মিখাইল ময়সেভিচ বতভিনিক ছিলেন দাবার ইতিহাসে ষষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, সর্বকালের অন্যতম সেরা দাবাড়ু। বতভিনিক ছিলেন হাতে গোনা সেই খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন, যারা দাবার ক্যারিয়ারে যেমন সফল, তেমনি কর্মজীবনেও। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন তড়িৎ প্রকৌশলী এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী। দাবার ভুবনে তার অবদান অপরিসীম, চেস থিওরিতে তার নিজস্ব সংযোজনগুলোই তাকে ইতিহাসে অমর করে রাখতে যথেষ্ট। নিজে যেমন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন, তেমনি বানিয়েছেনও। তার সোভিয়েত চেস স্কুল এর সুফল পরবর্তী প্রজন্ম ধরে সোভিয়েতরা পেয়েছে। পরবর্তী তিন বিশ্ববিজেতা গ্যারি ক্যাসপারভ, আনাতোলি কারপভ, ভ্লাদিমির ক্রামনিক তার সরাসরি ছাত্র। চেস কম্পিউটেশন এর অগ্রদূত এবং পথিকৃৎও ছিলেন তিনি।
১৯৪৮-৫৭, ১৯৫৮-৬০ ও ১৯৬১-৬৩- এই তিন দফায় দাবার রাজমুকুট ধরে রাখেন তিনি। ঐতিহাসিক এক ম্যাচে ১৯৬০ সালে দাবাবিশ্বের তৎকালীন সেনসেশান উদীয়মান তরুণ মিখাইল নেখমেভিচ তাল বতভিনিককে ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে হারিয়ে সেসময়ে সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন। এ বিষয়ে গ্যারি ক্যাসপারভের সাক্ষাৎকারে আমরা জেনেছি। ১৯৬১ সালে ফিরতি ম্যাচে ১৩-৮ পয়েন্টে জিতে বিশ্ববিজেতার খেতাব আবারও নিজের করে নেন বতভিনিক। সেই ম্যাচের পরে সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বতভিনিকের ভাষ্য নিয়েই এই সিরিজ। প্রেস কনফারেন্সটি ১৯৬১ সালে প্রথম রিগা সা’হস (Sahs) ম্যাগাজিনের দ্বাদশ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আজকে থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব!
প্রশ্নকর্তা: ম্যাচের ঠিক কখন আপনি জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন?
বতভিনিক: আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই বিশতম গেমটা অ্যানালাইজ করার সময়। আমি একটা স্টেলমেট আইডিয়া খুঁজে বের করেছিলাম, যার দ্বারা রুক (বাংলায় কিস্তি বলা হয়) অ্যাক্টিভেট করা যায়। মূল খেলার সময়, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এটা ড্র হবে এবং অন্যদিকে তাল স্টেলমেট আইডিয়াটা না দেখায় ভাবছিলেন তিনি জিতবেন। পরেরদিন যখন খেলা আবার কন্টিনিউ হলো, Rb5+ এর জবাবে তাল দ্রুতই Ka4 খেললেন। আমি পুনরায় নিশ্চিত হলাম যে, ম্যাচটা ড্র-ই হতে যাচ্ছে! তাল দ্রুতই ব্যাপারটা ধরে ফেললেন। তিনি আর এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি, ম্যাচটা তখনই মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
পয়েন্ট ব্যবধান এতটা হওয়ার পরও শেষদিকে তাল দারুণ আক্রমণাত্মকভাবে খেলেন, বলতে গেলে আগের থেকে আরও উদ্যমের সাথে। তিনি কোনোভাবেই ভেঙে পড়েননি, এমনকি আমার মনে হয় ম্যাচ যদি আরও চলত, হয়তো তিনি পয়েন্ট ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারতেন। উপরন্তু বলা যায়, ক্লান্তি আমার উপরই বেশি ভর করেছিল। কারণ, তালকে খেলতে যতটা প্রিসিশন-এর সাথে খেলতে হয়, আপনি সবসময় সেভাবে খেলা চালিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু বিশতম ম্যাচের সেই ঘটনার পর আমি আরও আক্রমণাত্মকভাবে খেলতে মানসিকভাবে সক্ষম হই। সেই সূত্র ধরেই একুশতম ম্যাচেও জয় পাই। আমার মনে হয়, তখন আমি এক আলাদা তালকে মোকাবিলা করেছিলাম, সেই ম্যাচের আগের তালের সাথে যার মিল অতি সামান্যই!
সোভিয়েত দাবাড়ু বা বিদেশিদের মধ্যে কে আপনাকে ১৯৬৩ সালে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে?
বতভিনিক: ১৯৬৩ সালের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট কে জিতবে-এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব যারা কোয়ালিফাই করবে সবারই সমান সম্ভাবনা আছে। যেকোনো সোভিয়েত গ্র্যান্ডমাস্টারই হতে পারেন। আর বিদেশিদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিশার অথবা ইউগোস্লাভ গ্র্যান্ডমাস্টার গ্লিগোরিচ বেশ সম্ভাবনাময়।
বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ টাইটেল ডিফেন্ড করাটা নাকি শ্বাপদসঙ্কুল, অন্তত আপনি এমনটাই বলেছিলেন। কেমন সমস্যার সেই সম্পর্কে একটু যদি বলতেন …
বতভিনিক: হ্যাঁ, এ বিষয়টা নিয়ে আমি আর ম্যাক্স উ (সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন) আলোচনা করেছিলাম। চ্যাম্পিয়নশিপ ডিফেন্ড করা সবসময়ই প্রতিকূল পরিস্থিতি, অন্যদিকে যখন আপনি চ্যালেঞ্জ করেন সেটা আরেকরকম ব্যাপার। সেই খেলোয়াড় তখন উজ্জীবিত থাকে, তার মাথায় শুধু থাকে জয়ের উন্মাদনা… বিশাল বড় একটা কিছু অর্জন করতে চলেছে সে, তার চিন্তাভাবনা ইতিবাচক থাকে সবসময়। আসলে তার হারানোর কিছুই থাকে না।
আর যখন আপনি টাইটেল ডিফেন্ড করেন, তখন আপনার মাথায় ঘুরতে থাকে- কেউ একজন কিছু একটা আপনার থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। একটা চাপ ভর করে থাকে আপনার উপর সবসময়ই। সেকারণে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ধীর গতিতে, কম এনার্জির সাথে খেলে। বিগত রিটার্ন ম্যাচগুলো এর প্রমাণ, এক্স-ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নরা সবগুলো রিটার্ন ম্যাচ জিতেছেন। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় তাল ম্যাচ শুরুর আগেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাকফুটে ছিলেন।
অনেকেই বলছে, এই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আপনার পারফরম্যান্স আগের যেকোনোবারের চেয়ে সেরা। সবথেকে সেরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন আপনি … এর সাথে কি আপনি একমত?
বতভিনিক: এটা বলা বেশ কঠিন, দাবায় আসলে পরম বলে কিছু নেই, সব আপেক্ষিক। আপনি বলতে পারেন, স্মিস্লভের সাথে খেলা ম্যাচটার থেকে এই ম্যাচে বেশি ভালো খেলেছি। কারণ, স্মিস্লভ তো আর তাল নন। হয়তো তাল এ ম্যাচে আউট-ফর্মে ছিলেন, কম প্রস্তুত ছিলেন। আগের ম্যাচগুলোয় আমি বেশকিছু ভুলও করেছিলাম, কিন্তু এ ম্যাচে কদাচিৎ ভুল খেলেছি। বিশেষ করে এন্ডিং-টা শার্প ছিল এবার। আগের ম্যাচগুলোয় কিছু ভুল প্রায়শই ঝামেলায় ফেলত আমাক, কিন্তু এবার দ্বিতীয় আর উনিশতম মাত্র এই দুই ম্যাচে পঞ্চম ঘণ্টায় একটু বিপাকে পড়েছিলাম; তাছাড়া বাকিগুলোতে ভালোভাবেই সামাল দিয়েছি।
তালের সাথে এমনিতে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন?
বতভিনিক: আমি আসলে খুব নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া মানুষ, অন্তর্মুখী বলতে পারেন। লোকেদের সাথে খুব কমই দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়। তাল আর আমার শহরও আলাদা, আবার আমাদের বয়সেও বড়সড় ব্যবধান রয়েছে। তবে এসব সত্ত্বেও ম্যাচ শেষ হলে এক সন্ধ্যা তার সাথে কাটানোর ইচ্ছা আমার আছে।
এই ম্যাচ নিয়ে কি কোনো বই লেখার ইচ্ছা আছে আপনার? যদি হ্যাঁ হয়, তবে আমরা কবে নাগাদ আশা করতে পারি?
বতভিনিক: এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। আসলে একটা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন, আর যখন সেটা বই লেখার জন্য তখন আরও কঠিন। সেই বই প্রকাশ হতে অনেক চেক আর কারেকশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যা প্রায় বছরখানেকের ব্যাপার-স্যাপার। সব মিলিয়ে আমি এখনও সিদ্ধান্ত পুরোপুরি চূড়ান্ত করিনি।
আপনাদের এই ম্যাচটি কি চেস থিওরিতে কোনো ভূমিকা রাখবে?
বতভিনিক: সবথেকে চমকপ্রদ যে ব্যাপার এ ম্যাচে ঘটেছে তা হলো, কারো-কানের জবাবে তাল e4-e5 খেলেছে যা আপনি কদাচিৎ দেখবেন। যার পর কালোর জন্য আপাতদৃষ্টিতে কিছু সমস্যার উদ্ভবও ঘটেছে, যদিও এর কোনোটাই গুরুতর ছিল না। আবার ফ্রেঞ্চ ডিফেন্সের বেলায়, আমি নতুন একটা ভ্যারিয়েশন ট্রাই করেছি, যদিও তাল সেখানে শক্তিশালী জবাব দেন। যদিও খুব দ্রুতই কুইন স্যাক্রিফাইস করেন বলে সেখানে সুবিধা করতে পারেননি তাল। কিংস-ইন্ডিয়ান আর নিমজো-ইন্ডিয়ানেও কিছু ভ্যারিয়েশন দেখতে পেয়েছি আমরা।
ম্যাচ চলাকালীন কি আপনার ওজন কমেছিল?
বতভিনিক: যদিও ওজন মাপা হয়নি, তবে আমার মনে হয় ওজন একই আছে। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, যখন স্নায়ুতন্ত্র মন্থর গতিতে কাজ করে, তখন ওজন বেড়ে যায়। গত ম্যাচে যেটা হয়েছিল, দুঃখজনকভাবে আমি খানিকটা মুটিয়ে গিয়েছিলাম।
ফিরতি ম্যাচ তুলে দেয়া হয়েছে, ফিদের এই নতুন সিদ্ধান্তকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
[বি.দ্র.: আগের নিয়মে একজন চ্যাম্পিয়ন টাইটেল হারালে বাই ডিফল্ট পরের বছর রি-ম্যাচ পেতেন, ঠিক যে নিয়মে বতভিনিক ১৯৬০ সালে তালের কাছে হারার পর ১৯৬১ সালে সরাসরি ফিরতি ম্যাচ পেয়ে যান]
বতভিনিক: এ ব্যাপারে আমার মত আমি সোভিয়েতস্কি স্পোর্ট (Sovetskiy Sport) পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকারে বলেছি। আমার মনে হয়, ফিদে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং দ্রুতই রিটার্ন ম্যাচ ফিরিয়ে আনা হবে। তালের মতামত Shakhmaty v SSSR পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, তিনিও চান রিটার্ন ম্যাচ থাকুক। যদি আমাদের বাকি খেলোয়াড়রাও এ বিষয়ে একমত হন, এবং বিদেশি দাবাড়ুরাও চান, তাহলে হয়তো ফিদে তার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে আর রিটার্ন ম্যাচও হয়তো ফিরে আসবে আবার!
(সংক্ষেপিত)
এই সাক্ষাৎকারটি মিখাইল বতভিনিক দিয়েছিলেন মিখাইল তালের সাথে তার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ফিরতি ম্যাচে জয়ের পর। ব্যক্তিগত জীবনে মিখাইল তালের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আরেক দাবার মাস্টারমাইন্ড রশিদ গিবাতোভিচ নাজমুদ্দিনোভের। তার সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করুন –