ধরুন, আজ আপনি আয়োজন করে বাতি নিভিয়ে বেশ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন। চোখ বন্ধ করে ভাবছেন, “গোল কোরো না গোল কোরো না, ছোটন ঘুমায় খাটে!” যে করেই হোক কাল ভোরে উঠতেই হবে, ধরতে হবে জরুরি কোনো ক্লাস বা মিটিং। কিন্তু তবু মাথার ভেতর কে যেন উচ্চৈঃস্বরে গোল করেই চলেছে।
“আচ্ছা, একটু আগে যে বন্ধুর পোস্টে কমেন্ট করে এলাম, একটুখানি দেখে আসি তো সেখানে কী কথাবার্তা চলছে? আর ওই যে, ইন্সটাগ্রামের ওই পোস্টেই বা লাইক-কমেন্টের কী অবস্থা? আচ্ছা, অমুক বন্ধুর সাথে স্ন্যাপচ্যাটের স্ট্রিক ভেঙে গেল না তো আবার?”
হাত বাড়াতেই পেয়ে গেলেন সাধের স্মার্টফোনটি, যেন আপনার অপেক্ষাতেই গাইছিলো, “দাও সাড়া দাও, এইদিকে চাও, এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।” কী, মিটিমিটি হাসছেন তো? এর পরের গল্পটা আশা করি আপনার জানাই আছে, ফোন থেকে চোখ তুলে চাইতেই দেখলেন, “ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে!”
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন এমনটি হচ্ছে? কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনবরত আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন ‘সুখের ডোজ’ (DOSE– ডোপামিন, অক্সিটোসিন, সেরাটোনিন, এন্ডোরফিন), আর আপনার হাতের কাছে থাকা স্মার্টফোন প্রতিনিয়ত সেই কাজটি আরো সহজ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি কর্টিসল আর মেলাটোনিনের সাথে আপনার নিত্যদিনকার যুদ্ধ তো রয়েছেই।
এতক্ষণ যে নামগুলো বললাম, সেগুলো আমাদের অতি পরিচিত কিছু হরমোন। হরমোনের বৈজ্ঞানিক আলাপচারিতায় মাথা না দিয়ে চলুন একে মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রার সাথে তুলনা করি। মন দিয়ে শুনলে অর্কেস্ট্রার প্রতিটি সুর-তাল-লয় যেমন আলাদাভাবে চেনা যায়, তেমনি এদের একত্র ঐকতানও বড় মোহনীয় লাগে। একইভাবে প্রতিটি হরমোনই তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আপনার সম্পূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে। আবার অর্কেস্ট্রার একটিমাত্র সুরও যদি কেটে যায়, পুরোটাই শ্রুতিকটু মনে হবে, হরমোনের বেলাতেও তা-ই।
এবার আসুন জেনে নিই, আপনার স্মার্টফোন কীভাবে আপনার হরমোনগুলোকে বিভ্রান্ত করছে।
ডোজের চক্রে ঘুরপাক
“বাহ! আমার ছবিতে দশটি নতুন লাইক। মানুষ আমাকে পছন্দ করছে!”
“হা-হা! তরু আমার পোস্টে এটা কী কমেন্ট করল? আমাকে তো এর একটা উত্তর দিতেই হবে। বেশ মজা হবে মনে হচ্ছে!”
“আরে বাহ! আমার প্রিয় স্যার আমাকে রি-টুইট করেছেন!”
এমনভাবেই আপনি হারিয়ে যাচ্ছেন ডোপামিনের সাগরে, অক্সিটোনিনের মিথ্যা সামাজিক নিরাপত্তার আশ্বাসে, সেরোটোনিনের আত্মবিশ্বাসে আর এন্ডোরফিনের অপার্থিব দুঃখ নিরাময়ের আশ্রয়ে, অর্থাৎ আপনি ঘুরপাক খাচ্ছেন ডোজের চক্রে।
এবার একে একে আসি। ডোপামিনকে বলা যায়, ‘যত পাই তত চাই’ ধরনের হরমোন। অনেকে আবার একে বলে ‘ভালোলাগার হরমোন’। প্রিয় কোনো খাবার খেলে, পছন্দের কোনো পণ্য কেনার পর বা ধরুন, ব্যায়াম করার পর আপনার মনে যে সুখবোধ কাজ করে, তার পেছনে যে হরমোনের হাত রয়েছে, তিনিই এই ডোপামিন। মূলত যে কাজটি আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে, তা আবার করার জন্য ডোপামিন আপনাকে উদ্বুদ্ধ করে।
এবার বোধহয় কিছুটা মেলাতে পারছেন, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এই ডোপামিনের ফাঁদে আপনাকে আটকে ফেলছে? যতবার আপনি লাইক বা রিঅ্যাকশন পাচ্ছেন, ততবার আপনার কাছে তা পুরস্কার বলে মনে হচ্ছে। প্রিয় কোনো মানুষের হাসি মুখের ছবি, অন্যান্য বন্ধুদের থেকে পাওয়া ভালো কোনো কমেন্ট বা ম্যাসেজ- প্রতিবার আপনার মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণ পথগুলোকে উস্কে দিচ্ছে, আর আপনিও ‘আরো চাই, আরো চাই’ চক্রে পড়ে বারবার স্মার্টফোনটি হাতে নিচ্ছেন অথবা চালিয়ে যাচ্ছেন বিরামহীন স্ক্রলিং। ডোপামিনের কী সহজলভ্য আধার!
বিজ্ঞানের ভাষায় ডোপামিন নিয়ন্ত্রিত নিউরনের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ;রিওয়ার্ড প্রেডিকশন এরর এনকোডিং’। আর এই বৈশিষ্ট্যেরই সদ্ব্যবহার করা হয় ক্যাসিনোগুলোতে। অনেকে আবার একে কোকেইন আসক্তির সাথেও তুলনা করেন ।
শুনলে হয়তো অবাক হবেন, মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার সময়কাল এখন গোল্ডফিশের চেয়েও কমে গেছে! এর পেছনে যে আপনার স্মার্টফোনটির কোনো হাত থাকতে পারে, সে সন্দেহ কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মিলিয়ে দেখুন তো, এমন কিন্তু হরহামেশাই ঘটে যে, আপনি কোনো একটি বিষয় পুরোপুরি না পড়েই স্ক্রল করে যাচ্ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন অবাঞ্ছিত তথ্যের সাগরে। ফলস্বরূপ এতসব নিত্যনতুন আর অপ্রোজনীয় ইনপুট নিতে গিয়ে আপনার অপ্রস্তুত মস্তিষ্ক সহজেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।
এবার আসি ডোজের অন্য সদস্যদের কাছে। আপনার মনে বিশ্বাস, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, সামাজিক স্বীকৃতি এই অনুভূতিগুলোর জন্ম দেওয়ার জন্য দায়ী হরমোন হলো অক্সিটোসিন। কাউকে সাহায্য করলে আপনার মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি কাজ করে, তা-ও এই অক্সিটোনিনেরই কাজ।
আপনি ধরে নিচ্ছেন, যত বেশি লাইক-কমেন্ট, তত বেশি আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, কিংবা কেউ আপনাকে ট্যাগ করলে আপনার মনে হচ্ছে, “আহা, আমি কত জনপ্রিয়!” কিংবা “আমি কি হনু রে!”– এসবের নাটের গুরু কিন্তু সেরাটোনিন। বলা হয়ে থাকে, আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন আপনার শরীরে সেরাটোনিনের মাত্রা অন্যান্য দিনের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি থাকে। কী, মেলাতে পারছেন তো?
অন্যদিকে, এন্ডোরফিন হলো ‘একের ভেতর দুই’ হরমোন, একইসাথে দুঃখ উপশমকারী এবং সুখবর্ধনকারী। কর্টিসোলের সাথে এর আবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে।
কর্টিসোল, মানসিক চাপ এবং নোমোফোবিয়া
ধরুন, আপনি কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছেন। কিছুদূর যেতেই পকেটে বা ব্যাগে হাত দিয়ে বারবার দেখে নিচ্ছেন, ফোন ঠিকঠাক আছে তো? কিংবা বাড়িতে থাকলেও একটু পরপরই মনে হচ্ছে, ফোনটা যে কোথায় রেখেছি? ফোনের সাথে আপনার যেন একেবারে দহরম-মহরম সম্পর্ক। শুধু আপনি নন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষের মনে স্মার্টফোন হারানোর এই আতঙ্ক কাজ করে, বারবারা জেনিংস একে বলছেন নো-মোবাইল-ফোবিয়া বা নোমোফোবিয়া।
আবার ধরুন, কখনো কি এমন হয়েছে, আপনার হঠাৎ মনে হলো ফোন বেজে উঠেছে, বা পকেটে থাকা অবস্থায় মনে হলো ফোন ভাইব্রেট করছে? কিন্তু ফোনখানা হাতে নিয়ে একেবারে বোকা বনে গেলেন, কিছুই তো নেই! হ্যাঁ, আপনি ফ্যান্টম ভাইব্রেশনের শিকার হয়েছেন।
আপনি একটু পরপর নোটিফিকেশন চেক করছেন, সারাদিন আপনার মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছে, “কী জানি কী হয়ে গেলো আমাকে ছাড়াই!”
উপরের প্রতিটি ঘটনার পেছনেই একজন বেশ মনের আনন্দে কলকাঠি নাড়ছেন, তিনিই হলেন কর্টিসোল। কর্টিসোলকে বলা হয় ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ হরমোন, যা মূলত আপনাকে আসন্ন কোনো বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে বা সে পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে, যেমনটি আপনি হয়তো অনুভব করবেন কোনো রাগান্বিত ষাঁড়ের সামনে পড়লে।
কর্টিসোলের উস্কানিতে আপনি স্মার্টফোনটি হাতে নিচ্ছেন আর মুহূর্তেই মানসিক চাপ থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, কারণ এখানেই নিঃসরিত হচ্ছে এন্ডরফিন, আর এভাবেই পূর্ণ হচ্ছে সুখের ডোজ, একইসাথে বাড়ছে স্মার্টফোনের প্রতি আপনার আসক্তি।
এখানেই শেষ নয়, মরার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ে তখন, যখন আপনি দেখলেন কোনো খারাপ খবর, বা অফিসের বসের কোনো ই-মেইল, যেগুলোতে আপনার মানসিক চাপ এবং কর্টিসোলের নিঃসরণ উভয়ই বাড়ছে বৈ কিছু কমছে না। ধরুন, আপনি গড়ে চার ঘণ্টারও বেশি সময় স্মার্টফোনের পেছনে ব্যয় করেছেন। আর এত সময় ধরে এভাবে কর্টিসোলের ক্রমাগত ওঠানামার ফলে আপনি বিষণ্নতা, স্থূলতা, স্মৃতিভ্রংশ, উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, বিপাকীয় জটিলতা এবং হৃদরোগসহ আরো নানা রকম রোগকে একটু একটু করে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
দু’চোখে ঘুম আসে না!
আপনি এদিকে কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না আর ওদিকে হতভাগা মেলাটোনিন মাথা চাপড়ে মরছে, কারণ তার নিঃসরণের হার যে কমে গিয়েছে। অনেক রকম কাজের মধ্যে মেলাটোনিনের একটি কাজ হলো আপনার ঘুমের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাতের বেলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই মেলাটোনিন নিঃসরণের হার বেড়ে যায়, যা আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করে।
স্মার্টফোন থেকে নির্গত হয় ব্লু-লাইট বা উচ্চ শক্তির দৃশ্যমান আলো। আপনার মস্তিষ্ক একে দিনের আলো ভেবে ভুল করে। সেইসাথে মেলাটোনিন নিঃসরণের হার কমিয়ে দেয়, আর আপনি ভোগেন নিদ্রাহীনতায়। শুধু তা-ই নয়, ফোন থেকে যে তড়িত-চুম্বকীয় রশ্মি নির্গত হচ্ছে, তা-ও কিন্তু অনেকরকম হরমোনের চক্রকেই বিপর্যস্ত করতে পারে।
তাহলে উপায়?
সবই তো বোঝা গেল, কিন্তু ফোর-জি থেকে ফাইভ-জি’তে উত্তরণের এ যুগে স্মার্টফোন ছাড়া আমরা তো প্রায় অচল। এক্ষেত্রে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি:
- বিভিন্ন ট্ট্যাকিং অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সহজেই যাচাই করে নিতে পারেন, দিনে ঠিক কত ঘণ্টা আপনি স্মার্টফোনের পেছনে ব্যয় করছেন। এখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, স্মার্টফোনে একটি ই-বুক পড়া আর ফেসবুকে অহেতুক স্ক্রলিং করার মধ্যে কিন্তু বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই চেষ্টা করুন, প্রতিদিন অল্প অল্প করে অপ্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে স্ক্রিনিং এর সময়টা কমিয়ে আনতে।
- নিজেই খেয়াল করুন, কোন অ্যাপ্লিকেশন আপনার মেজাজের উপর কীরকম প্রভাব ফেলছে। সে অনুযায়ী ছাঁটাই করুন আতঙ্ক উত্তেজক অ্যাপগুলোকে।
- যে ওয়েবসাইটগুলোতে অকারণে বেশি সময় কাটাচ্ছেন, সেগুলোতে ব্যবহার করতে পারেন বিভিন্ন রকম ওয়েবসাইট ব্লকার। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অ্যাপেও রয়েছে স্ক্রিনিং সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা উপায়।
- জরুরি ই-মেইল ছাড়া বন্ধ করে রাখুন অন্যান্য অহেতুক নোটিফিকেশনের শব্দ কিংবা পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড নোটিফিকেশন সিস্টেমকে।
- প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা, কিংবা সপ্তাহে অন্তত একদিন স্মার্টফোন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে চেষ্টা করুন। এতে আপনার কর্মোদ্দীপনা বাড়বে বহুগুণে। কাজটি কিন্তু একেবারেই সহজ, আপনি চাইলেই স্মার্টফোনটি বাড়িতে রেখে দৈনিক এক ঘণ্টা হাঁটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে পারেন অথবা করতে পারেন মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম। খাবার টেবিলে, পারিবারিক আলোচনায় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় স্মার্টফোন বর্জন করুন।
- যথাসম্ভব চেষ্টা করুন আপনার দিনের শুরু এবং শেষ যেনো স্মার্টফোনের সাথে না হয়। ঘুমাতে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই ফোনটিকে হাতের নাগালের বাইরে কোথাও রেখে দিন।
আপনার বুদ্ধিমত্তাকে আপনার বিরুদ্ধে নয়, বরং আত্মোন্নয়নে কাজে লাগান। স্মার্টফোনটি হাতে নেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবুন, আপনি কি আসলেই আপনার মূল্যবান সময়ের যথাযথ ব্যবহার করছেন?