Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি: দ্বিতীয় পর্ব

হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, সেয়ানে সেয়ানে; কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। যে-ই মনে হচ্ছে, একটি দলের বাজিমাৎ হবে, সঙ্গে সঙ্গে অপর দলটি উলটে দিচ্ছে পাশার দান। সব হিসেব-নিকেশ মুহূর্তেই বদলে যায়। যখনই কোনো একটি দলকে নিতান্ত যাচ্ছেতাই মনে হয়, ঠিক তখনই দলটি উদ্ভাসিত হয় সামর্থ্যের সবটা মেলে। নিংড়ে দিয়ে নিজেদের, প্রমাণ রাখে তাদের ঝেড়ে ফেলার সময় হয়নি এখনো। প্রত্যেকটি টেস্ট, প্রতিটি মুহূর্ত ছড়িয়েছে উত্তেজনা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দল দুটি লড়াই করে গেছে। কেউ কাউকে তিল পরিমাণ দেয়নি ছাড়। স্মরণকালের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ও রোমাঞ্চপূর্ণ সিরিজ শেষে ক্রিকেট-জনতার নতুন করে উপলব্ধি হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার অনন্য সৌন্দর্য।

সেই সৌন্দর্য্যের স্ন্যাপশট-স্বরূপ আমাদের এই আয়োজন। বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি ২০২০-২০২১ এর চারটি টেস্টকে শব্দগুচ্ছে বন্দী করে চারটি অধ্যায় ও তিনটি পর্বের সমন্বয়ে সাজানো আমাদের এই উপস্থাপনা। আজ থাকছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়; দ্বিতীয় পর্ব।

টিম পেইন ফুরফুরে, চিন্তিত অজিঙ্কা রাহানে; Image Source: cricket.com.au

দ্বিতীয় অধ্যায়

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বহু ইতিহাস ও ক্ল্যাসিকের সাক্ষী। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ঐতিহ্যের গৌরবময় অংশীদার, ক্রিকেট কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একটানা ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট আয়োজনের অহঙ্কার এমসিজির অঙ্গে, তারও আগে শেফিল্ড শিল্ড টুর্নামেন্টের ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস মধ্যকার ম্যাচ আয়োজন হতো। ১৯৮২-এর অ্যাশেজ ক্ল্যাসিক — যেখানে ইংল্যান্ডের জয় মাত্র ৩ রানে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার লিডও ছিল মাত্র তিন রান, ধুন্ধুমার উত্তেজনার চতুর্থ দিনের বিকেল পেরিয়ে অবাক উত্তেজনার পঞ্চম দিনের সকাল, বোর্ডার-থম্পসনের শেষ উইকেটে শ্বাসরুদ্ধকর ৭০ রান… এক অবাক ক্ল্যাসিকের উপাখ্যান যেন! ১৯৯৮-এর অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মের অ্যাশেজও উত্তেজনা ছড়িয়েছিল অতিমাত্রায়। ১২ রানের জয়ে সেখানেও শেষ হাসির মালিক অ্যালেক স্টুয়ার্টের ইংল্যান্ড।

সেই এমসিজিতে ভারত ৩৬-এর দুঃখ ভুলতে চায়, অস্ট্রেলিয়া চায় সিরিজে নিরঙ্কুশ আধিপত্য।

ভারত মাথা তুলতে চায়, অস্ট্রেলিয়া চায় ঘন ঘন এমন উচ্ছ্বাস-মুহূর্ত; Image Source: cricket.com.au

এক.

দলের নেতা তিনি, এই দলটা তার। লোকে বলে বিরাটের ভারত। গত কয়েক বছরে দলটাকে গড়েছেন বহু শ্রম, চিন্তা ও পরিকল্পনা দিয়ে। বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সখ্যতা সেই বয়সভিত্তিক দল থেকে। জীবনে যে জিনিসটা তিনি অপছন্দ করেন সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে পরাজয়। অথচ আগের টেস্টেই ৩৬-এর লজ্জা মাথা পেতে নিতে হয়েছে। পরের টেস্টে সেই লজ্জা উপশমের জন্য থাকার উপায় নেই। সতীর্থদের সঙ্গে লম্বা আলাপ জুড়েছেন, বিদায় নিয়েছেন, বলেছেন যা হয়েছে ভুলে যেতে। জীবনে উত্থান-পতন থাকেই, অতীত আঁকড়ে নয়, বাঁচতে হবে ভবিষ্যত সুন্দরতর করার বাসনা বুকে চেপে। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন যাকে, তার উপর অগাধ আস্থা রাখেন বিরাট। আজিঙ্কা রাহানে কাঁধ পেতে নিয়েছেন সেই দায়িত্ব। কোনো আড়ষ্টতা নেই, সংকোচ নেই, জড়তা নেই। জানেন, তাকে কী করতে হবে। প্রথমেই ভুলে যেতে হবে কী হয়েছিল, আরো ভুলে যেতে হবে দলে কে আছে কে নেই। সেরা এগারোজনই এই দলের অংশীদার — মাথায় গেঁথে নিতে হবে তা।

ছোটবেলায় অনেকটা পথ মায়ের সঙ্গে হেঁটে ক্রিকেটের ক্লাসে যেতেন অজিঙ্কা, সঙ্গে পিলপিল পায়ে হাঁটতো পুঁচকে ভাইটাও। আজিঙ্কার ক্রিকেট ব্যাগ বইতো সে। আজিঙ্কা জানেন তার পরিবার কী পরিমাণ ত্যাগ করেছে, কী পরিমাণ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছে। জীবনের কঠিনতম দিনগুলির সঙ্গে কুস্তি লড়ার অভিজ্ঞতায় ভরপুর আজিঙ্কার ঝুলি। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো দলটাকে সাহসের সঙ্গে পথচলার মন্ত্র শোনান আজিঙ্কা রাহানে; ভারতবর্ষে ক্রিকেট নামক ধর্মে অন্যতম ধর্মগুরুর আসন অলঙ্কৃত যিনি করছেন, তাকে তো সাহসী হতেই হবে।

ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক; Image Source: PTI

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বহু বহু কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছে। শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট সন্তানের অবারিত ভাণ্ডার তার। তবুও স্টিভ স্মিথ আর সবার মতো নন, অস্ট্রেলিয়ায় এমন ক্রিকেট প্রতিভা আর এসেছে বলে মনে করেন না বহু বিদগ্ধ ক্রিকেট পণ্ডিত। সেই তার ব্যাটে নেই রান, হোক এক টেস্ট বা দুই টেস্টের জন্য, কপালে ভাঁজ পড়বেই। মিডল অর্ডারে ল্যাবুশেনের সঙ্গে স্মিথ জুড়লে তাও অজি-ব্যাটিংয়ের নাঙা অংশে কিছু তালি পড়ে, নইলে যে বেঢপ আকারে সমস্ত ফাঁকফোকড় উদোম হয়ে বেরিয়ে পড়ে! বক্সিং ডে’র সঙ্গে স্মিথের দোস্তি জবরদস্ত। টানা চার বছর বক্সিং ডে টেস্টে স্মিথ চারটি ভিন্ন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন। নিষেধাজ্ঞার যতি না পড়লে সেই ‘টানা’ কতদিন পর্যন্ত টানত কে জানে!

উইনিং কম্বিনেশন ভাঙার প্রয়োজন দেখে না অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে প্রবল ঝড়ে বিধ্বস্ত নীড়, এখানে-সেখানে ধ্বসে পড়া ও ভেঙ্গে পড়া অংশ মেরামত চেষ্টায় তৎপর। ঋদ্ধিমান সাহার বদলে তাই রিশাভ পান্ত, পৃথ্বি শ’র পরিবর্তে শুভমান গিল, কোহলির বদলে ঢুকে পড়েন রবীন্দ্র জাদেজা। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বোলিংটাও পাওয়া যায় তাহলে। অনেকের চোখ কুঁচকে উঠে, কোহলির জায়গায় জাদেজা? 

কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। শামি আহমেদের ইঞ্জুরি কপাল খুলে দেয় মোহাম্মদ সিরাজের, যিনি অল্প ক’দিন আগে হারিয়েছেন প্রিয় পিতা। তার অধিনায়ক বিরাট কোহলি তাকে বলেছেন — আরে ব্যাটা, শক্ত হ। বিশ্বাস রাখ নিজের উপর। তোর বাবা তোকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সম্পূর্ণ করা লাগবে তো। সিরাজ শক্ত থাকেন, ভেঙে পড়েন না হৃদয়ের উথাল-পাতাল যন্ত্রণার পরও। আহা, বাবা দেখে যেতে পারলেন না তার কষ্ট ও ত্যাগের চূড়ান্ত পরিণতি। তার আদরের ধন সিরাজ ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করবে টেস্ট ক্রিকেটে। সিরাজ অভিষেকের আনন্দে আনন্দিত? নাকি পিতৃবিয়োগ ও পিতার এই দেখে যেতে না পারার দুঃখে কাতর?

মোহাম্মদ সিরাজ। ভারতের পেস ইউনিটের নতুন সংযোজন; Image Source: Getty Images

দুই.

সময় যখন পক্ষ বদলায়, তখন সৌভাগ্যও বুঝি পালিয়ে বেড়ায়। দুর্ভাগ্যের এই গ্যাঁড়াকলে টসও ভারতের বিপক্ষে। টেস্ট ক্রিকেটের মজাটাই হচ্ছে এখানে হাসি-কান্না পর্বে পর্বে ভাগ করে আসে। চূড়ান্ত আনন্দের উপলক্ষ্য পেতে যেমন ধাপে ধাপে অতিক্রম করতে হয় নানান বাঁধা ও অম্ল-মধুর পথ-পরিক্রমা, ঠিক তেমনি দুর্ভাগ্যকে জয় করার মন্ত্রও শিখতে হয় সময় নিয়ে।

দলনেতার অনুপস্থিতি, পরীক্ষিত পেস বোলার হারিয়ে ফেলা, এবং ৩৬-এর লজ্জা… সবকিছুর বিপরীতে প্রতিরোধ জানাতে দলের অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ কুশীলবদের দায়িত্বের জন্য কাঁধ পেতে দিতে হয়। রবি অশ্বিন ঠিক সেই কাজটাই করলেন। সবচেয়ে বড় বাধা স্টিভ স্মিথকে ফেরালেন ‘শূন্য’ দিয়ে। হায় স্মিথ, বুদ্ধির খেলায় অশ্বিনের বিপক্ষে পর্যুদস্ত আবার! মার্নাস ল্যাবুশেন, অজি মিডল অর্ডারের নতুন স্তম্ভ, ঠিক ঠিক চালিয়ে গেলেন লড়াই। বুমরাহ-অশ্বিন আতঙ্ক ছড়ালেও একপ্রান্তে নির্ভরতা হয়ে রইলেন। সাড়ে তিন ঘন্টার লড়াইয়ের মৃত্যু ঘোষণা করেন এক নবাগত চরিত্র — মোহাম্মদ সিরাজ। লাল বলের ক্রিকেটে প্রথম উইকেটের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হলো ৪৫টি বল মাত্র। ইশ, বাবা দেখে যেতে পারেনি তা! সিরাজের গৌরবময় মুহূর্ত, সিরাজের আবেগঘন মুহূর্ত!

বুমরাহর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া বোতলবন্দী হলো মাত্র ১৯৫ রানে। পরপর দুই ইনিংসে স্বদেশ-মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার দুইশ’ ছোঁয়া হলো না! অন্যভাবে বললে, ভারতের বোলিং-বিভাগের দুর্দান্ত প্রদর্শনীতেই আটকে গেল অজিরা।

প্রথম টেস্টে স্টার্কের গোলায় প্রথম মিনিটেই ভারতের প্রথম দেয়াল ধ্বসে পড়েছিল, এবারে সময় লাগে ছয় মিনিট। প্রথম ওভারেই কুপোকাত মায়াঙ্ক। এরপর আবার সেই পুজারার পসরা, দাঁত কাঁমড়ে পড়ে থাকা এক নাছোড়বান্দা। গিলও দেখান সক্ষমতা ও তার অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা। কামিন্সের প্রতাপে দু’জনই খসে পড়লে মধ্যমঞ্চে আসন গাড়েন হ্যাংলা-পাতলা একজন, আজিঙ্কা রাহানে।

কঠিন বরফকে স্বচ্ছ কাঁচ ভেবে ভুল হয় অনেকের। রাহানেকে দেখে কারো কারো মনে হয়, আরে দুটো চাপ দিলেই ও ব্যাটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দেবে, লেজ গুটিয়ে পালাবে। কিন্তু কঠিন বরফকে কাঁচ ভেবে ভাঙতে গিয়ে দেখা যায় লোহার মতো শক্ত তা। ভাঙতে গেলে উলটো প্রতিঘাত জোটে। রাহানে দম হারান না কিছুতেই। মৃত্যুতক বীরের মতো লড়ে যাওয়া দিগ্বীজয়ী যোদ্ধা যেন!

প্রথমে ভিহারী, তারপর পান্টকে নিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেয়ার পর জাদেজাকে সাথে নিয়ে উপহার দেন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাস্টারক্লাস। কামিন্সের দাপুটে আগ্রাসন, হ্যাজলউডের সুশৃঙ্খল আক্রমণ, স্টার্কের অসম্ভব সব গোলা, আর লায়নের ছলাকলা-কৌশল — সবকিছু রাহানে নামক কঠিন বরফে আছড়ে পড়ে ঝিমিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই মেলবোর্নে, বক্সিং ডে-তে বছর ছয়েক আগে আজিঙ্কা রাহানের ১৪৭ রানের স্ট্রোকময় গল্পটাও কেমন ফ্যাকাশে ঠেকে এদিনের সুদৃঢ় ও নিশ্চল কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ এক ক্যাপ্টেন্স নক-এ। শেষটা রান আউটের মতো করুণ হলেও ভারত লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় এগিয়ে যায় বহুগুণ।

ক্যাপ্টেন লিড ফ্রম দ্য ফ্রন্ট; Image Source: cricket.com.au

তিন.

যে দল ব্যাটিংয়ে নামতেই আগে ‘৩৬’ পার করুক’ — বিদ্রুপ গায়ে মেখেছিল সেই তারাই আসরের সবচেয়ে উঁচু স্থান দখলে নেয় মাত্র ঘন্টাকয়েকের ব্যবধানে। ক্রিকেট মহাভারতের পুরোধা-ব্যক্তিত্ব দেখতে-শুনতে যেমনই নরম-সরম ঠেকুন না কেন, স্বভাবে-আচারে যেমন শান্ত-সুবোধ হন না কেন, আদতে ভীষণ জাঁদরেল, অসম্ভব চৌকষ ও আগ্রাসী একজন। বোলার ব্যবহারে তার বিচক্ষণতা, নেতৃত্বকালে তার চাতুর্য অবাক করে বারবার।

টেস্ট ক্রিকেটে ‘চূড়ান্ত’ বলতে কিছু নেই, যেকোনো সময় যেকোনো রঙিন কিছু ধূসর যেমন হতে পারে, ঠিক তেমনি সুউচ্চ চূড়াও সমতল মনে হতে খুব বেশি সময় লাগে না। ১৩১ রানে পিছিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়াকে পেছন-পায়ে রাখলেও সম্মুখ-পদে ফিরে আসা খুব কঠিন নয়। স্মিথ ও ল্যাবুশেনের মতো দুই রানমেশিন আছেন, মেশিন যদি একবার স্টার্ট নেয়… ভারতের সাধ্য কী, রানের পাগলা ঘোড়াকে আটকায়!

ভারত-শিবিরে স্বস্তির বদলে অস্বস্তি শুরুতেই। জো বার্নসকে ফিরিয়ে মিনিট কয়েক বাদে উমেশ যাদবকেও ফিরতে হয়। অভিষিক্ত সিরাজের নবীন কাঁধের খুব প্রয়োজন পড়ে দেশমাতৃকার। সিরাজও ঢেলে দেনে নিজেকে নিংড়ে। বুমরাহ দায়িত্ব নেন, জাদেজা-অশ্বিনও পিছিয়ে থাকেন না। আর স্মিথ-ল্যাবুশেন বাদ দিলে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের যে রুগ্ন ও হাড় জিরজিরে দশা প্রকট হয়, তার কোনো তুলনা হয় না। ঠিক দুইশ’তে থামে অস্ট্রেলিয়া। সিরিজে প্রথমবারের মতো দুইশ’ তাদের। কমেন্ট্রি বক্সে অনেক অস্ট্রেলিয়ান সাবেক বসেন, রথী-মহারথীর আড্ডা জমে, কী অনুভূতি হয় তাদের? অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া, অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া — যাদের দাপট প্রতাপে র‍্যাংকিং গণনার শুরু হতো দ্বিতীয় হতে। এক নাম্বার তো অস্ট্রেলিয়ারই, যেন রেজিস্ট্রি করা হয়ে গেছে। আজকালের পরিক্রমায় কী বিশ্রী অবস্থা দলটার!

বোলিং ইউনিটের আরেক প্রাণভোমরা উমেশ যাদবকে হারালেও, স্বস্তি ভারত শিবিরে। টার্গেট খুব বড় নয়। জয় এসে গেছে ‘ঐ দেখা যায়’ দূরত্বে। ৭০ রানের লক্ষ্যটা ৩৬-এর চেয়ে বেশি, প্রায় দ্বিগুণ। অনেকেরই আশঙ্কা — ভারত আসলেই পারবে তো? অত কম রান তাড়া করতে গিয়ে কেউ হারেনি। ইতিহাস জানায়, সর্বনিম্ন ৮৫ তাড়া করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ইংল্যান্ড। যে ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় শতবর্ষী ধুন্ধুমার এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার। ইংল্যান্ড ক্রিকেট মহলে হাহাকার উঠেছিল — ধ্বংস হয়ে গেছে ইংলিশ ক্রিকেট। পুড়িয়ে ছাইভস্ম নিয়ে যাওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সেই অস্ট্রেলিয়াও শিকার হয়েছে ছোট্ট লক্ষ্য তাড়া করতে না পারার ব্যর্থতার। ভারতেরই বিপক্ষে মুম্বাইয়ে মাত্র ১০৭ রানের নাগাল পায়নি সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া, কুম্বলে-কার্তিকের স্পিনে নাকাল হয়ে ৯৩-তেই যায় গুটিয়ে।

তবুও অনেক অস্ট্রেলিয়া সমর্থক ‘৩৬’ বুকে নিয়ে আশার প্রহর গোণে। আর অনেক ভারতীয় সমর্থক ‘৩৬’ বুকে বেঁধে আশঙ্কার ক্ষণ গোণে।

ভারতের জন্য দুঃসংবাদ। চোট পেয়ে দলছুট উমেশও; Image Source: cricket.com.au

চার.

পুজারা নামক সুরক্ষিত দুর্গ ধ্বসে পড়ে কামিন্সের লক্ষ্যভেদী আঘাতে। তারও আগে স্টার্ক নিশ্চিত করেন আগরওয়ালের সংহার। ধুকপুক ভারত-হৃদয়ে কম্পন উঠে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। ভারতও ডরায়; ১৯ রানে দুইজন নেই, গেল বার (অ্যাডিলেইডে ৩৬-এর দিনে) ১৯ রানে ছয়জন গিয়েছিল, এবার কী হবে তাহলে?

ডরান না একজন রাহানে। ডরাতে দেন না ‘নবীন’ গিলকেও। গিলের ব্যাটে স্ট্রোকের ফুলঝুরি, সন্ত রাহানে নির্ভরতা দেন গিলকে, দলকে। অস্ট্রেলিয়ার সকল চেষ্টা ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসে, যেন কঠিন দেয়ালে প্রত্যাখ্যাত হয় বারবার। ইতিহাস রচনায় আজিঙ্কা রাহানে ও শুভমান গিল সময় নেন ৬৮ মিনিট। সিরিজে ফেরে ভারত। ইতিহাস-রচনায় নেতৃত্ব দেন অজিঙ্কা। ভারতের ক্রিকেটে লজ্জাজনক এক অধ্যায়ের পর যুক্ত হয় গৌরবময় সোনালী পালক।

টেস্ট ক্রিকেট! পতন-উত্থানে অনিন্দ্য সুন্দর সময়ের রাজসিক মিলনমেলা।

ঐতিহাসিক জয়ে ভারত-শিবিরে স্বস্তি; Image Souce: cricket.com.au

****

রবিচন্দ্রন অশ্বিন টুইটে জানান, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ভয় না পেয়ে বরং দেয়ালে ঠেস দিয়ে লড়াইয়ের জ্বালানী খুঁজে নিতে হয়। 

টুইট করেন ভিরাট কোহলিও। এই দল নিয়ে গর্বিত হন তিনি। দলটা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রশংসা না করে উপায় নেই। সিরাজের সবচেয়ে বড় স্তাবক ও পিঠ চাপড়ে দেয়া একজন তিনি, তাই তার টুইটে সিরাজকেও ম্যানশন করতে ভুলেন না পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া ভারত-দলপতি।

ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ়চেতা। ভাঙবে, কিন্তু মচকাবে না; Image Souce: cricket.com.au

প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়, যেমন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল আগেরবার। টেস্ট ক্রিকেট এমনই — আজ যদি দেখায় পতনের নিম্নতম গহ্বর, তবে অর্জনের রাজকীয় ডালি নিয়ে আগামীকাল উপস্থিত হবে হয়তো। যেন মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও বেদনা-পরিহাসের রকম ও ধরন জানতে চায়, দেখতে চায়, বুঝতে চায়। টেস্ট ক্রিকেটের কত্ত বিদঘুটে স্বাদ-আহ্লাদ যে হয়!

জীবনের নানা বাঁকে পরাজয় ডাকে যদি কভু,

হার না মেনে জয়ের বাসনা হৃদয়ে পোষো তবু;

প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙানো কঠিন কিছু নয়

লড়াইয়ের জেদ আর সাহস যদি থাকে সঞ্চয়।

এ যেনো জীবন-যুদ্ধের এক টুকরো অনুকৃতি—

কেবলই খেলা নয়; টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি!

তৃতীয় অধ্যায়

সিডনির কুখ্যাত ‘মাঙ্কিগেট’ কেলেঙ্কেরীতে কলঙ্ক লেগেছিল শচীন টেন্ডুলকারের শুদ্ধতায়। কাকে কে ‘বানর’ বলেছে, তা নাকি শুনতে পাননি তিনি! অথচ ঘটনার খুব কাছেই ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বজন গ্রহণযোগ্য ক্রিকেট-চরিত্র। বিশ্ব ক্রিকেটের যেন মনে হয়, শচীন ‘অতিমানব’ নন, সাধারণ মানবমাত্র। তারও পক্ষপাতিত্ব আছে।

অস্ট্রেলিয়ার নিশ্চিত আউটে আম্পায়ার থাকেন নির্বিকার, আর ভারতীয় ব্যাটসম্যানের বেলায় ফটাফট তুলে দেন আঙ্গুল। এক-দুইবার নয়, একটি টেস্টে বারবার ঘটে এমন। বাম্প ক্যাচে সৌরভ যাবেন না কিছুতেই, আউট হননি তিনি। রিকি পন্টিং ইঙ্গিতে ‘আউটের ভঙ্গি’ করতেই আম্পায়ার জানিয়ে দেন — সৌরভ তোমাকে যেতে হচ্ছেই। এককালের ‘পান্টার’ বুঝি এখানে শুদ্ধবাদী যুধিষ্ঠির বনে গেছেন! অনিল কুম্বলে প্রেস কনফারেন্সে স্পষ্ট সুরে ঘোষণা করেন, একটা দলই ক্রিকেটের স্পিরিট নিয়ে খেলছে। বডিলাইন সিরিজে যে দাবি তুলেছিলেন বিল উডফুল। হিস্ট্রি রিপিটস। মাইকেল ক্লার্কের ১১ বলের ম্যাজিক্যাল স্পেল, রুদ্ধশ্বাস জয় অস্ট্রেলিয়ার। অতি নাটকীয়তার অবিশ্বাস্য রূপায়ন শেষে অস্ট্রেলিয়া পায় টানা ষোলতম জয়।

এবারের রঙ্গশালা সেই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড

এক.

লজ্জা ভুলে গৌরবের উপলক্ষ্য পেয়ে গেছে ভারত। বহুকাল গল্প করার মতো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের রাজতিলক তাদের ললাটে। ইনজুরি থেকে ফিরেছেন রোহিত শর্মা। যদিও ইশান্ত-শামির পর উমেশকেও হারাতে হয়েছে। পেস ইউনিটে এক বুমরাহই ভরসা, অন্য দু’জন নবাগত — নবদীপ সাইনি ও মোহাম্মদ সিরাজ। আজিঙ্কা রাহানের অধিনায়কত্বে শতভাগ জয়ের রেকর্ড, অথচ টস-হাসি হাসার সৌভাগ্য হয় না। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে ফিরেছেন ওয়ার্নার, ওয়েড নেমে গেছেন নিচে, অভিষেক হয়েছে উইল পুকোভস্কি’র। হায় অস্ট্রেলিয়া, ওপেনারের অভাব দেশজুড়ে! জাস্টিন ল্যাঙ্গার ছিলেন ফিলিপ হিউজের গুরু, মেন্টর, পথ প্রদর্শক। ল্যাঙ্গার অস্ট্রেলিয়ার কোচ এখন, একজন যোগ্য ওপেনারের অভাব সবচেয়ে বেশি বোধ করছেন তিনি; নিশ্চয়ই প্রিয় শিষ্যকে মিস করছেন আরো বেশি!

যেবার ফিলিপ হিউজ ইহলোক ছাড়লেন পুরো ক্রিকেট বিশ্ব কাঁদিয়ে, সেবারও ভারত ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। বিরাট কোহলি আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বুঝে নিয়েছিলেন ‘সিডনি টেস্ট’ দিয়েই। অধিনায়ক যথারীতি ‘মাস্টারক্লাস’ উপহার দিয়েছিলেন, অধিকারী হয়েছিলেন বিরল এক রেকর্ডেরও। অধিনায়ত্বের অভিষেকে টানা তিনটি সেঞ্চুরির গৌরব কেবল বিরাট ছাড়া আর কারো নেই। অ্যাডিলেইডে ১১৫ ও ১৪১-এর পর সিডনিতে ১৪৭। সিডনির সেই ম্যাচে আজিঙ্কা রাহানে দুই ঘন্টারও বেশি সময় এবং শেষ পৌনে এক ঘন্টা ভুবনেশ্বর কুমারকে সাথে নিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন ভারতের ড্র।

দুই.

ছেলেটা ভুল করেছিল। শাস্তিও পেয়েছে। উঁহু, কানমলা বা চিমটি কাটা নয়, রীতিমতো নির্বাসন পেয়েছিল। মনস্তাপে পুড়েছে সে। কেঁদেছে অনুশোচনায়, অনুতপ্ত হৃদয়ের বিগলিত রুপ চোখের অশ্রু হয়ে গাল বেয়ে নেমেছে। বাবার কাঁধে লুকিয়েছে মুখ, মায়ের কোলে খুঁজেছে আশ্রয়। তবু করুণা হয়নি সমাজের। এই জনপদ তাকে অচ্ছুৎ করেছে, এই সমাজ তাকে বিতাড়িত করেছে। তারপর যখন সাজা ভোগ শেষে ফিরেছে জনারণ্যে, জনগণ তখনো তাকে গ্রহণ করেনি সাদরে। কঠিন আগুনে পুড়ে সোনা হয়েছে সে, সোনার বালক তাই শত-সহস্র অপমান সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নির্বিকার। কিছুতেই কিছু আর যায়-আসে না তার। গালি, দুয়ো, টিটকারিতেও মনোযোগ নড়ে না। সে দুঃসময়কে পক্ষে আনার মন্ত্র শিখে গেছে। অতঃপর সমাজের বাসিন্দাদের বিমোহিত করে সে উপহার পায় স্বর্ণখচিত সিংহাসন, একসময়ের সমাজচ্যুত ছেলেটি পুনরায় সমাসিত হয় সমাজপতির আসনে।

স্টিভ স্মিথ — লোকচক্ষুর তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা উপেক্ষা করে উদযাপনের উপলক্ষ্য হন। সমাজের সসম্ভ্রম শ্রদ্ধা ও জনতার মুগ্ধতা মেখে সিক্ত হন রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের অত্যুজ্জ্বল বিভায়। অ্যাশেজ ২০১৯-এর অন্য নাম স্মিথের অ্যাশেজ, যেখানে ঘটে রাজপুত্রের রাজকীয় প্রত্যাবাসন। এখন দু’টি টেস্টে রান না পেলে কী আসে যায়! স্টিভ স্মিথ — অবাক গল্পের রাজপুত্তুর, তার রাজত্বের অধিকার গ্রহন করা সময়ের ব্যাপার।

ঘরের মাঠে হতাশ করেন না তিনি। ল্যাবুশেনের সঙ্গে জুটিটা জমে যায় তার। ল্যাবুশেন ৯১তে ফিরলেও, স্মিথ ঠিকই তুলে নেন ২৭তম সেঞ্চুরি। আচমকা ছন্দপতনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ধ্বসে গেলেও একপ্রান্তে স্মিথ থাকেন নির্ভরতা হয়ে। রবীন্দ্র জাদেজার বাজপাখির ক্ষিপ্রতা তার মৃত্যু ডেকে আনলেও ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে ১৩১ রানের অনবদ্য অপরাজেয় গল্পগাঁথা। বুদ্ধির খেলায় যে অশ্বিন টেক্কা দিচ্ছিলেন বারবার, সেই অশ্বিনের সঙ্গে পায়ের কাজ দেখিয়ে মাৎ করলেন এইবার। বাছাধন, ঘিলু শুধু তোমাদের মস্তিষ্কেই আছে তা-ই শুধু নয়, ঘিলু কিছু আমার মাথায়ও আছে। কৌশল পরিবর্তন করে, ছন্দবদ্ধ পায়ের কাজ, পায়ের ভার সামান্য এদিক-সেদিক করেই স্মিথ রাজত্বের মালিকানা বুঝে নেন আবার। সতীর্থ ও বন্ধুদের ব্যর্থতায় অস্ট্রেলিয়ার দৌড় ৩৩৮-এ আটকে যায় যদিও।

রাজপুত্রের প্রত্যাবর্তন; Image Souce: cricket.com.au

তিন.

ক্রিকেট দু’পেয়ে মানুষদের খেলা হলেও কামিন্সদের মতো কোনো কোনো অতিমানবও খেলতে নামেন। মজা পেয়ে আর উঠতে চান না। ফলে অতিমানবীয়তার স্বরূপ সম্ভোগের সৌভাগ্য হয় মানুষের। পুজারার মতো সাধক পুরুষও হোঁচট খেতে বাধ্য হন কামিন্সের ‘অমানুষিক’ ধারাবাহিকতায়। তিনটি রানআউট — ল্যাবুশেন-হ্যাজলউড যেন বাজপাখি হতে চান জাদেজার মতো; ভারত আটকে যায় ২৪৪-এ। ৯৪ রানে পিছিয়ে থাকার চেয়েও আতঙ্কজনক ব্যাপার হচ্ছে জাদেজা-পান্তের ইনজুরি, শঙ্কামুক্ত নন কেউই। অস্বস্তিতে গোটা ভারত।

একজন বোলারের খামতি, পর্যদুস্ত মানসিকতা, অস্ট্রেলীয় দর্শকের বর্ণবাদী আচরণ… সব মিলিয়ে কেমন যেন গুটানো অবস্থা ভারতীয় ক্রিকেটে। এই সর্বনাশা সফর শেষ হলেই বাঁচে সবাই।

মার্নাস ল্যাবুশেন, স্টীভ স্মিথ, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের দুই রত্ন; Image Souce: cricket.com.au

স্মিথ-ল্যাবুশেন বুঝি মানিকজোড়। দু’জনের ব্যাটে রানের ফল্গুধারা। রানমেশিন দুটোর একসঙ্গে ছোটার প্রহরই গুনছিল পুরো অস্ট্রেলিয়া, অপেক্ষার প্রহর কেটে গেছে, ছুটছে একসঙ্গে। এবার আর পায় কে! পুরো চারটা সেশন ও প্রায় ১৩০ ওভার হাতে রেখে ভারতকে ৪০৭ রানের সুবিশাল চূড়া পাড়ি দেয়ার চ্যালেঞ্জ অস্ট্রেলিয়ার। ভারত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে কি করবে না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন তারা জাদেজা ও পান্তের সাপোর্ট পাবে কি পাবে না!

শুরুটা চমৎকার হলেও দিনের কয়েক ওভার আগে রোহিত আউট। রোহিতের বড় ইনিংস ও উইকেটে থাকা বড্ড প্রয়োজন ছিল দলটার। নৈশপ্রহরীর বদলে অধিনায়ক নিজেই প্রহরার দায়িত্বে নামেন। দুই উইকেটে ৯৮ রান নিয়ে দিনশেষ করে ভারত। অস্ট্রেলিয়ার এগিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার যেন, ভারতের বিজয় সে তো দূরের, পরাজয় এড়ানোই কঠিন — যেমনটা কঠিন সিডনির শেষ দিনের পিচে লায়নকে সামলানো।

প্রীতি নারায়ণ তার স্বামীকে দেখছেন। মাঠে কী অসম্ভব লড়াই করছে মানুষটা! অথচ গত রাতে ব্যথার চোটে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে দেখেছেন তাকে। প্রীতি তো বুঝতেই পারেননি এই ভদ্রলোক সকালবেলা মাঠে নামতে পারবে! রবি অশ্বিন নিজেই বলেছিলেন দুঃসময় চখন চারপাশ থেকে চেপে ধরতে চায় ঠিক তখনই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রদর্শনের উত্তম সময়। সেই প্রচেষ্টার উজ্জ্বলতর উদাহরণ হয়ে রইলেন তিনি, তার হার না মানা লড়াই, শারীরিক অসুস্থতার পরও বীরের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো দেখে প্রীতি নারায়ণ অবাক হলেও নিশ্চিতভাবেই গর্ব বোধও করেছেন। এমন দীপ্তিমান সাহসী ‘বর’ ক’জনের ভাগ্যেই-বা জোটে!

পান্টের দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে, তবুও লড়াইয়ে পিছপা হন না তিনি। হনুমা ভিহারীর ব্যাটে ঐশ্বরিক কিছুর ইঙ্গিত। ভিহারীর খুব কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়, ওদিকে যন্ত্রণা চেপে ব্যাট-প্যাড নিয়ে প্রস্তুত জাদেজা। যেন বার্তা পাঠায় — বন্ধু, পরাজয়ে ডরে না বীর। যদি হারতেও হয়, তাহলে পরাজয় হোক বীরের ন্যায়।

সিডনি মহাকাব্যের দুই মহাবীর, রবি অশ্বিন ও হনুমা ভিহারী; Image Souce: cricket.com.au

চার.

আজিঙ্কা রাহানে আদতেই ‘নাইটওয়াচম্যান’ ছিলেন বুঝি। দিনের শুরুতেই আউট। তারপর মধ্য মাঠে রিশাভ পান্তের আগমন। ব্যাটে স্ট্রোকের ফুলঝুরি, বুকে সাহস আকাশ-সমান। সিংহহৃদয়ে লড়াইয়ের অদম্য তেজ। প্রবল বেদনার কোনো ছাপ নেই শরীরি ভাষায়, ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে স্কোরবোর্ড তরতর করে ফুলে ফেঁপে উঠে। সাধক-পুরুষ পুজারা ধ্যানমগ্ন। সে ধ্যান ভাঙবে, সে সম্ভাবনা কম। পান্টের সঙ্গে প্রায় তিন ঘন্টার যৌথ অংশীদারিত্বে তার ভূমিকা নিতান্তই নিরীহ। ১১৭ বলে ৯৭ রানে পান্ট যখন ফিরছেন, তখনও বাকি প্রায় অর্ধ-দিবস। ওভারপ্রতি রান দরকার মোটে তিন।

পুজারা তবু ধ্যান ভাঙেন না, খোলস ছেড়ে বেরোন না। খানিক বাদে প্রায় পৌনে পাঁচ ঘন্টার কঠিন সংগ্রাম শেষে শ্রান্ত সৈনিকের ন্যায় তার তাঁবুতে ফেরা, কিছুতেই একজন পরাজিতের নয়; বরং তখনও তা বীরত্বের অনুপম চেতনা। অনেকেই তার এই অধ্যবসায় বোঝে না, এই লড়াইয়ের মানে জানে না। কিন্তু ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাস অমন একজন চরিত্র পেয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে পারে না!

হনুমা ভিহারী ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন। বলের পর বল আঘাত হানে শরীরে, লড়াইটা তবু চালিয়ে যান। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান নেই আর। অশ্বিন আর তাকেই যতটা সম্ভব কাটাতে হবে এই উইকেটে। ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে উঠছে অস্ট্রেলিয়ান অহং, অজি-রক্ত; যেন কোনো দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছে তারা, কোনো বোবাকে চাইছে কথা বলাতে, কোনো বধির শুনছে না বলে গাল পাড়ছে। তিন ঘন্টা ও ৪২ ওভারে ৬২ রানের জুটি গড়ে ম্যাচটা বাঁচিয়ে নেন হাফ-ফিট দুই ইন্ডিয়ান

ইতিহাস রচনার তারিখটা ছিল ১১ই জানুয়ারি। রাহুল দ্রাবিড়ের জন্মদিনতাই কি অমন দেয়াল হয়ে ওঠা? রাহুল ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড় এত আনন্দপূর্ণ বার্থডে ট্রিবিউট আর কখনো পাননি নিশ্চয়!

ফোর্থ স্ট্যাম্প থেকে কবজি ঘুরিয়ে
ফ্লিক করে মারা চার—
এক-দুইবার নয় দেখি বারবার,
মুগ্ধতা প্রতিবার।
আপনি যেন ক্রিকেট মাঠের
মকবুল ফিদা হুসেইন,
রঙ তুলির আঁচড়ের মতো—
ব্যাটের পরশে যেন মনে হয়,
অদ্ভুত ঘোরের কোনো বিভ্রম আঁকেন।

ফ্রন্টফুটে গুচ্ছ শটে
বাহারী রঙের ড্রাইভ…
দেখতে শুধু
হেঁটে যাওয়া যায়—
মাইলের পর মাইল।
তিনটে কাঠ-কাঠিকে যক্ষের ধনের মতো
সযতনে আগলে রাখার সাধনা,
কে করেছে কবে
আপনার পরে বা আগে,
আপনিই গুড-বেটার-বেস্ট; আর কেউ না।
আপনি নেই বলে…
এসব এখন আর দেখা হয় না।

চক্ষে আঁধার দেখা ধাঁধার মতো
গুগলি বা দুসরা
ক্ষণে ক্ষণে ভ্রম এঁকে দেয়া ঘূর্ণি,
ভেঙে যাওয়া পিচে স্পিন সামলে,
হার না মানা মনে
ঠাঁই টিকে থাকা,
আজকাল আর দেখি না।
দেখি না টিকে থাকার
সেই মরণপণ সাধনা।

অফ স্ট্যাম্প ধরে টানা বল করে যাওয়া
একটার পর একটা লুপ-ফ্লাইট,
শরীর তাক করা শর্ট পিচ বা বাউন্সারে,
ড্রাইভ, কাট, হুক বা পুল করার
স্বতঃস্ফূর্ত কামনা;
নিজেই গলা টিপে আওড়ে যাওয়া
কেবল টিকে থাকার মন্ত্রণা—
আপনি নেই বলে,
আজকাল এসব আর দেখা হয় না।

একটু প্রতিভার সঙ্গে অনেকটা পরিশ্রম মেশালে
সাধারণ কেমন হয়ে উঠে অসাধারণ
অনন্য সাহস-বলে!
স্বপ্নের পথে সবটা নিবেদিত হলে
সাফল্য কেমন লূটায় পায়ে,
জেনেছি তাই
আপনাকে জানার পরে।

নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হয়েছেন আপনি
সযতনে সাজিয়েছেন খাঁদহীন সোনায় নিজেকে,
রেখেছেন ছাপ দিয়েছেন দীক্ষা,
কীভাবে নিজেরে ভেঙে
আবার নতুন করে গড়ে!
আপনি নেই বলে
সেই ভাঙা-গড়া,
দলের জন্য নিজেকে উজার করা,
এখন আর দেখি না।

মাঠের ভেতর শান্ত-নম্র, ভদ্র-সভ্য
নিপাট ভালো মানুষটি
আজকাল আর ড্রোন ক্যামেরাতেও
ধরা পড়ে না,
আপনি নেই বলে
শান্ত লোকের মিষ্টি হাসিও আর
চোখে পড়ে না…।

রাহুল ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়। শান্ত লোকের মিষ্টি হাসি; Image Source: ESPNCricinfo

****

টেস্ট ক্রিকেট অ্যাট ইটস বেস্ট। সাফল্য-ব্যর্থতা, পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনা হাতে হাত ধরে পাশাপাশি চলে আর কোথায়! মিনিটে মিনিটে উত্তেজনা, মুহূর্তে মুহূর্তে রোমাঞ্চ, ক্ষণে ক্ষণে রঙ-বদলের আবেদন, সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তার এমন যুগপৎ যুগলবন্দী পৃথিবীর আর কোনো ক্রীড়াক্ষেত্রে নেই। সিডনির সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে রেখে যায় চতুর্থ ইনিংসে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের গত চার দশকে সর্বশ্রেষ্ঠ ‘দেয়াল’ বিনির্মাণ। হাফ-ফিট চার-চারজন ক্রিকেটার সাথে নিয়ে পাড়ি দেয়া ১৩১ ওভারের দুর্গম যাত্রা এবং গোটা চারেক সেশনের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর পথচলা! ভারতীয় ক্রিকেট সিডনির ১১ই জানুয়ারি কোনোদিন ভুলবে না। কোনো ক্রিকেট দর্শকও কি ভুলতে পারবে?

টেস্ট ক্রিকেট আসলে শুধু ক্রিকেটের সবচেয়ে সুন্দর আঙিনা নয়, জগতের সবথেকে সর্বোত্তম ও সৌন্দর্য্যমণ্ডিত খেলা।

টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি; Image Souce: cricket.com.au

হার-জিৎ মীমাংসাহীন, তবু কী অবাক আনন্দ!

গোমড়ামুখো হিটলার বোঝেনি সে তাল-লয়-ছন্দ।

হৃদয় অলিন্দে যেন শীতল সুখের সমীরণ

ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকিতেও কী পুলক-উপকরণ!

ক্রিকেট-কাননে নান্দনিকতার কত রঙ-রূপ-সৃষ্টি

মোহিত মনের মন্ত্র-পাঠ; টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি!

This article is in Bengali language, where we tried to describe beauty of test cricket with based on 'border-gavaskar trophy' of 2020-2021. Here is the second part of three episode with second and third chapter.

Featured Image: cricket.com.au

Related Articles