ব্যস্ততার হাজারটা প্রহরশেষে মানুষ একটুখানি নিজের মতো করে কিংবা নিজের ভালোলাগাতে ডুবতে চায়। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সে সুযোগ মেলে খুব কমই। ধর্মীয় উৎসব বা বছর শেষের ধরনভেদে কিছু ছুটিতে যেটুকু সময় মেলে হৈ-হুল্লোড়ে কাটানোর, তাতেই সন্তুষ্টির হাসি আপামর বাঙালির। কিন্তু অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ ছুটি যে বাঙালীর মনে বিপরীত প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দেয়, সেটার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে বোধহয় করোনা ভাইরাস।
আমরা যেখানে ব্যস্ততা থেকে বাঁচতে নিত্যনতুন নানান অজুহাতে গা ভাসাই, সেই আমরাই ব্যস্ততায় ফের নাম লেখাতে হাঁসফাঁস করে যাই ক’টা দিন ঘরবন্দি থেকে। তবু সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরবন্দি থাকাটাই এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে কার্যকর উপায়৷ মহামারি আকার ধারণ করা এই ভাইরাস পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষকে ঘরবন্দী করে রাখছে, সামনের দিনগুলোতে অবশ্য এর সুফলও পাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরা। অপ্রয়োজনে চার দেয়ালের বাইরে গিয়ে সেই সুফল পাওয়ার আশায় আমরা যেন জল ঢেলে না দিই।
কী করছেন সারাদিন চার দেয়ালে কার্যত বন্দী থেকে? এমন কিছু নিয়ে আলোচনা করা যাক, যা হয়তো কাজে লেগে যেতে পারে আপনারও।
১. সবার আগে সচেতনতা
করোনা ভাইরাস থেকে নিজে এবং পরিবারকে বাঁচাতে পরিবারের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকরী কিছু ভূমিকা রাখুন। পরিবারের সব সদস্যের ঘরে থাকা নিশ্চিত করুন, একইসাথে উৎসাহিত করুন নিয়ম মেনে সময়ে সময়ে হাত ধোয়া থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত অন্যান্য পরামর্শ মেনে চলায়। প্রয়োজনের তাগিদে বাইরে যেতে হয়ই, তবে সেটা অতি অবশ্যই দিনে একবার হলেই ভালো হয়। খেয়াল রাখবেন, শিশু, বয়স্ক কিংবা অসুস্থ কেউ যাতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আনতে বাইরে না বেরোয়।
সচেতন এবং সতর্ক না থাকলে আমাদের দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, বাইরের দেশের আলোকে বুঝিয়ে বলুন পরিবারের সকল সদস্যকে। আমি আপনি আমাদের এমন পরিবার থেকে পরিবারে যদি পরিস্থিতির ভবিষ্যত ভয়াবহতা বুঝতে এবং বোঝাতে পারি, তবেই এই ভাইরাস মোকাবেলা সম্ভব।
২. পরিবারকে সময় দিন
এই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ছুটি খুব কমই পেয়ে থাকে। আর যেটুকু পাওয়া যায়, সেটাতেও পরিবারের সব সদস্য একসাথে হওয়ার সুযোগ থাকে না নানা কারণে। করোনা ভাইরাস সুযোগ করে দিয়েছে পরিবারের সকলকে এক হওয়ার, একসাথে বেশ কিছুদিন কাটানোর। এই সুযোগটা ছেড়ে পরে আফসোস যেন না করতে হয়, তার জন্য সময়টা পরিবারকে দিতে পারেন। সম্পর্কের টানাপোড়েন বা অযাচিত সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব ঘোচানোর এমন চমৎকার সুযোগ আর পাবেন না হয়তো।
সময় দিন মা-বাবাকে, তাদের সাথে একসাথে টেলিভিশন দেখুন, তাদের ভাবনা জানুন, শুনুন তাদের গল্প। তারা খুব অল্পতেই খুশি হয়ে যান। আপনি তাদের সময় দিচ্ছেন, এটা ভেবে তারা মনে একপ্রকার শান্তি পাবেন। পরিবারের ছোট্ট সদস্যটির প্রতিও নজর দিন, তার নানান বিষয়ের কৌতূহল মেটান, খেলুন তার সাথে। সময়টা আশা করি খারাপ কাটবে না আপনার।
৩. রান্নাঘরটার সাথেও পরিচিত হোন
রান্নাঘরের দায়িত্ব সাধারণত মায়েদের কাছেই থাকে, তারা কি এক দৈব উপায়ে যে রান্নার সকল কাজ সুনিপুণভাবে সামলে যান সে এক রহস্যই বটে। পরিবারের সব সদস্য বাসায় থাকলে এমনিতে মায়েদের কাজের চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ। করোনায় বাসায় থাকার এই দিনগুলোতে মা’কে সাহায্য করতে পারেন রান্নার কাজগুলোয়। ঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এই রোগ থেকে বাঁচার যেহেতু অন্যতম উপায়, নিতে পারেন এই দায়িত্বটাও। ইউটিউব বা রেসিপির বই ঘেঁটে করতে পারেন রান্নাও। এতে করে মায়েদের কষ্ট যেমন কমবে, পাবেন নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদও।
৪. ধর্মীয় বিশ্বাসটাকে করুন মজবুত
আমরা নানান অজুহাতে ধমীর্য় কাজগুলো পালনে অনীহা প্রকাশ করে থাকি হরহামেশাই। ঘরবন্দী থাকার এই দিনগুলোয় অজুহাতের বদভ্যেস থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। যার যার ধর্মীয় রীতি মেনে প্রার্থনা করতে পারেন নিজের জন্য, পরিবারের মানুষগুলোর জন্য এবং দেশটার জন্য৷ প্রার্থনার শক্তি সবসময়ই কাজে লাগে। পরিবারের ছোট্ট সদস্যটিকেও উৎসাহিত করতে পারেন ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়, আপনাকে দেখেই শিখবে সেসব।
৫. বাড়াতে পারেন জানার পরিধি
অবসরের সবচেয়ে সেরা বন্ধু সম্ভবত বই। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে ছোটবেলা থেকেই আমরা নানান ধরনের বই পড়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠি, এতে করে যেমন আমাদের জানার পরিধি বাড়ে, তেমনি মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে অগ্রসর হতে পারি সহজেই৷ বাসায় থাকার এই দিনগুলো তাই কাজে লাগানো যেতে পারে বই পড়ায়৷ তবে একটু কৌশলী হওয়া উচিত বই নির্বাচনে, এতে করে কার্যকরী কিছু উপকারও পেতে পারেন৷ অনেকদিন যদি বই পড়ে না থাকেন, সেক্ষেত্রে শুরু করতে পারেন সহজ ভাষার কিছু গল্প বা উপন্যাসের বই দিয়ে। এতে আপনার বই পড়ায় ধৈর্য বাড়বে।
জানার আগ্রহটাকে যদি বাড়িয়ে তুলতে চান তাহলে তথ্য বা গবেষণামূলক বই পড়তে পারেন। আজকাল অনেককেই অনুপ্রেরণামূলক বই পড়ায় আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়। পড়ার তালিকায় রাখতে পারেন তেমন বইও। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই পড়ে সে জ্ঞানও বাড়াতে পারেন। চাইলে ইংরেজির দক্ষতাও বাড়াতে পারেন ভিনদেশী ভাষার বই পড়ে। নিজের ভালোলাগা বা শখের ব্যাপারগুলো নিয়ে আরও জানতে চাইলে সে ধরনের বইও পড়তে পারেন। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সময়ে এখন ঘরে বসে বিনামূল্যে এই সব ধরনের বই-ই পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করে পড়তে পারবেন মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপে।
৬. মুভি-সিরিজও হতে পারে অবসরের সঙ্গী
বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিনোদন দুনিয়াতেও ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। বইয়ের মতোই এখানেও পরামর্শ থাকবে মুভি কিংবা সিরিজ নির্বাচনে কৌশলী হতে। এখন বাংলাদেশে ভালো ভালো মুভি তৈরি হচ্ছে। সেসব দিয়ে শুরু করে দেখার পরিধি বিস্তৃত করতে পারেন বলিউড, হলিউড কিংবা কোরিয়ান মুভি ইন্ডাস্ট্রির দুনিয়ায়৷ দেখতে পারেন মালায়লাম, তেলেগু, ইরানি, তুর্কি কিংবা অন্য ভাষার মুভি।
৭. বিকশিত হোক আমাদের না দেখা প্রতিভা
আমরা জানি বা না জানি এটা বোধহয় সত্য, আমাদের সবার ভেতরটায় কিছু না কিছু প্রতিভা আছেই। কেউ হয়তো গান গাইতে পারি, সেটা বাথরুমে হোক কিংবা ভরা মজলিসে। কেউবা পারি কবিতা লিখতে, গল্প বলতে। কারো আবার রান্নার হাত ভালো বা কেউ হয়তো পারি ভালো ছবি আঁকতে। ধরনভেদে হাজারও এমন প্রতিভা লুকিয়ে আছে আমাদের মনের গোপন কোণে। সেই প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ নিন এই সময়টাতে।
নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করুন, অবশ্যই ঘরের মধ্যে থেকে। আপনার ভালো লাগার প্রশংসা যখন অন্যরা করবে, দেখবেন মনের মাঝে কেমন একটা সুন্দর অনুভূতির জন্ম হয়। যদি নিন্দাও শুনে থাকেন, সেটা থেকে শিক্ষা নিন, চেষ্টা করুন আরেকটু ভালো করার।
৮. সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও রাখুন মাথায়
আমরা প্রায় সবাই-ই নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে থাকি। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার এই দিনগুলোয় সচেতন থাকতে হবে সেসব ব্যবহারেও। কারো কাছ থেকে পাওয়া কোনো খবর নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র থেকে যাচাই না করে অন্যদের না জানানোই বুদ্ধিমানের পরিচয় হবে। মানুষকে উৎসাহিত করুন সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে। সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন ছিন্নমূল মানুষদের সাহায্যার্থে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে, সামর্থ্যনুযায়ী চেষ্টা করুন সেসবে সাহায্যের হাত বাড়াতে।
আমি আপনি আমরা সবাই মিলেই তো এই বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের মত এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সরকারকে সাহায্য করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাসায় থাকা নিশ্চিত করাই বাঁচাতে পারে হাজারও প্রাণ। ভালো থাকা আর রাখার গল্প বেঁচে থাকুক আরো হাজারটা বছর।