কাইল মায়ার্স বলতে গেলে অসাধ্যই সাধন করেছেন। এশিয়ার মাটিতে প্রায় ৪০০ রান তাড়া করে ফেলবে কোনো দল, সে দিবাস্বপ্ন অনেকেই দেখেন না। সেটা অবশ্য কেউ দেখেনওনি এর আগে। অথচ সাগরিকায় মায়ার্স করে দেখালেন সেটিই।
অভিষেক টেস্টেই খেলেছেন ২১০ রানের অপরাজিত ইনিংস, ৩৯৫ রানের পাহাড় টপকে দলকে এনে দিয়েছেন জয়। অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরিই নেই কারো, এশিয়ায় চতুর্থ ইনিংসে কস্মিনকালেও কোনো ব্যাটসম্যান দু’শো পেরোতে পারেননি। মায়ার্স পেরেছেন।
মায়ার্সের ইনিংস নিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেছেন, অসাধারণ খেলেছেন এই ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান। কিন্তু মুমিনুল কিন্তু চাইলেও বলতে পারতেন, ‘ইউ আর ওয়েলকাম!’
কেন? কেন মায়ার্স ধন্যবাদ দেবেন মুমিনুলকে? এগুলো প্রশ্ন নয়। বরং প্রশ্ন, কেন দেবেন না?
পঞ্চম দিনের প্রথম সেশনেই আউট ছিলেন মায়ার্স। কিন্তু তাইজুল ইসলামের বলে লেগ বিফোরের আবেদনে আম্পায়ার সাড়া দেননি। মুমিনুলও আর রিভিউ নিতে পরোয়া করেননি। অথচ মায়ার্স আউট ছিলেন!
পুরো টেস্টেই দেখা গিয়েছে মুমিনুলের রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব। যেই দ্বিতীয় ইনিংসে চতুর্থ দিন শেষে জয়ের পথেই বাংলাদেশ, সেখান থেকে দুজন অভিষিক্ত ব্যাটসম্যান যে ম্যাচ বের করলেন, তা তাদের কৃতিত্ব অবশ্যই। কিন্তু, দায় নিতে হবে মুমিনুলকেও।
কেন? অধিনায়ক তো বলেছেনই, বোলাররা ভালো জায়গায় বল করতে পারলে, সুযোগ নিতে পারলে, ফল বাংলাদেশের পক্ষে আসতো।
বললেই হয়ে গেল? সেই ফল পক্ষে আনার চেষ্টা কোথায়? পুরো দিনজুড়ে ক্লোজ-ইন ফিল্ডার বেশিরভাগ সময়েই ছিলেন মাত্র দুইজন, একজন স্লিপে, অন্যজন সিলি মিড অফ কিংবা শর্ট লেগে। অর্থাৎ, এনক্রুমাহ বোনার জানতেন, মিরাজ কিংবা নাঈমের অফ স্পিন তিনি লেগ স্লিপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন। তাইজুলের অফ স্পিনটা একটু হাওয়ায় ভাসিয়ে অফসাইডে খেললেও দোষ নেই। ব্যাপারটি একই মায়ার্সের জন্যও।
মুস্তাফিজ যখন নতুন বল হাতে নিলেন, তার জন্যও মাত্র দু’জন খেলোয়াড় ক্যাচিং পজিশনে – ফার্স্ট স্লিপ ও গালি। সেই দ্বিতীয় স্লিপের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ক্যাচ চলে গিয়েছে কমপক্ষে দু’টি।
এসবের দায় মুমিনুল কীভাবে এড়াবেন? বোলারদের সমর্থন দেওয়ার যে বিষয়টি, সেটি না করার অপরাধ মুমিনুল কীভাবে অস্বীকার করবেন?
রিভিউ নেওয়ার ব্যাপারে পুরো দায়ই মুমিনুলকে নিতে হবে। একজন বোলার কিংবা উইকেটরক্ষক মিলে অধিনায়ককে বলতে পারেন এ ব্যাপারে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি তার। সেখানে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখিয়েছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতা।
আপনার বোলার যখন নাঈম হাসানের মতো তরুণ একজন বোলার, তিনি অবশ্যই রিভিউ নেওয়ার ব্যাপারে চাপ দিতে দ্বিধায় ভুগবেন। সেখানেই এগিয়ে আসার কথা অধিনায়কের। অথচ মুমিনুল যেন নিজেই এখনও সদ্য দলে জায়গা পাওয়া তরুণ, সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করছেন না। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তাসকিন আহমেদের বলে জস বাটলারকে আউট দেননি আম্পায়ার, তাসকিনের কথা শুনে মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা নিজে থেকে রিভিউ নিয়েছিলেন। ফলাফল, বাটলার আউট, ম্যাচ বাংলাদেশের পকেটে।
মুমিনুল যদি বিন্দু পরিমাণ কনভিকশন দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হেলাফেলা না করতেন, তাহলে হয়তো আউট হতেন মায়ার্স কিংবা বোনার। আট বছর হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে, তবু যদি দোলাচলে ভোগেন একটি সিদ্ধান্ত নিতে, তবে তার দায় আপনার ঘাড়েই বর্তায়। যদি এত বছর খেলার পরও তামিম-সাকিব-মুশফিকদের কথা ছাড়া কিছু না করেন, তাহলে সামনে এগুনোর পথটা থাকছে কী করে?
তবে রিভিউয়ের ক্ষেত্রে দোষটা পুরোটা মুমিনুলকে না দিয়ে লিটন দাসকেও ভাগ দেওয়া যায়। টেস্টে উইকেটকিপারের ভূমিকা কেবল বল ধরাই নয়, বরং আরও অনেক কিছু। সেখানে লিটনকে যেন কেউ নামিয়ে দিয়েছে গত শতকের শুরুর দিকের কোনো এক নির্বাক সিনেমায়। ব্যাটসম্যানের মনোযোগ নাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা কিপারদেরই দেওয়া হয়, ঋষভ পন্ত অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে যা করে দেখিয়েছেন। যে মুশফিকের কিপিং নিয়ে এত সমালোচনা, তিনিও অন্তত চুপ থাকতেন না।
কিন্তু লিটন যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি, কথা বলবেনই না। এমনকি রিভিউ নেওয়ার সময় সিদ্ধান্ত জানানো, সেটিতেও খুব জোর গলায় ইনপুট দিচ্ছেন না। অথচ স্রেফ দেশের সেরা ব্যাটিং প্রতিভা বলেই লিটন দেশের সেরা উইকেটকিপার নুরুল হাসান সোহানের বদলে একাদশে জায়গা পাচ্ছেন। লিটনকে ব্যাটিং অর্ডারে ওপরে তুলে সোহানকে খেলানোর সময় এসেছে কি না, সেটি ভাবারও সময় হয়তো এসেছে ম্যানেজমেন্টের।
আবারও ফেরা যাক মুমিনুলের কাছে। শেষ দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ৯০ ওভারে ২৮৫ রান। দিনকয়েক আগেই গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়ায় মহাকাব্য রচনা দেখেও কি মুমিনুলের মনে হয়নি, উইকেট না নিলে এই ম্যাচে হার ভিন্ন অন্য কোনো ফলাফল সম্ভব নয়? হ্যাঁ, কাইল মায়ার্স নিঃসন্দেহে নিজের ক্যারিয়ারের, এমনকি তার পুরো ক্যারিয়ারেরই হয়তো, সেরা ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উইকেট বের করার তাগাদাটা কোথায় ছিল?
ব্যাটসম্যান কোনো জায়গা দিয়ে বাউন্ডারি মারলেই সেখানে বাউন্ডারিতে ফিল্ডার দিচ্ছেন, সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন। তাতে লাভ কী হয়? ব্যাটসম্যান সিঙ্গেল নিয়ে চাপ কমানোর সুযোগ পান। যে বোলারকে খেলতে পারছেন না, তার বোলিং থেকে রেহাই পান। ব্যাটসম্যানকে যখন আপনি সেট হতে দিচ্ছেন, উইকেট পাবেন কোথা থেকে?
আবারও ফিরে যাই ক্লোজ-ইন ফিল্ডারের প্রসঙ্গে। পুরো দ্বিতীয় ইনিংসে মুমিনুল কি বোলারের সঙ্গে মিলে কোনো পরিকল্পনা সাজিয়েছেন? তিনি চোটে উঠে যাওয়ার পর তামিম যেভাবে নাঈমকে বোঝালেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে, সেটি মুমিনুল কি সারা দিনে তার স্পিনারদের সঙ্গে করেছেন? ব্যাটসম্যানের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে পরিকল্পনা সাজিয়েছেন?
ম্যাচের পর তিনি বলেছেন বোলাররা আরেকটু ভালো লাইন-লেংথে বল করলে ফল হয়ত ভিন্ন রকম হত। হ্যাঁ, হতে পারতো। কিন্তু বোলারদের নিয়ে ভিন্ন লাইনে চিন্তা কি মুমিনুল নিজে করেছেন?
করলেও মাঠে সেটির প্রয়োগ দেখা যায়নি। বরং মনে হয়েছে, মুমিনুল এবং বাংলাদেশ দল অপেক্ষায় রয়েছে, কখন কেউ না কেউ একটি ম্যাজিক ডেলিভারি করবেন কিংবা ব্যাটসম্যান ভুল করবেন, যাতে ভর করে জয়ের পথে পা বাড়াবেন তারা।
হ্যাঁ, কাইল মায়ার্স অসাধারণ খেলেছেন। হ্যাঁ, মুমিনুল হক এখনও টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অনভিজ্ঞ, মাত্র এটি পঞ্চম টেস্ট। হ্যাঁ, বোলার, টিম ম্যানেজমেন্ট, সবারই হয়তো দোষ ছিল। কিন্তু যখন আপনি অধিনায়ক, মাঠে আপনার কাজ কেবল ব্যাটসম্যান কিংবা ফিল্ডার হিসেবে নয়, আরও অনেক কিছু। ক্রিকেট-ফুটবল নয়, এখানে অধিনায়কের দায়িত্ব অনেক বড় কিছু।
অধিনায়কত্বের পাঁচ টেস্টে মুমিনুলের দু’টি সেঞ্চুরি ইতঃমধ্যে, গড়ে আড়াই ইনিংসে দুটি। হয়তো অধিনায়কত্বের চাপটা ব্যাটিংয়ে লাগছে না আপনার। কিন্তু ক্যাপ্টেন, অধিনায়কত্বের কী হবে? সেখানে উন্নতি যে বড় দরকার!
বাংলাদেশ ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড তো দূরে থাক, পাকিস্তানের মতো সমৃদ্ধ বোলিং লাইনআপ নিয়েই নামে না। বাংলাদেশের স্পিনারদের উইকেট পেতে হয় ভিন্ন চিন্তা করে, অথবা র্যাংক টার্নারে। সেখানে অধিনায়কের দায়িত্বটা একটু বাড়তি, সেটি অন্তত এই টেস্টে পালন করতে পারেননি মুমিনুল।
হয়তো সামনে পারবেন। হয়তো সামনে দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব করে চমক লাগিয়ে দেবেন কক্সবাজারের সৌরভ। কিন্তু এই টেস্টের ভুলগুলো শোধরানো যাবে না, মিনি।
পুরো বিশ্ব কাইল মায়ার্সের অনন্য ইনিংসের জন্য সাগরিকা টেস্টকে মনে রাখুক। আপনি মনে রাখুন আপনার অধিনায়কত্বের ভুলের জন্য, সেখান থেকে শেখার জন্য। আপাতত প্রত্যাশা এটুকুই।