করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের জীবনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কিছু মানুষ এই সময়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঘরে খাবারের অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজের খোঁজে বাইরে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মানুষ পুরো দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে ঘরে বন্দী আছে। এরই মধ্যে মুসলিমদের সিয়াম-সাধনার রমজান এসেছে। এই রমজান বিগত বছরগুলো থেকে ভিন্ন। রেস্তোরাঁতে নেই ইফতার কিংবা সেহরির ভিড়, শপিং মলগুলোতে নেই কেনাকাটার হিড়িক। যারা ঘরে দিন কাটাচ্ছেন, তারা রমজান মাসে আল্লাহর ইবাদত করা সহ আরো কী গঠনমূলক কাজ করে সময় ব্যয় করতে পারেন, সে ব্যাপারে আলোচনা করব এ লেখায়।
সময়ের সঠিক ব্যবহার
সময়টা এখন কিছুটা কঠিন। টিভি, পত্রিকা, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে করোনাভাইরাসের খবর ভাসছে প্রতিনিয়ত, যা মনকে করে তোলে উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় সামাজিক মাধ্যম পরিত্যাগ মনকে কিছুটা চিন্তামুক্ত করে তুলতে পারে। যদি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা সম্ভব না-ও হয়, তবু রুটিন করে ফেলুন সকাল-বিকাল এবং রাতে ১০ মিনিট করে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট সামাজিক মাধ্যমের জন্য ব্যয় করবেন।
ইসলামের পথে সময় ব্যয় করার সঠিক সময় রমজান মাস। নিয়ম করে ফেলুন, প্রতিদিন ইসলাম সম্পর্কিত নতুন কিছু শিখবেন। হতে পারে নতুন কোনো একটি দোয়া কিংবা নতুন একটি হাদীস। যা শিখবেন, তা অন্যের সাথেও ভাগ করে নিন।
ডিজিটাল এ যুগে বই পড়ার অভ্যাসটি হারিয়ে যেতে বসেছে। চাইলে পুরনো বইগুলো ঘেঁটে পছন্দের বইটি আবার পড়তে পারেন। অথবা পছন্দের বিষয়ের কিংবা পছন্দের লেখকের নতুন কোনো বই কিনে পড়তে পারেন। অনলাইন কেনাবেচার যুগে বই অর্ডার দিলেই আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। নিজে পড়ুন, পরিবারের সদস্যদেরও বই পড়তে উৎসাহ দিন।
পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনুন
মনে পড়ে, ছোটবেলায় নিজের হাতে ঈদকার্ড বানাতেন? মনে এক পশলা আনন্দ বয়ে যেত ঈদকার্ড বানানোর পর নিজের প্রতিভা দেখে। পরিবার, আত্মীয় কিংবা বন্ধুরা যথেষ্ট খুশিও হতো সে ঈদ কার্ড পেয়ে। এ আনন্দ টাকা দিয়ে কেনা যায় না। আরেকবার ফিরিয়ে আনুন না নিজের শৈশবকে! এবার ঈদে নিজের হাতে ঈদকার্ড বানিয়ে শুভেচ্ছা জানান আপনার আশেপাশের মুখগুলোকে।
আরেকটি হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ডায়েরি লেখা। কোয়ারেন্টাইনে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করুন ডায়েরিতে। এ ঘটনাগুলোই একসময় স্মৃতি হয়ে আসবে আপনার কাছে। হয়তো তখন আপনি অনেক সম্পদশালী, কিন্তু বেঁচে থাকলে বিশ বছর পর ডায়রিটি যখন পড়বেন, নিজের অজান্তেই বলে উঠবেন,
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!”
বদভ্যাস পরিহার
সিগারেট খেতে মন চাইছে? আপনার পরিবারের পাশের মানুষটির দিকে তাকান। সেই মানুষটি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করে। সিগারেট ক্যান্সারের কারণ, একথা তো সিগারেটের প্যাকেটেই লেখা থাকে। এছাড়াও হয়তো খুব মন চাইছে চায়ের দোকানে কিছুক্ষণের জন্য আড্ডা দিতে যেতে, কিন্তু এখন সেই দোকানের আড্ডাটি হতে পারে করোনা সংক্রমনের একটি জায়গা। একটুখানি মনোবল সৃষ্টি করেই আপনি পারবেন পবিত্র এ মাসে এই আত্মধ্বংসাত্মক অভ্যাসগুলো পরিহার করতে।
গীবত বা অন্যের অবর্তমানে তার বদনাম করা থেকে বিরত থাকার সঠিক সময় এখন। মূলত অন্যকে নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি হয় যখন দুই বা তার বেশি মানুষ একত্রিত হয়। হোম কোয়ারেন্টাইনের এ সময়ে পরিবার ব্যতীত অন্য মানুষের সাথে খুব কমই দেখা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় এ অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে পারলেই হয়ে যাচ্ছে, কারণ বাইরের মানুষের সাথে আপনি এখন মিশছেন না। এতে করে আস্তে আস্তে অভ্যাসটি একেবারেই চলে যেতে পারে।
ছোটদের সময় দেয়া
বাইরের জরুরি কাজে আপনি যার বা যাদের দিকে সবচেয়ে কম মনযোগ দিয়ে থাকেন, তারা হলো পরিবারের ছোট সদস্যরা। এ সময় তাদের পড়াতে সাহায্য করুন, তাদের সাথে গল্প করুন, নবী, খলিফা ও সাহাবীদের গল্প পড়ে শোনান। ইফতারের আগে খেজুর গুনে সংখ্যা শেখাতে পারেন, চাল কিংবা মুড়ি গুনে নামতা শেখাতে পারেন। সুর করে পড়ে আরবি হরফ শেখান, সূরা শেখান। ছোট্ট একটি জায়নামাজ কিনে দিন, নামাজ পড়তে না জানলেও নামাজে উৎসাহিত হবে।
ব্যায়াম
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে ব্যায়াম করা প্রয়োজন। এসময় নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে হলেও কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। ফজরের নামাজের পর ভোর বেলা কিংবা ইফতারের আগে বিকেলবেলা ছাদে হাঁটতে পারেন। ইউটিউব দেখে যোগব্যায়ামও করা যায়। কোনো অবস্থাতেই নামাজ পরিত্যাগ করবেন না। নামাজের ফলে শরীরের ব্যায়াম হয়। নামাজ মনকে প্রশান্তও করে।
সম্পর্ক মজবুত করা
দ্রুতগতির এই জীবনে কাজের ফাঁকে যা সবচেয়ে অবহেলিত, তা হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্ক। ভেবে দেখেছেন কি, অবস্থা স্বাভাবিক হলে আবার কবে পরিবারের সাথে এভাবে সময় কাটাতে পারবেন? উপভোগ করে নিন প্রত্যেকটি দিন, প্রত্যেকটি মিনিট, প্রত্যেকটি সেকেন্ড। ইফতারের টেবিলে বাবার প্লেটে খেজুর তুলে দিন, মায়ের কাছে নানাবাড়ির গল্প শুনুন, জীবনসঙ্গীর সাথে হাসুন, সন্তানকে নিয়ে খেলুন। সবার সাথে যত পারুন, মন খুলে হেসে নিন। এমন সময় সবসময় আসবে না, এই সময়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে বরং শাপেবর ভেবে কাজে লাগান সবটা অবসর। টেলিফোনে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কথা বলুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আত্মীয়তার দূরত্ব লাঘব করুন।
দানে দায়মুক্তি
কখনো ভেবেছেন কি, প্রতিদিন অফিস যাওয়ার পথে যে শিশুটি ফুল বিক্রি করত, আজ তার কি অবস্থা? এমন হাজারো দরিদ্র শিশু কিংবা অসহায় মানুষের জন্য আপনার কিছুটা সাহায্য অনেক গুরুত্ব বহন করতে পারে। এক কাজ করে দু’রকম লাভ পেতে কে না ভালোবাসে? আপনার সাহায্যে অসহায় মানুষের পেটে দিতে পারেন খাবার, মুখে ফোটাতে পারেন হাসি; আবার রমজান মাসে এই দানের বদলে আল্লাহ আপনাকে উপহার দেবে অন্য সময় থেকে বেশি সওয়াব। বড় কিছু না হোক, অন্তত অফিসে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকা রিকশা ভাড়াটাই ব্যয় করুন ওদের পেছনে।
নিজের হাতে সাহায্য করতে ভাইরাস সংক্রমনের ভয়? সাহায্য করতে মোবাইল ফাইন্যান্সিং সার্ভিসগুলোর সাহায্য নিন, অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোর মাধ্যমে আপনি সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আপনার সাহায্য পাঠাতে পারবেন। যাকাত দিন যাদের প্রয়োজন, তাদেরকে; খোঁজ নিন আপনার বাসায় কাজ করা মানুষটি কিংবা অফিসের পিওনটির সাহায্য দরকার কি না। আপনার যাকাতের হক কিন্তু আপনার কাছের মানুষেরই সবচেয়ে বেশি। নিকটাত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর দায়িত্ব সবার আগে নিন। এভাবে প্রত্যেকে যদি নিজেদের কাছের অসহায় মানুষের দায়িত্ব নিই, তাহলে আর একটি মানুষও থাকবে না ক্ষুধার্ত।।