আগের পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল দুই পক্ষ কীভাবে একের পর এক ভুল এবং দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে যুদ্ধের গতিপথ ধীর করে দিয়েছিল। ৭ মে, ১৯৪২ সালে সেই দুর্ভাগ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। অস্ট্রেলিয়ান নৌ-বহরের অ্যাডমিরাল ক্রেসের ক্রুজার ফোর্সের জ্বালানী প্রায় শেষের দিকে। তিনি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে পোর্ট মোর্শবির ৪১০ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান নিয়েছেন। এসময় তিনি আরো জানান, এয়ার সাপোর্ট না পেলে তিনি তার মিশন কমপ্লিট করতে পারবেন না। কিন্তু ফ্লেচার কোনো জবাব দেননি এবং তিনি যে রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখবেন সেটাও আগে থেকে বলেননি। তবে তিনি সঠিক কাজটিই করেছিলেন, কেননা জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘যুইকাকু’ সেই মেসেজটি ইন্টারসেপ্ট করে।
তাকাগি ধরে নেন, টাস্কফোর্স ১৭ ক্রুজার ফোর্সকে সাপোর্ট দিতে তাদের সাথে যুক্ত হতে যাবে। ফলে তারা রাতের আগেই আরেকবার আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। বিকাল সোয়া পাঁচটায় অ্যাডমিরাল হারা ৮টি টর্পেডো বোম্বার দিয়ে ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকা সার্চ করতে পাঠান। গ্রাউন্ড বেজড রিকনসিস বিমানগুলোর ভুল রিপোর্ট পেতে পেতে বিরক্ত হয়ে এতক্ষণে নিজেদের রিকনসিসের উপর ভরসা করতে শুরু করেছেন! তখনই কেবলমাত্র ৭ ঘন্টার ফ্লাইট শেষ করে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ও অয়েল ট্যাংকারে হামলা করা বিমানবহরের ডাইভ বোম্বারগুলো ল্যান্ড করেছে।
ক্লান্ত পাইলটদের আবারো জরুরি মিশনে পাঠানোর জন্য রিফুয়েলিং করা হলো। তরুণদের বিশ্রাম দিয়ে কমান্ডার তাকাহাসি শিমাজাকি, লেফটেন্যান্ট তাঁমৎসু ইমার মতো অভিজ্ঞ পাইলটদের নেতৃত্বে ১২টি ডাইভ বোম্বার, ১৫টি টর্পেডো বোম্বার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় টেকঅফ করে। তাদেরকে ২৭৭ ডিগ্রি বেয়ারিংয়ে ৫২০ কি.মি. দূরে যেতে বলা হয়। এদিকে আগের ৮টি টর্পেডো বোম্বার দিয়ে ২০০ নটিক্যাল মাইল সার্চ করে ফ্লেচারের টাস্কফোর্স ১৭ এর দেখা পায়নি।
এসময় সৌভাগ্যের ছোঁয়া পায় মার্কিন বাহিনী। ৮টি টর্পেডো বোম্বার যখন ২০০ নটিক্যাল মাইল সার্চ করছিল তখন ভারী মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় ফ্লেচারের নৌ-বহর। ফলে গোধূলির অল্প আলোতে তারা ক্যারিয়ারগুলোর অল্প দূর থেকে উড়ে গেলেও মেঘের কারণে কিছু দেখতে পায়নি। এদিকে পৌনে ছয়টার সময় তাকাগির ৩৭০ কি.মি. পশ্চিমে থাকা টাস্কফোর্স ১৭ এর রাডার জাপানি বিমানবহরকে শনাক্ত করে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডার টেকনোলজি একদমই নতুন ছিল। সীমিত রেঞ্জে সামান্য তথ্য দিতে পারতো তখনকার রাডার। তারপরও অ্যাডমিরাল ফ্লেচার প্রায় অন্ধের মতো তার কমব্যাট এয়ার পেট্রোল (CAP) গ্রুপের ১১টি ওয়াইল্ডক্যাট যুদ্ধবিমানকে ঝুঁকি নিয়ে প্রেরণ করেন।
কিন্তু ফাইটার গ্রুপের কমান্ডার পল রামসি, জেমস ফ্ল্যাটলি এর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তারা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে হামলা করেন এবং ৭টি টর্পেডো বোম্বার ও ১টি ডাইভ বোম্বার গুলি করে ভূপাতিত করেন। তাদের ৩টি ওয়াইল্ডক্যাট জাপানিদের গুলিতে ভূপাতিত হয়। ৮ম টর্পেডো বোম্বারটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরে নিজে নিজেই সমুদ্রে বিধ্বস্ত হয়।
প্রথম গ্রুপের এই ৮টি টর্পেডো বোম্বার হারানোর ফলে জাপানিরা কত বড় ক্ষতির শিকার হয় তা বলে বোঝানো যাবে না। এগুলো হাতে থাকলে জাপানিদের ক্ষতিগ্রস্ত ইউএসএস ইয়র্কটাউন ডোবানো একদমই সহজ হয়ে যেত। এই ইয়র্কটাউনই মিডওয়ের যুদ্ধে আরো চারটি জাপানি ক্যারিয়ার ডোবাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই আলোচনা না হয় মিডওয়ে যুদ্ধের লেখার জন্য তোলা থাক।
সন্ধ্যার আগের প্রায় অন্ধকারে হওয়া এই হামলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির কারণে কমান্ডার তাকাহাসি শিমাজাকি মিশন বাতিল করে ফেরত আসার অনুমতি চান। অ্যাডমিরাল তাকাগি অনুমতি দিলে তারা জ্বালানী বাঁচানোর জন্য পেলোড (Payload) কমানোর কৌশলের অংশ হিসেবে নিজেদের বোমাগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে নিজেদের ক্যারিয়ারের দিকে ফিরতে শুরু করেন। ঐ অঞ্চলে সেদিন সূর্যাস্ত হয়েছিল সাড়ে ছয়টায় এবং ঠিক সাতটার সময় তারা মার্কিন ক্যারিয়ার দুটো দেখতে পান। যাওয়ার পথে একটু আগেই টাস্কফোর্স ১৭-কে তারা মেঘের কারণে দেখতে পায়নি। এখন মেঘমুক্ত এলাকায় সন্ধ্যার অন্ধকারেও জাপানিরা মার্কিন ক্যারিয়ার দুটোকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে তখন মেশিনগানের গুলি ব্যতীত আক্রমণ করার আর কোনো অস্ত্র নেই!
একটু আগেই জ্বালানী বাঁচাতে বোমাগুলো পানিতে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এমনকি অন্ধকারে মার্কিন ক্যারিয়ারকে নিজেদের ক্যারিয়ার মনে করে ল্যান্ড করতে গিয়েছিল জাপানি পাইলটরা! মার্কিন অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের গুলি শুরু হলে তারা বুঝতে পারে যে এটা শত্রুর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ঐ মুহূর্তে তাকাগি ও ফ্লেচারের ক্যারিয়ারগুলো পরস্পরের ঠিক ১৯০ কি.মি. দূরে ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জাপানি পাইলটরা নিজেদের ক্যারিয়ার খুঁজে পাচ্ছে না এমন খবর পেয়ে তাকাগি সার্চলাইট জ্বালিয়ে অবশিষ্ট ১৮টি বিমানকে রাত দশটায় ল্যান্ড করার সুযোগ দেন। অ্যাডমিরাল হারার ভুল সিদ্ধান্তে ৯টি বিমান ও কয়েকজন এলিট পাইলট হারায় জাপান। রাতে কেউ আর কাউকে আক্রমণ করার সাহস করেনি। দুই পক্ষই পরদিন সকালের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুটি নিতে থাকে।
ক্যারিয়ার বনাম ক্যারিয়ার যুদ্ধ
এসব কারণে মূল যুদ্ধ ৮ মে-তে গড়ায়। ভাইস অ্যাডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি তাকাগিকে অবিলম্বে মার্কিন ক্যারিয়ার ধ্বংসের নির্দেশ দেন এবং রাতের মধ্যেই আরো ২৪০ কি.মি. উত্তরে সরে যেতে বলেন যেন সকালবেলা দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে আলাদাভাবে দুটো স্কাউট টিম প্রেরণ করতে পারেন। কেননা তিনি পোর্ট মোর্শবি হামলার তারিখ ১০ থেকে পিছিয়ে ১২ তারিখ নির্ধারণ করে অ্যাডমিরাল গোটোর ইনভেশন ফোর্সকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। ফলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সের কমান্ডার গোটোর নৌবহরের খুঁজতে খুঁজতে অযথা সাগরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ফ্লেচারের ক্যারিয়ার যদি অরক্ষিত ইনভেশন ফোর্সে হামলা করে তবে মারা যাবে ল্যান্ডিংয়ের অপেক্ষায় থাকা ৫ হাজার পদাতিক সৈনিকসহ অসংখ্য নাবিক। তাই তাকাগি রাতের মধ্যেই নির্ধারিত পজিশনে চলে আসেন। এই সুযোগে দুই পক্ষের ক্লান্ত পাইলটরা ঘুমিয়ে নেয় এবং রাতের মধ্যেই সব বিমান উড্ডয়ন করার মতো প্রস্তুতি সেরে ফেলে যেন একদম ভোরে আকাশে ওড়া সম্ভব হয়।
রাতের জাপানি বিমান ল্যান্ডিংয়ের ঐ ঘটনার পর ফ্লেচার জানতেন শত্রু ক্যারিয়ার তার খুব নিকটেই আছে। তাই সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে তিনি অ্যাডমিরাল ফিচকে ৩৬০ ডিগ্রি সার্চ করতে ১৮টি স্কাউট বিমান প্রেরণ করতে নির্দেশ দেন। বিমানগুলোকে ৩৭০ কি.মি. এলাকা সার্চ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ঘন মেঘের ফাঁক দিয়ে লেক্সিংটনের স্কাউট পাইলট জোসেফ স্মিথ কোনোরকমে জাপানি ক্যারিয়ার ফোর্সকে দেখতে পেয়ে টাস্কফোর্স ১৭-কে রিপোর্ট করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী অ্যাডমিরাল ফ্লেচার নিজেদের ৩৯০ কি.মি. দূরে জাপানি ক্যারিয়ার ফোর্সকে খুঁজে পান।
এসময় তার হাতে ১১৭টি অপারেশনাল বিমান ছিল। ৯টা ২৫ মিনিটের মধ্যেই তার ৭৫টি বিমান আক্রমণের জন্য রওনা হয়ে যায়। তবে দুটো ক্যারিয়ার পৃথক পৃথক স্ট্রাইক গ্রুপ প্রেরণ করে ইয়র্কটাউন গ্রুপে ছিল ৬টি ফাইটার, ২৪টি ডাইভ বোম্বার ও ৯টি টর্পেডো বোম্বার। এরা ৯টা ১৫ মিনিটে আকাশে ওড়ে। লেক্সিংটন গ্রুপের ৯টি ফাইটার, ১৫টি ডাইভ বোম্বার ও ১২টি টর্পেডো বোম্বারের দ্বিতীয় স্ট্রাইক গ্রুপ ৯টা ২৫ মিনিটে আকাশে ওড়ে। (প্রিয় পাঠক, আর্টিকেলের এই পর্যায় থেকে সময় নির্দেশক শব্দগুলোর দিকে আপনার বাড়তি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাহলেই পুরো পরিস্থিতি সহজে অনুধাবন করতে পারবেন। )
এদিকে অ্যাডমিরাল হারা সকাল ৬টা ১৫-তে ৭টি স্কাউট বিমান প্রেরণ করেন। এগুলো মার্কিন ক্যারিয়ারের আনুমানিক বেয়ারিং ১৪০ থেকে ২৩৫ ডিগ্রি বরাবর ৪৬০ কি.মি. পর্যন্ত সার্চের নির্দেশ দেয়া হয়। এদেরকে সার্চের কাজে সাহায্য করতে তুলাগি থেকে তিনটি সি-প্লেন ও রাবাউল থেকে চারটি মিতসুবিসি জি-ফোর বোম্বার পাঠান ফ্লিট কমান্ডার অ্যাডমিরাল ইনোয়ি। সকাল সাতটায় তাকাগি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স নিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে যান এবং অ্যাডমিরাল গোটোর পাঠানো ক্রুজার ফোর্সের সাথে মিলিত হন। ইতিমধ্যে অ্যাডমিরাল গোটো তার ইনভেশন ফোর্স নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সের রেঞ্জের বাইরে উডলাক আইল্যান্ডের ৭৪ কি.মি. পূর্বে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে আসন্ন ক্যারিয়ার যুদ্ধের ফলাফল শোনার আশায় রেডিওতে কান পেতে বসে আছেন।
জাপানি ক্যারিয়ার ‘শকাকু’ এর স্কাউট পাইলট লেফটেন্যান্ট ‘কেনজো কানো’ সকাল ৮টা ২২ মিনিটে মার্কিন ক্যারিয়ারের অবস্থান শনাক্ত করেন। অর্থাৎ মাত্র ফ্লেচারের মাত্র দুই মিনিট পর অ্যাডমিরাল তাকাগি শত্রু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের খোঁজ পান। তার হাতে ৯৫টি অপারেশনাল বিমান ছিল, কিন্তু পাইলট সংকট ও অন্যান্য কারণে তিনি ৬৯টি বিমান হামলার উদ্দেশ্যে পাঠাতে সক্ষম হন। এর মধ্যে তার ১৮টি ফাইটার, ৩৩টি ডাইভ বোম্বার ও ১৮টি টর্পেডো বোম্বারের সমন্বয়ে কম্বাইন্ড স্ট্রাইক ফোর্স সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে টেকঅফ করে। অর্থাৎ ইয়র্কটাউন গ্রুপের বিমানগুলোর সাথে সাথে জাপানি পাইলটরাও আকাশে উড়াল দেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার তাকাহাসি এবং শিমাজাকি।
দুই পক্ষের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো একে অন্যের দিকে পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যায় যেন নিজেদের বিমানগুলোর ফিরতি পথ সংক্ষিপ্ত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রায় একই সময়ে বিমানগুলো একে অপরের ক্যারিয়ারে হামলা করে! এজন্য হামলা চলাকালে দুই পক্ষের ক্যারিয়ারগুলোর কাছে নিজের এয়ার প্রটেকশনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিমান ও পাইলট হাতে ছিল না! ফলে আক্রমণের ধাক্কা দুই পক্ষের জন্যই বিধ্বংসী ছিল।
ভাগ্য বনাম ভুল সিদ্ধান্ত
এবার সব দিক দিয়েই ভাগ্যের সহায়তা পায় গত দুই দিনের দুর্ভাগা জাপানিরা। রাতের মধ্যেই ঘন মেঘ মার্কিনিদের উপর থেকে সরে গিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে আসে। জাপানি ক্যারিয়ারগুলো যে কোর্স ও স্পিড নিয়ে আগাচ্ছে তাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ক্লাউড কাভারেজ পেয়ে যাবে। ফলে ভিজিবিলিটি কমে মাত্র ৪ থেকে ২৮ কি.মি-তে নেমে আসবে যা দিনের আলোতেও মার্কিন পাইলটদের জন্য টার্গেট খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে মার্কিন ক্যারিয়ারের উপর আকাশ এতটাই পরিস্কার যে খালি চোখেই ৩১ কি.মি. দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলেও মার্কিনিরা নিজেদের ভুলের কারণে পরে আফসোস করে। ইয়র্কটাউন ডাইভ বোম্বারগুলো আকাশে আগে উঠলেও তারা গতি কমিয়ে রেখেছিল যেন ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটন থেকে সবার শেষে টেকঅফ করা টর্পেডো বোম্বারগুলো যেন তাদের সাথে যোগ দিতে পারে। ফলে দুই বিমান একসাথে হামলা করবে জাপানি ক্যারিয়ারে। কিন্তু ১০টা ৩২ মিনিটে জাপানি ক্যারিয়ারের অঞ্চলে পৌঁছে গেলেও মাত্র ২৫ মিনিট দেরি করে আক্রমণ শুরু করে জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘যুইকাকু’ খারাপ আবহাওয়ার অঞ্চলে প্রবেশ করে ফেলে। এসময় দুটো ক্যারিয়ার পরস্পরের ৯ কি.মি. এর মধ্যে থাকলেও ভারী মেঘের কারণে ‘যুইকাকু’ কে আর দেখতেই পায়নি। ফলে মার্কিন বিমান হামলার পুরো ধাক্কাটি ‘শকাকু’ কে হজম করতে হয়।
সাড়ে ১০টায় শনাক্ত হওয়া অপর ক্যারিয়ার শকাকুর উপর ১১টায় তারা হামলা করে। এই সামান্য দেরির সুযোগে আগে থেকে কমব্যাট এয়ার পেট্রোল (CAP) মিশনে আকাশে থাকা ১০টি ফাইটারের সাথে আরো ৬টি বিমান আকাশে ওড়ায় তাদের এয়ার কাভার ডিফেন্সের জন্য। প্রথমে ৭টি ডাইভ বোম্বার হামলা চালায়, কিন্তু শকাকু একেবেঁকে সবগুলো বোমা ফাঁকি দেয়। তারপর আরো ১৭টি ডাইভ বোম্বার একযোগে হামলা চালায়। এ সময় দুটি এক হাজার পাউন্ডের বোমা জাপানি ক্যারিয়ারটির ফ্লাইট ডেকের একদম সামনের অংশে আঘাত করে। বাকিরা শকাকু ও তার এসকর্ট যুদ্ধজাহাজগুলোর এন্টি এয়ারক্রাফট গানের প্রচন্ড গুলির মুখে টার্গেটে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়।
জন পাওয়ার নামের একজন পাইলট দ্বিতীয় বোমাটি নিখুঁতভাবে ফেলার জন্য এতটাই নিচে নেমে এসেছিলেন যে ডাইভ দিয়ে বোমা ফেলার পর আর বিমান সোজা করার পর প্রচন্ড গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাগরে ক্রাশ করেন। এতে তিনি ও তার টেইল গানার (দ্বিতীয় ককপিটে থাকা মেশিনগানার) নিহত হন। তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননার মরণোত্তর ‘মেডেল অফ অনার’ পদক দেয়া হয়। তার বোমাটি শকাকুর মারাত্মক ক্ষতি করে। এ সময় যাদের জন্য হামলা শুরু করতে দেরি করা হয়েছিল সেই ইয়র্কটাউন টর্পেডো বোম্বার গ্রুপের ৯টি বিমানই তাদের টর্পেডো মিস করে। এছাড়া ডগফাইটে (আকাশযুদ্ধ) দুটি মার্কিন ডাইভ বোম্বার এবং দুটি জাপানি জিরো ফাইটার ভূপাতিত হয়।
সাড়ে এগারোটায় আক্রমণে আসে লেক্সিংটন এয়ারগ্রুপ। আরো একটি এক হাজার পাউন্ডের বোমা শকাকুর ফ্লাইট ডেকে আঘাত করে। বোমার আগুন এবং সেকেন্ডারি এক্সপ্লোশান জাহাজটির মারাত্মক ক্ষতি করে। এ সময় ২৩৩ জন ক্রু আহত/নিহত হয়। তবে জাহাজটির ইঞ্জিনরুম সচল থাকায় এটি তখনও ফুল স্পিডে চলতে পারছিল। ফলে লেক্সিংটন টর্পেডো বোম্বার গ্রুপের ১১টি টর্পেডোই ফাঁকি দেয় শকাকু।
এদিকে যুইকাকুর উদ্দেশ্যে ডাইভ দেয়া দুটো বিমানই খারাপ আবহাওয়ার কারণে টার্গেট মিস করে। বাকিরা ঘন মেঘের কারণে টার্গেটই খুঁজে পায়নি। এ সময় ১৩টি জাপানি জিরো ফাইটারের বিরুদ্ধে ১৫টি ওয়াইল্ডক্যাটের আকাশযুদ্ধে ৩টি মার্কিন বিমান ভূপাতিত হয়। শকাকুর ফ্লাইট ডেক এত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে এর ক্যাপ্টেন টাকাতসুগো যোজিমা জাহাজটিকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে অবিলম্বে পিছু হটার আবেদন করেন। অ্যাডমিরাল তাকাগি ও হারা একমত হন এবং দুটো ডেস্ট্রয়ারের প্রহরায় সোয়া বারোটায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে শকাকু। এসময় আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছিল জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি।
মার্কিন ক্যারিয়ারে হামলা
১০টা ৫৫ মিনিটে লেক্সিংটনের CXAM-1 রাডার ১২৬ কি.মি. দূরে বিশাল বিমানবহর শনাক্ত করে সেদিকে কমব্যাট এয়ার পেট্রোল (CAP) গ্রুপের ৯টি ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার প্রেরণ করে। উল্লেখ্য, তখনও রাডার টেকনোলজির শৈশবকাল চলছে এবং এগুলো তেমন আগত বিমানের রেঞ্জ বলতে পারলেও উচ্চতা কত সেটি হিসাব করতে পারতো না।
সাধারণত টর্পেডো বোম্বারগুলো খুব নিচু হয়ে উড়ে আসে। তাই ৬টি ওয়াইল্ডক্যাট মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে গেল ইন্টারসেপ্ট করতে। কিন্তু জাপানিরা সেদিন বিকল্প কৌশল গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। গতকাল রাতে অযথা ৮টি টর্পেডো বোম্বার হারানোয় এখন ফুলস্কেল টর্পেডো অ্যাটাক করা সম্ভব নয় বিধায় কমান্ডার শিমাজাকি ১৪টি টর্পেডো বোম্বার লেক্সিংটনে এবং ৪টি বিমান ইয়র্কটাউনে হামলা করতে পাঠান। তাছাড়া মার্কিন ক্যারিয়ারকে শনাক্ত করা শকাকুর সেই স্কাউট পাইলট লেফটেন্যান্ট কেনজো কানো ফেরার পথে জাপানি বিমানবহরের সাথে মিলিত হন। তার ফুয়েল প্রায় শেষের দিকে ছিল। তারপরও তিনি অ্যাটাক ফোর্সকে পথ দেখিয়ে মার্কিন ক্যারিয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
এজন্যই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছিল জাপানি বিমানবহর। কেনজো তখনও নিজের ক্যারিয়ার শকাকুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর জানতেন না। তারপরও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে জাপানি পাইলটদের কামিকাজি (আত্মঘাতী) স্বভাব কাজ করেছিল। তিনি জানতেন যে আকাশ পরিস্কার থাকায় অধিক উচ্চতা থেকেও মার্কিন ক্যারিয়ারগুলো দেখা যাবে।
এদিকে ওয়াইল্ডক্যাটগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করতে পাঠানোর কারণে লেক্সিংটন ও ইয়র্কটাউন থেকে যথাক্রমে ১৫ ও ৮টি ডাইভ বোম্বার কমব্যাট এয়ার পেট্রোলের জন্য আকাশে ওড়ানো হয়। আক্রমণের সময় ৪টি টর্পেডো বোম্বার গুলি করে ভূপাতিত করে ডন্টলেস ডাইভ বোম্বার। এসব মার্কিন বিমান মূলত আকাশযুদ্ধে দক্ষ নয়। তাই ইয়র্কটাউনের চারটি ডন্টলেস অনায়াসে জাপানি জিরো ফাইটারের শিকার হয়। জ্বালানী কম থাকায় যুদ্ধের সময় কেনজোর বিমানটি আকাশে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তবে শেষদিকে দিকে জিরো ফাইটারের সঙ্গী হিসেবে আকাশযুদ্ধে অংশ নেন।
জাপানিদের মূল হামলা শুরু হয় সকাল সোয়া এগারোটায়। এ সময় দুটো মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পরস্পরের ২.৫ কি.মি. দূরে ছিল। ইয়র্কটাউনে হামলা করা চারটি টর্পেডো বোম্বারই তাদের টার্গেট মিস করে। ইয়র্কটাউনের তুলনায় পুরনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার লেক্সিংটনের হার্ডশিপ টার্ন নিয়ে ম্যানুভার করার ক্ষমতা কম ছিল। ফলে বাকি ১৪টি টর্পেডো বোম্বার তার জন্য আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়। এটি যথাসাধ্য একেবেঁকে টর্পেডো ফাঁকি দিতে শুরু করে।
এমনও হয়েছে যে লেক্সিংটনের দুপাশ দিয়ে দুটো টর্পেডো বুলেটের মতো পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। কিন্তু কমান্ডার শিমাজাকি ও তার পাইলটরা ছিল মার্কিনিদের চেয়ে দক্ষ। চারটি টর্পেডো বোম্বার এন্টি-এয়ারক্রাফট গানের গুলিতে ভূপাতিত হলেও বাকিরা একদম কাছে গিয়ে টর্পেডো হামলা করেন। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে দুটো টর্পেডো আঘাত করে ইউএসএস লেক্সিংটনকে। একটি এভিয়েশন ফুয়েল স্টোরেজ ক্ষতিগ্রস্ত করায় পুরো জাহাজে গ্যাসোলিন বাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় টর্পেডো পোর্টসাইডের ওয়াটারলাইনে বিদীর্ণ করে। এর ফলে সামনের দিকে তিনটি ফরোয়ার্ড ফায়ার রুমের ওয়াটারপ্রেশার কমে গিয়ে একটি বয়লার অচল হয়ে যায়। অপর বয়লারের সাহায্যে জাহাজটি এখনও ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪৪ কি.মি. গতি তুলতে সক্ষম। তবে এটি ডাইভ বোম্বারের হাত থেকে বাঁচতে যথেষ্ট নয়।
৩৩টি ডাইভ বোম্বার টর্পেডো বোম্বারের অ্যাটাক শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত আকাশে শিকারি ঈগলের মতো ৩/৪ মিনিট ধরে ঘুরতে থাকে। তাদের হামলা শুরু হতেই শকাকু থেকে আসা কমান্ডার তাকাহাসির ১৯টি ডাইভ বোম্বার লেক্সিংটনকে এবং তামৎসু ইমার ১৪টি বিমান ইয়র্কটাউনের উদ্দ্যেশে ১৪ হাজার ফুট উপর থেকে ঈগলের মতো ডাইভ শুরু করে।
৪টি ওয়াইল্ডক্যাট কমান্ডার তাকাহাসির বোম্বার গ্রুপকে ইন্টারসেপ্ট করতে চাইলে তাদেরকে বাধা দেয় জিরো ফাইটারগুলো। কিন্তু লেফটেন্যান্ট ইমার গ্রুপকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় ইয়র্কটাউনের ওয়াইল্ডক্যাট বিমানগুলো। অনেকগুলো বোমা অল্পের জন্য মিস হলেও লেক্সিংটনের ফ্লাইট ডেকে পরপর দুটি বোমা আঘাত করে। এই দুটো বিস্ফোরণ বিশালকায় জাহাজটির মরণঘন্টা বাজিয়ে দেয়।
দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায় নাবিকরা। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে লেফটেন্যান্ট তামুৎসু ইমার ডাইভ বোম্বার গ্রুপ ইয়র্কটাউনের ফ্লাইট ডেকের ঠিক মাঝখানে একটি আড়াইশো কেজির বোমা আঘাত করে। অন্যান্য জাপানি বোমার তুলনায় এটি আকারে ছোট হলেও এটি ছিল আরো বিধ্বংসী। সেমি-আর্মার পিয়ার্সিং শ্রেণীর বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগে জাহাজের চারটি ডেক ভেদ করে ভেতরে ঢুকে তারপর বিস্ফোরিত হয়। এতে ১৩ ফুট ব্যাসের বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয় এবং ৬৬ জন নাবিক হতাহত হয়। এই বোমাটি আঘাত করার পর আরো ১২টি বোমা একেবেঁকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয় ইয়র্কটাউন। তাদের একটি ওয়াইল্ডক্যাটের হাতে দুটো ডাইভ বোম্বার ভূপাতিত হয়।
জাপানি বিমানগুলো হামলা শেষ করে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মার্কিন কমব্যাট এয়ার পেট্রোল (CAP) গ্রুপের বিমানদের বিরুদ্ধে ডগফাইটে লিপ্ত হয়। ছোটখাট এই আকাশযুদ্ধে তিনটি ওয়াইল্ডক্যাট ও তিনটি ডন্টলেসের হাতে তিনটি টর্পেডো বোম্বার, একটি ডাইভ বোম্বার ও একটি জিরো ফাইটার ভূপাতিত হওয়ার পর জাপানিদের মনোবল ভেঙে পড়ে।
কমান্ডার তাকাহাসি পাইলটদের বাড়ির পথ ধরার নির্দেশ দেন। ঠিক বারোটার সময় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলো আক্রমণ শেষে নিজেদের ক্যারিয়ারে ফেরার সময় একে অপরকে অতিক্রম করে। এসময় দুই পক্ষের জ্বালানী ছিল একদম তলানিতে। তারপরও দু’পক্ষ একে অপরের উপর গুলি চালায়। তবে এতে কেবল জাপানিদেরই দুটো বিমান ভূপাতিত হয়, যার একটি ছিল তাকাহাসির। অপর বিমানটি লেফটেন্যান্ট কেনজো কানোর, যিনি জাপানি বিমানবহরকে পথ দেখিয়ে মার্কিন ক্যারিয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই বিমান হামলায় জাপানিরা যেমন নিখুঁতভাবে হামলা করেছে, মার্কিনিরা তেমনভাবে পারেনি। আবার জাপানিরা এই মিশনে যে পরিমাণ বিমান হারিয়েছে তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি তেমন কিছুই নয়।
তাহলে এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জিতলো?
(চলবে)