২৫শে মার্চ কী হয়েছিল? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পুরো বাংলাদেশে নির্মমতার স্টিম রোলার চালিয়েছিল, তা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট থাকলেও অন্দরমহলে কী ঘটেছিল, এ নিয়ে অনেক অস্পষ্টতা বিদ্যমান পর্যাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্তের অভাবে। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট কেন হয়েছিল, কেনই বা তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, তখনকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব।
২৫শে মার্চের প্রেক্ষাপট
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬০ আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লিগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি ছিলেন না। একাত্তরে মার্চের ৩ তারিখে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন ঢাকায়। কিন্তু মার্চের ১ তারিখে বেতার বার্তায় সুর পরিবর্তন করে তিনি অধিবেশন স্থগিত করেন। ফলে সারা বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২ ও ৩ তারিখে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে সংঘর্ষে অনেকে আহত হন।
এদিকে আইয়ুব খানের আদেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলায় প্রচুর পরিমাণে সেনা আসা শুরু করে। তিনি টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৭০ সালে বেলুচিস্তানে নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে কুখ্যাত ছিল টিক্কা খান। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু দাবি জানান,
“সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে বেসামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে।”
এ ঘোষণার পর ৪ মার্চ আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেন। ৬ই মার্চে ইয়াহিয়া বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু করার ঘোষণা দেন পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য। তার অধিবেশন ডাকার উদ্দেশ্য ছিল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্ধারিত ভাষণ ঠেকানো। ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন এই বলে,
“৭ মার্চের ভাষণে এমন কিছু বলবেন না যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় থাকবে না এবং যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তাহলে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঢাকা শহর গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।”
ছাত্রনেতারা চাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু যেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ রাজি ছিলেন না। কারণ বঙ্গবন্ধুর কথা স্পষ্ট ছিল, তিনি বাস্তিল দুর্গের বিপ্লবের মতো শুধু শুধু প্রাণহানি এবং ব্যর্থ বিপ্লবের খলনায়ক হতে চান না।
দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও অযথা প্রাণহানি এড়ানোর জন্য তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তবে বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে বলেন,
“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”
লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই ঘোষণা দেন,
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বস্তুত, এই উক্তিগুলোর মাধ্যমে তিনি প্রছন্নভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। এ ধরনের বক্তৃতা দেয়ার পরে আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কারণ জনগণ এর অন্তর্নিহিত বার্তা বুঝে নিয়েছিল। পুরো দেশ অচল করে দিয়েছিল জনতা ৭ মার্চের ঘোষণার পর থেকে। এরপর ১২ মার্চ পাকিস্তানের এক সামরিক কর্মকর্তা ঢাকায় এসে তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেনের সাথে আলোচনা করেন টিক্কা ও ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় বসা নিয়ে। ৭ মার্চের ঘোষণার পর কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুরো দেশ চলতে থাকে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঠিকঠাক যাতে চলে সেজন্য বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ ৩৫টি বিধি জারি করেন। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন।
১৬ মার্চ থেকে ২০ মার্চ একটানা ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লিগের নেতাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সেসব আলোচনা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছাড়াই অমীমাংসিত থেকে যায়। ২১ মার্চ সন্ধ্যায় ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ২২ মার্চ ভুট্টো ও ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসেন। কিন্তু আবারও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়ে যায়। এদিকে গোপনে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে পাকিস্তানী সেনারা বেসামরিক পোশাকে অনবরত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করতে থাকে এবং অনবরত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রের চালান আসতে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরে। এদিকে বারবার আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় ২২ মার্চের পরে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা হয়নি।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তান বেতারে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়নি। এদিন সকাল ৯টা ২০ মিনিটে পল্টন ময়দানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করে বুঝিয়ে দেন, বাঙালির মুক্তি আসন্ন।
২৩ ও ২৪ মার্চে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সাথে আওয়ামী লিগের নেতাদের চিঠি চালাচালি ও বৈঠক হয়। কিন্তু পাকিস্তানীরা কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিল না। তাই কোনো দফারফা ছাড়াই আলোচনা আবার ভেস্তে যায়। আসলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে নীরবে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গণহত্যার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মার্চের ২৪ তারিখে ইয়াহিয়া টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে নির্দেশ প্রদান করেন অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার জন্য। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে পাকিস্তান চলে যান অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার আগে।
২৫শে মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা
২৩ তারিখ থেকেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সিরাজুল আলম খানকে ২৪ মার্চ একান্তে কাছে ডেকে নিয়ে বলেন,
“ইয়াহিয়া আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে, ওরা আগামীকাল রাতেই আক্রমণ করবে, প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যেন শক্তিশালী হয়। কাউকে বলিস না, আমি বাসাতেই থাকব। আমাকে না পেলে ওরা উন্মাদের মতো আচরণ করবে, আর সে সুযোগে আমাকে মেরে ফেলবে।“
বঙ্গবন্ধু গণহত্যার প্রস্তুতি আঁচ করে ২৪ মার্চ থেকেই আওয়ামী লিগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল নেতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন।
২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার ২-৩টি খসড়া তৈরি করেন এবং সিরাজুল আলম খান ও তাজউদ্দিনের সাথে আলোচনা করে স্বাধীনতার ঘোষণা চূড়ান্ত করেন। ২৪ মার্চ রাও ফরমান আলী লে. কর্নেল এ জেড খানকে ২৫ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশে রেকি করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এরপর তাঁর বাড়িতে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি বুঝে পুলিশের সাহায্যে ওয়ারলেস ব্যবহার করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। ঘোষণাটি ছিল,
“The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours. Insha Allah. Joy Bangla” Mujibur Rahman
(“শত্রুরা আমাদের আঘাত করেছে। আপনারা পাল্টা আঘাত করুন। ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।” মুজিবুর রহমান)
সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ২৬ মার্চ ভোর ৫টা পর্যন্ত লালবাগ থানার ওসির রুমে ছিলেন এবং সেখান থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেন। এরপর থেকে শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আরেকটি স্পষ্ট তথ্য জানা যায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে, তার ভাষ্য অনুযায়ী,
“১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছিল আমাদের বাড়ি। রাত ১২-৩০ মিনিটে আব্বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দেন। আর সেই খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেওয়া হলো পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। এ খবর পাকিস্তানী সেনাদের হাতে পৌঁছাল। তারা আক্রমণ করল বাড়িটিকে। ১টা ৩০ মিনিটে তারা আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আজো মনে পড়ে সেই স্মৃতি। লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণে যে দরজা, তার পাশে যে টেলিফোন সেটটি ছিল, ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছেন। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর, গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহীত হওয়ার পর এক ভাষণে শেখ মুজিব ২৫শে মার্চ রাতের কথা স্মরণ করে বলেন,
“যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার আর সময় নেই এবং আমার সোনার দেশকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে, তখন আমার মনে হলো, এই বুঝি আমার সময় শেষ। তখন আমি বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম, কেমন করে বাংলার মানুষকে এ খবর পৌঁছিয়ে দিব এবং আমি তা দিয়েছিলাম তাদের কাছে।”
এম আর আখতার মুকুল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও কথক ছিলেন। তার ভাষ্যমতে,
“২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি টেলিফোনে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে জানান। সেখান থেকে এটি চট্টগ্রামের এম এ হান্নান এর কাছে পৌঁছায়, যা তিনি বেতারে পাঠ করেন”
চট্টগ্রামের আওয়ামী লিগ নেতা এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ ও ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এ বার্তা ছিল গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশের জনগণের কাছে শেষ বার্তা বা স্বাধীনতার ঘোষণা। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর আদেশে বাংলার জনসাধারণ যার যা কিছু ছিল, তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার্থে।
অপারেশন সার্চলাইট
বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খান ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর নির্দেশে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে।
পাকিস্তানী প্রশাসন কোনো পাল্টা আক্রমণের যাতে শিকার হতে না হয়, সেজন্য মার্চ মাসের শুরু থেকেই বাঙালি সেনা ও পুলিশদের নিরস্ত্র করা শুরু করে। অনেক বাঙালি সেনাকে ছুটিতে পাঠানো হয় এবং পাকিস্তানে বদলি করা হয়। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করে প্রস্তুতি শুরু করা হয় পাশবিক তাণ্ডব চালানোর। পাকিস্তানী সেনারা ১১টা ৩০ মিনিটে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ফার্মগেটে মিছিলরত বাঙালিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা করে।
হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ করে ছাত্র–শিক্ষকদের চিরতরে স্তব্ধ করা এবং ঢাকা শহর গুঁড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া।
আক্রমণের প্রথম হিটলিস্টে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এরা কারফিউ জারি হওয়ার সাথে সাথে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং হলগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল,এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু।
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব ও শাহ চিশতী হেলালুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে কেন্দ্র করে। তাই অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। হলটি নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ৭ জন শিক্ষকসহ প্রায় ২০০ জন ছাত্র-কর্মচারীকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলিগ নেতা শাহ চিশতী হেলালুর রহমানকে হলের ২১৫ নম্বর রুমে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
এরপরে হানাদার বাহিনী জগন্নাথ হলে মর্টার আক্রমণ চালায়। সেই সাথে চলতে থাকে অনবরত গুলিবর্ষণ। জগন্নাথ হলের উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে প্রায় ৪১ জন ছাত্র ও ২১ জন কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। হানাদার বাহিনী শহিদুল্লাহ হল এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রবেশ করে অগণিত ছাত্র ও কর্মচারীদের হত্যা করে। রোকেয়া হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা আক্রমণ করে হল কোয়ার্টারের ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। অপারেশন সার্চলাইটে সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
এরপর পাকিস্তানী সেনারা রাজারবাগ পুলিশলাইনে আক্রমণ করে অগণিত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। সেখান থেকেই পাকিস্তানী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ শুরু হয়। কিন্তু রাজারবাগ পুলিশলাইনের পুলিশেরা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি পাকিস্তানীদের আধুনিক অস্ত্রের অনবরত আক্রমণের মুখে।
পুরো ঢাকা শহরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাণ্ডবলীলা চালায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুরো ঢাকাকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করে। তারা ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়। এতে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি শহীদ হয়। ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের তত্কালীন সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মতে,
২৫শে মার্চ রাতে ইকবাল হলের ২০০ ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় শিক্ষক ও তাদের পরিবারের ১২ জন নিহত হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত হয়। পুরোনো ঢাকায় পুড়িয়ে মারা হয় ৭০০ লোককে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে ঐ রাতে শুধু ঢাকায় ৭ হাজার বাঙালি নিহত হয়।
২৫শে মার্চ টিক্কা খান তার পরিকল্পনা সফল করতে পুরো ঢাকা শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, হাজার হাজার মানুষের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছিল। বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা থেকে বাংলার কসাই হয়ে আরেকটি বিদ্রোহ দমনের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল হয়তো, তার সাথে ইয়াহিয়াও। কিন্তু টিক্কা খানেরা জানতো না, বাঙালি দমে যাওয়ার পাত্র না। ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’- এ চেতনা হাজার বছর ধরে বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত।
২৫শে মার্চের নির্মম গণহত্যা সত্ত্বেও বাংলার বিপ্লবী জনতা টানা ন’মাস মাটি কামড়ে লড়াই করে পাকিস্তানীদের সমুচিত জবাব দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিল। পৃথিবীতে কোনো দেশ এত তাড়াতাড়ি জন্মযুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনতে পারেনি। মূলত ২৫শে মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইট বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়াকেই যেন ত্বরান্বিত করেছিল।