২০১৯ সালে ইরানি রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি মন্তব্য করেন যে, ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে’র কারণে বিগত দুই বছরে ইরানের ২০০ বিলিয়ন (বা ২০,০০০ কোটি) মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের সম্ভাব্য মোট দেশজ উৎপাদনের (Gross Domestic Product, ‘GDP’) মূল্য প্রায় ৩১৭ বিলিয়ন। এটির সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়, মার্কিন ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে’র ফলে ইরানের কী বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে!
ইরানি রাষ্ট্রপতি যেটিকে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেটিকে অর্থনীতির পরিভাষায় ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ (economic sanctions) বলা হয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক শাস্তি। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই শাস্তি কার্যকর করা হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রটির নিকট পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হতে পারে, রাষ্ট্রটির কাছ থেকে পণ্য আমদানি করা বন্ধ করা হতে পারে, বিদেশে থাকা রাষ্ট্রটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে, এমনকি রাষ্ট্রটির সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যে লিপ্ত এরকম রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের ওপরও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যখন চূড়ান্ত ও সর্বব্যাপী আকার ধারণ করে, তখন সেটিকে ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যখন শাস্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন সেটিকে অর্থনৈতিক অবরোধ (embargo) বলে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কার্যপদ্ধতি অর্থনৈতিক, কিন্তু প্রায়শই এর উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক, সামরিক বা সামাজিক কোনো লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। সাধারণত কোনো রাষ্ট্র তার বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রক্ষার জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। কার্যত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি হাতিয়ার। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বাকযুদ্ধ এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের মাঝামাঝি পর্যায় হলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।
কোনো রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রটিকে নিজের মর্জিমাফিক কাজ করতে বাধ্য করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সরকার পরিবর্তন’ (regime change)। এক্ষেত্রে প্রচলিত যুক্তি হচ্ছে, কোনো রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক দুর্দশার সম্মুখীন হবে এবং রাষ্ট্রটির নাগরিকদের জীবনমানের অবনতি ঘটবে। এর ফলে রাষ্ট্রটির জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করবে এবং সরকারের পতন ঘটাবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সবক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার এই উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নানাবিধ হতে পারে– একপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক এবং সার্বজনীন। কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি কেবল একটি রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি একপাক্ষিক (unilateral) অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। যেমন: ২০১৫ সালে তুরস্ক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর তুরস্কের ওপর আরোপিত রুশ নিষেধাজ্ঞা ছিল একপাক্ষিক। কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি একাধিক রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি বহুপাক্ষিক (multilateral) অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। যেমন: ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সম্মিলিতভাবে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ছিল বহুপাক্ষিক। আর কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি বিশ্বের অন্য সকল রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি সার্বজনীন (universal) অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সাধারণত জাতিসংঘ কর্তৃক কোনো রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা হয় সার্বজনীন।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আমদানি এবং রপ্তানি উভয়ের ওপরই আরোপিত হতে পারে। আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ কোনো রাষ্ট্র থেকে কিছু বা সকল পণ্য আমদানি হ্রাস/বন্ধ করা। অন্যদিকে, রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ কোনো রাষ্ট্রের নিকট কিছু বা সকল পণ্য রপ্তানি হ্রাস/বন্ধ করা। সাধারণত কোনো রাষ্ট্রের নিকট রপ্তানি করার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানি করার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ঐ রাষ্ট্রটির বেশি ক্ষতি করে, কারণ কোনো রাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা বন্ধ করে দিলে তার আয় হ্রাস পায়। অন্যদিকে, কোনো রাষ্ট্রের কাছে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তারা সাধারণত সেই পণ্য নিজেদের দেশেই উৎপাদন করার চেষ্টা করে (যদি সেই পণ্যটি উচ্চ প্রযুক্তিগত না হয়) এবং এটি তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কতিপয় নমুনা
ঐতিহাসিকভাবে, বহু পূর্ব থেকেই মানবজাতি কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন কর্তৃক ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সৃষ্ট ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’ (Continental System) এর একটি উদাহরণ। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী, ফ্রান্স ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রকে ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু নেপোলিয়নের এই ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ কার্যকর হয়নি। একে তো নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্রিটেনের যেমন ক্ষতি হচ্ছিল, নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধ্য হওয়া ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোরও তেমনই ক্ষতি হচ্ছিল। ফলে তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য করতে শুরু করে, এবং এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বস্তুত ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের মূল কারণ ছিল ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’ উপেক্ষা করে রাশিয়া কর্তৃক ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়া। নেপোলিয়নের পরিণতি কী হয়েছিল, সেটা সকলেরই জানা। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীর জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে।
১৯৩৫ সালে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী ইতালি ইথিওপিয়া আক্রমণ করে এবং এর প্রত্যুত্তরে জাতিপুঞ্জ (League of Nations) ইতালির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা ছিল অকার্যকর, কারণ ইতালির নিকট কিছু কিছু পণ্য রপ্তানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি, কিংবা ইতালির জন্য সুয়েজ খালও বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। এর ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইতালির সমরযন্ত্রকেও অচল করতে পারেনি আর ইথিওপিয়ায় সৈন্য প্রেরণও আটকাতে পারেনি। ফলে ১৯৩৬ সালের মধ্যে ইতালি সম্পূর্ণ ইথিওপিয়া দখল করে নেয় এবং সেটিকে ইতালির একটি উপনিবেশে পরিণত করে। একই বছর জাতিপুঞ্জ ইতালির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। অর্থাৎ, দুর্বলচিত্তে গৃহীত নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালে জাপান ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচীনে সৈন্য মোতায়েন করলে এর প্রত্যুত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস ও চীন জাপানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন জাপানের জন্য অতি প্রয়োজনীয় তেল, লৌহ আকরিক ও ইস্পাত আমদানির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই ঘাটতি পূরণ করতে জাপান ডাচ উপনিবেশ ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ’ (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) আক্রমণ ও দখল করে নেয়, এবং এর আগে এই অভিযানে যাতে কোনো বাধা না আসে সেটি নিশ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলাফল খুবই অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক হতে পারে।
১৯৫৯ সালে কিউবান বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যেকার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে এবং ১৯৬২ সাল থেকে কার্যত যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর প্রায় পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এখন পর্যন্ত এই অবরোধ বজায় আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি, অর্থাৎ কিউবায় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটেনি। আবার, ১৯৯০ সালে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের পর কুয়েত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য ইরাককে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু ইরাক সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়নি এবং অবশেষে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন একটি বহুজাতিক জোটকে যুদ্ধের মাধ্যমে কুয়েত থেকে ইরাকিদের বিতাড়িত করতে হয়েছিল। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে যে রেজিম চেঞ্জ ঘটবেই বা কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফলাফল অর্জিত হবেই, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে রেজিম চেঞ্জ ঘটাতে সক্ষম। ২০০৪ সালে ইউক্রেনে ‘কমলা বিপ্লবে’র (Orange Revolution) মাধ্যমে পশ্চিমাপন্থী ভিক্তর ইয়ুশ্চেঙ্কো ক্ষমতা লাভ করেন এবং ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য সচেষ্ট হন। প্রত্যুত্তরে রাশিয়া ইউক্রেনকে কম দামে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো রুশ গ্যাসের জন্য যে মূল্য প্রদান করে, ইউক্রেনের কাছেও সেই মূল্য দাবি করে। এর ফলে ইউক্রেনের জ্বালানি আমদানির ব্যয় চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায় এবং ইউক্রেন এই মূল্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ২০০৬ সালে রাশিয়া ইউক্রেনকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণ চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। ফলে ইয়ুশ্চেঙ্কোর জনপ্রিয়তা দারুণভাবে হ্রাস পায় এবং ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
অনুরূপভাবে, ১৯৯৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল, এবং এর ফলে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সরকার পরিবর্তন না ঘটলেও দীর্ঘদিনব্যাপী চলমান নিষেধাজ্ঞার ফলে সুদানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। ২০১৯ সালে সুদানে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং এর ফলে সুদানের রাষ্ট্রপতি ওমর আল–বশির ক্ষমতাচ্যুত হন, এক্ষেত্রে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ক্ষেত্রবিশেষে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফলাফল এনে দিতে সক্ষম।
ইরান এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ধরা যেতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ‘ইসলামি বিপ্লবে’র ফলে ইরানের মার্কিনপন্থী শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং একটি শিয়া ইসলামপন্থী ও তীব্র মার্কিনবিরোধী সরকার দেশটির শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মোটামুটি ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক বিরাজ করছে, এবং ইরানের সরকার পরিবর্তন করা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যে মার্কিনিরা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
১৯৭৯ সালে একদল ইরানি মিলিট্যান্ট ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেয় এবং মার্কিন কূটনীতিকদের জিম্মি করে। প্রত্যুত্তরে ১৯৭৯ সালের ১৪ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা ইরানি সরকারের সকল সম্পদ সাময়িকভাবে জব্দ করে। এই জব্দকৃত সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন (বা ১,২০০ কোটি) মার্কিন ডলার। ক্রমশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের মধ্যে ‘আলজিয়ার্স অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইরান জিম্মিকৃত মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি দিতে সম্মত হয়, বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে জব্দকৃত সম্পত্তি ফিরিতে দিতে এবং অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে রাজি হয়।
১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইরানকে সকল প্রকারের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়। ১৯৮৭ সালে মার্কিন সরকার ইরানকে আন্তর্জাতিক ‘সন্ত্রাসবাদী’ গ্রুপগুলোকে সমর্থন প্রদান ও পারস্য উপসাগরে বেসামরিক জাহাজের ওপর আক্রমণ পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত করে, এবং এর শাস্তিস্বরূপ ইরান থেকে সকল প্রকার পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অবশ্য ইরাক–ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই নিষেধাজ্ঞার বহুলাংশেই অবসান ঘটে।
১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং মার্কিন নাগরিকদের ইরানের তেলশিল্পের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকতে নিষেধ করা হয়। তেল ইরানের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ বিধায় ইরানি তেলশিল্পে মার্কিন বিনিয়োগের অভাব ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রত্যাহারের ফলে ইরান প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৯৬ সালে ইরানি পারমাণবিক প্রকল্প ও বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের প্রতি ইরানি সমর্থনের কারণ দেখিয়ে মার্কিন কংগ্রেস ‘ইরান নিষেধাজ্ঞা আইন’ (Iran Sanctions Act, ‘ISA’) জারি করে। এই আইনের মাধ্যমে যেসব বিদেশি কোম্পানি ইরানি তেলশিল্পে ২০০ মিলিয়ন বা (২০ কোটি) মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে, তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারির বিধান রাখা হয়।
২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘Comprehensive Iran Sanctions, Accountability and Divestment Act’ জারি হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যেসব ফাঁকফোকর ছিল সেগুলো পূর্ণ করা হয়। এর আগ পর্যন্ত ইরান থেকে কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কার্পেট আমদানির অনুমতি ছিল, কিন্তু এই আইনে সেগুলোও নিষিদ্ধ করা হয়, এবং এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানা ও ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়। ১০০ মার্কিন ডলার বা তার কম মূল্যের উপহার, তথ্য এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া ইরান থেকে অন্য কোনো কিছু নিয়ে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অনুরূপভাবে, ১০০ মার্কিন ডলার বা তার কম মূল্যের উপহার, মানবিক সহায়তা, বিশেষ কিছু দ্রব্য, ঔষধ ও তথ্যসামগ্রী ছাড়া অন্য কোনো কিছু ইরানে প্রেরণের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তদুপরি, কোনো ইরানি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরো বৃদ্ধি করে। যেসব বিদেশি কোম্পানি ইরানি তেল ও রাসায়নিক শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান ইরানি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়িত, তাদেরকেও এই নিষেধাজ্ঞার আওতাধীনে আনা হয়। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে বেশ কয়েকটি মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান, ডাচ, চীনা ও ইমারাতি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে।
কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ইরানের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে ইরান ও ৬টি বৃহৎ শক্তির মধ্যে ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এর মধ্যে দিয়ে ইরান কর্তৃক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার বিনিময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মাত্রা হ্রাস করে। ফলে পরবর্তী দুই বছর ইরানি অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।
কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ইরানের ওপর পূর্বাপেক্ষা কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৮ সালে জারিকৃত ‘Countering America’s Adversaries Through Sanctions Act’ এর মাধ্যমে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে জড়িত থাকা, ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রি বা ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যেকোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। ফলে ইরানের ওপর মার্কিন চাপ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল রপ্তানিকে একদম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে আগ্রহী।
নতুন এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ২০১৮ সালে ইরানের জিডিপি ৪.৮% এবং ২০১৯ সালে ৯.৫% হ্রাস পায়। ইরানে ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় (বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার ৪২,১০৫ ইরানি রিয়ালের সমতুল্য), এবং ইরানি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাত্র ১০%–এর ওপর ইরানের কর্তৃত্ব বজায় থাকে। ২০১৫–২০১৭ সালে ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু নতুন করে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এটি মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। অবশ্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মার্কিন মুদ্রা ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করা কিংবা মার্কিন ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করা ইরানের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই একই কারণে অন্য কোনো রাষ্ট্রও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানের সঙ্গে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছে না।
অবশ্য এতদিন ধরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকার পরও ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি, অর্থাৎ রেজিম চেঞ্জ হয়নি। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানি জনসাধারণের দুর্দশা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের দুর্দশা বৃদ্ধি একদিকে যেমন সরকারবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করতে পারে, অন্যদিকে তেমনি মার্কিন ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে’র ওপর নিজেদের সব সমস্যা চাপিয়ে দিয়ে ইরানি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালীও করে তুলতে পারে। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে কতটুকু কার্যকরী, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।