পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকারি গোপনীয় কার্য সম্পাদনের লক্ষ্যেই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার কাজই হলো নিজ দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা, গবেষণা করা ও সেগুলোকে নিরাপদে রাখা। একে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, গুপ্তচর সংস্থা, সিক্রেট এজেন্সি ইত্যাদি যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এদের কাজ কিন্তু মোটামুটিভাবে এক। অর্থাৎ দেশের সুরক্ষার প্রতি নজর রাখা।
এদের মাঝে কোনো সংস্থার নজর থাকে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রতি, আবার কোনো কোনোটি যুক্ত থাকে অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ব্যাপারে। তাই নিরাপত্তার কারণে এদের কার্যক্রম গোপন রাখা হয়। কাজটাই যখন গোপনীয়, তবে কী করে নিক্তি দিয়ে মাপি যে এদের মাঝে সেরা কোনটি? কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া পৃথিবীর সেরা সেরা সিক্রেট এজেন্সিগুলোর অন্দরমহল আসলে কেমন হয় তা জানি কি করে? তবুও চেষ্টার কমতি নেই এদের অন্দরমহল নিয়ে জানার। এদের মাঝেই যাদের নাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি বিখ্যাত, তাদের দিকেই নজর ফেরানো যাক।
সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (এমআই৬) – ব্রিটেন
হলিউড নায়ক জেমস বন্ডের কল্যাণে তার এজেন্সি এসআইএস, প্রকারান্তরে এমআই৬ বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠে। ১৯০৯ সালে উইলিয়াম মেলভিল নামক সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরোর এক কর্মকর্তা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৪ সালের আগ পর্যন্ত এমআই৬ নামটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি। এমনকি সরকারিভাবেও স্বীকার করা হতো না সংস্থাটির অস্তিত্ব।
সিক্রেট এজেন্সিগুলোর মাঝে এটি অতি প্রাচীন। মূলত এর আদলেই তৈরি হয়েছে সিআইএ। সংস্থাটির সদর দপ্তর অবস্থিত লন্ডনের ভাউক্স হল ক্রসে। ঐতিহাসিকভাবে বলশেভিক বিপ্লবের সময় থেকেই রাশিয়ার সাথে এমআই৬ স্নায়ু যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এটি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অবস্থানের প্রতি একটু বেশি নজরদারি করছে বলে ধারণা পাওয়া যায়।
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ইংরেজীতে সংস্থাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিআইএ নামেই পরিচিত। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবারে জাপানি বোমাবর্ষণের ঘটনার রেশ ধরেই এই এজেন্সির জন্ম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন একটি বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হলো সিআইএ। এই সংস্থার জবাবদিহিতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে। এর হেড কোয়ার্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের ল্যাংলিতে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে এসেও সিআইএ নির্ভর করে তাদের বিরাট নেটওয়ার্ক মানুষ সোর্সের উপরেই, যাতে তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এত গোপনীয়তা বজায় রাখার পরেও ঠেকানো গেলো না ৯/১১ দুর্ঘটনা, যা ইতিহাসে ভয়ঙ্কর একটি অধ্যায় সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছে।
১৯৪৭ সালে অনুমোদিত হওয়া ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সিআইএ গঠন করা হয়, যাতে বলা হয়, ‘এটি কোনো পুলিশ বা আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান নয়, দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই কাজ করুক না কেন।‘ ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের পূর্বে সিআইএ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান গোযন্দো সংস্থা; এটি শুধু নিজের কর্মকাণ্ডই নয়, বরং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডও দেখাশোনা করত।
কিন্তু ২০০৪ সালে অনুমোদিত ইন্টেলিজেন্স রিফর্ম অ্যান্ড টেররিজম প্রিভেনশন অ্যাক্ট, ২০০৪ দ্বারা তা পরিবর্তিত হয়। এছাড়া সুনামের পাশাপাশি সংস্থাটির দুর্নামও কম নয় বটে। কাউন্টার টেররিজমের নামে কখনও কখনও হিউম্যান সাবজেক্টের উপরে অদ্ভুত সব পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো, অত্যাচার, খুন ইত্যাদি অপবাদও এর বিরুদ্ধে এড়ানো যায় না একেবারেই। বহু দেশের সরকার উল্টে দেওয়ার পেছনেও এর ভূমিকা রয়েছে।
ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) – রাশিয়া
১৯৯৫ সালের ৩ এপ্রিল এর জন্ম। সংস্থাটির আসল নাম এতই কাঠখোট্টা যে তা পড়তে গলা শুকিয়ে আসার কথা। আসল নাম হলো ফেডারেলনায়া সুলঝবা বেজপাসনোস্তি রাশিস্কয় ফেডেরাটসি।
জনশ্রুতি আছে যে, সামরিক শক্তির দিক থেকে রাশিয়ার সুবর্ণ দিন এখন আর নেই। তবে এফএসবি’র কার্যকারিতার প্রভাব ও ভয়াবহতার কথা অনুমান করতে হবে এর পূর্বসূরি সংস্থার কথা মাথায় রেখে। সে সময় রাশিয়ার প্রবাদ প্রতিম সিক্রেট এজেন্সি ছিল কেজিবি, আর তারও আগে এর নাম ছিল চেকা। এফএসবি’র সদর দফতর রাশিয়ার মস্কো শহরের ল্যুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারে।
সংস্থাটির জবাবদিহিতা প্রেসিডেন্ট রাশিয়ান ফেডারেশন। রাশিয়ার এই সংস্থাটিকে পুরোপুরিভাবেই সামরিক বাহিনী হিসেবেই গণ্য করলে ভুল হয় না। এফএসবি’র দুই বিশেষ বাহিনী ‘আলফা গ্রুপ’ এবং ‘উইমপেল’। এরা মূলত গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে উগ্রপন্থীদের দমনে বিশেষভাবে বিখ্যাত।
মোসাদ – ইসরায়েল
‘মোসাদ’ শব্দটির অর্থ হিব্রু ভাষায় হলো ‘ইন্সটিটিউট’। আনুষ্ঠানিকভাবে এই বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম Institute for Intelligence and Special Operations। শুধু খবর জোগাড় করার দিক থেকে চিন্তা করলে মোসাদের মতো চৌকস এজেন্সি খুঁজে পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। ‘মোসাদ’কে ঘিরে যেসব রহস্যজনক ও চাঞ্চল্যকর গল্প চালু আছে, তার কোনো তুলনা হয় না। মোসাদের এমন কিছু অভিনব অপারেশন রয়েছে যেগুলো গল্পের বই বা সিনেমা কেও হার মানায়।
এই গ্রুপটি WORLD’S MOST EFFICIENT KILLING MACHINE নামেও বিশ্বে পরিচিত। এরা রিপোর্ট করে ইসরায়েলের খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। অবশ্য অন্য দেশের সিক্রেট এজেন্সিগুলোকেও সমান তালে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে মোসাদ। শোনা যায়, মোসাদের স্পেশাল বাহিনী, যার নাম ‘কিডন’, তারা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নির্দয় ও খুনে ইউনিট। হিব্রু শব্দ ‘কিডন’ এর বাংলা অর্থ হলো ‘বেয়নেটের আগা’।
কথিত আছে, মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ জন ইসরায়েলি হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রায় ২০ বছর ধরে দায়ী প্যালেস্টাইনী হামলাকারীদের এক এক জনকে খুঁজে বের করে শেষ করে কিডন। সে অপারেশনটির নাম ছিল ‘ র্যাথ অফ গড’ যা আজও ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বরের কথা। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ‘মোসাদ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে ‘মোসাদ’ এর পূর্বসূরি বলা চলে সেসব ইহুদিদের, যারা ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত ছিল।
‘মোসাদ; এমন একটি সংস্থা যার অন্দরমহলের খবর চরম গোপনীয়তার বেড়াজালে মোড়ানো। তাই ‘মোসাদ’ সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। কর্মী সংখ্যা বা তাদের পরিচয়ের ক্ষেত্রেও বজায় রাখা হয় গোপনীয়তা। তবে ধারণা করা হয় এর কর্মী সংখ্যা কম করে হলেও ১,২০০ হবে। এর সদর দফতর ইসরায়েলের তেলআবিবে।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলে আরও দু’টি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে- অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘শিন বেত(Shin bett)’ এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘আগাফ হা-মোদি’ইন’ – সংক্ষেপে ‘আমন’ (Aman)।
রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং (‘র’) – ভারত
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশের আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ দু’ভাবেই কাজ সম্পাদন করতে পারে। একসময় ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি দেশটির আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ দু’রকম সুরক্ষার প্রতি নজর রাখত। কিন্তু ১৯৬২ সালের চীন যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকেই ভারত সরকার উপলব্ধি করতে শুরু করে যে দেশের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্যে দেশটির আলাদা এজেন্সি অত্যন্ত প্রয়োজন।
তাই ১৯৬৮ সালে গঠিত হয় রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং বা সংক্ষেপে ‘র’। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছেই জবাবদিহি করে। ধারণা করা হয় ভারতের সামরিক অগ্রগতির প্রধান কারণ হলো ‘র’ এর সক্রিয়তা। সংস্থাটির বর্তমান প্রধান রাজিন্দর খন্না যিনি উগ্রপন্থীদের ব্যাপারে একজন গভীর বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের ট্রেনিং দেওয়ার সময়কালে ‘র’ এর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাছাড়া মালয়েশিয়াতে সাধারণ মানুষের মাঝে ভেদাভেদ দূরীকরণে, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় তামিল উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মায়ানমার রাষ্ট্রে বিভিন্ন গ্রুপের ট্রেনিং দেওয়া ইত্যাদি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ‘র’ জড়িত ছিল বলে জানা যায়। শোনা যায়, কারগিল যুদ্ধ এবং মুম্বাই হামলার সময়েও ‘র’ এর কাছে এমনও অনেক আগাম খবর হাতে ছিল।
তথ্যসূত্র
১) storypick.com/intelligence-agencies/
২) topyaps.com/top-10-intelligence-agencies-of-world
৩) abcnewspoint.com/top-10-best-intelligence-agencies-in-the-world-2015/
৪) rednewswire.com/worlds-top-10-intelligence-agencies-that-do-the-impossible/