জফরা আর্চার, ওশান থমাস, ম্যাট হেনরি কিংবা লকি ফার্গুসন- বিশ্বকাপটা এখন পর্যন্ত তো ওই গতিতারকাদেরই। তাদের গতির তোড়ে উড়ে যাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরা; কেউ আহত হয়ে যাচ্ছেন মাঠের বাইরে, কেউ বা ফিরছেন ড্রেসিংরুমে। বিপরীতে স্পিনাররা যেন অনেকটাই ম্রিয়মাণ, এখনো দেখা যায়নি তাদের স্পিনজাদু। এমনকি যে লেগ স্পিনারদের নিয়ে এত আলোচনা, তারাও পারেননি আলো কেড়ে নিতে। অবশ্য অতীত ইতিহাসের কথা মাথায় রাখলে এমনটা তো হবারই ছিল। বিশ্বকাপের মঞ্চটা তো সবসময়ই রাঙিয়েছেন গতিময় বোলাররা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের গত সাত আসরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে চলুন জানা যাক, পেসার আর স্পিনারদের পারফরম্যান্স বিগত আসরগুলোতে কেমন ছিল সেই সম্পর্কে।
১৯৯২ বিশ্বকাপ
সাদা পোশাক পেরিয়ে রঙিন পোশাকে লাল বল পেরিয়ে সাদা বলে ১৯৯২ ছিল অনেক বদলের বিশ্বকাপ। অবশ্য বদলায়নি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পেসারদের আধিপত্যের ধারা।
সেই আসরে পেসারদের পকেটে গিয়েছিল ৩৪৪ উইকেট। বিপরীতে স্পিনাররা দখল করেছিলেন মাত্র ৯৪ উইকেট। শীর্ষ ২০ উইকেটশিকারির তালিকাতেও তাই নাম দেখা যায় মাত্র দুজন স্পিনারের- মুশতাক আহমেদ আর সেই বিশ্বকাপের আলোড়ন দীপক প্যাটেলের। আর সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির মুকুট পরেছিলেন ‘সুইংয়ের রাজা’ ওয়াসিম আকরাম।
অবশ্য রান দেয়ার বেলায় পেসারদের চেয়ে কিছুটা কিপটে ছিলেন স্পিনাররা। সেই আসরে ওভারপ্রতি ৪.১৬ রান বিলিয়েছিলেন তারা। পেসাররা রান দিয়েছিলেন ০.০৭ বেশি, ৪.২৩ করে।
তবে উইকেট আদায়ে স্পিনারদের চেয়ে পেসাররা ছিলেন এগিয়ে। গড়ে ৩১.৫৮ রান পরপর পেসাররা তুলে নিয়েছিলেন উইকেট, বিপরীতে স্পিনারদের দিতে হয়েছিলো চার রান বেশি, ৩৫.২৯ করে।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ
উপমহাদেশের মাটিতে সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। স্পিনারদের ভাগ্যে তাই বদলের আশা থাকলেও সেই বদল সামান্যই।
উইকেট কলামে স্পিনারদের নামের আধিক্য বেড়েছিল সেবার, ১৬৯ বার উইকেট প্রাপ্তির উল্লাসে মেতেছিলেন স্পিনাররা। তবে বরাবরের মতো সেবারও পেসারদের উইকেটপ্রাপ্তির সংখ্যাই ছিল বেশি, ২২৮ বার ব্যাটসম্যানরা উইকেট দিয়েছিলেন পেসারদের বলে।
উপমহাদেশের ধীরগতির উইকেটে রানও উঠেছিল ধীরগতিতে। স্পিনাররা রান বিলিয়েছিলেন ওভারপ্রতি ৪.৫২ করে, পেসাররা কিছুটা কম, ৪.৫০ রেটে।
স্পিনারদের উইকেটসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কমেছিল বোলিং গড়, বিগত আসরের ৩৫.২৯ বোলিং গড় কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৩.২৩। পেসাররা যে উপমহাদেশের উইকেটে সুবিধা করতে পারেননি, সেটা বোঝা যায় সাড়ে সাইত্রিশ ছোঁয়া বোলিং গড় দেখে।
প্রথমবারের মতো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছিলেন একজন স্পিনার, ভারতের অনিল কুম্বলে ৭ ম্যাচে উইকেট পেয়েছিলেন ১৫টি। টুর্নামেন্টে তার চেয়ে বেশি বলও করেননি আর কেউ। বিপরীতে পেস বোলাররা যে মনোযোগ দিয়েছিলেন রান আটকানোতে, সেটা বোঝা যায় অলরাউন্ডার ব্রায়ান ম্যাকমিলানের তিনেরও কম (২.৯৫) ইকোনমি রেট দেখে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ
পেসার (২৭.৭১) আর স্পিনারদের (৪০.৭১) বোলিং গড়ের পার্থক্য ছিল তের। পরিসংখ্যানই তো স্পিনারদের যন্ত্রণার কথা বলে!
বিশ্বকাপ ফিরেছিল তার জনকের দেশে, ফিরেছিল পেসারদের দাপটও। সেবার গতিময় বোলারদের ঝুলিতে গিয়েছিল ৪৬১ উইকেট। বিপরীতে, স্পিনাররা আবারও মাথা কুটে মরেছিলেন ব্রিটিশ উইকেটে, ৪২ ম্যাচের টুর্নামেন্টে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র ৮৭টি। পেসাররা এগিয়ে ছিলেন সমস্ত পরিসংখ্যানেই, স্পিনারদের ৪.৬৭ ইকোনমি রেটের বিপরীতে পেসাররা রান দিয়েছিলেন ওভারপ্রতি ৪.২৩ হারে।
শেন ওয়ার্নের কাছে এসব পরিসংখ্যান যে নিছকই এক সংখ্যা, তার প্রমাণ ছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। স্পিনারদের দৈন্যদশার বিপরীতে শেন ওয়ার্ন সেই বিশ্বকাপে ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ১৮.০৫ গড়ে তুলে নিয়েছিলেন ২০ উইকেট, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ। সঙ্গী ছিলেন অবশ্য আরও একজন, নিউ জিল্যান্ডের বাঁহাতি পেসার জিওফ অ্যালট।
২০০৩ বিশ্বকাপ
পেসারদের দাপট অব্যাহত ছিল চার বছর পরের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপেও। সেবার অবশ্য আরও একটু বেশি, ৪৮২ উইকেট তুলেছিলেন পেসাররা।
দুই বিশ্বকাপের মাঝে দল বেড়েছিল দুটি। পেসারদের দাপট বজায় থাকলেও স্পিনারদের উইকেটসংখ্যাও তাই বেড়েছিল বিগত বিশ্বকাপের চাইতে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, ১৯৫টি।
শীর্ষ পাঁচ উইকেটশিকারীর তালিকায় অবশ্য ঠাঁই হয়নি কোনো স্পিনারের। চামিন্দা ভাসকে সবার ওপরে রেখে বাকি চারটি স্থান দখল করেছিলেন ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জহির খান এবং শেন বন্ড।
উইকেট তুলতে গিয়ে রান খরচে কিছুটা উদার হয়েছিলেন পেসাররা, স্পিনারদের চেয়ে অবশ্য সামান্যই। স্পিনাররা যেখানে রান দিয়েছিলেন ওভারপ্রতি ৪.৫০ করে, পেসাররা সেখানে রান দিয়েছিলেন ৪.৬৭ করে।
২০০৭ বিশ্বকাপ
২০০৩ বিশ্বকাপ শেষ করেছিলেন স্পিনারদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে, চার বছর পরের বিশ্বকাপে পেছনে ফেলেছেন আরও কয়েকজন পেসারকে। মুত্তিয়া মুরালিধরন সেবার দশ ম্যাচে উইকেট পেয়েছিলেন ২৩টি। তবু সেবার মুরালির চেয়েও উইকেটপ্রাপ্তিতে এগিয়ে ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, ঝুলিতে পুরেছিলেন ২৬টি উইকেট।
ম্যাকগ্রার দেখানো পথে হেঁটেছিলেন বাকি পেসাররাও, তুলে নিয়েছিলেন ৪৫৪ উইকেট। বিপরীতে স্পিনাররা প্রথমবার ছাড়িয়েছিলেন ২০০ উইকেটের কোটা, পেয়েছিলেন ২০১ উইকেট।
স্পিনার আর পেসারদের গড়ের ব্যবধানও কমে এসেছিলো বেশ। এক উইকেট তোলার আগে পেসাররা দিয়েছিলেন গড়ে ৩১.৩৭ রান; স্পিনাররা খানিক বেশি, ৩২.২০ করে। ওভারপ্রতি রান খরচাতেও এগিয়ে ছিলেন স্পিনাররাই, অবশ্য সামান্যই। স্পিনারদের ৪.৮৫ রানের বিপরীতে পেসাররা রান দিয়েছিলেন ৪.৭৯ করে। এমনকি, যে তিনবার বোলাররা পাঁচ উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন, সবই জুটেছিল পেসারদের কপালে। সবচেয়ে বেশি বল করেছিলেন অবশ্য একজন স্পিনার, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি।
২০১১ বিশ্বকাপ
উপমহাদেশের মাটিতে পনের বছর পরে এসেছিল বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম। স্পিনাররাও তাই এযাবৎকালের সেরা সময় কাটিয়েছিলেন সেই বিশ্বকাপেই। বিশ্বকাপের মোট ওভারের ৪৭% বল করেছিলেন কোনো না কোনো স্পিনার, সে বিশ্বকাপে স্পিনারদের দাপট বোঝাতে এ তথ্যই যথেষ্ট।
উইকেটসংখ্যাতেও সেই দাপট স্পষ্ট, ২৯৫ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন ওয়ার্নের উত্তরসূরি কিংবা মুরালির অনুসারীরা। পেসারদের উইকেটসংখ্যা ছিল তারপরও বেশি, ৩৭৬টি।
নতুন বলে পেসারদের আধিপত্যেও ভাগ বসিয়েছিলেন স্পিনাররা, প্রথম পাওয়ারপ্লের ২২ শতাংশ ওভার করেছিলেন স্পিনাররা, যেখানে তারা তুলে নিয়েছিলেন প্রথম পাওয়ারপ্লেতে পড়া উইকেটের ২৫ শতাংশ। এমনকি রানের চাকাতেও বাঁধ দিয়ে রেখেছিলেন তারা; প্রথম দশ ওভারে পেসাররা যেখানে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৪.৮১ করে, স্পিনাররা মোটে ৩.৭৮ হারে।
টুর্নামেন্টজুড়েই অবশ্য বজায় ছিল এমন ধারা। পেসাররা রান বিলানোর ক্ষেত্রে সেই টুর্নামেন্টে উদার ছিলেন বেশ। তাদের ওভারপ্রতি ৫.১৮ রানের বিপরীতে স্পিনাররা দিয়েছিলেন ৪.৬০ হারে। উপমহাদেশের মাটিতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি একজন স্পিনারকে হতেই হতো। ২১ উইকেট নিয়ে শহীদ আফ্রিদি ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
২০১৫ বিশ্বকাপ
তাসমান সাগরপাড়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ, সেই আগের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। ১৪ দলের বিশ্বকাপে ম্যাচ হয়েছিল ৪৭টি। তাতে পেসাররা বাগিয়েছিলেন ৫৪০ উইকেট, স্পিনাররা এর এক-তৃতীয়াংশেরও কম, মাত্র ১৫০টি। এমনকি প্রথম ২৬ ম্যাচে নতুন বল তুলে নেননি কোনো স্পিনার। বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান ২৭তম ম্যাচে বল তুলে নিতেই ভাঙে সেই ধারা।
পেসারদের ৩১.২৬ গড়ের বিপরীতে স্পিনারদের গড় ছিল ৪৩.৬৮-এরও বেশি। একমাত্র ১৯৭৯ বিশ্বকাপেই ক্রিকেট দেখেছিল এর চেয়ে বাজে বোলিং গড়। সেই আসরে স্পিনাররা প্রতি উইকেট পেতে রান দিয়েছিলেন গড়ে ৬৩ করে।
ব্যাটসম্যানরা ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকেই বোলারদের ওপর ঘোরাচ্ছেন ছড়ি, পেসাররা সেই আসরে রান দিয়েছিলেন ওভারপ্রতি ৫.৭২ করে। স্পিনারদের ইকোনমি রেটও পাঁচ ছাড়িয়েছিল প্রথমবারের মতো, ৫.২৩।