পৃথিবীতে যুদ্ধ বিমানের কতই না ধরন রয়েছে। পিস্টনের যুগ শেষ হয়ে এল জেট ইঞ্জিনের যুগ, পালটে গেল আকাশযুদ্ধের ধরন-ধারণ। শীতল যুদ্ধের সময়টা জুড়ে মার্কিন-সোভিয়েত দুই পক্ষই চেষ্টা করেছে দক্ষ যুদ্ধ বিমান বানিয়ে আকাশে আধিপত্য কায়েম করবার জন্য। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছিল বড় জাহাজ বা বিরাট সেনাদল থাকলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, প্রয়োজন সুদক্ষ বিমানবাহিনী, যারা আকাশ থেকে আক্রমণ বা প্রতিরক্ষা, দুটোতেই সমান কৃতিত্ব দেখাবে।
পশ্চিমা বিমানের তুলনায় সোভিয়েত বিমানের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। সোভিয়েত বিমান দেখতে কদাকার, দামে সস্তা এবং প্রযুক্তিগত চাকচিক্যে তুলনামূলক মলিন। কিন্তু সস্তা হওয়ায় বানানো যেত বিপুল সংখ্যায়, আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে যেত ব্যবহারিক গুণাবলির কারণে। এজন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রভূত পরিমাণে এই বিমান কিনত। সোভিয়েত ডিজাইন ব্যুরোগুলোর মধ্যে মিগ আর সুখোই বরাবরই উন্নত যুদ্ধবিমান আনিয়ে খ্যাত, কিন্তু তন্মধ্যে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে মিগ-২১।
মিগ-২১ (ন্যাটো কোড: ফিশবেড) ওরফে বালালাইকা ওরফে পেন্সিল বিশ্বের সর্বাধিক নির্মিত সুপারসনিক গতিসম্পন্ন জেট যুদ্ধ বিমান। এ বিমান ৬০টিরও বেশি দেশের হয়ে আকাশে উড়েছে, লড়েছে মধ্যপ্রাচ্য আর পূর্ব এশিয়া আর আফ্রিকার রণাঙ্গনে। ভূপতিত করেছে অসংখ্য পশ্চিমা বিমান। দক্ষ পাইলটের হাতে পড়লে মিগ-২১ যথার্থই হয়ে উঠত ভয়ংকর। দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য প্রযুক্তিগত ব্যবধান সত্ত্বেও সমরক্ষেত্রে অবিরাম সাফল্যের বিবেচনায় যুদ্ধবিমানের জগতে মিগ-২১ কিংবদন্তি হওয়ার দাবি রাখে।
খুঁটিনাটি
মিগ-২১ ডেল্টা ডানা বিশিষ্ট ৪৮ ফুট লম্বা একক ইঞ্জিন আর একক পাইলট চালিত যুদ্ধ বিমান। ফাইটার অথবা ইন্টারসেপ্টার; দুই ভূমিকাতেই বিমানটি কাজে লাগানো চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমিতে আক্রমণের জন্যও এই বিমান ব্যবহৃত হয়েছে। এর তুমানস্কি আর-২৫ ইঞ্জিন দুই মিনিট পর্যন্ত আফটারবার্নার ব্যবহারের সুবিধা দিত। আফটারবার্নার হচ্ছে বাড়তি গতি বৃদ্ধির একটি মেকানিজম। বিমানটি প্রায় ৫৭ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে। রেঞ্জ অবশ্য বেশি নয়, ৬০০ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। গতিবেগ থাকে ম্যাক ১.৩ থেকে ২ পর্যন্ত।
খুব বেশি অস্ত্রশস্ত্র বিমানটি নিতে পারে না: দুই/ চারটি মিসাইল, একটি ২৩ মিলিমিটার কামান, দু-চারটি আড়াইশো বা পাঁচশো কেজি বোমা, ব্যস। আর বাড়তি তেলের জন্য নিতে পারে ফুয়েল ট্যাংক। ওড়া বা নামার জন্য বিমানটির লম্বা রানওয়ে প্রয়োজন হয়। তবে অপেক্ষাকৃত কম জটিল নকশা আর উন্নত কিন্তু সীমিত ব্যয়ের ইঞ্জিনের কারণে মিগ-২১ বিশেষ কদর পেয়েছে। ২৬ বছরে সাড়ে ১১ হাজারের মতো মিগ-২১ বানানো হয়েছে।
যুদ্ধে মিগ ২১
ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন বোমারুর জ্বালায় উত্তর বা দক্ষিণ ভিয়েতনাম, কোথাও টেকার উপায় ছিল না। ১৯৬৫ এর শেষ নাগাদ শুরু হল অপারেশন রোলিং থান্ডার, লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলা হতে থাকে ভিয়েতনামে। গেরিলা ঘাঁটি থেকে শুরু করে জনবসতি, ক্রমাগত বোমাবর্ষণে নিহত হচ্ছিল অযুত-লক্ষ মানুষ। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেশ কিছু মিগ-২১ পাঠানো হয় ভিয়েতনামী পাইলটদের জন্য।
বিমানযুদ্ধে পাঁচ বা তার অধিক শত্রুবিমানকে ভূপতিত করতে পারলে পাইলট ‘এস’ উপাধি পান। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মোট ১৩ জন ভিয়েতনামী পাইলট মিগ-২১ ব্যবহার করে এই উপাধি পেয়েছেন, এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিমানটি যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সফল। মনে রাখতে হবে, এসব পাইলটরা লড়েছিলেন মার্কিন বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা সে আমলেও সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনী বলে বিবেচিত হতো।
ভিয়েতনামী পাইলটরা অবশ্য মিগ-১৭ ও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু মিগ-২১ এর গতি, দ্রুত উচ্চতায় ওঠার ক্ষমতা এবং এর নিখুঁত কামান আর ভয়ানক দু’খানা স্বল্পমাল্লার মিসাইল মার্কিনদের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিনদের পছন্দের বিমান ছিল ভারি ও শক্তিশালী এফ-৪ ফ্যান্টম, আকারে এরা মিগের দ্বিগুণ। এগুলোর পাহারায় অতিকায় বি-৫২ বোমারু আর এফ-১০৫ থান্ডারচিফ বোমাবর্ষণ করত। ভিয়েতনামীরা মিগ-২১ ব্যবহার করত অনেকটা গেরিলা পদ্ধতিতে। আচমকা এসে কয়েকটা বিমান ভূপতিত করেই আবার হারিয়ে যাওয়া ছিল কৌশল। মিগ-২১ গুলো আবার ভূমিতে অবস্থিত নির্দেশনাকারীদের সহায়তা নিত। প্রায় হাজারখানেক যুদ্ধবিমান হারিয়ে ১৯৬৮ এর শেষ নাগাদ অপারেশন রোলিং থান্ডারের ইতি হয়। আকাশযুদ্ধের পাশাপাশি ভূমি থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানের কারণেও অসংখ্য বিমান ধ্বংস হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে মার্কিনরা অপেক্ষাকৃত হালকা এফ-৫ টাইগার, স্কাইহক আর ডেল্টা ডার্ট যুদ্ধবিমান ব্যবহার করলেও মিগ-২১ অত্যন্ত সফলভাবে বিমানযুদ্ধে ব্যবহৃত হতে থাকে। আকাশযুদ্ধে প্রায় ৭০টির মতো মার্কিন ভূপতিত করেছে ভিয়েতনামের মিগ-২১, যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি বলে দাবি করা হয় নানা পক্ষ থেকে। তবে মিগ-২১ এর প্রধান কাজ ছিল আচমকা হামলা চালিয়ে বোমারু বিমানের ঝাঁককে উদ্দেশ্যচ্যুত করা, সে কাজটি সফলভাবেই করেছিল এই আকাশযান।
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধেও ইসরায়েলী বিমানবাহিনীর ফরাসি মিরেজ আর মার্কিন এফ-১৬ এর বিরুদ্ধে মিশরীয় আর সিরীয়রা মিগ-২১ ব্যবহার করেছিল। তবে যেহেতু আরবরা ঠিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল না, তাদের প্রতি সোভিয়েতদের সাহায্যেও কিছুটা কমতি থেকে যায়। আরব পাইলটরা বেশ কিছু সফলতা অর্জন করলেও এজন্য মোটা দাগে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলের বিমান আধিপত্যই দেখা গিয়েছিল। মূলত প্রশিক্ষণ আর যন্ত্রাংশের ঘাঁটতি আরবদের মূল ক্ষতিটা করে দেয়। তবে এই মিগ-২১ ব্যবহার করেই মিশরীয় পাইলটরা বিখ্যাত ‘পুগাচেভ কোবরা’ কৌশলের আবিষ্কার করেছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানি এফ-১৪ টমক্যাটের বিরুদ্ধেও মিগ-২১ লড়েছে।
সমর প্রযুক্তি বিবেচনায় ভারতীয়রা রুশ অস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতীয় মিগ-২১ পাকিস্তানী স্যাবর জেটের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সফল বিমান হিসেবে প্রমাণিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কার্গিল যুদ্ধেও মিগ-২১ ব্যবহৃত হয়েছে। ভারত এ পর্যন্ত ১২০০’র মতো মিগ-২১ কিনেছে বা নিজেই বানিয়ে নিয়েছে।
এই মুখ্য তিনটি যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও ইথিওপিয়া-সোমালিয়া যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়া আর অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধসহ অনেকগুলো লড়াইয়ে মিগ-২১ সফলতা দেখিয়েছে। বর্তমানে চলমান সিরিয়া আর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও মিগ-২১ অংশগ্রহণ করেছে, যদিও বিমানগুলো মূলত ভূমিতে হামলার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে।
দুর্বলতা
মিগ-২১ এর দুর্বলতা ছিল বহুবিধ। শুরুর দিকে এটি আকাশে উড়তে পারত মাত্র ৪৫ মিনিট। বিমানটির ইঞ্জিন বেশ স্পর্শকাতর, সামান্য তাল-বেতালে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। মাঝামাঝি অংশে তেলের ট্যাংক থাকার কারণে আকাশে মিগ-২১ নিয়ন্ত্রণে রাখাও বেশ কঠিন। নামবার জন্য প্রয়োজন হতো প্রায় আধ কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে।
মিগ-২১ চালানো সহজ বটে, কিন্তু আকাশযুদ্ধে একে সফলভাবে ব্যবহার করতে হলে পাইলটকে হতে হবে দক্ষ। এজন্য দেখা যায় ভিয়েতনামে মার্কিনদের বিরুদ্ধে মিগ-২১ অসাধারণ সাফল্য দেখালেও আরব পাইলটদের হাতে এই মিগ-২১ই ইসরায়েলের সাথে জয় পেতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বৈমানিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিগ-২১ এর যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থ হয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে।
ঘনঘন দুর্ঘটনা ঘটায় মিগ-২১, বিশেষ করে পুরোনো বিমানগুলো এক আতঙ্কের নাম। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে বহু দশক ধরেই এই বিমান ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রচুর ভারতীয় পাইলট মারা গিয়েছেন ‘উড়ন্ত কফিন’ খ্যাত এই বিমান ওড়াতে গিয়ে।
পরিশেষ
মিগ-২১ এর সাফল্য ব্যাপক হলেও ডেল্টা ডানার নকশা পরে বাতিল হয়ে যায় অত্যাধুনিক মিগ-২৯ এর কারণে। তবে চীন-পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে বহুকাল ধরে মিগ-২১ এর চীনা সংস্করণ চেংদু এফ-৭ ব্যবহৃত হয়েছে। সোভিয়েতরা ভিয়েতনামে মিগ-২১ পাঠিয়েছিল চীনের মাধ্যমে। চীন সে সুযোগে বহু যন্ত্রাংশ নকল করে নেয়। চেংদু এফ-৭ তারই পরিণতি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পর সোভিয়েতরা বাংলাদেশকে দুই আসনের একটি মিগ-২১ উপহার দিয়েছিল, বর্তমানে সেটি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।