প্রতিদিন কত কিছু করি আমরা! সকালে ঘুম থেকে উঠেই নানা কাজে লেগে পড়তে হয় আমাদেরকে। এসব কাজের মধ্যে আমাদের জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত হয় নানা অভ্যাস। তার কোনো কোনোটি ভালো অভ্যাস, কোনোটি আবার খারাপ।
একদল ব্রিটিশ গবেষক সম্প্রতি ছয় লাখ মানুষের জীবনের বিভিন্ন অভ্যাস ও বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রোগের ইতিহাস নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিনের নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস একটি মানুষের গড় আয়ুতে যোগ করতে পারে বাড়তি কয়েকটি বছর। অর্থাৎ কিছু অভ্যাস মেনে চললে আপনি হয়তো আরো কয়েক বছর বেশি বাঁচবেন। গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন এই অভ্যাসগুলো সম্পর্কে। তাহলে চলুন আজকে আমরা জেনে নেই গবেষণাপত্রে প্রকাশিত সেই সাতটি অভ্যাস সম্পর্কে, আর সাথে থাকছে একটি বোনাস।
১. কখনোই ধূমপান শুরু করবেন না
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যেসব অভ্যাস স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তার মধ্যে প্রথম হলো ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে যারা ধূমপান করেন আর যারা করেন না, এদের মধ্যে যারা ধূমপান করেন তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন।
এক্ষেত্রে দুজনের গড় আয়ুর পার্থক্য খুবই চমকপ্রদ। গড় হিসেবে দেখা গেছে, “দিনে এক প্যাকেট সিগারেট আপনার গড় আয়ু থেকে সাত বছর কমিয়ে দেয়!”– গবেষণার অন্যতম প্রধান উশার ইনিস্টিটিউটের পিটার জোসি জানিয়েছেন এই তথ্য।
তাই আপনি যদি কখনো ধূমপান না করে থাকেন তবে ভবিষ্যতেও কখনো ধূমপান করার কুবুদ্ধি মাথায় আনবেন না।
২. কমিয়ে আনুন কোলেস্টেরল
এই গবেষণায় গবেষকরা মানব শরীরের যে জিনটি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম বেশির উপর ভূমিকা রাখে তার উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষের দেহে এই জিনটি বিদ্যমান তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে। ফলে তাদের গড় আয়ু কিছুটা কমে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন এই কমে যাওয়ার পরিমাণ হলো আট মাস। অর্থাৎ যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তাদের গড় আয়ু স্বাভাবিক মানুষের থেকে আট মাস কমে যায়।
এক্ষেত্রে আপনার শরীরে এই জিনটি আছে কিনা সেটা হয়তো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তবে আপনি খুব সহজেই আপনার খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি খাদ্য খাওয়া এবং চর্বি জাতীয় খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি রোধ করতে পারবেন। ফলে আপনার জীবনে যোগ হবে আরো আটটি মাস!
৩. ঝরিয়ে ফেলুন বাড়তি ওজন
গবেষণার এই পর্যায়ে গবেষকরা সেই সব মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন, যারা তাদের শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে এনেছেন। গবেষণার ফলাফল ছিলো খুবই সুনির্দিষ্ট। দেখা গেছে, প্রতি কেজি ওজন কমানোর ফলে তাদের জীবনের গড় আয়ু বেড়ে গেছে ২ মাস করে। আপনি যদি আপনার শরীরের বাড়তি ওজনের ৬ কেজি কমিয়ে ফেলতে পারেন তবে আপনি আরো এক বছর বেশি বেঁচে থাকতে পারবেন!
তাই এখনি আপনার বর্তমান ওজন মাপুন। দেখুন তা স্বাভাবিক ওজন থেকে বেশি না কম। যদি বেশি হয় তবে আর বসে না থেকে এখনই লেগে পড়ুন ওজন কমানোর কাজে।
৪. ত্যাগ করুন ধূমপান
আপনি যদি একজন ধূমপায়ী হয়ে থাকেন তবে এতদিনে নিশ্চয়ই আশেপাশের লোকজন, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে অনেক বকা খেয়েছেন। সেই সাথে ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি থেকে নিশ্চয়ই ধূমপানের বহু কুফলও জেনে গেছেন। এবার তাহলে একটা বাড়তি তথ্য জেনে নিন।
গবেষকরা পরীক্ষায় দেখেছেন, সকল ধূমপায়ীর জীবনেই এমন একটি সময় আসে যখন সে সম্পূর্ণভাবে ধূমপান পরিত্যাগ করতে পারে। আর এ সময় যদি সে ধূমপান ত্যাগ করতে সক্ষম হয় তবে সে তার জীবনের হারানো সেই সাত বছর (উপরের ১ নং পয়েন্টের) আবার ফিরে পেতে পারবে এবং তার গড় আয়ু একজন অধূমপায়ী ব্যক্তির সমান হয়ে যাবে। তাহলে কবে আসবে সেই মুহূর্তটি? হয়তো সেই মুহূর্তটি আজই, এখনই। যে সিগারেটটি হাতে নিয়ে আপনি এখন এই লেখাটি পড়ছেন সেটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার এখনই সময়। তাই জীবনে যদি বাড়তি সাত বছর বেশি বাঁচতে চান তবে ছুঁড়ে ফেলে দিন হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি।
৫. খুলে দিন মনের জানালা
একটি পুরানো ধারণা কিংবা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে না থেকে বরং খোলা মনের হোন। সব সময় নতুন নতুন জিনিস জানার চেষ্টা করুন। নতুন কিছু দেখার চেষ্টা করুন। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করুন। পুরনো অন্ধ বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কার ত্যাগ করে মনকে করুন আরো বিশাল।
গবেষকরা জানিয়েছেন, সংকীর্ণমনা মানুষের চেয়ে খোলামেলা, হাসিখুশি মানুষেরা বেশি দিন বাঁচেন। তাই আপনি যদি নতুন কিছু করতে ভয় পান কিংবা নতুন কিছু জানার অনাকাঙ্ক্ষা আপনার থেকে থাকে তবে আজই পরিত্যাগ করুন।
৬. উচ্চশিক্ষিত করুন নিজেকে
তথ্যটা হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে, তবে জেনে রাখুন- আপনার উচ্চমাধ্যমিক কলেজে কাটানো প্রতিটি বছরের জন্য আপনি আপনার জীবনে যোগ করেছেন বাড়তি ১১ মাস! না, এটা কোনো বানানো কথা নয়। গবেষকদের করা একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অশিক্ষিত মানুষের থেকে উচ্চ শিক্ষিত মানুষেরা অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলোতে কম জড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষিত মানুষেরা জানেন কোন অভ্যাসগুলি তাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তারা বুঝতে পারেন কী করলে এগুলো ত্যাগ করা যাবে। যেটা অশিক্ষিত মানুষেরা খুব কমই জানতে পারেন। তাই উচ্চ শিক্ষিত করুন নিজেকে। গড়ে তুলুন নানা তথ্যসমৃদ্ধ বই পড়ার অভ্যাস।
৭. কমিয়ে ফেলুন রক্তচাপ
ধূমপানের পর মানুষের মোট গড় আয়ুতে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হলো রক্তচাপ। গবেষকরা দেখেছেন, উচ্চ রক্তচাপ খুব সহজেই আপনার জীবন থেকে গড়ে ৫.২ বছর কেড়ে নিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ রক্তচাপের ফলে আপনি আপনার বাকি জীবনটাই হারিয়ে ফেলতে পারেন যদি আপনার হার্ট এ্যাটাক হয়।
ফলে আপনাকে আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সব সময়। আর এজন্য খাদ্যাভাস পরিবর্তন, ব্যায়ামের পাশাপাশি হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে ওষুধেরও। তাই সকালবেলা হাঁটা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ইত্যাদি অভ্যাস গড়ে তুলুন আজই।
বোনাস: শারীরিক কার্যকলাপে ব্যস্ত রাখুন নিজেকে
ভিন্ন একটি গবেষণায় ব্রিংহাম ইয়ং উইনিভার্সিটির একদল গবেষক ৫,৮২৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক শারীরিক কার্যকলাপের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন।
তারা দেখেছেন যেসব মানুষ প্রতিদিন একটানা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটার মতো কোনো শারীরিক অভ্যাসের সাথে যুক্ত তাদের শরীরের কোষের ‘টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্য’ তাদের থেকে নয় বছর কম বয়সী মানুষের সমান। এখানে ‘টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্য‘ হচ্ছে দেহ কোষের ক্রোমাটিডের এমন একটি অংশ যা মানুষের স্বাস্থ্য ও গড় আয়ুর উপর ভূমিকা রাখে। ফলে আপনি যদি শারীরিকভাবে কর্মঠ হয়ে থাকেন, তবে আপনার জীবনে আপনি যোগ করতে পারবেন আরো নয়টি বছর!
ফিচার ইমেজ – health.havard.edu