Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রফুল্ল চাকী: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় এক বীর

১৯০৫ সালে সমগ্র বাংলা অঞ্চলকে কেটে দুভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার প্রধান লর্ড কার্জন; যা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। সাধারণভাবেই বাংলার জনগণ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ জানায় এবং রাজপথের আন্দোলন শুরু করে। সে সময় এখনকার মতো অল্পবয়সে বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হতো না। তখন কিছু বয়স হবার পর ছেলেরা স্কুলে ভর্তি হতো আর মেয়েদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক পড়াশোনা করতো। যেকোনো ধরনের আন্দোলন সংগ্রামেও এই স্কুলের ছেলেরাই এগিয়ে থাকতো। সে কারণে ধূর্ত ব্রিটিশ সরকার বাংলা অঞ্চলে কার্লাইল সার্কুলার জারি করে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সংগ্রাম করতে না পারে। কিন্তু বিপ্লব যাদের রক্তে মিশে আছে, আইন কিংবা সার্কুলার জারি করে তাদের কি আর পথভ্রষ্ট করা যায়? সে সময় কার্লাইল ভঙ্গ করে যারাই ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের সকলকেই বিভিন্নভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। কাউকে করা হয়েছে জরিমানা, কাউকে বেত্রাঘাত আবার কাউকে করা হয়েছে সরাসরি বহিষ্কার। আর এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন বগুড়ার সন্তান প্রফুল্ল চাকী। তাই বিপ্লব করতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা হিসেবে ১৯০৬ সালে রংপুর জেলা স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি।

সম্পূর্ণ বাংলা অঞ্চল একত্রে; ছবি: আজিজ তারেক

বিপ্লবী জীবন

বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে মূলত সমগ্র বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আমেজ ছড়িয়ে পরে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংঘের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা সংগঠিত হতে থাকে। তেমনই এক সংঘের নাম গুপ্ত সমিতি। ১৯০৬ সালে এ সমিতির সভ্য হন চাকী। বলা যায় এই সংঘের মাধ্যমেই বিপ্লবে হয় হাতেখড়ি। জিতেন্দ্র রায়, অবিনাশ চক্রবর্তী, ঈশানচন্দ্র চক্রবর্তীর সংস্পর্শে থেকে নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি হাতে কলমে শেখেন অস্ত্রের ব্যবহার। এরই মধ্যে বিপ্লবী কাজে রংপুর ভ্রমণে আসেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। তার সাথে পরিচিত হয়ে পরবর্তীতে চাকী যোগ দেন বিপ্লবী দল যুগান্তরে। সেখানে পরিচয় হয় সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত ও অরবিন্দ ঘোঘের সাথে।

যুগান্তরে যোগ দেবার পূর্বে গুপ্ত সমিতির উদ্যোগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যাম্পফিল্ড ফুলার ও গভর্নর এন্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। কেননা বাংলা অঞ্চলের দায়িত্বে থাকার দরুন এরাই বাঙালি বিপ্লবীদের ওপর সবচাইতে বেশি অত্যাচার করতে থাকে। তাই বিপ্লবীদের সভায় এদের মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হয়।

তখনকার বিপ্লবীরা হামলা কার্য পরিচালনায় ব্যবহার করতো কিছু হাত বোমা, দুয়েকটা পিস্তল। তবে এগুলো খুব সহজে জোগাড় করা যেত না। তাই মাঝে মাঝে বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে ডাকাতির প্রয়োজন পড়তো। এমনই এক জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করে অর্থ লুট করা ছিল প্রফুল্ল চাকীর প্রথম অ্যাসাইনম্যান্ট। উদ্দেশ্য ছিল লুট করা অর্থ দিয়ে কেনা হবে অস্ত্র এবং তা ব্যবহার করেই হত্যা করা হবে ফুলারকে। চার/পাঁচ জনের বিপ্লবী দল রংপুরের জমিদার বাড়িতে ডাকাতির করতে গেলে দেখা যায় সেখানে পুলিশ অবস্থান করছে। সে কারণে সেবার অর্থ লুট করা সম্ভব হয়নি এবং ফুলারকেও হত্যা করা যায়নি। পরবর্তীতে আবারও পরিকল্পনা হয়। এবার ট্রেনের লাইনে ব্যাটারি চালিত বোমা পুঁতে রাখা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফুলার অন্য পথে যাত্রা করলে সে পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়।

প্রফুল্ল চাকী; source: unbumf.com

ফুলারের পর এন্ড্রু ফ্রেজারকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। ফুলারের হত্যা পরিকল্পনা মতো ফ্রেজারের ক্ষেত্রেও রেললাইনে বোমা পুঁতে রাখা হয়। কিন্তু সেবার বোমা বিস্ফোরিত না হওয়ায় বেঁচে যায় ফ্রেজার। পরবর্তীতে আবারও বোমা পুঁতে রাখা হয়, কিন্তু বিকল্প পথে ফিরে যাওয়ায় আবারও বেঁচে যায় ফ্রেজার।

বারবার হত্যা পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও ততদিনে বিপ্লবী কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করেন প্রফুল্ল চাকী। বোমার ব্যবহার সম্পর্কে বেশ সমৃদ্ধ ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে তার দখলে। এরই মধ্যে ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্ট নতুন করে ঝামেলা বাঁধালেন। পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুষি মারার অপরাধে সুশীল সেন নামে ১৩ বছরের কিশোরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। বিচারক কিংসফোর্ট ১৫ টি বেত্রাঘাতের রায় দেন। সে সময় ১৫ বছর বয়সের চেয়ে কম কাউকে বেত্রাঘাত করার নিয়ম ছিল না। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করেন এই বিচারক। বেত্রাঘাতের ফলে রক্তাক্ত হয় সুশীল সেন এবং সেখানেই কাতরাতে কাতরাতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বর্বরতম এ আচরণে ক্ষিপ্ত হয় বাংলার তরুণ সমাজ। বিপ্লবীরা সিন্ধান্ত নেয় কিংসফোর্টকে হত্যা করার। সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীনকুমার ও অরবিন্দ ঘোষের সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় প্রফুল্ল চাকীর ওপর। সহযোগী হিসেবে তার সাথে যোগ দেন ক্ষুদিরাম বসু। এটিই ছিল তাদের জীবনের শেষ সশস্ত্র সংগ্রাম।

প্রফুল্ল চাকী স্মারক ডাকটিকেট; Source: istampgallery.com

প্রফুল্ল চাকীর সর্বশেষ অপারেশন

কলকাতার গোপীমোহন দত্তের ১৫ নং বাড়িতে বসে কিংসফোর্টের জন্য তৈরি করা হল পুস্তক বোমা বা বুক বোম্ব। হেমচন্দ্র আর উল্লাসকর মিলে এই বোমাটি তৈরি করেন। এই বোমার বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি বইয়ের ভাঁজে রেখে দেয়া যায়। উদ্দেশ্য তা কিংসফোর্টকে উপহার হিসেবে পাঠানো। এবং বই খোলামাত্রই বোমাটি বিস্ফোরিত হবে। নানান কায়দা-কানুন করে অবশেষে বইটি কিংসফোর্টের কাছে পৌঁছান হয়। এবার অপেক্ষা সুঃসংবাদের। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকলেও সংবাদের আর ‘সু’ হয়ে ওঠা হয় না। বিপ্লবীরা বুঝতে পারে যে বইটি তিনি খুলেননি। পরিকল্পনামাফিক কাজ না হওয়ায় আবারও নতুন করে পরিকল্পনা করতে বসেন বিপ্লবীরা।

কলকাতার নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের ৩৮/৫ নং বাড়িতে পুনরায় পরিকল্পনা করা হল। ততদিনে কিংসফোর্ট বদলি হয়ে মোজাফফরপুরে। ১৯০৮ সালের ১৫ এপ্রিল, মোজাফফরপুর রেল স্টেশনে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু মিলিত হলেন। লক্ষ্য একটাই, কিংসফোর্টের মৃত্যু। স্টেশন থেকে যেতে হবে ক্লাব হাউজে; কারণ সেখানে থেকেই সাদা ফিটন গাড়িতে করে ফিরে আসে কিংসফোর্ট, সাথে আছে রিভলবার ও বোমা। সতর্কতার সাথে অপেক্ষা করতে থাকেন চাকী ও ক্ষুদিরাম। এবার যেভাবেই হোক লক্ষ্যভেদ করতেই হবে। কোনো ভুল করা যাবে না। লাগলে আরও সময়  নিতে হবে। এমন করেই পাঁচদিন কেটে যায়। কিন্তু কোনোভাবেই সুবিধা করা যাচ্ছিল না। ষষ্ঠদিন অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ১৯০৮, এই দিনটিকেই মোক্ষম হিসেবে বিবেচনা করলেন প্রফুল্ল। প্রতিদিন রাত আটটায় সাদা ফিটন গাড়িতে (ঘোড়ার গাড়ি) করে ইউরোপিয়ান ক্লাবে মদ্যপান করতে যায় ঘাতক। এ সুযোগেই ঘায়েল করতে হবে ঘাতককে।

প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু; Source: unbumf.com

ঠিক রাত আটটায় অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে আসছিল সাদা ফিটন গাড়িটি। একটু কাছে আসতেই গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়ে মারে সময়ের শ্রেষ্ঠ সে সন্তানেরা। না এবার আর ভুল নয়, ঠিক গাড়িতেই বিস্ফোরিত হয় বোমাটি। সাথে সাথে উড়ে যায় ব্রিটিশ সাদা ফিটন গাড়ি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেবারও কিংসফোর্টকে মারতে ব্যর্থ হন বিপ্লবীরা। কারণ গাড়িতে তখন ছিলেন ইংরেজ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা সন্তান। কিংসফোর্টের স্থলে সেদিন নিহত হন সে দুজন বিদেশি।

ঘটনার একঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং আততায়ীকে ধরতে সাহায্য করলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ততক্ষণে মোজাফফরপুর থেকে পালিয়ে গেছেন দুজনই। আত্মরক্ষার স্বার্থে দুজন নিজেদের কাছে দুটি রিভলবার সংরক্ষণ করে এবং ধরা না পড়ার কথা চিন্তা করে দুজন দুটি আলাদা পথে পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। পথে পানি পান করতে গিয়ে ওয়ালি স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পরেন ক্ষুদিরাম। ক্ষুদিরাম সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে রোর বাংলায় প্রকাশিত ক্ষুদিরাম বসু: বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মশাল শীর্ষক প্রবন্ধে।

মৃত্যু পরবর্তীতে তোলা ছবিতে চাকী; Source: shibham.wordpress.com

প্রফুল্ল পালিয়ে ট্রেনে করে কলকাতা ফিরে আসার পথে সমস্তিপুর স্টেশনে স্বজাতি নন্দলাল ব্যানার্জী নামক এক দারোগার সন্দেহের মুখে পালানোর চেষ্টা করেন। দারোগা তা বুঝতে পেরে ধাওয়া করে এক পর্যায় চাকী তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। প্রাণপণ পালাবার চেষ্টা করেও শেষতক ধরা পরবার ভয়ে আত্মাহুতি দেন প্রফুল্ল। সাথে বহনকৃত রিভলবার দিয়ে নিজের চিবুকের নিচে দুটি গুলি করে তার সংগ্রামী জীবনের ইতি টানেন বাংলাদেশের ছেলে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী। তবে মৃত্যু পরবর্তী ছবিতে তেমন চিহ্ন খুঁজে না পাওয়ায় অনেকে মনে করেন চাকী আত্মহত্যা করেননি বরং পুলিশই তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

পরিণতি

১৮৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বিহার গ্রামে জন্ম নেন প্রফুল্ল চাকী। তারপর জীবনের ১৯টি বসন্ত পেরিয়ে ২০তম বসন্তের আগেই দেশমাতৃকার টানে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন তিনি। ১৯০৮ সালের ২ মে পুলিশের হাতে আটক না হয়ে নিজের জীবন দিয়েই বাকি বিপ্লবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন তিনি। জীবিত অবস্থায় হয়তো দেশকে স্বাধীন দেখতে পাননি, তবে তার মৃত্যু ও ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর সমগ্র দেশব্যাপী বঙ্গভঙ্গ ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আরও জোরালো হয়। এবং একসময় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। প্রফুল্ল চাকী কিংবা ক্ষুদিরাম বসুরা হয়তো স্বাধীনতা এনে দিয়ে যেতে পারেননি, তবে স্বাধীনতার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এই অকুতোভয় বাঙালিদের হাত ধরেই।

প্রফুল্ল চাকী স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য; Source: wikimedia commons

ফিচার ইমেজ: Edited by writer

তথ্যসূত্র: শত বিপ্লবীর কথা, সম্পাদনা: শেখ রফিক, পৃষ্ঠা ২৭-৩১, প্রকাশ: ২০১৪

Related Articles