান সেনাবাহিনীর প্রায় ২,২০০ সৈন্য এই প্রাসাদটি পাহারা দিত। এই সৈন্যব্যুহ ভেদ করে আমিনকে খুন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই কেজিবি এই অভিযানের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
২৭ ডিসেম্বর রাতে কেজিবির স্পেৎসনাজের ৫৫ জন সৈন্য, ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের ৫২০ জন সৈন্য এবং ৮৭ জন সোভিয়েত প্যারাট্রুপার– মোট ৬৬২ জন সোভিয়েত সৈন্য তাজবেগ প্রাসাদ আক্রমণ করে। আফগান সৈন্যরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে সোভিয়েত সৈন্যরা তিনগুণেরও বেশি সংখ্যক আফগান সৈন্যকে পরাজিত করে এবং রাষ্ট্রপতি আমিনকে খুন করে। ২০০ জনের বেশি আফগান সৈন্য নিহত এবং প্রায় ১,৭০০ আফগান সৈন্য সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়। অন্যদিকে, মাত্র ১৪ জন সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৭ জন ছিল ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সদস্য।
এই অভিযানে সোভিয়েতদের সংশ্লিষ্টতা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। আফগান প্রচারমাধ্যমে ঘোষণা করা হয় যে, একটি আফগান বিপ্লবী আদালতে আমিনকে তাঁর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৮০ সালের ১০ জানুয়ারি ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রত্যাবর্তন করে। সৈন্যদের প্রত্যেককে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়, কিন্তু তাদেরকে এই অভিযান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
আমিনকে সরিয়ে মস্কো আফগানিস্তানের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপ্রধান বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। মস্কোর পরিকল্পনা ছিল– সোভিয়েত সৈন্যরা বছরখানেক আফগানিস্তানে থেকে ইসলামপন্থী মিলিট্যান্টদের পরাজিত করতে আফগান সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করবে এবং এরপর সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু মার্কিন, পাকিস্তানি, ইরানি ও চীনা সহায়তায় আফগান মিলিট্যান্টরা আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পুরো আফগানিস্তানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের ‘ভাল্লুকের ফাঁদে’ আটকা পড়ে যায়।
১৯৮১ সালের অক্টোবরে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নকে আবার আফগানিস্তানে প্রেরণের করা হয়। এই সৈন্যদলটি আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে আফগান মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও অ্যামবুশ (ambush), বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তিরক্ষা অভিযান এবং আফগান পুনর্গঠনের কাজেও অংশগ্রহণ করে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে এই বাহিনীর সৈন্যরা আফগানিস্তানের জৌজ্জান প্রদেশের জার কুদুক অঞ্চলে অবস্থিত মিলিট্যান্টদের ঘাঁটিগুলো দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালের এপ্রিলে তারা জৌজ্জান প্রদেশের সানচারাকা অঞ্চলে মিলিট্যান্টদের দ্বারা অবরুদ্ধ আফগান সরকারি সৈন্যদলকে উদ্ধার করে। ১৯৮২ সালের অক্টোবরে তারা সামানগান প্রদেশের কুলি ইশান অঞ্চলে ২টি মিলিট্যান্ট গ্রুপকে ধ্বংস করে দেয়।
১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাটালিয়নটি মার্মোল উপত্যকায় তাদের সর্বশেষ অভিযানে অংশ নেয় এবং সেখানকার মিলিট্যান্টদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেয়। একই মাসে ব্যাটালিয়নটিকে চূড়ান্তভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আফগান যুদ্ধে ব্যাটলিয়নটির সর্বমোট ৩৪ জন সৈন্য নিহত ও ১ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়।
‘শ্তর্ম–৩৩৩’ অভিযানে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের কৃতিত্বে মস্কোর নীতিনির্ধারকরা মুগ্ধ হয়ে অনুরূপ আরেকটি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর ‘তুর্কিস্তান সামরিক জেলা’ এবং ‘লাল ব্যানার মধ্য এশীয় সামরিক জেলা’র (Краснознамённый Среднеазиа́тский вое́нный о́круг, САВО) মুসলিম সৈন্যদের মধ্য থেকে সেরাদেরকে বাছাই করে নিয়ে গঠন করা হয় ‘২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন’, আনুষ্ঠানিকভাবে যেটির নাম ছিল ১৭৭তম পৃথক স্পেশাল–পার্পাস ডিটাচমেন্ট (177-й отдельный отряд специального назначения)। ব্যাটালিয়নটির সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন ছিল জাতিগত উইঘুর, অন্যরা ছিল তাজিক, উজবেক, কাজাখ ও কিরগিজ জাতিভুক্ত। ব্যাটালিয়নটির কমান্ডার মেজর (পরবর্তীতে কর্নেল) বোরিস কেরিমবায়েভ ছিলেন একজন জাতিগত কাজাখ এবং ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মেলস বেকবোয়েভ ছিলেন একজন জাতিগত কিরগিজ।
ব্যাটালিয়নটিকে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের অনুরূপ কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং এরপর আফগানিস্তানে প্রেরণ করা হয়। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বাহিনীটিকে উত্তর আফগানিস্তানের ফারিয়াব প্রদেশের দারঝোব জেলায় মোতায়েন করা হয়। সেখানে তাদেরকে আফগান পুনর্গঠনের কাজে নিযুক্ত করা হয়। অঞ্চলটির অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল জাতিগত তাজিক ও উজবেক। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন তাদের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মগত সামঞ্জস্যের কারণে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ঐ অঞ্চলের মিলিট্যান্টদের দমন করার জন্য তারা স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে একটি বড় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তদুপরি, তাদের প্রচেষ্টায় এতদঞ্চলের একজন মিলিট্যান্ট কমান্ডার মৌলভি পাহলোয়ান তার দলের প্রায় ১৫০ যোদ্ধাসহ আফগান সরকারি বাহিনীতে যোগদান করেন।
একটি স্পেৎসনাজ ব্যাটালিয়নকে মস্কো কেন সম্মুখযুদ্ধে না নিযুক্ত করে পুনর্গঠনের কাজে নিযুক্ত করল? বস্তুত এটি ছিল আফগান মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক অভিযানের অংশ। এর মাধ্যমে মস্কো প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সোভিয়েত সৈন্যরা আফগান জনসাধারণের সমর্থন লাভে সক্ষম। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন ঐ অঞ্চলটিতে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, যখন বাহিনীটিকে ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়, তখন অঞ্চলটির স্থানীয় নেতারা আফগান রাষ্ট্রপ্রধান কারমালকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন বাহিনীটিকে সেখান থেকে প্রত্যাহার না করা হয়। এমনকি তাঁরা দারঝোব জেলায় জনগণের নিজেদের অর্থে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে ঐ অঞ্চলে রেখে দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন!
১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে মোতায়েন করা হয় কাবুল থেকে ৭০ কি.মি. দূরে পাঞ্জশির উপত্যকায়। এখানে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিলেন বিখ্যাত আফগান মিলিট্যান্ট কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদ। ‘পাঞ্জশিরের সিংহ’ নামে পরিচিত জাতিগতভাবে তাজিক ও ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম এই গেরিলা নেতা ছিলেন আফগান যুদ্ধের সবচেয়ে সফল মিলিট্যান্ট কমান্ডার। তার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারাই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন করে।
১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সোভিয়েত ও আফগান সৈন্যরা পরপর ৬ বার পাঞ্জশির আক্রমণ করে, কিন্তু মাসুদের নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের তারা পিছু হটতে বাধ্য করলেও পুরোপুরিভাবে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। এই অভিযানগুলোতে প্রায় ৩,০০০ সোভিয়েত সৈন্য হতাহত হয়, আর আফগান সরকারি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো বেশি। তদুপরি, প্রায় ১,০০০ আফগান সৈন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও ৯টি ট্যাঙ্কসহ মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যোগ দেয়।
সোভিয়েত সৈন্যরা মাসুদকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে না পারার মূল কারণ ছিল– মিলিট্যান্টদের কাছ থেকে অঞ্চলটি দখল করে নেয়ার পর সোভিয়েতরা আফগান সরকারি সৈন্যদের হাতে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিত, আর এরপর মাসুদের বাহিনী আফগান সরকারি সৈন্যদের হারিয়ে দিয়ে অঞ্চলটি পুনর্দখল করে নিত। মাসুদ দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, একজন সোভিয়েত সৈন্যও পাঞ্জশিরে থাকতে পারবে না!
সোভিয়েতরা মাসুদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এবং ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে পাঞ্জশিরে মোতায়েন করে। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যদেরকে পাঞ্জশিরের সঙ্গে রাজধানী কাবুলকে সংযোগকারী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই পথে অবস্থিত সালাং টানেলের মাধ্যমে মধ্য ও পূর্ব আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহ করা হতো।
মাসুদের যোদ্ধারা বহুবার ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সোভিয়েত সৈন্যরা দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করে এবং মিলিট্যান্টদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অবশেষে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে মাসুদ সোভিয়েতদের সঙ্গে ৬ মাসের জন্য একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং তার বাহিনী সালাং টানেলে সোভিয়েত কনভয়গুলোকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়। ১৯৮৩ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন অঞ্চলটিতে মোতায়েন ছিল। এরপর বাহিনীটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরিয়ে নেয়া হয়। আফগান যুদ্ধে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের মোট ৫০ জন সৈন্য নিহত এবং ২ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়।
২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মেজর বোরিস কেরিমবায়েভ আফগান মিলিট্যান্টদের নিকট পরিচিত ছিলেন ‘কালো মেজর’ (Kara Major) নামে। তাকে মিলিট্যান্টরা একইসঙ্গে সমীহ ও ভয় করত। ১৯৯২ সালে কাজাখস্তানের সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল হিসেবে তিনি অবসর নেন এবং ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেলস বেকবোয়েভ কিরগিজস্তানের সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি কিরগিজস্তানের প্রথম উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরবর্তীতে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কিরগিজস্তানের সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন ‘শ্তর্ম–৩৩৩’ অভিযানে এবং ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন পাঞ্জশির উপত্যকার যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিল। আফগান যুদ্ধের প্রাথমিক বছরগুলোতে এই দুইটি মুসলিম স্পেৎসনাজ সৈন্যদল সোভিয়েত রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে বিপুল রণনৈপুণ্য ও সাহসিকতা দেখিয়েছিল। মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহের সময় মুসলিম সৈন্য ব্যবহারের এই সোভিয়েত ঐতিহ্য মস্কো ধরে রেখেছে। মস্কো যখন চেচনিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ইঙ্গুশ, দাগেস্তানি ও তাতার সৈন্যদের মোতায়েন করে, কিংবা যখন কসোভোর যুদ্ধক্ষেত্রে ইঙ্গুশ শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে, অথবা যখন সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে চেচেন ও ইঙ্গুশ সামরিক পুলিশ পাঠায়, তখন আফগান যুদ্ধক্ষেত্রে সোভিয়েতদের মুসলিম স্পেৎসনাজ প্রেরণের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে।