এজন্য (একাকী বিশ্ব ভ্রমণের জন্য) সাহসের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আগ্রহের।
– ডার্ভলা মার্ফি
৮৮ বছর বয়সী আইরিশ পর্যটক ও প্রখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী লেখক ডার্ভলা মার্ফি, বরাবরই বেশ বিনয়ী স্বভাবের ছিলেন। তার কৃতিত্বের জন্য তিনি নিজেকে ‘সাহসী’ হিসেবে বিবেচনা করতে বা বিশেষায়িত করতেও নারাজ। কিন্তু তার অর্জন যে সমাজের চিরাচরিত প্রথার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত সাহসী এক দৃষ্টান্ত- এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ অভিযানে কাটিয়ে এবং সেসকল অভিযানের দুঃসাহসিক গল্প নিয়ে ২৬টি বই লেখার পরে আজ কোনো স্থানের পরিবেশকে বা মানুষকে বুঝতে পারাটা ডার্ভলার জন্য মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। ভ্রমণকাহিনী লেখার জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে ‘ক্রিস্টোফার অ্যাওয়ার্ট-বিগস্ মেমোরিয়াল প্রাইজ’সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন।
জীবনের নবম দশকের শেষ প্রান্তে এসে আজ পেছনে ফিরে তাকালে যদিও বেশ বৈচিত্র্যময় ও অনন্য অভিজ্ঞতার নিদর্শন বহুল বিরাজমান, কিন্তু তার এই ভ্রমণ জীবনের সূচনা হতে হতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়; তবে প্রথম ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে ডাবলিন থেকে সপরিবারে লিসমোর যাওয়ার অভিজ্ঞতাকেই তিনি উল্লেখ করেন। সেই যাত্রায় তার বাবার গাড়ির একটি চাকায় আগুন ধরে যায়। মা-ই তাকে ১৬ বছর বয়স থেকে সাইকেলে একাকী ইউরোপ ভ্রমণে উৎসাহিত করেন, এটা ১৯৪০ এর দশকের কথা।
ডার্ভলার প্রাথমিক জীবনের বেশিরভাগই কাটে অসুস্থ বাবা-মায়ের সেবাযত্নে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় এই দায়িত্ব পালন তার কাছে ধর্মপালনের মতোই পবিত্র ছিল। ত্রিশের কোঠায় পা রাখার অল্প সময় পরেই তার বাবা-মায়ের মৃত্যু ঘটে। আর এর এক বছর পর থেকেই শুরু হয় তার দুঃসাহসিক ভ্রমণ জীবনের। কিন্তু শুরুতেই তিনি কোনো সহজ পথ বেছে নেননি। ডাবলিন থেকে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি পর্যন্ত যাত্রাই ছিল তার জীবনের প্রথম অভিযান। ৩২ বছর বয়সে ‘রজ’ নামের একটি সাইকেল এবং একটি পিস্তল সাথে নিয়ে তিনি এই যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। তবে এর পরিকল্পনা করেন আরও প্রায় দুই দশক আগে।
১০ বছরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার বাবা-মা তাকে একটি ব্যবহৃত সাইকেল উপহার দেন এবং তার দাদা তাকে একটি ব্যবহৃত অ্যাটলাস বা ভৌগলিক মানচিত্র পাঠান। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব ভাল সাইকেল চালাতে পারতেন, কিন্তু তার নিজের কোনো সাইকেল ছিল না। জন্মদিনের কিছুদিন পরেই একদিন তার মাথায় এভাবেই সাইকেল চালিয়ে ডাবলিন থেকে দিল্লি যাওয়ার চিন্তা আসে। ১৯৬৩ সালে ৩২ বছর বয়সে তার সেই সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি যাত্রা শুরু করেন। আর সেই অভিযানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লেখা তার প্রথম ভ্রমণকাহিনীমূলক বই ‘ফুল টিল্ট: আয়ারল্যাণ্ড টু ইণ্ডিয়া উইথ অ্যা বাইসাইকেল‘ ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়।
লিসমোরের কাছে যে খাড়া টিলার উপরে এই চিন্তাটা আমার মাথায় আসে, তা আমি কখনোই ভুলবো না। টিলার অর্ধেক সাইকেল চালিয়ে উঠতে গিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়- “যদি যথেষ্ট সময় ধরে আমি এভাবেই সাইকেল চালাতে পারি, তাহলে আমি ভারতে পৌঁছাতে পারবো।”
– ডার্ভলা মার্ফি
বইটিতে উল্লেখিত উক্ত ভ্রমণের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে পিস্তলের সাহায্যে শেয়াল ও উত্যক্তকারী মানুষদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর গল্প রয়েছে। আরও রয়েছে ঐ যাত্রায় তিনি যে বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন সেগুলোর কথা, এমনকি দুর্ঘটনায় হাড় ভাঙার উল্লেখও রয়েছে। এছাড়াও সেই অভিযানে তিনি বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাত ও সাপেরও মুখোমুখি হন। অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এই অভিযানে তিনি বেশ কিছু সেবামূলক কাজের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
ভারত ছাড়াও ডার্ভলা তার ভ্রমণ জীবনে আফগানিস্তান, পেরু ও সাইবেরিয়ার মতো দুর্গম দেশগুলোতে বেশ শান্তিপূর্ণ সময় কাটান। ‘জাদুময় মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ একটি শহর‘- তার ভাষায় এভাবেই আফগানিস্তানের প্রাচীন হেরাত শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়। দেশটির ‘ঘোরবান্দ উপত্যকা‘কে তিনি ‘গার্ডেন অফ ইডেন‘ এর সাথে তুলনা করেছেন। আর তার কাছে হিন্দু কুশ পর্বতমালাকে ‘অবিশ্বাস্য, অতুলনীয় সৌন্দর্য্যমণ্ডিত‘ মনে হয়েছে।
১৯৭৭ সালে মেয়ে রেচেল ও যৎসামান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সাথে নিয়ে তিনি পেরুভিয়ান আন্দেজ পর্বতমালায় ১,৩০০ মাইল ট্রেকিং করেন, যে পথে খুব অল্প সংখ্যক পর্যটকই নিজেদের পায়ের ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ২০০২ সালে ৭০ বছর বয়সে পরিকল্পনা নয়, বরং দুর্ঘটনার শিকার হয়েই তিনি সাইবেরিয়াতে পৌঁছান। কিন্তু বরফের মতোই শীতল মানসিকতার জন্য প্রসিদ্ধ এই দেশটির মানুষদের আতিথেয়তায় তিনি বেশ বিস্মিত হন। আর বৈকাল হ্রদ ও লীনা নদীর সৌন্দর্য তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে।
আমি যে ধরনের ভ্রমণে যাই, সেগুলোর ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধকতা‘ শব্দটির ব্যবহার আমার একেবারেই পছন্দ নয়, কারণ আমার ভ্রমণের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই। নিশ্চিতভাবেই বেড়াতে গিয়ে তাপমাত্রার তারতম্য ও অন্যান্য কারণে কষ্ট হয়েছে, কিন্তু ততটাও না। আমি পর্বতারোহণ বা এই জাতীয় গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযানে যাই না, শুধুমাত্র ভাল লাগে বলেই আমি ভ্রমণ করি।
নিজের এই বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ জীবনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বেছে নিতে গিয়ে তিনি ১৯৬৬-৬৭ সালের শীতকালে তিন মাসব্যাপী ইথিওপিয়ায় ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতার কথাই বলেন। এই ট্রেকে তার সঙ্গী ছিল একটি ভারবাহী খচ্চর যাকে তার প্রকাশকের নামানুসারে তিনি ‘জক‘ বলে ডাকতেন। এই যাত্রাটি শুধুই যে বৈরি আবহাওয়া এবং ভৌগলিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের জন্য উল্লেখযোগ্য তা-ই নয়; এই অভিযানে প্রায় এক হাজার মাইল তাকে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হয়, এমনকি স্থানীয়দের বৈরিতারও শিকার হতে হয়।
এই অভিযানে তিনি তিনবার ডাকাতদের খপ্পরে পড়েন, আর এর মধ্যে একবার অস্ত্রধারী ডাকাতেরা তাকে হত্যাও করতে চায়। তবে এই ধরনের আপত্তিকর পরিস্থিতি এবং শারীরিক অসুস্থতার শিকার তাকে আরও অনেকবারই হতে হয়েছে। ১৯৭০ এর দশকের শুরু থেকেই তিনি আরও বেশি জটিল ও দুর্গম পরিস্থিতিতে আবৃত স্থানে ভ্রমণ করতে শুরু করেন। উত্তর আয়ারল্যাণ্ড, রোমানিয়া, বলকান, সাউথ আফ্রিকা, রোয়াণ্ডা এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০০৮-১০ সালে ইসরাইল ও ওয়েস্ট ব্যাংক ভ্রমণের পূর্বে তিনি প্রস্তুতির জন্য ২০০ এরও বেশি বই পড়েন বলে উল্লেখ করেন।
সেটি (ইথিওপিয়ায় ট্রেকিং) আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিযান। সেখানে তিন সপ্তাহ যাবৎ আমি এমন দূরবর্তী একটা জায়গায় ছিলাম যে, সেখানকার মানুষ অর্থের ব্যবহার জানতো না।
– ডার্ভলা মার্ফি
ডার্ভলা একজন সত্যিকারের পর্যটক। তিনি হোটেলে থাকতে পছন্দ করেন না। খুব সাদামাটা কোনোমতে থাকার একটা ব্যবস্থা হলেই তিনি খুশি, এমনকি মেঝেতে শুয়ে রাত কাটাতেও তার আপত্তি নেই। ৮৪ বছর বয়সে গ্যাটউইক থেকে আয়ারল্যাণ্ডের উদ্দ্যেশ্যে ফিরতি বিমানে চড়ার আগের অপেক্ষাকালীন সময়ে, রাতের ঘুমের জন্য তিনি বিমান বন্দরের মেঝেই বেছে নেন। এই ধরনের সরল ও খুব সাদামাটা স্বভাবের কারণেই পাঠকেরা তার লেখায় পৃথিবীর বাস্তব চিত্রকে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। পর্যটক জীবনের যাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বের গল্প তিনি ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘হুইলস্ বিফোর হুইলস্‘ বইটিতে তুলে ধরেন, এটা সেই সময়ের গল্প যখন তার জীবনের পুরোটা জুড়েই ছিল অসুস্থ বাবা-মায়ের সেবা করা। তাই প্রথমে ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশের পরে, এই বইটি পাঠকদেরকে তার জীবনের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট করে তোলে।
আধুনিক সভ্যতার কারণে পর্যটন শিল্পের যে ক্ষতিসাধিত হয়েছে সে ব্যাপারে ডার্ভলা ভীষণ ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত। শুধু বিলাসবহুল হোটেলে থাকাই তার অপছন্দ নয়- পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্গম স্থানে পাকা রাস্তার নির্মাণ, সর্বক্ষণ মুঠোফোন ও ল্যাপটপের মাধ্যমে যুক্ত থাকা ও ইন্টারনেটে অবিরাম নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের গণসমাগম থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজের বাড়ন্ত পুঁজিবাদ নিয়েও তার যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। এসকল কিছুর কারণে একাকী ভ্রমণ করাকে তিনি আর ততটা নিরাপদ মনে করেন না। মেয়ে রেচেল মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ভারতে পুরো এক বছরের একাকী ভ্রমণ সম্পন্ন করে, কিন্তু নাতনিদের জন্য এই অর্জন তার কাছে আর আগের মতো নিরাপদ মনে হয় না।
আমি নিজে যখন একাকী ভ্রমণ করি তখন একজন মেয়ে হয়েও বেশ নিরাপদ বোধ করতাম, এমনকি রেচেলের বেলায়ও আমার কোনোরকম দুশ্চিন্তা হয়নি। কিন্তু আমার নাতনিদের মধ্যে যদি কেউ এমনটা করতে চায়, তাহলে আমি বেশ চিন্তিত বোধ করবো যা আগে কখনও করিনি। আমার মনে হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পর্ণোগ্রফির প্রচারের কারণেই পুরুষদের ব্যবহারে এই ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
– ডার্ভলা মার্ফি
এক সময়ে ‘লিসমোর মার্কেট‘ হিসেবে পরিচিত জায়গাটিতেই ডার্ভলা বর্তমানে বাস করছেন। একটি উন্মুক্ত উঠানের চারদিকে পাথরের তৈরি কিছু পুরোনো বাড়ির মধ্যে তার বাড়িটিও একটি। এক কামরা থেকে আরেক কামরায় যেতে হলে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই বাড়িটির একটি ঘরে তার পড়া ও লেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। এই ঘরটির মেঝে থেকে ছাদ অব্দি বইয়ে ঠাসা। বাড়িটিতে কুকুর বেড়ালের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা রয়েছে। অনেকের কাছে বেশ অস্বস্তিকর মনে হলেও ৮৮ বছর বয়সী ডার্ভলার কাছে এই বাড়িটিই আপন নিবাস।
তিনি সারা জীবনই টাইপরাইটারে তার ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। তার ঘরে নেই কোনো টেলিভিশন বা ওয়াশিং মেশিন, আর মুঠোফোন তো নিঃসন্দেহে নেই-ই। একজন জাত আইরিশের মতোই বিয়ার পান করা তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তবে বয়সের সাথে সাথে তার শরীর বেশ খানিকটাই ভেঙে পড়েছে। সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, এমনকি সামান্য হাঁটাচলাও আর আগের মতো সম্ভব নয়। এসব কিছুর পাশাপাশি তার সবচেয়ে পছন্দের কাজটি থেকেও তাকে অবসর নিতে হয়েছে, সেই কাজটি হলো লেখালেখি করা।