Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অতীত মহামারিগুলো থেকে নেওয়া ৫টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে নিউ নরমাল। কোভিড-১৯ মহামারির পূর্বের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। মানবজীবন এবং সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হচ্ছে নতুন কিছু অভ্যাস। পূর্বের বিভিন্ন সময়ের মহামারি নানাভাবে বদলে দিয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা। মানুষ মহামারির সাথে লড়াই করতে গিয়ে শিখেছে নতুন সব বিষয়, যা কখনো সক্রিয়ভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজে এসেছে, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহস জুগিয়েছে, কখনো বা জাগিয়েছে বাঁচার নতুন অনুপ্রেরণা।

কোয়ারেন্টিন

কোয়ারেন্টিন‘ শব্দটি ইতালীয় ‘কোয়ারেন্টা’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘৪০’। ১৩৭৭ সালের ২৭ জুলাই ব্যাধির ইতিহাসে প্রথম বন্দরনগরী রাগুসারের (বর্তমান ডাব্রোভনিক) আইনে কোয়ারেন্টিন যুক্ত করা হয়। তখন এই শহরটিতে বুবোনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ মহামারির তাণ্ডব চলছে। নগরীর জনগণের জীবন রক্ষার্থে তৈরি করা এই নতুন আইনে বলা হয়েছিল, “জীবাণু ছড়িয়ে পড়া অঞ্চল থেকে যারা আসবে তারা (রাগুসা) বা এর অন্য কোনো জেলায় প্রবেশ করতে পারবে না, যদি না তারা জীবাণুমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ম্রকান দ্বীপে বা কাভাত শহরে একমাস অবস্থান করে।

সেকালের চিকিৎসকদের ধারণা ছিল রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ব্ল্যাক ডেথের বিস্তার কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর হয়েছিলও তা-ই। 

Image Source : Times of India

১৩৭৭ এর দশকে উদ্ভূত সেই কোয়ারেন্টিন পরবর্তীতে বহু রোগের বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকান শহরগুলোতে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈনিকরা ফিরে আসছিল, তখন এখানে চলছিল স্প্যানিশ ফ্লু। সান ফ্রান্সিসকোতে, নৌপথে আগমনকারীদের শহরে প্রবেশের আগেই পৃথক করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সান ফ্রান্সিসকো এবং সেন্ট লুইসে সামাজিক জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। একইসাথে এই অঞ্চলের থিয়েটার ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শুধু স্প্যানিশ ফ্লুতে নয়, চতুর্দশ শতকের পরের সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইয়েলো ফিভার, বুবোনিক প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কোভিড-১৯ সহ বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির গতি রোধে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। 

ওয়াইন উইন্ডো

চতুর্দশ শতাব্দী থেকে আঠারো শতক অবধি বিশ্ব এক ভয়াবহ মহামারির কবলে পড়ে; যার নাম বুবোনিক প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথও বলা হয় একে। ভয়াবহ এই মহামারির কবলে পড়ে ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই মহামারির পরবর্তী সময় বিশ্ব চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবাতে খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে, তবে সেকালে মহামারির বিস্তৃতি রোধে যে সকল ব্যাবস্থা বা সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছিল তার চর্চা বর্তমান সময়েও লক্ষ্য করা যায়।

শুধু বর্তমান সময়ের কোভিড-১৯ নয়, ষোড়শ শতকে যখন প্লেগ মহামারির প্রকোপ ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ইতালিও এ থেকে মুক্ত ছিল না। বরং এখানে মহামারির সংক্রমণ ছিল ভয়াবহ। এই সময় ইতালির লোকেরা ‘ওয়াইন উইন্ডো’ বা ‘বুচেটে দেল ভিনো’ ধারণাটি নিয়ে আসে। সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করে মদ ক্রয়-বিক্রয় কাজে মদের দোকানের প্রাচীরে এই ছোট জানালা তৈরি করা হয়েছিল।

ওয়াইন উইন্ডো; Image Source : plague-treatment.blogpost.com

সমগ্র ফ্লোরেন্স এবং টাস্কানি শহর জুড়ে এখনও সেকালের প্রায় শতাধিক ওয়াইন উইন্ডো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যদিও এগুলোর বেশিরভাগ বন্যাসহ নানা কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে এই ওয়াইন উইন্ডোর ধারণা মানুষের সামনে পুনরায় ফিরে এসেছে। দোকান-মালিক এবং ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এগুলোকে আবার ওয়াইন এবং ককটেল বিক্রির কাজে ব্যবহার করছেন।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ওয়াইন উইন্ডো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাত্তেও ফাগলিয়া বলেন, “আমরা সমস্ত ওয়াইন উইন্ডো দ্বারা একটি মাইলফলক স্থাপন করতে চাই, যখন লোকেরা এটি কী এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে পারবে, তখন তারা এর আরো বেশি কদর করবে।

মাস্ক পরিধান

প্লেগ চলাকালে রোগীদের চিকিৎসা করার সময়ে চিকিৎসকরা দীর্ঘ, পাখির মতো চিটযুক্ত একপ্রকার মুখোশ পরিধান করতেন। এটি তাদের মুখ এবং নাককে আংশিকভাবে ঢেকে রাখত। রোগী এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চিকিৎসকরা এই উপায় অবলম্বন করতেন। কিন্তু এর পেছনে তারা যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দাঁড়া করিয়েছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। মিয়াসমা তত্ত্বে বিশ্বাসী সেই সময়কার চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন, বাতাসের গন্ধের সাথে রোগ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল তাদের মাস্ক পরিধানের কারণ। তাদের চিটযুক্ত এই মুখোশে সুগন্ধযুক্ত একপ্রকার ঔষধি মিশ্রিত থাকত।

Image Source : BL Business Insider

কিন্তু ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি চলাকালে মুখোশগুলো জনসাধারণের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সান ফ্রান্সিসকোতে মুখোশ পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি যারা মুখোশ পরিধান করবে না তাদের জরিমানা, কারাবাস থাকে শুরু করে তাদের নামগুলো সংবাদপত্রগুলোতে ‘মাস্ক স্ল্যাকার’ হিসাবে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় সংবাদপত্রগুলো কেবল তাদের লজ্জা দেবার জন্য নয়; তারা ঘরে কীভাবে মুখোশ বানাবেন সেই সম্পর্কে নির্দেশাবলীও ছাপিয়েছিল। 

ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সামগ্রী

প্লেগ মহামারি চলাকালীন চিকিৎসকরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য এক বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন- এই পোশাকগুলো তাদের বায়ুবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করবে। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্স এবং ইতালিতে এর প্রচলন হয়।

প্লেগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকরা প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ওভারকোট এবং পাখির ঠোঁটের ন্যায় চাঁদযুক্ত মুখোশ, একজোড়া গ্লাভস, বুট, এবং প্রশস্ত ডানাযুক্ত টুপি পরিধান করতেন। কালের পরিক্রমায় সেই বিশেষ পোশাক পরিবর্তিত হয়ে আজ আমাদের সামনে এসেছে এক নতুন রূপে, যাকে আমরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সামগ্রী বা পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট নামে চিনি।

সতেজ বায়ু এবং ভিন্নধর্মী শিক্ষা কার্যক্রম

বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বর্তমান মহামারিকালে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথাও সাময়িক, আবার কোথাও দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মহামারিকালীন শিক্ষা কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়ার ঘটনা এবারই নতুন নয়।

১৬৬৫ সালে প্লেগের প্রকোপ চলাকালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তখন সবাই বিশ্বাস করত, তাজা বাতাস, বিশুদ্ধ বায়ু চলাচল এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখে। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় যাতে তারা সতেজ বায়ু থেকে বঞ্চিত না হয়।

নেদারল্যান্ডের একটি ওপেন-এয়ার স্কুল; Image Source : Wikipedia

মুক্ত এবং সতেজ বায়ুর ধারণার প্রেক্ষিতে জার্মানিতে প্রথম ওপেন-এয়ার স্কুলের সূচনা হয়। ১৯১৮ সাল নাগাদ ১৩০টিরও বেশি আমেরিকান শহর সেগুলো মেনে চলা আরম্ভ করে। স্প্যানিশ ফ্লু প্রাদুর্ভাবের সেকেন্ড ওয়েভে শিকাগো এবং নিউ ইয়র্কের সরকারি বিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় নিউ ইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য কমিশনার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, “শিশুরা বিদালয়ের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে তাদের বাড়ি চলে যায়, কিন্তু ওপেন-এয়ার স্কুলগুলোতে সর্বদা শিক্ষার্থীদের পরিদর্শন এবং রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

সতেজ বায়ু রোগ নিরাময়ে সক্ষম- এমন ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছিল ওপেন-এয়ার স্কুল। আর ওপেন-এয়ার স্কুলের হাত ধরে মহামারিকালে জন্ম নেয় ভিন্নধর্মী শিক্ষা কার্যক্রম।

Related Articles