একটি যন্ত্র বানালে তা বাজারে ছাড়ার আগে যেমন নানা প্রকার পরীক্ষা করে তারপর আনা হয়, ঠিক তেমনই পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র বা বোমা ব্যবহারের পূর্বে সেগুলোর কার্যকারিতা, কার্যকর এলাকা এবং বিস্ফোরণের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাই হলো পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষণ। এই পরীক্ষাগুলো কোনো কোনো দেশ উন্মুক্ত স্থানে করছে, কেউ আবার লুকিয়ে মাটির নিচে করছে। বিংশ শতাব্দী থেকে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র সৃষ্টিকারী দেশগুলো এসকল পরীক্ষা চালিয়ে আসছে।
পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষায় যন্ত্রগুলো কীভাবে কাজ করছে, কী কী পরিস্থিতিতে সেগুলো কাজ করছে, কীভাবে এর কর্মীগণ কাজ করবে, এর গঠন এবং তৈরির উপকরণসমূহ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে কিনা ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও এই পরীক্ষাগুলো বৈজ্ঞানিক এবং সামরিক শক্তির নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে। অনেক দেশ আবার এ পরীক্ষাগুলো কূটনীতিক উদ্দেশ্য নিয়েও চালিয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক কিছু পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণ
সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ‘ট্রিনিটি’ সাংকেতিক নামে এই পরীক্ষা চালানো হয়। বিস্ফোরণকালে বিজ্ঞানীগণ এবং অন্যান্য সকলে বিস্ফোরণের স্থান থেকে ১০,০০০ গজ দূরে অবস্থান করছিলেন। ঐ বোমাটিতে প্রায় ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টন টিএনটি ব্যবহার করা হয়েছিল। যে টাওয়ারের উপর বিষ্ফোরণের পূর্বে বোমাটি রাখা হয়েছিল, বিষ্ফোরণের পর সেটি বাষ্পায়িত হয়ে গিয়েছিল! এই বোমাটি বানানো হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ে নি, কেননা এর পূর্বেই জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের আগে যুক্তরাষ্ট্র ৬টি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায় ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট। বোমাটির নাম ছিল ‘আরডিএস-১’।
এরপর ১৯৫২ সালের ১লা নভেম্বর প্রথম থার্মোনিউক্লীয় বোমা প্রযুক্তির পরীক্ষা চালানো হয়েছিল মার্শাল দ্বীপের এনিটাক অ্যাটলে। এ পরীক্ষার সাংকেতিক নাম ছিল ‘আইভি মাইক’। বোমাটি নাগাসাকির সেই ভয়াবহ বোমা বিষ্ফোরকের মতোই ছিল। ৩০ সেন্টিমিটার পুরুত্বের বেলনাকৃতির ট্যাংকে হিমায়িত তরল ডিউটেরিয়াম (হাইড্রোজেনের আইসোটোপ) ভর্তি ছিল। যখন ট্রিগার করা হয় তখন পারমাণবিক বিভাজনের তত্ত্বানুযায়ী ভাঙতে শুরু করে, আবার পরবর্তী ধাপে শক্তি সঞ্চয় করে একত্রিত হয়। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক পরীক্ষণ।
পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণের সময় অনেক বড় বিপত্তি ঘটতে পারে। তেমনই এক ভয়াবহ বিপত্তি ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে ‘ক্যাসেল ব্র্যাভো’ পরীক্ষায়। এটি ছিল নতুন ধরনের একটি হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা ধারণাও করতে পারেন নি কিছু কিছু তেজষ্ক্রিয় পদার্থ কতটা বিপজ্জনক রূপ ধারণ করতে পারে। পরীক্ষার সময় বিস্ফোরণ ঘটানো হলে দেখা গেল যতটুকু বিস্ফোরণ হবার কথা তার দ্বিগুণ বিষ্ফোরণ হয়েছে এবং তেজষ্ক্রিয়তার খুব দ্রুত শত শত মাইল ছড়িয়ে পড়ে। এ ছড়িয়ে পড়াকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভবপর ছিল না, কেননা বিজ্ঞানীরা এর গতিপথ জানতেনই না! ফলশ্রুতিতে বহু জনবহুল দ্বীপ তেজস্ক্রিয় দূষণের শিকার হয় এবং অনেকেই তেজস্ক্রিয়তায় পুড়ে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এর বহু বছর পরেও ঐসব দ্বীপের মানুষেরা ক্যান্সারসহ জন্মগত জটিলতায় ভোগেন। ঐ সকল এলাকার সামুদ্রিক মাছ যেসব এলাকায় সরবরাহ করা হতো তারাও তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছিল সেই সময়। এক কথায়, পারমাণবিক বোমার মর্মার্থ সারা বিশ্বের মানুষ খুব ভাল করেই বুঝেছিল এই দুর্ঘটনার পর।
বায়ুমন্ডলে এভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো খুবই বিপজ্জনক। তাই নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা চারটি রাষ্ট্রের মধ্যে তিনটি রাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু রাষ্ট্র মিলে ‘লিমিটেট টেস্ট ব্যান ট্রিটি’ (এলটিবিটি) নামক চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী, বায়ুমন্ডলে বা পানির নিচে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পরীক্ষণকে নিষিদ্ধ করা হয় নি, তবে পরিবেশের যেন উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি না নয় সেদিকে কড়া নজর দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। নিয়ম আসলেই সকলে মানছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা বলেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করেছিল এসব তাদের গোপন তথ্য পাবার জন্যই করা। ১৯৮৮ সালে এলটিবিটিকে সম্প্রসারিত করে সব ধরনের পরিবেশের জন্য প্রযোজ্য করতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র এর বিপরীতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে।
পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণের কিছু ধরণ
পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণকে ঐতিহাসিকভাবে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- বায়ুমন্ডলীয়, ভূগর্ভস্থ, নভোমন্ডলীয় এবং জলদেশে।
বায়ুমন্ডলীয় পরীক্ষণ
এ পরীক্ষাগুলো বায়ুমন্ডলে করা হয়ে থাকে। সাধারণত বোমাকে বিষ্ফোরণের পূর্বে কোনো টাওয়ার, বেলুন ইত্যাদির উপরে রাখা হয় বা উড়োজাহাজ থেকে ফেলা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সকলেই মিসাইল বোমা পরীক্ষণ চালিয়েছে এভাবে। এই বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আবর্জনা বাতাসে মিশে জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এলটিবিটিতে এ ধরনের পরীক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ভূগর্ভস্থ পরীক্ষণ
এই ধরনের পরীক্ষাগুলো মাটির নিচে বেশ গভীরে করা হয়ে থাকে। স্নায়ু যুদ্ধকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণই এ প্রক্রিয়ায় চালিয়েছে। ১৯৫১ সালের ২৯ নভেম্বর প্রথম এই ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো পারমাণবিক বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় পদার্থ যেন বায়ুমন্ডলে না মিশতে পারে। তবে আখেরে পুরোপুরি লাভ হয় না। গভীরতা কম হলে বিষ্ফোরণের পর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো মাটি ফেটে তেজষ্ক্রিয়তা বাইরের পরিবেশে মেশে। এছাড়া আশেপাশের এলাকায় প্রবল ভূকম্পন অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সাল পর্যন্ত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, যুক্তরাজ্য ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, এবং চীন ও ফ্রান্স ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে।
নভোমন্ডলীয় পরীক্ষণ
বায়ুমন্ডলের উপরেও পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়। এক্ষেত্রে পরীক্ষণ ডিভাইসগুলো রকেটের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এ ধরনের অধিক উচ্চতায় সংঘটিত হলে আয়নোস্ফিয়ারে তড়িচ্চুম্বকীয় অনুরণন সৃষ্টি করে, যার ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো দুই গোলার্ধের বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে পড়ে।
জলদেশে পরীক্ষণ
পারমাণবিক বোমা পানির নিচে বিষ্ফোরণ ঘটিয়েও পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে বোমাকে জাহাজের সাথে বেঁধে পানির নিচে নেওয়া হয়। বিষ্ফোরণের সময় জাহাজটিও ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণত সমুদ্র তলদেশের বড় বাধা বা ক্ষতিকর জীব ধ্বংসের জন্য এই ধরনের পারমাণবিক যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। তবে পানির উপরিভাগের কাছাকাছি বিষ্ফোরণ ঘটালে সমুদ্রের পানিতে এবং উপরের বাষ্পে মাত্রাতিরিক্ত তেজষ্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে কাছাকাছি অন্যান্য জাহাজ এবং মালামাল দূষিত হয়।
পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণের উদ্দেশ্য
বোমার গাঠনিক তথ্য পর্যবেক্ষণ
বোমা কীভাবে কাজ করছে, কতটুকু কার্যকর হবে, বিস্ফোরণের মাত্রা কতখানি ইত্যাদি তথ্য বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
বোমার প্রভাব পর্যবেক্ষণ
বোমার গঠন, উপকরণ ইত্যাদির পরিবেশগত প্রভাব এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভাব দুটি বিষয় সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। মূলত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে এর প্রভাব দেখা হয়।
নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
পরীক্ষাগুলোতে বোমার মাধ্যমে কী কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এটি নিশ্চিত করা হয় যে, তৈরিকৃত পারমাণবিক বোমাটি দুর্ঘটনাবশত বিষ্ফোরিত হবে না। নিরাপত্তা পরীক্ষায় মজুদ রাখাকালীন এবং বহন করার সময় কোনো বিপদ ঘটে কিনা তার প্রতি সুগভীর পর্যবেক্ষণ চালানো হয়।
ফিচার ইমেজ- The Vermont Independent