রুমীয় সেলজুকদের প্রতিপাদ্য করে সাজানো আমাদের এই সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি আদি সেলজুকদের বিষয়ে। সেলজুকদের উত্থান, দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার শুরুটা, ঐতিহাসিক মাঞ্জিকার্টের (মালাজগার্টের) যুদ্ধ ইত্যাদি উঠে এসেছে প্রথম পর্বে। এছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের বিখ্যাত শাসক, যেমন- আলপ আরসালান, মালিক শাহ, উজির নিজাম-উল-মুলক প্রমুখের নামও জেনেছি। আজকের পর্বে থাকবে রুমে তথা আনাতোলিয়ায় সেলজুকদের বসতি স্থাপন, বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, শাসন প্রতিষ্ঠা, আদি সেলজুকদের সাথে লড়াই, আনাতোলিয়ায় তাদের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী শাসক বংশ যেমন দানিশমান্দ বংশ প্রভৃতি বিষয়।
প্রখ্যাত গবেষক হিলেনব্র্যান্ডের মতে, মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধের অন্তত চার দশক আগে থেকেই সালতানাতের শুরু। আলপ আরসালান কর্তৃক সম্রাট চতুর্থ রোমানোস ডায়োজেনাস (শাসনকাল ১০৬৮-৭১ খ্রিস্টাব্দ) পরাজিত ও বন্দী হন এ যুদ্ধে। মোটামুটি এর পর থেকেই তুর্কিরা অবাধে আনাতোলিয়ায় প্রবেশগম্যতা পেতে শুরু করে। বিভিন্ন ছোটখাট অভিযান তারা অনায়াসেই চালাতে থাকে, সাথে তাদের গবাদিপশুর জন্য চারণভূমি হিসেবেও ব্যবহার করতে থাকে। মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধের পর বাইজান্টিয়াম জুড়ে তুমুল গৃহযুদ্ধ বেধে যায়, যার ফলশ্রুতিতে তাদের একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণে তুর্কিদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। যদিও এসময়ে আনাতোলিয়া বাইজান্টীয় শাসকদের অধীনেই ছিল, কিন্তু তুর্কিরা কার্যত স্বাধীনভাবে পুরো ভূখণ্ড জুড়েই বিচরণ করতে থাকে, এমনকি পশ্চিমে মারমারা সাগর অবধি।
বেশকিছু গোত্রপ্রধানের অধীনে বিভিন্ন বংশ হিসেবে তুর্কিরা সেসময় অবস্থান করত, উদাহরণস্বরূপ দানিশমান্দ বংশ, সালতুক বংশ (একাদশ শতকের শেষভাগে), আর্তুক বংশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের এই কাল সম্পর্কে খুব নগণ্যই তথ্য পাওয়া যায় হেতু দুঃখজনকভাবে সেলজুক বংশের এসময়ের কর্মকাণ্ড অস্পষ্ট থেকে গিয়েছে। তবে প্রথম নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় সোলায়মান বিন কোতলোমোস সম্পর্কে, যার নাম আমরা প্রথম পর্বে শুনেছিলাম। তাকে সালতানাত অফ রুমের প্রতিষ্ঠাতা মানা হয়।
ইসলামি স্বর্ণযুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সেবত বিন আল জাওজি (মৃত্যু ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ, সিরিয়া) থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সিরিয়ায় অবস্থানরত কিছু তুর্কমেন সোলায়মানকে তাদের সাহায্যার্থে আমন্ত্রণ জানায়। তারা ফাতেমীদের হয়ে সেলজুক সুলতান মালিক শাহের বিপক্ষে লড়ছিল। তিনি তাদের আহ্বানে সাড়া দেন এবং যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে মালিক শাহের সৈন্য কর্তৃক বন্দী হলেও তিনি কোনোমতে আনাতোলিয়ায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
পরবর্তীতে সোলায়মান শাহ নাইসিয়া তথা ইজনিককে ভিত্তি ধরে তার ঘাঁটি গড়েন। এই শহরটি ঠিক কীভাবে তার হস্তগত হয় সেটি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ১০৮১ সালেই নাইসিয়া সেলজুকদের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, এমনটাই ধরা হয়। সোলায়মান শাহের সেখানে উপস্থিতি ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই, যখন তিনি নিসোফোরাস বোটানিয়েটসকে (শাসনকাল ১০৭৮-৮১ খ্রিস্টাব্দ) সফলভাবে বাইজান্টীয় সম্রাট হিসেবে মসনদে বসতে সাহায্য করেন। পশ্চিমে তুর্কি বিস্তৃতিতে কিছুটা ভাটা পড়ে নতুন সম্রাট অ্যালেক্সাস কমনেনাস (শাসনকাল ১০৮১-১১১৮ খ্রিস্টাব্দ) এর উত্থানে। তিনি সোলায়মান শাহের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে বাইজান্টীয় আর তুর্কিদের মধ্যে সীমানা নির্ধারিত হয় ড্র্যাকন নদীর মাধ্যমে, এর মাধ্যমে সম্রাট মূলত বিথিনিয়া আর বসফরাসে তুর্কি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চেয়েছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় সোলায়মান শাহ্র পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড দেখা যায় ১০৮৪ সালে, যখন তিনি পূর্ব-সিলিশিয়া দখল করে নেন এবং অ্যান্টিয়কেও আক্রমণ করেন। অ্যানা কমনেনার বর্ণনামতে, এসময় ক্যাপাডোশিয়া অঞ্চলও সেলজুকদের অধীনে ছিল। ইবনুল আসিরের বর্ণনামতে সোলায়মান শাহকে ṣāḥeb Qunya wa-Aqṣarā wa-aʿmālehā men belād al-Rum অর্থাৎ ‘রুম ভূমির কুনয়া এবং আক্সারা অঞ্চলের শাসক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অভিযানে সোলায়মান শাহ নিহত হন।
রুমের সালতানাতের এই নব্য অবস্থায় সোলায়মান শাহের মৃত্যুর পর তাদের বিস্তৃতি থেমে যায়। সোলায়মান শাহ নাইসিয়া ত্যাগের সময় দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তার আত্মীয় আবুল কাসেমের উপর। কিন্তু এই নতুন শাসক একদিকে বাইজান্টীয়, আরেকদিকে আসল সেলজুকদের যুগপৎ মোকাবিলা করে রাজ্য বিস্তার করতে পারেননি। সোলায়মান শাহের মৃত্যুর পর মালিক শাহ আনাতোলিয়ার দিকে নজর দেন। তিনি বাইজান্টীয় সম্রাট অ্যালেক্সাসের সাথে চুক্তি করেন এবং আবুল কাসেমের উপর আক্রমণ করতে নিজের দুই সেনাপতি বোরসোক আর বুজানকে প্রেরণ করেন। এক বর্ণনানুযায়ী মালিক শাহ্র লক্ষ্য ছিল সকল মুসলিম অঞ্চলকে এক শাসনের অধীনে নিয়ে আসা।
আদি সেলজুকদের এক অভিযানে অ্যান্টিয়কে সোলায়মান শাহ্র ছেলে কিলিজ আরসালান গ্রেপ্তার হন। তাকে ইসফাহানে বন্দী করে রাখা হয়। মালিক শাহ্র মৃত্যুর পর তিনি আনাতোলিয়ায় ফিরে আসেন এবং ১০৯২ সালে নাইসিয়া অবরোধ করেন। তার অবস্থান আরও দৃঢ় হয় একজন তুর্কি আমিরের মেয়েকে বিয়ের মাধ্যমে, যিনি স্মিরনা তথা ইজমির এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই কিলিজ আরসালান, ইতিহাসে কিলিজ আরসালান দ্য ফার্স্ট নামে খ্যাত; কারণ পরবর্তীতে এই নামে আরও শাসক আবির্ভূত হন।
তবে উক্ত অঞ্চলে সেলজুকদের শাসন হুমকির সম্মুখীন হয় বাইজান্টীয়দের উত্থানের কারণে। সম্রাট অ্যালেক্সাস কমনেনাস শক্তিশালী হয়ে ওঠেন আর অন্যদিকে ক্রুসেডাররাও হানা দিয়ে বসে। প্রথম ক্রুসেড দোরগোড়ায় চলে আসে, ১০৯৭ সালে বাইজান্টিয়রা ক্রুসেডারদের সহায়তায় নাইসিয়া অবরোধ করে। সেবছরের শেষদিকে সুলতান কিলিজ আরসালান ক্রুসেডারদের কাছে এক ভয়াবহ যুদ্ধে পরাজিত হন যেটি দরিলাম বা এস্কিশেহেরে সংঘটিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তিনি তার সামরিক কার্যক্রম পূর্ব আনাতোলিয়ায় এবং জাজিরাতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
কিলিজ আরসালান ১১০৬ সালে সাময়িকভাবে দানিশমান্দদের কাছ থেকে মালাটিয়া এবং হাররান অঞ্চল অধিকার করে নেন। তার অর্জনের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হয়, যখন তিনি মসুল অবরোধ করেন, যেটি কিনা আদি সেলজুকদের অধীনস্থ একটি অঞ্চল ছিল। মসুলের তৎকালীন গভর্নর ছিলেন চাভলি (বা শাভলি)। পরবর্তী বছরে এমনকি সেখানে সেলজুক সুলতান মোহাম্মাদ তাপরের বদলে খুতবা পড়ানো হতে থাকে কিলিজ আরসালানের নামে। যদিও কিলিজ আরসালান ১১০৭ সালে চাভলি কর্তৃক পরাজিত হন এবং কাবুর (হাবুর) নদী অতিক্রম করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান। (ইবনে আসির, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৫, ৪২৬-৩০) তাকে দিয়ারবাকিরের সিলভানে সমাহিত করা হয়। তাকে যে কবরস্থানে দাফন করা হয়, সেটি নির্মাণ করেন মিয়াফারকিন তথা সিলভানের আতাবে (আতা বেগ) মেহমেদ বে।
উপর্যুক্ত ঘটনাটি (চাভলি এবং কিলিজ-এর যুদ্ধ) সেলজুকদের দুই অংশের বিভেদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যদিও রুমের সেলজুকরা শুরুতে মূল সেলজুকদের অধীনে থেকেই শাসন পরিচালনা করছিল, যেমনভাবে অন্যান্য আরও অনেক বংশই বশ্যতা স্বীকার করে অবস্থান করছিল, কিন্তু কিছুকাল পর থেকে তারা স্বাধীন আচরণ করতে থাকে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আসল সেলজুকদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতেই আক্রমণ পর্যন্ত করে। মূল সেলজুকদের অংশে সেসময়ের সুলতান মোহাম্মাদ তাপর ছিলেন পূর্ববর্তী সেলজুক সুলতান মালিক শাহ্র ছেলে, যিনি কিনা আবার আনাতোলিয়াকে মুসলিমদের জন্য দ্বার উন্মোচনকারী সুলতান আলপ আরসালানের ছেলে। মজার ব্যাপার হলো, কথিত আছে যে, আলপ আরসালানের গোঁফ এত বড় ছিল যে, শিকার এবং খাওয়া-দাওয়ার সময় সেগুলো বেঁধে রাখতে হত! সমসাময়িক বিখ্যাত দার্শনিক ও ইসলামি জ্ঞান-চর্চায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব হুজ্জাতুল ইসলাম (ইসলামের দলিল) যার উপাধি, ইমাম গাজ্জালির সাথে মালিক শাহ্র সুসম্পর্ক ছিল।
মালিক শাহ্র ধার্মিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ, তার বিখ্যাত উক্তি স্মরণীয়,
হে আল্লাহ্, যদি আমি ইসলামের জন্য উপকারী হই, তবে আমাকে বিজয় দান করুন। আর যদি আমার প্রতিপক্ষ উপকারী হয়, তবে তাকে সাহায্য করুন এবং বিজয় দিন।
বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসিয় খলিফা কায়িম বিন আমরুল্লাহর সাথে মালিক শাহ্র ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। খলিফা তাকে মুইজ-উদ্দিন এবং জালাল-উদ্দৌলা উপাধিতে ভূষিত করেন। সাথে কাসিম-আমির-উল-মুমিনিন নামে আরও একটি উপাধি দেন, যা ইতোপূর্বে কাউকে দেয়া হয়নি; এর অর্থ খিলাফাতের একনিষ্ঠ সমর্থক। এছাড়া মালিক শাহ শাসক হিসেবে ন্যায়পরায়ণ ছিলেন, তার উপনাম ছিল Just Sultan। যুদ্ধক্ষেত্রে পারদর্শিতার স্বীকৃতিস্বরূপ তার আরেক নাম ছিল আবুল ফাতহ; উল্লেখ্য, ফাতহ অর্থ বিজয়।
মূল সেলজুক শাসকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় বেশ পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তাদের আমলে পুরো অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে তোলেন, এবং ভালো পরিমাণে অর্থ-সহায়তা বরাদ্দ দিতে থাকেন। আলপ আরসালান এই খাতে তার নিজস্ব উপার্জনের এক দশমাংশ দান করতেন। তার ছেলে মালিক শাহ এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বার্ষিক ৩০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ভাতা ধার্য করেন। মালিক শাহ্র ছেলে সুলতান সঞ্জর ছিলেন এক্ষেত্রে সকলের থেকে ব্যতিক্রম এবং অগ্রগণ্য। তিনি শয়ে শয়ে নয়, বরং হাজারে হাজারে স্বর্ণমুদ্রা দান করতেন এবং বহু মূল্যবান পোশাক, ঘোড়া এবং দামী-সামগ্রী বিজ্ঞানীদের উপহার-স্বরূপ দান করতেন।
[চলবে…]