Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রিন্স গ্যাব্রিয়েল দা’ন্নুনজিয়ো: সাহিত্যিক, যোদ্ধা এবং ফিউমের রাজা

ইতালির প্রিন্স গ্যাব্রিয়েল দা’ন্নুনজিয়োকে ব্যাখ্যা করতে পারে একটিমাত্র শব্দ- সর্বকর্মা। তিনি ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক, দুর্ধর্ষ বৈমানিক ও প্রেমিক, যোদ্ধা ও সেনাপতি, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও নাবিক এবং মাত্র ষোল মাসের জন্য হলেও ‘একটি ভূখন্ডের অধিপতি’। এক পুরুষে এমন প্রতাপ রীতিমতো বিরল বললেই চলে। ইতালির জনগণের কাছে খ্যাতি আর শৌর্যে হয়ে উঠেছিলেন প্রবাদপুরুষ। ১৮৬৩ সালের দক্ষিণ ইতালির এক ধনী জমিদার বংশে তার জন্ম। 

গ্যাব্রিয়েল দা’ন্নুনজিয়োর সাহিত্য ছিল নিষিদ্ধ ও তুমুল জনপ্রিয়। তিনি নিজেকে খ্যাতির চূড়ায় দেখার স্বপ্নে থাকতেন অধীর। এমনকি, অনেকে বলে, দা’ন্নুনজিয়োর শখ ছিল মৃত্যুর সময় যেন তাকে কামানে পুরে গোলার মতো ছুঁড়ে দেওয়া হয় বা অন্ততপক্ষে এসিডে দেহখানা গলানো হয়। অ্যাডভেঞ্চার আর প্রতিষ্ঠার মোহে অতিষ্ঠ এই প্রিন্সের মৃত্যু হয় ১৯৩৮ সালে, নিজের বিছানায় শুয়ে। 

কবি ও সাহিত্যিক

স্কুলে পড়বার সময়েই কবিতা লিখে নাম কুড়িয়েছিলেন। ইতালীয়দের দুর্ভাগ্য যে দান্তের মতো কবি এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁর জন্ম দেওয়ার পরেও কালক্রমে ঐ নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। রেনেসাঁর কয়েক শতাব্দী পরেও দা’ন্নুনজিয়ো এই শোক ভুলতে পারেননি।

প্রায় দুই দশকব্যাপী সাহিত্যজীবনে ইতালীয় সাহিত্যকে করেছেন গরিমামণ্ডিত। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প আর নাটক। অবশ্য ভ্যাটিকান তার অনেক লেখাই নিষিদ্ধ করে। ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন গ্রীক ও লাতিন সাহিত্য দ্বারা। বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে ইল ফুয়োকো বা অগ্নিশিখা, লে ভার্জিনি দেল্লে রোক্কে, লা জিয়োকোন্ডা আর অসংখ্য কবিতা এবং সনেট। নিটশে, দস্তয়েভস্কির পাশাপাশি ফরাসি আর ইংরেজি শিল্পতত্ত্বের প্রভাব দেখা যায় তার লেখায়। প্রচুর অলংকার এবং জাঁকজমকপূর্ণ ভাষা ছিল তার বৈশিষ্ট্য। ইতালির রুপ-সৌন্দর্য, ব্যক্তিজীবনের প্রেম, ভালোবাসা, ভোগ, বিলাস, ইতালির গৌরব ও দুর্দশা নিয়ে দরদ প্রভৃতিকে আলেখ্য করে অসাধারণ সব সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বহু বছরের জন্য ইতালীয় সাহিত্যের চূড়ামণি হয়েছিলেন তিনি। 

প্রিন্স দা’ন্নুনজিয়ো; Image Source: peoplepill.com

প্রেমিক

দেখতে যে খুব সুদর্শন ছিলেন তা বলা চলে না, বরং উল্টোটাই। ২৩ বছরেই মাথায় পড়েছিল টাক, গোল চোখ দুটির যেন কোটর থেকে ছিটকে পড়ার যোগাড়। কিন্তু এই দা’ন্নুনজিয়োর কবিতা আর বাগাড়ম্বরের চোটে ইতালীয় মেয়েরা হয়েছিল কাতর। তিনি নাকি একসাথে পাঁচটি মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারতেন, পাঁচজনকেই আলাদা চিঠি লিখতেন, এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাঁচটি চিঠির মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সাহিত্য জীবনেও এই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক চরিত্র অংকন করে। প্রেমিকাদের অনেকেই ছিলেন থিয়েটার আর মঞ্চের ডাঁকসাইটে সুন্দরী। 

ইলিওনোরা দুসে ও দা’ন্নুনজিয়ো; Image Source: amillionsteps.velasca.com

বৈমানিক

দা’ন্নুনজিয়ো যে সময়কার মানুষ, তখন বিমানপোতের ব্যবহার সবে চালু হয়েছে। রাইট ভাতৃদ্বয়ের একজন, উইলবার রাইটের সাথে বিমান উড়িয়েছেন। আজকের যুগে স্টান্ট ফ্লাইং যেটাকে বলা হয়, অর্থাৎ বিমান নিয়ে নানারকম উড়ন্ত কসরৎ, দা’ন্নুনজিয়ো সেটার পথিকৃৎদের একজন। এবং মনে রাখতে হবে, সেই আমলে বিমানশিল্প নিতান্তই শিশু, কাজেই দুর্ঘটনার আশংকা ছিল বহুগুণ বেশি। ইতালীয় এই নায়ক অবশ্য ওসবের থোড়াই কেয়ার করতেন। ফলশ্রুতিতে বিমান দুর্ঘটনায় একখানা চোখ হারান। 

ছিলেন সুদক্ষ বৈমানিক; Image Source: newrepublic.com

প্রথম মহাযুদ্ধ

প্রথম মহাযুদ্ধে দা’ন্নুনজিয়ো চেয়েছিলেন ইতালিকে শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশ হিসেবে তুলে ধরতে। দক্ষ বৈমানিক ছিলেন। ১৯১৮-তে খোদ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রাজধানী ভিয়েনার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে লিফলেট ফেলেন ইতালীয়দের বীরপনার বিবরণ দিয়ে। যদিও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির লোকেদের ভাষা ছিল জার্মান। কাজেই ইতালীয় ভাষায় লিফলেটে দা’ন্নুনজিয়োর বাগাড়ম্বর খুব অল্প লোকেই বুঝতে পেরেছিল। 

নৌ সেনা হিসেবেও দা’ন্নুনজিয়ো বেশ তোলপাড় তোলেন। ছোট কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির নৌ অবরোধ ভেদ করে হামলা চালান বাকার বন্দরে। যদিও সামরিক দিক দিয়ে বিশেষ কোনো ক্ষয়ক্ষতি শত্রুপক্ষের করতে পারেননি। তবে যুদ্ধে পর্যদুস্ত ইতালীয়দের জন্য এই দুটি দুঃসাহসিক অভিযান বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। 

ফিউমের রাজা

প্রথম মহাযুদ্ধে ইতালি যোগ দিয়েছিল মিত্রপক্ষে। কিন্তু যুদ্ধে তারা বিশেষ বীরপনা দেখাতে পারেনি। বাড়তি খরচের চাপে উল্টো ইতালিরই দেউলিয়া হওয়ার দশা। যা-ই হোক, যুদ্ধের পর ফ্রান্সে শান্তিচুক্তি হলো, কিন্তু তাতে ইতালির ভাগে কোন শাঁসালো জমি পড়লো না। মিত্রপক্ষ কেবল লিবিয়ার মরুভূমিটা ইতালীয়দের দিল। এই অপমানে ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে দা’ন্নুনজিয়ো লোকলস্কর জোগাড় করে হামলা চালিয়ে বসেন ফিউম বন্দরে। 

সৈন্যদের সাথে প্রিন্স দা’ন্নুনজিয়ো; Image Source: peoplepill.com 

ফিউম প্রাচীন শহর। এর মালিকানা পূর্বে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির হাতে থাকলেও অধিবাসীরা অধিকাংশই ছিল ইতালীয়, কিন্তু শহরটির আশপাশের অঞ্চলে আবার থাকতো ক্রোট, সার্ব আর স্লোভেন জাতির মানুষ। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দখলে থাকা এই শহর নিয়ে প্রচুর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে ফিউমকে যুগোশ্লাভ সাম্রাজ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক করা হয়। 

দা’ন্নুনজিয়ো ততদিনে বিখ্যাত কবি-যোদ্ধা। তিনি দুই-আড়াই হাজার সৈন্য জোগাড় করে ফিউম দখল করে নিলেন, পিছু হটে গেল শহরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মিত্রপক্ষীয় সৈন্যরা। ফিউমকে ইতালীর কার্নেরো রিজেন্সির অন্তর্গত ঘোষণা করলেন দা’ন্নুনজিয়ো, আর দাবি করলেন যেন ইতালীয় সাম্রাজ্যের সাথে একে জুড়ে নেওয়া হয়। 

খোদ ইতালীর রাজা কিন্তু যুদ্ধশেষে, এমন চুক্তির খেলাপ মানতে পারলেন না। দেন-দরবার চালিয়ে ইতালি আর যুগোশ্লাভ সাম্রাজ্য এক চুক্তি করলো, এতে ফিউমবাসীকে পাঁচ বছর সময় দেওয়া হয় আলোচনা চালিয়ে একটা হিল্লে করবার জন্য। দা’ন্নুনজিয়ো আরো উত্তপ্ত হয়ে নিজেকে সার্বভৌম ঘোষণা করলেন। 

দা’ন্নুনজিয়োর নেতৃত্বে ফিউমের ইতালীয়দের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা হলো নতুন সরকার, তার সাতজন মন্ত্রী। অর্থনীতিকে নয়টি ভাগে ভাগ করে সেগুলোর ভার ছেড়ে দেওয়া হয় একেকটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের হাতে। দা’ন্নুনজিয়ো তার সমস্ত  কলাকল্পনা ঢেলে লিখলেন সংবিধান। সংগীতকে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। পাশাপাশি নানা নতুন চিন্তাধারা আর নিয়ম আমদানী করা হয়, যেগুলো পরে মুসোলিনী হুবহু অনুকরণ করেন।

ভূঁইফোড় এই শাসক বেশি দিন টিকতে পারেননি। ১৯২০ সালে ইতালীয় নৌবাহিনীর হামলায় দা’ন্নুনজিয়োর সরকারের পতন ঘটে। তিনি আবার নিজের জমিদারিতে ফেরত যান। বর্তমানে ফিউম ক্রোয়েশিয়ার অন্তর্গত, নাম দেওয়া হয়েছে রিজেকা।  

ফ্যাসিজমের জনক

দা’ন্নুনজিয়ো যতই যুদ্ধ-হাঙ্গামার মধ্যে জড়ান আর যা-ই করেন, তিনি ছিলেন কবি। কাজেই কবি-কল্পনার মিশেল তার চিন্তা-ভাবনায় ছিল প্রকট। রোমক সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব তাকে ভীষণ প্রভাবিত করত। নয়া ইতালিতেও তিনি সেসব প্রথা-প্রচার আমদানির চেষ্টা চালিয়েছেন। ফিউমের শাসনকর্তা থাকবার সময় এসবের প্রচলন হলে পরে মুসোলিনী এগুলো ফ্যাসিস্টদের মধ্যে চালু করেন। ইতালীয় ফ্যাসিস্টদের কালো শার্ট পরা, রোমান কায়দায় স্যালুট দেওয়া এবং ইলিয়াড মহাকাব্য থেকে অ্যাকিলিসের অনুকরণে হুংকার দেওয়া; সবই দা’ন্নুনজিয়োর আমদানি। তবে মুসোলিনীর সাথে তিনি কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে।

১৯২২ সালে মুসোলিনী দলবল পাকিয়ে রোম অভিমুখে মার্চ করলে ইতালিতে তিনিই হর্তাকর্তাবিধাতা হিসেবে একরকম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। সম্রাট তৃতীয় ইমানুয়েল ছিলেন তার হাতের পুতুল। দা’ন্নুনজিয়ো যদিও ফ্যাসিজমের ভক্ত ছিলেন, রাজনীতিতে কিন্তু তিনি মুসোলিনীর পক্ষে বা বিপক্ষে নামলেন না। ১৯২৪ সালে ইতালীর সম্রাট তৃতীয় ইমানুয়েল তাকে ‘প্রিন্স’ উপাধি দেন। 

প্রিন্সের ভাস্কর্য; Image Source: New York Times

১৯৩৮ সালে প্রিন্স গ্যাব্রিয়েল দা’ন্নুনজিয়ো মৃত্যুবরণ করেন। তার নামে আছে জাদুঘর, বিমানবন্দর এবং বিশ্ববিদ্যালয়। ইতালীর লোকে প্রিন্সকে ইল ভাতে (কবি) ও ইল প্রোফেতে (নবী) বলে ডাকতো।

Related Articles