২য় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া উপদ্বীপে বিভাজনের সুর ওঠে। সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথের খেসারত হিসেবে দুই কোরিয়া দুই মতধারায় বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয় নতুন দুটি রাষ্ট্র- উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে উত্তর কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট ধারার সরকারব্যবস্থা। আর সেই সরকারের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন কিম ইল সুং নামক এক সামরিক নেতা। ক্ষমতায় আসীন হয়ে তিনি নিজেকে দেশটির সুপ্রিম লিডার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হয় ‘কিম’ বংশের এক বিতর্কিত এবং রহস্যঘেরা অধ্যায়।
উত্তর কোরিয়া কেমন রাষ্ট্র হবে, তা নির্ধারিত হয়েছিল এই সুপ্রিম লিডারের (মহান নেতা) শাসনামলে। তার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার পুত্র ‘কিম জং ইল’। এর ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতার পালাবদলের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তর কোরিয়াতে। আর উত্তর কোরিয়ানদের নিকট কিম বংশধারা হয়ে ওঠে ঐশ্বরিক অবতার। মহান নেতার চেয়েও অনেক বড় হয়ে ওঠে এই বংশের নেতাদের জাতীয় পরিচয় এবং পদমর্যাদা। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন সুপ্রিম লিডার কিম জং ইল।
জন্ম নিয়ে বিভ্রান্তি
উত্তর কোরিয়ার জনতার নিকট কিম বংশধারা দেবতাতুল্য মর্যাদা পায়। এই বংশের দ্বিতীয় শাসক কিম জং ইলকেও তারা পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মান করতো। তার ব্যক্তিত্ব, সাধারণ জীবনযাপন, শখ, ক্রীড়াজীবন, শিক্ষা এমনকি জন্মকালীন ঘটনা নিয়েও তাই দেশজুড়ে বিভিন্ন উপকথা এবং কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার জাতীয় নথিপত্রে এসব তথ্য পাওয়া যাবে। নথি অনুযায়ী ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পেকদু পর্বতের এক গোপন সামরিক ঘাঁটিতে জন্ম নিয়েছে কিম জং ইল। তার জন্মের সময় আকাশে জোড়া রংধনুর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাছাড়া আকাশে সেদিন এক নতুন তারার দেখা মিলেছিল। এই দুই ঘটনা যেন জানান দিচ্ছে নতুন শিশু কিম জং ইলের ঐশ্বরিক মর্যাদার কথা। তাছাড়া দেশের জনগণকে শেখানো হয়, কিম জং ইলের জন্মবার্ষিকী সারাবিশ্বে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়।
কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাগজপত্রে দেখা যায় ভিন্ন গল্প। সোভিয়েত তথ্যমতে, ১৯৪২ নয়, ১৯৪১ সালে সাইবেরিয়ার ভিয়াতস্কোয়ে অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল কিম জং ইলের। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, দেশের জাতীয় নেতার জন্ম কোরিয়ায় হয়নি, এমন তথ্য তার সুপ্রিম লিডার হওয়ার পথের কাঁটা হতে পারতো। তাই হয়তো পিতা কিম ইল সুং এই তথ্য বদলে দিয়েছিলেন।
তার পিতা কিম ইল সুং ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ৮৮তম বিগ্রেড-এর ১ম ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। মূলত জাপানিদের হাতে নির্বাসিত কোরিয়ান এবং চীনা সৈনিকদের নিয়ে এই ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়েছিল। কিম ইল সুংয়ের প্রথম স্ত্রী কিম জং সুক ছিলেন কিম জং ইল-এর মা। জাতীয় নথিতে পাওয়া যায়, কিম জং ইল এক বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, যাদের আমৃত্যু সাধনা ছিল বিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে রক্ষা করা।
শিক্ষাজীবন
কিম জং ইলের শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয়েছে কোরিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে- এমনটি দেখা যাবে জাতীয় নথিতে। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে তিনি রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে তার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন। তিনি ছাত্র থাকা অবস্থায় সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে থাকেন। পিয়ংইয়ংয়ের নামসান উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি শিশু ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক যুব লীগ (ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ) সহ নানা সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। মার্ক্সবাদ নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতেন তখন থেকেই। তবে তার শিক্ষাগণ্ডি কৃষি, সঙ্গীত, যন্ত্রপ্রকৌশলসহ একগাদা বিষয়ে বিস্তৃত ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি দেশের ক্ষেত-খামারে ভ্রমণ করতেন। অন্যান্য ছাত্রদের তিনি মহান আদর্শকেন্দ্রিক শিক্ষায় নিয়োজিত থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, সেই সময়ে দুই কোরিয়াতে অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং কোরিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই কারণে তাকে গণচীনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষালাভের জন্য। কিম জং ইল ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষালাভ শেষে তিনি কিম ইল সুং বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক্সবাদি অর্থনীতি নিয়ে অধ্যায়ন করেন। তাছাড়া দর্শন এবং সমরবিদ্যা ছিল তার ঐচ্ছিক বিষয়। এসময়ে তিনি তার পিতার সাথে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভ্রমণে সঙ্গী হয়ে ওঠেন। বলতে গেলে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন কিম জং ইল।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
১৯৬১ সালের জুলাইয়ে কিম জং ইল উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেন। যদিও ১৯৫৬ সালের পর থেকে সোভিয়েত মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে উত্তর কোরিয়া, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওয়ার্কার্স পার্টি কিছুটা স্তালিন ধাঁচের রাজনীতি পরিচালনা করতো। ওয়ার্কার্স পার্টির মতবাদকে কোরিয়াতে ‘জু-চে’ বা জুচে (Juche) নামে ডাকা হয়। জুচে শব্দের অর্থ আত্মনির্ভরশীলতা। আত্মনির্ভরশীলতা ছাড়াও সুপ্রিম লিডারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এই দলের মূলনীতি। এই সমর্থন থেকে দলটি তাদের সুপ্রিম লিডারকে ঘিরে হাজারো উপকথা প্রচার করতে থাকে। এভাবে সুপ্রিম লিডারকে ঐশ্বরিক অবতার হিসেবে উপস্থাপন করা হয় জনতার সামনে।
রাজনীতি এবং শিক্ষা- দুটো একসাথে চালিয়ে যান কিম জং ইল। ’৬৪-এ শিক্ষাজীবন সমাপ্তি শেষে তিনি রাজনীতিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তখন উত্তর কোরিয়ার সাথে সমসাময়িক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর নীতিগত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। এই কারণে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয় থেকে বেরিয়ে আসে উত্তর কোরিয়া। এমন সময়ে দলের আদর্শিক অবস্থান শক্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিতে কিম জং ইলকে নিয়োগ দেন তার পিতা কিম ইল সুং। তিনি দেশের সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশে বহু মতবিরোধী সামরিক কর্মকর্তা এবং নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব
পরবর্তীতে উত্তর কোরিয়া সরকারের প্রচারণা বিভাগ (প্রোপ্যাগান্ডা) এবং আন্দোলন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিনোদন উপদানের সেন্সরশিপ বা কাটছাঁট এই বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত ছিল। তিনি দেশজুড়ে নির্দেশনা জারি করেন যেন দেশের সকল লেখক, শিল্পী এবং কর্মকর্তা শুধু ওয়ার্কার্স পার্টির মতাদর্শ প্রচারের জন্য কাজ করে। গণমাধ্যমে তিনি জুচে মতবাদ প্রচারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। জাতীয় নথি অনুযায়ী, কিম জং ইল কোরিয়ান ফলিত কলায় বিপ্লবের সূচনা ঘটান। তিনি নতুন শিল্পকলায় উৎসাহিত করতেন দেশের শিল্পীদের।
ইতিহাস, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং উপকথার মিশ্রণের মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু সিনেমার প্রযোজনা করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওয়ার্কার্স পার্টির আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার সেরা মাধ্যম হতে পারে সিনেমা। সিনেমায় তিনি তার পিতা এবং পার্টির গৌরবগাঁথা ঘুরেফিরে প্রচার করেন। তাছাড়া তিনি ৬টি অপেরা রচনা করেন এবং বেশ কয়েকবার সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায় জাতীয় নথি থেকে। সিনেমা এবং সঙ্গীত নির্মাণ ছাড়াও তিনি নিজে বিদেশি সিনেমার ভক্ত ছিলেন বলেন জানা যায়। তার সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজারের বেশি সিনেমার ক্যাসেট ছিল। ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ, গডজিলা, র্যাম্বো সিরিজ এবং জেমস বন্ড সিরিজের সিনেমাগুলো ছিল তার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকার শীর্ষে। তার প্রিয় নায়িকা ছিলেন ক্লিওপেট্রাখ্যাত এলিজাবেথ টেলর।
তার সিনেমার ঝোঁক থেকে তিনি একবার এক অদ্ভুত কাজ করে বসেন। তিনি সুপ্রিম লিডার হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ‘গডজিলা’ সিনেমার সংস্করণ নির্মাণ করবেন। যে-ই ভাবা সেই কাজ। তিনি ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমার পরিচালক শিন সাং-উককে অপহরণ করার নির্দেশ দেন। অপহৃত সাং-উক তার নির্দেশে ‘পুলগাছারি’ নামে সেই সিনেমা নির্মাণ করেন। এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি বেশ আলোচিত হন।
ক্ষমতার শীর্ষে
১৯৭০ এর শুরু থেকেই কিম জং ইলকে সুপ্রিম লিডার হওয়ার জন্য তৈরি করতে থাকেন তার পিতা। তাকে পার্টির শীর্ষ নেতাদের কমিটির অন্তর্ভূক্ত করা হয়। উত্তরোত্তর পদোন্নতি হতে থাকে তার। তিনি এসময়ে জনগণের সাথে আমলাদের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের এক মাস বাধ্যতামূলকভাবে মাঠপর্যায়ে অধস্তনদের সাথে কাজ করার নিয়ম চালু করেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া তার প্রস্তাবিত ‘থ্রি-রেভ্যুলুশান টিম’ সারাদেশে ভ্রমণ করে জনগণকে কারিগরি, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতো। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে তাকে সুপ্রিম লিডারের উত্তরসূরি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯০-৯১ এর দিকে তিনি উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনী সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে তার পিতা কিম ইল সুং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন কিম জং ইল। শুরু হয় দেশটির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
কিন্তু তাকে ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করতে লেগে যায় আরও ৩ বছর। ১৯৯৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির সুপ্রিম লিডার নির্বাচিত হন। তার পিতা কিম ইল সুং-কে তিনি উত্তর কোরিয়ার ‘অনন্তকালীন রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেন। এছাড়া তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার একমাত্র উৎস হয়ে ওঠেন।
শাসনামল
কিম জং ইল যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন উত্তর কোরিয়ায় অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক ছিল। ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং দূর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি দেশের অন্যতম মূলনীতি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেন। এই নীতি অনুযায়ী বহির্বিশ্ব থেকে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে কোনোরূপ সহযোগিতা ছাড়াই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। তিনি এই নীতি থেকে সরে আসেন এবং কয়েকটি দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে থাকা পারমাণবিক বোমা প্রকল্প বাতিল করে বহিরাগত দলের তত্ত্বাবধানে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। এই চুক্তিতে প্রধান ঠিকাদার ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। এটি দেশটির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
এমনকি তিনি ১৯৯৯ সালে দূরপাল্লার মিসাইল পরীক্ষাও স্থগিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে। প্রতিদানে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে দেয়। তিনি প্রথম উত্তর কোরিয়ান নেতা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা কিম দে-জাং এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইতালি এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বহুলাংশে উন্নত হতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ২০০২ সালের দিকে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াকার বুশ উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং ইরাককে ‘শয়তানের অক্ষ’ হিসেবে মন্তব্য করেন। এর পেছনে উত্তর কোরিয়ার গোপন পারমাণবিক বোমা নির্মাণের প্রচেষ্টাকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র।
চুক্তিভঙ্গের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরে যায়। কিম জং ইল সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৩ সালে পারমাণবিক সক্ষমতা সম্প্রসারণ রোধে স্বাক্ষরিত নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন চুক্তি থেকে উত্তর কোরিয়ার নাম বাতিল ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে নিজেদের পারমাণবিক বোমা তৈরির কথা জানিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে হৈচৈ ফেলে দেন। এরপর থেকে উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক সক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বিদ্যমান অস্থিরতা নিরসনে হাতিয়ার হিসেবে এই ইস্যু ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে কিম জং ইলের বিরুদ্ধে।
২০০৬ সালে কিম জং ইল গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে জানান যে, উত্তর কোরিয়া মাটির নিচে সফলভাবে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছে। এরপর ২০০৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন লি মিউং-বাক। তিনি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। সম্পর্কে চূড়ান্ত অবনতির মধ্য দিয়ে একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। ২০১০ সালে জলসীমান্তে দক্ষিণ কোরিয়ার রণতরী চিওনান ডুবিয়ে দেয় উত্তর কোরিয়া। একই বছর ইয়ংপিয়ং দ্বীপে দুই দক্ষিণ কোরিয়ান মেরিন সেনাকে হত্যা করে উত্তর কোরিয়া। এর ফলে কিম জং ইলের শাসনামলে দুই কোরিয়ার সম্পর্ক তিক্ততর হয়ে ওঠে।
কিম জং ইলকে নিয়ে প্রচলিত যত উপকথা
আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হলেও দেশের ভেতর কিম জং ইলের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী ছিল। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক এবং গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে লাগাতার উপকথা এবং স্তুতিমূলক অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে থাকে। তার জন্ম নিয়ে প্রচলিত উপকথা সম্পর্কে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া তিনি মাত্র ৩ সপ্তাহ বয়সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন এবং ৮ সপ্তাহ বয়সে হাঁটতে পারতেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাত্র ৩ বছরে প্রায় ১,৫০০টি পুস্তক লিখেছেন এবং ৬টি অপেরা সম্পাদনা করেছেন। জাতীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে জানা গেছে, কিম জং ইল সম্পাদিত অপেরাগুলো ‘ইতিহাসে যেকোনো সঙ্গীত থেকে শ্রেয়তর’। ১৯৯৪ সালে পিয়ংইয়ংয়ের গণমাধ্যমে একটি খবর প্রচারিত হয়। সেখানে জানানো হয়, জীবনে প্রথমবার গলফ খেলতে গিয়ে কিম জং ইল ৩৮টি আন্ডার পার রাউন্ড খেলেন যার মধ্যে ১১ বার তার গলফ বল প্রথম শটে গর্তে পতিত হয়েছে। তার এই কীর্তির সাক্ষী হিসেবে ১৭ জন দেহরক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়। এই ঘটনার পর পরই ক্রীড়া জীবন থেকে চিরতরে অবসর নেন কিম জং ইল।
উত্তর কোরিয়ায় প্রকাশিত রডোং সিনমুন নামক এক জাতীয় পত্রিকায় দাবি করা হয়েছিল, কিম জং ইল-এর পরনের কোটটি বৈশ্বিক ফ্যাশনের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই ধরনের সংবাদ পরবর্তীতে তার সন্তান কিম জং উনকে নিয়েও প্রচারিত হয়েছে। সংবাদমতে, বিশ্ববাসী কিম পরিবারের অনুকরণে পোশাক পরিধান করে এবং চুল ছাঁটাই করে। তবে সকল উপকথাকে ছাড়িয়ে গেছে উত্তর কোরিয়ার জাতীয় ওয়েবসাইটে লিখিত জীবনীতে করা একটি হাস্যকর দাবি। সেখানে দাবি করা হয় সুপ্রিম লিডার কিম জং ইল মলমূত্র ত্যাগ করেন না। পরবর্তীতে সেই ওয়েবসাইটটি অকার্যকর করে দেওয়া হয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের হাস্যকর মন্তব্য দায়ী ছিল কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। এভাবে প্রতিনিয়ত কিম পরিবারবর্গ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে একের পর এক উপকথা, যা দেশটির নাগরিকরা একবাক্যে বিশ্বাস করে।
মৃত্যু
২০০৮ সালে কিম জং ইলের স্বাস্থ্য অবনতি দেখা দেয়। অসুস্থতার কারণে তিনি টানা কয়েকমাস জনসম্মুখে উপস্থিত হতে পারেননি। তখন থেকেই গুঞ্জন উঠে তার মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে। ধারণা করা হয়, তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন থেকেই তার পুত্র কিম জং উনকে উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ চলতে থাকে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই রহস্যজনক নেতার মৃত্যু ঘটে। উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, দেশবাসীর উন্নয়নের কাজে ট্রেনে ভ্রমণরত অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর ২ দিন পর এই সংবাদ প্রচারিত হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উপর কড়াকড়ি থাকায় বিদেশি রাষ্ট্রনেতা এবং সাংবাদিকরা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নিমন্ত্রিত হননি। তার শবযাত্রার সময় পথের দু’ধারে কয়েক হাজার কোরিয়ান দাঁড়িয়ে কান্নারত অবস্থায় তাদের ‘মহান নেতা’কে শেষবারের মতো বিদায় জানায়। পুরো দেশ প্রিয় নেতার মহাপ্রয়াণের শোকে অচল হয়ে পড়ে।
কিম জং ইল একজন রহস্যময় নেতা ছিলেন। দেশীয় উপকথার বাহুল্যে তার জীবনের সকল ঘটনার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এর কারণে তাকে নিয়ে খুব কম ঘটনা সম্পর্কে সূক্ষ্মভাবে জানা গেছে। এসব কারণে তার জীবনী অনেকটাই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে গবেষকদের নিকট। তার মৃত্যুর এক দশক পরেও তার সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
তার সন্তান কিম জং উন বর্তমানে দেশটির ক্ষমতায় আছেন। তিনি তার দাদার ন্যায় তার পিতাকেও চিরন্তন সম্মাননা প্রদান করার মাধ্যমে এক মহাপুরুষ হিসেবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে আসছেন।