১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে আরবদের সাথে ইসরায়েলের অনেকগুলো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়েছে। চতুর্দিক থেকে শত্রুদেশ দিয়ে ঘেরা ইসরায়েল সর্বদা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকে। এই ভয়ই তাদেরকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে। ইসরায়েল সবসময় তাদের শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর উত্থানকে বিশেষ করে সামরিক উত্থানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। বিভিন্ন সময়ে নিজেদের জন্য হুমকি এমন অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষককে হত্যা করেছে তাদের গোয়েন্দারা। হামলা করেছে শত্রুদেশের বিভিন্ন সামরিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্থাপনায়। নিজেদের স্বার্থে অপারেশন চালিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখার তাগিদে একবার মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অন্যতম প্রধান শত্রু ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতেও হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইরাক তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার ও গবেষণার জন্য ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আইআরটি-৫০০০ নামক একটি ২ মেগাওয়াটের পারমাণবিক চুল্লি অধিগ্রহণ করে। কয়েক বছর পর ১৯৬৮ সালে ইরাক পারমাণবিক শক্তি বিস্তার রোধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ইরাক শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির অধিকার পায় কিন্তু সেইসাথে আবার চুক্তিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে ইরাক পারমাণবিক শক্তি বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ সময় তারা ফ্রান্স থেকে পারমাণবিক চুল্লি ক্রয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। ইরাক ফরাসি সরকারের কাছ থেকে গ্যাস কুলড গ্রাফাইট সংশোধিত প্লুটোনিয়াম উৎপাদনকারী চুল্লি ও পুনঃপ্রসারণকারী প্ল্যান্ট ক্রয় করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা একইভাবে ইতালীয় সরকারকে তাদের সিরিন চুল্লি বিক্রি করার জন্য রাজি করতে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ইরাকি সরকার ফরাসি সরকারকে তাদের একটি ওসিরিস ক্লাস পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি বিক্রিতে রাজি করতে সমর্থ হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ইরাকি ও ফরাসি সরকার প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করে। উক্ত চুক্তিতে একটি ছোট আইসিস-টাইপ চুল্লি, ৭২ কিলোগ্রাম ৯৩% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বিক্রয় এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইতিমধ্যে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি ক্রয়ের প্রচেষ্টার কথা ইসরায়েলের গোয়েন্দারা জেনে যায়। ইরাকের এমন উদ্যোগে ইসরায়েল আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ইরাকের প্রকল্প বাতিলের জন্য তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইৎঝহাক রাবিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দারা নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে ইৎঝহাক রাবিন প্রশাসন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের প্রচেষ্টাকে ধীর করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় মোসাদ ইরাকে কয়েকজন গোয়েন্দা নিয়োগ করে, এরা ইসরায়েলকে পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছিল। এছাড়া প্রকল্পের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বড় অংকের টাকা ও অন্যান্য লোভ দেখায় মোসাদ। ইসরায়েলের গোপন প্রচেষ্টায় ইরাকের পারমাণবিক চুল্লির নির্মাণকাজ কয়েক বছর পিছিয়ে যায়।
ইসরায়েলি গোয়েন্দারা এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রযুক্তিবিদদের হুমকিমূলক চিঠি দেয়। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ইসরায়েলি এজেন্টরা ফ্রান্সের লা সিয়েন-সুর-মের বন্দরে ইরাকে আসার অপেক্ষায় থাকা ওসিরাক চুল্লিটিতে নাশকতা চালায়।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আল তুয়েথা পারমাণবিক কেন্দ্রে ৪০ মেগাওয়াট লাইট-ওয়াটার বিশিষ্ট পারমাণবিক চুল্লির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রাচীন মিশরীয়দের মৃত্যুর দেবতা ওসিরিসের নামানুসারে চুল্লিটির টাইপের নামকরণ করা হয়েছিল ওসিরিস। কিন্তু ফরাসিরা ইরাকের নামটি শিরোনামে যুক্ত করার জন্য ওসিরিসের সাথে ইরাকের মিলনে ওসিরাক নামকরণ করে। ইরাক চুল্লিটির নামকরণ করে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় মাস তাম্মুজের নামানুসারে যে মাসে বাথ পার্টি ইরাকে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। দুটি চুল্লির একটিকে তাম্মুজ-১ ও অপরটিকে তাম্মুজ-২ নামকরণ করা হয়।
চুল্লিটির নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ১৯৮০ সালের ১৪ ই জুন মোসাদ এজেন্টরা প্রতিহিংসাবশত প্যারিসের একটি হোটেলে ইরাকি পারমাণবিক কর্মসূচির নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম মিশরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া এল মাশাদকে হত্যা করে।
পারমাণবিক চুল্লির নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। এদিকে আবার ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নানা অজুহাতে ইরাক তার প্রতিবেশী ইরানে আক্রমণ করে বসে। ইরানের বিপ্লবীরাও ইরাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইরাকের নির্মাণাধীন পারমাণবিক স্থাপনাকে নিয়ে ইরানও বিচলিত ছিল। একপর্যায়ে ইরান ইরাকের ওসিরাক চুল্লিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনার বিষয়ে যথেষ্ট গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট ছবি ইরানের কাছে ছিল না। বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরিতা সৃষ্টি হওয়ায় ইরানের গোয়েন্দারা ওসিরাক চুল্লির বিষয়ে খুব বেশি গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট ছবিও পাচ্ছিল না।
নিশ্চয়ই ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এই প্রবাদটি শুনেছেন। এ পর্যায়ে ইরান ও ইসরায়েল উভয় দেশ উক্ত প্রবাদের ব্যবহার করেছে। উভয় দেশের কমন শত্রু ছিল ইরাক। ইরান ও ইসরায়েল ইরাক ইস্যুতে একে অপরকে সহযোগিতা করতে থাকে। ইসরায়েল প্রথমে ইরানের মাধ্যমে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে আক্রমণ করিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করে। ইসরায়েলের গোয়েন্দারা ইরানকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। মূল পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করলে এর রেডিওএক্টিভ প্রভাব ইরানের উপরেও পড়তে পারে এই আশংকায় ইরান মূল চুল্লিতে হামলা না করে গবেষণা ল্যাবরেটরি, কন্ট্রোল বিল্ডিং ও ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইরান ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করে। রিপোর্ট অনুযায়ী উক্ত আক্রমণে ওসিরাক স্থাপনা মাঝারি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু ইসরায়েল এই স্থাপনাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ইরাক গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে বলে ইসরায়েল অভিযোগ করে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষকদের মতেই ইরাকের চুল্লিতে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য ধাতুর যোগান ছিল না এবং সেইসঙ্গে ইরাকের হাতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও ছিল না। কিন্তু ইসরায়েল ইরাকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করতে থাকে। কিছু বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইরাক নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির সামর্থ্য অর্জন থেকে অন্ততপক্ষে পাঁচ অথবা দশ বছর পিছিয়ে ছিল। আবার কিছু গোয়েন্দা তথ্য ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইরাক এক থেকে দুই বছরের মধ্যে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার মতো অবস্থায় চলে গিয়েছিল।
ইরাক ও ফ্রান্স উভয় দেশ পারমাণবিক চুল্লি অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে নয় বরং শান্তিপূর্ণ গবেষণার জন্য তৈরি করা হচ্ছে বলে দাবি করে। তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন আসন্ন নেসেট (ইসরায়েল পার্লামেন্ট) নির্বাচনে তার দল লিকুদ পার্টির পরাজয়ের আশংকায় ছিলেন। তিনি যেকোনো মূল্যে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করতে আগ্রহী ছিলেন। বেগিন আশংকা করছিলেন যে, বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে তারা হয়তো ইরাকের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আগে হামলা করবে না। তৎকালীন ইসরায়েলি প্রশাসন ইরাকের দ্বারা আরেকটি পারমাণবিক হলোকাস্টের আতঙ্কে ছিল। প্রধানমন্ত্রী বেগিন ইরাকে হামলার বিষয়ে এতটাই দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বশেষ যদি একটি কাজ করেন সেটি যেন ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা হয়।
১৯৮০ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি মন্ত্রীসভা ১০/৬ ভোটে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার অনুমোদন দেয়। প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত পেয়ে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) হামলার পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। প্রথমে অপারেশনটিকে ‘এমিউনিশন হিল’ নাম দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন ধারণা করেন, অপারেশন সম্পর্কে বিরোধী নেতা শিমন প্যারেজ জেনে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অপারেশনের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে পরিকল্পনা সাজানোর নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ‘অপারেশন অপেরা’ নামকরণ করা হয়। একে অনেকসময় ‘অপারেশন ব্যাবিলন’ নামেও ডাকা হয়।
অপারেশনের পরিকল্পনায় থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার শঙ্কা, বিমানগুলো সহজেই ইরাকে গিয়ে পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করতে পারবে কিন্তু আশংকা হচ্ছে যে তারা সবাই জীবিত ফিরে আসতে পারবে কিনা! ইরাক পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তার জন্য অনেকগুলো বিমানবিধ্বংসী মিসাইল স্থাপন করেছিল। এছাড়া ইরানের হামলার পর তারা আগের চেয়েও বেশি সতর্ক ছিল। সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার মতে হয়তো এক থেকে দুটি বিমান ফিরে নাও আসতে পারে।
কর্মকর্তারা অপারেশনের জন্য ৭ জুন তারিখ নির্ধারণ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, ৭ জুন হচ্ছে রবিবার আর এদিন ফরাসি টেকনিশিয়ানরা সাপ্তাহিক ছুটিতে থাকবে। ফলে ফরাসিদের কোনো ক্ষতি হবে না। ফ্রান্সের বিশেষজ্ঞদের কোনো ক্ষতি না করলে হয়তো ফরাসি সরকারের প্রতিক্রিয়া কিছুটা কম হবে এই ভাবনায় ৭ তারিখের পক্ষে কর্মকর্তারা মত দেন। হামলার দিন আক্রমণের জন্য পরিকল্পিত রুটে বা আশেপাশে কোনো বেসামরিক বিমান চলাচল করবে কিনা তাও দেখা হয়েছিল। সবকিছু বিবেচনা করে শেষপর্যন্ত হামলার সময় ৭ জুন বিকেলে নির্ধারণ করা হয়। ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটি থেকে ইরাকি চুল্লির দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইসরায়েলি বিমানগুলোকে জর্ডানিয়ান অথবা সৌদি আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে হয়েছে।
১৯৮১ সালের ৭ জুন বিকেলে স্থানীয় সময় ১৫:৫৫ (১২:৫৫ জিএমটি) মিশরের সিনাই উপদ্বীপের (তৎকালীন ইসরায়েল অধিকৃত) এটজিয়ন বিমানঘাঁটি থেকে ৮টি এফ-১৬এ বিমান যাত্রা শুরু করে। বিমানগুলো গাল্ফ অভ আকাবার উপর দিয়ে গিয়ে সৌদি-জর্ডান সীমান্ত অতিক্রম করে। প্রত্যেকটি বিমান দুটি করে মার্ক-৮৪ ২০০০ পাউন্ডের বোমা ও অন্যান্য ভারি অস্ত্রসহ ইরাকের উদ্দেশ্যে উড়ে যায়।
প্রত্যেক পাইলটের সাথে ইরাকি মুদ্রা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে যদি কোনো পাইলট ইরাকি আক্রমণ দ্বারা ভূপাতিত হয় তবে যেন তারা বেঁচে থাকতে পারে এবং পুনরায় ইসরায়েলে ফেরত আসতে পারে। এই বিমানগুলোকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ৬টি এফ-১৫ ঈগল বিমান পাঠানো হয়েছিল।
আক্রমণের দিন তৎকালীন জর্ডানের রাজা হুসাইন গাল্ফ অভ আকাবায় অবকাশ যাপন করছিলেন। ইসরায়েলি বিমানগুলো তার ইয়াটের উপর দিয়ে উড়ে যায়। বিমানগুলোর আগমনস্থল, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য বিষয় দেখে হুসাইন বুঝতে পারেন যে এগুলো ইসরায়েলি। তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে বিমানগুলো ইরাকি পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করতে যাচ্ছে। শীঘ্রই হুসাইন তার সরকারের কাছে বার্তা দেন এবং ইরাককে সতর্ক করে দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু যোগাযোগের সমস্যার কারণে তার বার্তা পৌঁছায়নি।
জর্ডান ও সৌদি আকাশসীমা অতিক্রম করার সময় শনাক্তকরণ এড়ানোর জন্য পাইলটরা একটি পরিকল্পনা করে। পাইলটরা জর্ডানের আকাশসীমায় থাকার সময় সৌদি উচ্চারণের আরবিতে কথা বলছিলেন যেন জর্ডানের বিমান নিয়ন্ত্রকরা তাদেরকে সৌদি টহলরত হিসেবে বিবেচনা করে। আবার সৌদি আকাশসীমায় থাকাকালীন তারা জর্ডানের রেডিও সিগনাল ও ফর্মেশন ব্যবহার করে জর্ডানিয়ান টহলরত হওয়ার ভান করে। এভাবে তারা সৌদি ও জর্ডানিয়ান সীমান্ত অতিক্রম করে। হামলায় অংশগ্রহণকারী এফ-১৬ বিমানগুলোর পাইলট হিসেবে ছিলেন জিয়েভ রাজ, এমোস ইয়াদলিন, ডব্বি ইয়াফ, হাগাই কাটজ, আমির নাচুমি, ইফতাখ স্পেক্টর, রেলিক শাফির এবং ইলান রামন। উক্ত অভিযানে অংশ নেওয়া সবচেয়ে কম বয়সী পাইলট ছিলেন ইলান রামন, পরে তিনি প্রথম ইসরায়েলি নভোচারী হয়েছিলেন এবং ২০০৩ সালে কলম্বিয়া মহাকাশ শাটল বিপর্যয়ে মারা গিয়েছিলেন।
সৌদি ও জর্ডানিয়ান আকাশসীমা অতিক্রম করে ফাইটারগুলো ইরাকি সীমান্তে এসে পৌঁছায়। ইরাকি সীমান্তে এসে বিমানগুলো আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এফ-১৬ ফাইটারগুলোর সাথে দুটি এফ-১৫ ফাইটার প্রহরী হিসেবে চুল্লির দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। বাকি এফ-১৫ ফাইটারগুলো ইরাকের আকাশে ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়তে থাকে যেন ইরাকি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে মূল আক্রমণ থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং প্রয়োজনে ব্যাক আপ হিসেবে কাজ করতে পারে। আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাওয়া দলটি ইরাকের রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ইরাকি মরুভূমিতে ভূমি থেকে মাত্র ৩০ মিটার উপর দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। সফলভাবে তারা ইরাকি রাডার প্রতিরক্ষার নিচ দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়।
ওসিরাক চুল্লির ২০ কিলোমিটারের মধ্যে আসার পর ফাইটারগুলো উপরে উঠতে থাকে। ২১৩০ মিটার উপরে উঠার পর সেখান থেকে ৩৫ ডিগ্রি কোণে ১১০০ কিলোমিটার পার ঘন্টা বেগে চুল্লিকে লক্ষ্য করে এগোতে থাকে। ভূমি থেকে ১১৭০ মিটার উচ্চতায় নামার পর এফ-১৬ ফাইটারগুলো চুল্লিকে লক্ষ্য করে ৫ সেকেন্ড পরপর মার্ক-৮৪ বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। এভাবে প্রায় দুই মিনিটের কিছু কম সময় ধরে আক্রমণ চলে। ২০০০ পাউন্ডের ১৬টি বোমার মধ্যে আটটি বোমা মূল চুল্লির শক্তিশালী কংক্রিটের কাঠামোতে আঘাত করে ধ্বংস করে দেয়।
সফলভাবে অপারেশনের পরে তারা ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে থাকে। কিন্তু তখনো তাদেরকে ইরাকি মিসাইলের ভয় তাড়া করছিল। শেষপর্যন্ত সবগুলো ফাইটার কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েই ইসরায়েলে ফেরত আসে। এই হামলায় দশ জন ইরাকি সৈন্য ও একজন ফরাসি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
আক্রমণের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ‘রেজ্যুলেশন ৪৮৭’ পাশ করে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে এটিকে আন্তর্জাতিক আচরণের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে। ইরাকের নিজেদের দেশে পারমাণবিক শক্তির উন্নয়নের অধিকার রয়েছে বলেও জাতিসংঘ উল্লেখ করে। ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এই আক্রমণের পর জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনের স্বাক্ষর করে। যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের কাছে ৪টি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ করা স্থগিত করে যদিও দু’মাস পর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
তবে জাতিসংঘ কর্তৃক ইসরায়েলের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র আটকে দেয়। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যেসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে এই হামলাকে হিরোশিমার সিকোয়েল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। লস এঞ্জেলস টাইমস এই আক্রমণকে রাষ্ট্র সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ হিসেবে অভিহিত করে। এই অপারেশনটি ১৯৮১ সালে ইসরায়েলের সংসদ নির্বাচনের ৩ সপ্তাহ আগে করা হয়েছিল ফলে তৎকালীন বিরোধী নেতা শিমন প্যারেজ এটিকে রাজনৈতিক কারণে করা হামলা বলে সমালোচনা করেন।
এই হামলা ইরাকের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ইচ্ছাকে দমাতে পারেনি বরং ইরাককে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে। পরবর্তীতে ইরাক তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম প্রকাশ্যে না করে গোপনে চালিয়ে যায়। ওসিরাকে হামলা বেগিন ডকট্রিনকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বেগিন ডকট্রিনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে তার শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন রোধে সামরিক পদক্ষেপ নেবে। বেগিন ডকট্রিন অনুযায়ীই পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সিরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করেছিল ইসরায়েল।