বৃদ্ধাশ্রম নামটি শুনলেই চোখের সামনে ধরা দেয় ক্রন্দনরত মায়ের মুখ, ম্রীয়মান বাবার দুর্বল চাহনি। এ যেন জীবনের পরম অভিশাপ। সারাজীবন নিজের ছেলে মেয়েদের বড় করে তুলে শেষ জীবনে সন্তানকে অবলম্বন করে বাঁচার চেষ্টা যেন অন্যায়। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি আমাদের দেশে এখনও মহামারী হিসেবে ধরা না দিলেও দিন দিন এর আবদার বেড়েই চলেছে। আর এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অসাধারণ এক লেখায় জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতা যেন পুরো বিষয়টিকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এক অদ্ভুত সৃষ্টিতে।
ছেলে আমার মস্ত মানুষ,মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার ।
নানান রকম জিনিস, আর আসবাব দামী দামী
সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার,আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!
নচিকেতার কথা ও সুরে এই গানটি শোনার সময় আমাদের কার না চোখ জলে ভেসেছে! জলে ভেজা ছলছল চোখের সামনে ধরা দেয় মায়ের প্রিয় মুখখানি। মনে মনে শপথ নিয়ে ফেলি কখনো মাকে চোখের জল ফেলতে দেবো না। সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকব। দশ মাস দশ দিন যেমন আঁতুড়ঘরে আমাদের ধারণ করে রেখেছিলেন, তার ঋণ তো কখনো শোধ হওয়ার নয়। তার সাথে আছে আমাদের বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত মেনে নেয়া সমস্ত আবদার। একটু অসুখ হলেই নিজে না ঘুমিয়ে আমাদের জন্য সারা রাত জাগা, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে আমাদের জন্য সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো, সন্তান না খাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকা- এসব কথা লিখতে লিখতেও শেষ হওয়ার নয়।
প্রকৃতির আজব খেয়ালে মানুষ জন্মানোর পর থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পড়ালেখা শেষ করে সে স্বাবলম্বী হয়। তারপর বিয়ে করে সংসার। এর মাঝে বাবা-মায়েরও বয়স কিন্তু বাড়তে থাকে, কমতে থাকে শরীরের শক্তি, অবলম্বন হয়ে পড়ে সন্তানেরা। সংসারের হাল ধরে সকলের দায়িত্ব নেয় বাড়ির ছেলে। কিন্তু কীসের খেয়ালে অতীতের সব স্মৃতি বিলুপ্ত হতে থাকে ছেলের। চিন্তায় তখন নতুন আত্মীয় স্বজন। ঘরের মাঝে জায়গা পায় অবলা পশুপাখিও। কিন্তু মস্ত ফ্ল্যাটে জায়গার কমতি পড়ে মা বাবার জন্য। এক সময়ের অবলম্বন সময়ের খেয়ালে বোঝা হয়ে পড়ে সন্তানের কাছে। অবশেষে বাবা-মায়ের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়তো এখনো আমাদের সমাজে সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে কোনো সেবা-যত্ন ছাড়া ঘরের এক কোণে ফেলে রাখার মধ্যেও নেই কোনো প্রকার বাহাদুরি।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি।
ছোট একটি সংসারে বাবা, মা, ছোট ছেলে এবং ছেলেটার দাদা। দাদার অনেক বয়স হয়ে গেছে। কোনো কাজ করার শক্তি নেই, সারাদিন এক বিছানায় পড়ে থাকে। একদিন ছেলেটার বাবা একটা ঝুড়ির উপর বুড়োকে বসিয়ে জঙ্গলে নিয়ে গেল। জঙ্গলে যাওয়ার পর ছেলেটা হঠাৎ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, তুমি দাদুকে ঝুড়িতে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?” বাবা উত্তরে বলে, “তোমার দাদুকে আমরা এখন জঙ্গলের ভেতর রেখে আসবো।”
“কেন?”, ছেলেটা অবাক হয়।
“কারণ তোমার দাদু তো বুড়ো হয়ে গেছে। কোনো কাজ করতে পারে না, আমাদের কোনো উপকারেও লাগে না, শুধু খায় আর ঘুমায়।কি লাভ তাকে বাসায় রেখে? তাই তাকে আমরা জঙ্গলে রেখে আসতে যাচ্ছি।” “ওহ!”, কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে ছোট ছেলেটা, তারপর বলল, “ঠিক আছে বাবা, কিন্তু দাদুকে রেখে আসার সময় আমরা কিন্তু অবশ্যই ঝুড়িটা নিয়ে আসবে।”“কেন?” একটু অবাক হয় বাবা।
“কারণ, যখন আমি বড় হব, তুমি তো তখন বুড়ো হয়ে যাবে, দাদুর মতো তখন তুমি কোনো কাজই করতে পারবা না।
শুধু খাবা আর ঘুমাবা। তখন তো তোমাকে বাসায় রেখে আমার কোন লাভই হবে না।শুধু শুধু তখন টাকা খরচ করে নতুন ঝুড়ি কিনতে যাব কেন? এই ঝুড়িতে করেই না হয় তোমাকে জঙ্গলে রেখে যাব।”
জানি না এই গল্পে আমাদের বোধশক্তির কোনো পরিবর্তন হয় কিনা? জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ একদিন এক অনুষ্ঠানে দুঃখ করে বলছিলেন “ভাবিনি কখনো বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম কথাটা শুনতে হবে।” কিন্তু দুঃখজনক হলেও ইদানীং বড় বেশি কানে আসছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ কথাটি।
এবার একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। পৃথিবীতে প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। গৃহছাড়া অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এ উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল এই শান রাজবংশ। প্রাচীন চীনে শান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা বর্তমান সমগ্র বিশ্বে প্রসার লাভ করে।
বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তন হয় ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের হাত ধরে। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে। এই সকল সংস্থা মূলত বৃদ্ধ বয়সে যাদের সহায় সম্বল নেই, তাদেরকে মাথায় রেখেই কাজ পরিচালনা করে।
মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। ২০১০ সালের পর ১ কোটি ২৫ লাখের বেশিতে এসে দাঁড়ায় এ সংখ্যা। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। এই ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা। বৃদ্ধাশ্রম ঠেকাও বর্তমানে একটি সামাজিক আন্দোলন। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আজকের নবীন ভবিষ্যতের প্রবীণ। বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাসস্থল। ডিজিটাল যুগের ইট-পাথরের পরিবেশেও অটুট থাকুক মিহি সুতায় বাঁধা পরিবারের সেই স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা।
বর্তমানে আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যা ‘জেনারেশন গ্যাপ’ কথাটির অর্থ প্রতিনিয়ত টের পাইয়ে দেয় আমাদের। ছেলে-মেয়েদের মন-মানসিকতার সাথে সাথে বাবা-মায়ের চিন্তা ভাবনা বদলাতে থাকে না। ছেলে-মেয়েরা প্রতিনিয়ত পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবিত। এমন অনেক সংসার আছে যাদের সব কয়টি ছেলেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে উচ্চতর পড়ালেখা এবং পাকাপোক্তভাবে থাকার উদ্দেশ্যে, ফেলে রেখে যাচ্ছে বাবা মাকে নিজ দেশে। মাঝে মাঝে দেখতে আসা আর আর্থিক সহায়তায় দায়িত্বের মেরুকরণে প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চয় রয়েছে। কিন্তু পিতা-মাতারা হয়ে পড়ছে বড় বেশি অসহায়। বুড়ো বয়সে হাতের কাছে কাউকে কাছে পাওয়ার নেই, যে হতে পারে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল।
ছোট্ট আরেকটি গল্পের দিকে আলোকপাত করি।
বৃদ্ধ বাবা এবং তার তরুণ সন্তান এক সকালে পার্কে হাঁটছিলেন। হঠাৎ একটা পাখি দেখে বাবা তার সন্তানের কাছে জানতে চাইলেন, বাবা ওটা কী পাখি? সন্তান বলল, টিয়া।
বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ওটা কী পাখি? ছেলে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল, বললাম না, ওটা টিয়া।
বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন,ওটা কী পাখি? এবার সন্তান মেজাজ চড়া করে বলল, শুনতে পাওনি ওটা টিয়া?
বাবা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ওটা কী পাখি ? সন্তান এবার আর পাখির নাম বাবাকে বলে নি। বলেছে, তোমার সমস্যা কী? পাগল হয়ে গেলে নাকি? একটা কথা এতবার বললাম, তারপরও তুমি বারবার জিজ্ঞাসা করছ, কী পাখি!
মেজাজ খারাপ করে বাবার সাথে কিছুক্ষণ ঝগড়া করে ছেলে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ল । বাসায় এসে বাবা একটি ডায়েরি নিয়ে আবারও ছেলের কাছে ফিরে গিয়ে ডায়েরিটা তাকে পড়তে বলে। ডায়েরিটা পড়ে ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল এবং বাবার কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল।
অনুমান করতে পারছেন, ডায়েরীতে কী লেখা ছিল? বাবা এই ডায়েরীটা তার ছেলের বয়স যখন ৪ বছর, তখন লিখেছিলেন। তখনও বাবা তার কৌতুহলী ছেলেকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন। ছেলে একটি টিয়া পাখি দেখে বাবার কাছে ৩২ বার জানতে চেয়েছিল বাবা ওটা কী পাখি। বাবা বিরক্ত হননি, বরং প্রতিবার উত্তর দিয়েছিলেন। বাবা তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন,আমার সন্তান আজ আমার কাছে একটি পাখি দেখে ৩২ বার তার নাম জানতে চেয়েছিল এবং আমি প্রত্যেক বার তাকে পাখিটির নাম বলেছি এবং আমার কলিজার টুকরা প্রত্যেকবারই আনন্দ পেয়েছে।”
প্রবীণদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে ১ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৫/১০৬ নম্বর প্রস্তাবে ১ অক্টোবর দিনটি প্রবীণদের জন্য পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। পরিবারের বয়স্কদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে এ দিবস।
সব সময় যে ছেলে মেয়ের অবজ্ঞার কারণেই বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় তা কিন্তু নয়। অনেক সময় অনেক নিঃসন্তান বাবা-মা, যারা শেষ বয়সে কারও সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে যায়, তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম এক আশ্রয়স্বরূপ। সেই দিক বিবেচনা করলে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এই সুযোগকে পুঁজি করে অনেকেই নিজেদের বাবা-মাকেও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে ব্যাকুল। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে সেবা যত্ন করার পরিবর্তে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা! সবাই মিলে বৃদ্ধাশ্রমকে ‘না’ বলার এটাই যেন প্রকৃত সময়।
শেষ করবো নচিকেতার কিছুটা অভিমানী লেখায় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটির শেষ স্তবক দিয়ে যা আমাদেরকে পরবর্তী জীবনের প্রতিফলন চোখের সামনে তুলে ধরে খুব সহজেই।
“খোকারও হয়েছে ছেলে, দু’বছর হলো
তার তো মাত্র বয়স পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোলো।
একশো বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট।
আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি
খোকা-আমি দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি।
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম
মুখোমুখি আমি, খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম!”