পৃথিবীতে এমন অনেক বিজ্ঞানী এসেছেন যারা নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবা করে গেছেন। তারা তাদের দিনরাত এক করা ও ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের মাধ্যমে কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। তেমনই একজন নিঃস্বার্থ বিজ্ঞানী ছিলেন বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর।
জলাতঙ্ক বা র্যাবিস ছিল সেকালের ভয়াবহ রোগের মধ্যে একটি। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিভিন্ন গুহাচিত্র থেকেও এর বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই প্রাচীন রোগের জন্য লুই পাস্তুর ১৮৮৫ সালে যখন জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, তখন বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০ কোটি। এই ১৫০ কোটির মধ্যে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি মানুষ কুকুর, র্যাকুন, শিয়াল ও বাদুড় প্রভৃতি প্রাণীর কামড়ের মাধ্যমে আক্রান্ত হতো। পাস্তুরের আবিষ্কৃত জলাতঙ্ক ভ্যাকসিন মানবকূলকে এ ত্রাস থেকে মুক্তি দিয়েছে। তবে এ আবিষ্কার রাতারাতি সম্ভব হয়নি; এর পেছনেও রয়েছে লম্বা ইতিহাস।
১৮২২ সাল। ফ্রান্সের এক গ্রামে এক দরিদ্র চামড়া ব্যবসায়ী অনুতাপ করছিলেন, “ইশ, যদি পড়াশোনা করতাম, তাহলে আজকে হয়তো ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত চামড়া পরিষ্কার করে দিন কাটাতে হতো না।” হঠাৎ তিনি খবর পেলেন, তার গর্ভবতী স্ত্রীর কোল জুড়ে এসেছে একজন পুত্রসন্তান। এ খবর শুনে আনন্দের সাথে তিনি স্থির করলেন, নিজে না পড়তে পারলেও সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। ব্যবসায়ীটি ছিলেন বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের গর্বিত পিতা, জিন-জোসেফ পাস্তুর।
লুই পাস্তুরের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তার পিতা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও তাকে একটি ব্যয়বহুল স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। এ সময় লুই পাস্তুর পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না। তবে তিনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার কাজে প্রায়ই তাকে সাহায্য করতেন। লুই এবং তার পরিবার যে গ্রামে বসবাস করতেন, তা ছিল জঙ্গলের নিকটবর্তী। এ জঙ্গলে অনেক নেকড়ে ছিল, যেগুলো প্রায় খাবারের সন্ধানে গ্রামে চলে আসত।
একদিন এক নেকড়ে তাদের গ্রামে এসে আটজনকে কামড় দিল। গ্রামের লোকেরা ওই পাগল নেকড়েকে হত্যা করলেও, নেকড়েটি যাদের কামড়েছিল, সেই আটজনের মধ্যে পাঁচজনই কিছুদিনের মধ্যে র্যাবিস বা জলাতঙ্কের শিকার হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আচরণ অনেকটা ঐ নেকড়ের মতোই হয়ে যাচ্ছিল। তাদের পিপাসা পেত, তবে তারা পানি দেখে ভয় পেত। খুব কম সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছিল। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে তারা প্রত্যেকে জলাতঙ্কের শিকার হয়ে মারা যান। তখন পর্যন্ত জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে, অথচ বেঁচে আছে- এমন ঘটনা একটিও ঘটেনি। তাই এ রোগের নিশ্চিত পরিণতি ছিল মৃত্যু।
বালক লুই এমন কষ্টদায়ক মৃত্যুর একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। বয়সে ছোট হলেও তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আফসোস, শুধু একজন বালক কেন, পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকই তাদের সাহায্য করতে পারত না! কেননা এ রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য এমন মৃত্যু নতুন ছিল না। প্রায়ই জঙ্গলের কোনো নেকড়ে বা আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে অনেকের মৃত্যু নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বালক লুই তার জীবনে এমনটি প্রথমবার দেখেছিলেন, যা তার মনে গভীর দাগ কাটে।
লুই সবসময় ভাবতেন, কেন তাদের বাঁচানো সম্ভব নয়? কেন তাদের কোনো ওষুধ দিয়ে সুস্থ করা যায়নি? বিরক্ত হয়ে তার বাবার জবাব ছিল,
“তুমি নিজেই কেন এ রোগের জন্য কোনো প্রতিষেধক তৈরি করছ না? অনেক পড়াশোনা করো এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করো। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করলে, এ রোগের প্রতিষেধকও বের করতে পারবে।”
এ ঘটনা আর তার বাবার কথাগুলো বালক লুইয়ের মন ও মগজে গেঁথে যায়। লুই ভেবেছিলেন,
“যদি পড়াশোনা করে এ রোগের প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে আমি দিনরাত পড়ব, কিন্তু এভাবে মানুষকে মরতে দেব না।”
এরপর থেকে লুই পড়াশোনায় অনেক মনোযোগী হয়ে যান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হবার পর বাবা তাকে পড়াশোনার জন্য প্যারিস পাঠান। প্রতিভাবান লুই নিজের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে অধ্যাপনায় যুক্ত হন।
শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় লুই নিজে জ্ঞান অর্জন করা কখনও ছেড়ে দেননি। প্রায় সকল খাদ্যদ্রব্যে অনেক ছোট প্রাণী থাকে। তবে এগুলো খালি চোখে দেখা যায় না, কেবলমাত্র সূক্ষ্ম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এদের দেখা যায়। তিনি এই ক্ষুদ্র অণুজীবের নাম দিয়েছিলেন- জীবাণু। তার আগে এ ধরনের জীবাণু বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি।
লুই বুঝতে পেরেছিলেন, জীবাণুর কারণে সকল খাবার দ্রুত নষ্ট হয়। তিনি আরো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, অণুজীবগুলো উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না। তিনি দুধকে ৭৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করে এবং ঠাণ্ডা করে দেখলেন, দুধ আগের থেকে বেশি সময় পর্যন্ত ভালো থাকে। কারণ, দুধ বা দুধের ন্যায় অন্য সকল তরল পদার্থ গরম করে ঠাণ্ডা করলে এতে থাকা সকল জীবাণু মারা যায়। এ প্রক্রিয়াকে বর্তমানে পাস্তুরাইজেশন প্রক্রিয়া বলা হয়।
লুই পাস্তুর চিন্তা করলেন, বিভিন্ন খাদ্যের মধ্যে যেমন বিভিন্ন জীবাণু থাকে, তেমনই মানবদেহেও এ ধরনের জীবাণু পাওয়া যেতে পারে এবং এমনও হতে পারে, এসব জীবাণুর কারণে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। জলাতঙ্কের জন্যও এ ধরনের জীবাণু দায়ী হতে পারে। তিনি ভাবলেন, তিনি যদি কোনোভাবে ঐ জীবাণুর সন্ধান করে, এগুলোকে মারার কোনো উপায় বের করে ফেলতে পারেন, তাহলে হয়তো বহু মানুষকে এই মরণব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।
এরপর থেকে লুই তার ল্যাবরেটরিতে দিনরাত পরিশ্রম করা শুরু করে দেন। তিনি যেখানেই কোনো জলাতঙ্কের শিকার কুকুরের সন্ধান পেতেন, খুব দ্রুত সেখানে চলে যেতেন। কুকুরের কামড়ের কারণে তিনি নিজে আক্রান্ত হতে পারেন; এমনটি তিনি কখনোই ভাবেননি। তিনি নিজে সেই আক্রান্ত প্রাণীকে ধরে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করতেন। গবেষণার প্রয়োজনে নিজের ল্যাবরেটরি সংলগ্ন এলাকায় আক্রান্ত কুকুর পুষছিলেন লুই। তিনি জানতেন, বিষয়টি ঠিক কতটা বিপজ্জনক, তবুও তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এসব কুকুর নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
অনেক গবেষণার পর একপর্যায়ে তিনি জলাতঙ্ক রোগের জন্য কোন জীবাণু দায়ী, তা বের করে ফেললেন। জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুর সহ অন্যান্য প্রাণীর শরীরের সাথে এদের লালায়ও এ রোগের জীবাণু থাকে। আর জলাতঙ্কে আক্রান্ত কোনো প্রাণী যখন মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীকে কামড়ায়, তখন ঐ প্রাণীর মুখ থেকে নিঃসৃত লালার সংস্পর্শে আসা প্রাণীও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। এভাবে লুই জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু এবং এ রোগ কীভাবে প্রাণী থেকে মানুষ বা অন্য প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হয়, তা বের করে ফেললেন। কিন্তু এখন মানবদেহে পৌঁছানো জলাতঙ্কের জীবাণু কীভাবে নষ্ট করা যাবে, এটা ছিল তার জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। দুধের মতো মানবদেহ তো আর আগুনে ফোটানো সম্ভব ছিল না, তাহলে উপায়?
পাস্তুর বিশ্বাস করতেন, আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে সকল ধরনের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি লুক্কায়িত থাকে; আমরা যাকে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলি। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না, আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেন হেরে যাচ্ছে।
এমন সময় তার একজন বন্ধু তার খামারের মুরগির একধরনের কলেরা জাতীয় রোগের কথা তাকে জানালেন। মুরগির এই মহামারি খুব দ্রুত ফ্রান্সের এক মুরগির খামার থেকে অন্য খামারে ছড়িয়ে পড়ছিল। এরপর লুই খামারের মুরগির রোগ নিয়ে তার গবেষণা শুরু করে দিলেন। মুরগির রোগ নিয়ে গবেষণাকালে তিনি দেখলেন, এমন কিছু রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু থাকে, যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে লুকিয়ে শরীরকে রোগে আক্রান্ত করে ফেলে। অর্থাৎ, আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সে জীবাণুর সাথে লড়াই করে তা ধ্বংসও করতে পারে। কিন্তু এ জীবাণু আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে লুকিয়ে কাজ করার ফলে তা চিহ্নিত হয় না।
তাহলে কীভাবে এত ধূর্ত জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি সম্ভব হবে? তার ধারণা ছিল, যদি একবার আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জীবাণুগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে নিশ্চিতরূপে তা এই জীবাণুকে ধ্বংসও করতে পারবে।
অবশেষে একদিন তিনি তার পরিশ্রমের ফল পেলেন। এ রোগে মারা যাওয়া মুরগির শরীর থেকে রোগের জীবাণু আলাদা করলেন। এরপর এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মুরগির কলেরা সৃষ্টিকারী জীবাণু নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। এতে জীবাণুগুলো আর রোগ সৃষ্টি করতে পারছিল না। এরপর তিনি নিষ্ক্রিয় জীবাণু দিয়ে তার তৈরি ভ্যাকসিন সুস্থ-সবল মুরগির ওপর প্রয়োগ শুরু করলেন। এর ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। যে মুরগিগুলোর উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলো সুস্থ ছিল, অন্য মুরগি কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছিল।
লুইয়ের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তিনি যখন তার ভ্যাকসিন মুরগির শরীরে প্রয়োগ করেছিলেন, তখন ভ্যাকসিনের জীবাণু নিষ্ক্রিয় হবার কারণে মুরগিগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় জীবাণুগুলো সক্রিয় জীবাণুর ন্যায় মুরগির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে নিজেদের লুকাতে পারেনি। এতে করে মুরগির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় এবং সক্রিয় উভয় ধরনের জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করা শিখে যায়। তার এ আবিষ্কার মানব ইতিহাসে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অনেক বড় অর্জন ছিল। এ আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে এর পরবর্তী কয়েক দশকে বহু প্রাণঘাতী রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
লুই পাস্তুর তার গবেষণা সক্রিয়ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাবলেন, যে প্রক্রিয়ায় মুরগির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়, তা কি অন্য রোগ বা অন্য প্রাণীর বেলাতেও কার্যকর হবে? হতেও তো পারে! অন্যান্য রোগ যদি জীবাণুর কারণে হয়, তবে জলাতঙ্কের বেলাতেও নিশ্চিত জীবাণু দায়ী। আর এ জীবাণুকে কাবু করতে পারলে হয়তো জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে। তার ধারণা এবারও সঠিক ছিল। তিনি একই তত্ত্ব ব্যবহার করে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিনও আবিষ্কার করে ফেললেন।
একদিন এক বিশালদেহী কুকুর উন্মাদের মতো চিৎকার করছিল। তার মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল জীবাণু আক্রান্ত লালা। কুকুরটিকে বন্দী করে খাঁচায় ভরে দেওয়া হলো। সে খাঁচায় ছেড়ে দেওয়া হলো একটি সুস্থ খরগোশকে। গবেষণার প্রয়োজনে এ লালা খরগোশের দেহে প্রবেশ করানো নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কুকুরটি খরগোশকে কামড়াচ্ছিল না। গবেষণার প্রয়োজনে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হলেন না লুই। বহু কষ্টে এক দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললেন সেই কুকুরকে। এরপর তাটিকে একটি টেবিলের ওপর শুইয়ে দিয়ে এর মুখটা নিচু করে ধরলেন। আর এর মুখের সামনে একটা কাঁচের পাত্র নিলেন, যাতে গড়িয়ে পড়তে লাগলো সেই লালা। এ দৃশ্য দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন লুই। এই লালা তিনি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা শুরু করলেন। প্রথমে প্রয়োগ করলেন একটি খরগোশের ওপর। পরবর্তী সময়ে এই বিষাক্ত লালা ব্যবহার করে তৈরি করে ফেললেন জলাতঙ্কের প্রতিষেধক।
তিনি জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করে একটি সুস্থ কুকুরের শরীরে প্রয়োগ করেন। এতে করে সেই পূর্ববর্তী ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
জলাতঙ্ক নিয়ে লুইয়ের গবেষণা প্রাথমিক পর্যায়ে সফল ছিল। কিন্তু কোনো জন্তুর শরীরে করা গবেষণা মানুষের শরীরেও সফল হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছিল না। তিনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন, এমন সময় এক ভদ্রমহিলা তার নয় বছরের ছেলেকে নিয়ে তার ল্যাবরেটরিতে হাজির হলেন। তিনি লুইকে জানালেন, দু’দিন আগে এক পাগল কুকুর তার বাচ্চাকে কামড়েছিল এবং ক্রমশ তার সন্তানের শরীরের অবনতি হচ্ছে। ছেলেটির নাম ছিল জোসেফ মিস্টার।
লুই সেই কুকুরটিকে খুঁজে বের করে পরীক্ষা করে দেখেন, কুকুরটি জলাতঙ্কের শিকার ছিল এবং এই বাচ্চাটিও জলাতঙ্ক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হবে।
যদিও লুই তার ভ্যাকসিন দিয়ে কুকুরের উপর সফল পরীক্ষা করেছিলেন, কিন্তু কোনো মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ছেলেটির শরীরে জলাতঙ্কের নিষ্ক্রিয় জীবাণু ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রয়োগের ফলে মানব শরীরে তা কীরূপ প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে কেউ জানত না। ভ্যাকসিন তখন পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। যদি লুই ছেলেটির উপর ওই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সফল না হতেন, তাহলে তার শারীরিক অবনতির জন্য সবাই তাকে দায়ী করত। এমনকি তার জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারত। কারণ, লুই কোনো লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক ছিলেন না এবং ভ্যাকসিন ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেত।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লুই অবশেষে ঠিক করলেন, তিনি ছেলেটির শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবেন। ভ্যাকসিন প্রয়োগ না করলেও তার নিশ্চিত পরিণতি মৃত্যু ছিল। ৬ জুলাই, ১৮৮৫ সালে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মানুষের ওপর জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। লুই শুরুর দিকে খুব কম মাত্রায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলেন এবং প্রতিদিন এর মাত্রা একটু একটু করে বাড়াতে শুরু করেন।
চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ছেলেটির মৃত্যু নিশ্চিত। অথচ সকলকে অবাক করে দিয়ে, সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছেন। চারদিক থেকে প্রতিদিন তার ল্যাবরেটরিতে এসে হাজির হতে লাগল কুকুরে কামড়ানো অসংখ্য রোগী। এর পরবর্তী ছয়মাসে যে ৩৫০ জন রোগী পাস্তুরের কাছে এলেন, তাদের সকলেই সুস্থ হয়ে উঠলেন; শুধু একটি মেয়ে ছাড়া, যাকে আনা হয়েছিল কুকুরে কামড়ানোর প্রায় ৩৬ দিন পর। তখন আর কিছুই করার উপায় ছিল না। আর এভাবেই লুই পাস্তুর আবিষ্কার করে ফেললেন জলাতঙ্কের হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার ভ্যাকসিন।