১৯৬৬ সাল। পেশাদার বক্সিং ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি। লন্ডনের পূর্ব দিকের একটি শহর শোরডিচ। সেখানে টাউন হল নামক এক জায়গার এক বক্সিং ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। গ্লাভস হাতে পড়তে পড়তে বক্সিং রিংয়ে উঠে এলেন জো ডেভিট্ট। অন্যপাশে তার প্রতিপক্ষও উপস্থিত। দর্শক কিছুটা হতবিহ্বল চোখেই দেখল, অন্য পাশে যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি শ্বেতাঙ্গ নন। বিংশ শতকের শেষের দিকে গায়ের রঙের ভেদাভেদ কিছুটা কমে আসলেও পুরোপুরি চলেও যায়নি। আর বক্সিং রিংয়ে একজন শ্বেতাঙ্গের বিপরীতে কৃষ্ণাঙ্গ মুষ্টিযোদ্ধাকে দেখা যায় না বললে চলে। সে ম্যাচে ঐ কৃষ্ণাঙ্গ মুষ্টিযোদ্ধা জিততে পারেনি। জীবনের প্রথম পেশাদার ম্যাচে তার থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে থাকা খেলোয়াড় ডেভিট্টের সাথে তার জিতে যাওয়ার কথাও নয়। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একটি কঠিন সময়ে তিনি বক্সিং খেলায় এক ভিন্নতা এনে দিলেন।
ক্যারিয়ারের প্রথম পেশাদার ম্যাচে জো ডেভিট্টের মুখোমুখি হওয়া সেই মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন বানি স্টার্লিং। ১৯৮৪ সালের ৪ এপ্রিল জ্যামাইকাতে জন্ম নিলেও মাত্র ৬ বছর বয়সে তার পরিবার জ্যামাইকা ছেড়ে লন্ডনে চলে আসে। মূলত তার বাবা আগে থেকেই লন্ডনে থাকতেন। বানি থাকতেন জামাইকাতে তার দাদীর কাছে। হুট করে তিনি মারা যাওয়ার তার বাবা তাকে নিজের কাছে লন্ডনে এনে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। স্টার্লিংয়ের সাথে আসে তার ছোট বোন জেনিফার।
মাত্র ৬ বছর বয়সে লন্ডনে আসা বানি স্টারলিং খুব স্বাভাবিকভাবেই মানিয়ে নিতে পারেননি। লন্ডন শহর সবার জন্য নয়, আর জ্যামাইকা থেকে আসা একজন কালো চামড়ার বালকের জন্য তো আরও কষ্টকর। লন্ডনের একটি প্রাইমারি স্কুলে প্রথমে ভর্তি হলেও ১২ বছর বয়সে তাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। সেই পুরো বোর্ডিং স্কুলে বানি স্টার্লিং ছিলেন একমাত্র ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে আসা বালক। টানা ১২ বছর সেখানে থেকে স্কুলের পাঠ শেষ করার পর তার পরিবার চেয়েছিল, বানি স্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। কিন্তু তার চাওয়া ছিল ভিন্ন।
বোডিং স্কুলে থাকা সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তিনি তার ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে যাবেন একজন মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে। সবরকম খেলাধুলাতেই তার আগ্রহ ও আবেগ ছিল, কিন্তু বক্সিংকে তিনি যেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। আর সে সময়ে লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্সিং খেলার সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। তাই সেদিকে না গিয়ে বানি স্টার্লিং লন্ডন কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হন। পাশাপাশি বক্সিং খেলাও নিয়মিত চলতে থাকে। এভাবে কয়েক মাস যাবার পর তিনি উপলব্ধি করেন, এভাবে দুটো ভিন্ন বিষয়কে একসাথে টানা সম্ভব নয়। এখানেই তার পড়ালেখা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু একই সাথে তার ক্যারিয়ারের প্রথম বাধা এসে উপস্থিত হয় । ১৯৭০-এর দিকে প্রবাসীদের জন্য ব্রিটিশ টাইটেলে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। তাই বানি স্টার্লিং যদি আসলেই বক্সিংকে নেশার পাশাপাশি পেশা হিসেবেও নিতে চান, তো সব থেকে সম্মানজনক একটি প্রতিযোগিতা তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু জেদ ও হার না মানা মনোভাব তাকে চেপে ধরলো। সেদিন থেকে তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠলো এই ব্রিটিশ টাইটেল। প্রথম প্রবাসী হয়েই তাকে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে।
১৯৬৬ সাল। পিকাডেল্লির ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাব। বেসরকারিভাবে বন্ধ দরজার পেছনে বক্সিং রিংকে ঘিরে অজস্র মানুষের ভিড় থাকলেও তাদের ভেতর আদতে কোনো কথা হচ্ছে না, চেচামেচিও প্রায় বন্ধ। তবে সিগারের ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ সেই কক্ষে বক্সিং রিংয়ে থাকা দু’জন যোদ্ধাকে ঘিরে সমর্থনের জোয়াড় উঠেছে। উইলি টারকিংটন নিজের চতুর্থ ম্যাচ খেলছেন, আর বানি স্টার্লিং দ্বিতীয়। ডান চোখের নিচে উইলির একটা আঘাত বেশ জোরেই লেগেছে। সেখানে পুনরায় আঘাত লাগলে যেন শরীরের শিরা-উপশিরা কেঁপে যাচ্ছে। গাঢ় লাল রঙের গ্লাভস পড়া দুই হাত দিয়ে স্টার্লিং চেষ্টা করে চলছেন মুখের ডান অংশ বাঁচাতে। তিনি সেদিন পারেননি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে জিততে। এমনকি একই রিংয়ে তৃতীয় ম্যাচে ফেস পার্কারের কাছেও হেরে বসেন তিনি।
পেশাদার ক্যারিয়ার শুরুর পরে টানা তিন ম্যাচে হার। বানি স্টার্লিং এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন কীভাবে? তার পরামর্শদাতা জর্জ ফ্রান্সিসের কারণে। সাদা চামড়ার এই কোচ অনেক বক্সারকে ক্যারিয়ার গড়ে দিয়ে বেশ নাম কামিয়েছিলেন। বানি স্টার্লিং তাকে চিনতেন সেই ১১ বছয় বয়স থেকে। তাই কোচ বাছাই করতে তার তেমন সমস্যা হয়নি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়কে ট্রেনিং করানোর জন্য জর্জ ফ্রান্সিসও নানারকম সমস্যা ও সমালোচনার ভেতর দিয়ে গেছেন। তবে তার কাছে খেলা এবং ঐ বক্সিং রিং সবসময় বেশি প্রাধান্য পেত। তাই তিনি কাকে ট্রেনিং দিচ্ছেন, তার গায়ের রঙ কী, এসব ভাবনা তার মস্তিস্কে আসতো না।
টানা তিন ম্যাচ হারের পর টানা আট ম্যাচে জয়। ১৯৬৪ সালের মে-তে সাউদার্ন এরিয়া মিডলওয়েট টাইটেল তিনি হেরে বসেন জনি ক্রামারের কাছে। কিন্তু এই ম্যাচ আবার ঐ বছরের ডিসেম্বরে পূনরায় অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ঠিকই ক্রামারকে হারিয়ে দেন স্টার্লিং। এরপর তার পরবর্তী টানা চার ম্যাচে তিনটিতে হেরে যান, অন্যটি ড্র। কিন্তু ১৯৭০ সালে ডেনিস প্লেজ ও হ্যারি স্কটকে হারিয়ে বানি স্টার্লিং ব্রিটিশ মিডলওয়েট টাইটেলের মূল মঞ্চে উঠে যান।
১৯৭০ সাল। ওয়েম্বলির এম্পায়ার পুলে সে সময়ের সব থেকে জনপ্রিয় ও লড়াকু মানসিকতার মার্ক রৌর মুখোমুখি বানি স্টার্লিং। বক্সিং রিংয়ের চারপাশে রৌর সমর্থকদের উপচে পড়া ভিড়। এমন পরিবেশে যেকোনো রক্তমাংসের মানুষ আগেই মানসিকভাবে হেরে যাবার কথা। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, বিপরীত সমর্থকদের মাঝে বানি স্টার্লিংয়ের কাছে মাত্র চতুর্থ রাউন্ডে হেরে বসেন মার্ক রৌ। এমন হারের পর সে রাতে বক্সিং রিংয়ে এক জঘন্য পরিবেশে তৈরি হয়। সে রাতে রিংয়ে ঢোকার আগে স্টার্লিং মাত্র ২৭ ম্যাচে ১৬ জয় নিয়ে আসা এক বহিরাগত খেলোয়াড়মাত্র। তার কাছে তাদের স্বপ্নের নায়কের এমন হার ইংল্যান্ডের অধিকাংশ জনগণই মেনে নেয়নি। তাই বানি স্টার্লিংয়ের প্রথম ব্রিটিশ টাইটেল জয়ের রাতের স্মৃতি প্রায় দুঃস্বপ্নের মতোই তার কাছে বারবার ফিরে আসত।
ওয়েম্বলিতে ব্রিটিশ টাইটেল জেতার পাশাপাশি কমনওয়েলথ মিডলওয়েট টাইটেল জেতার পরও ঐ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত স্টার্লিংকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে গন্য করা হতো না। তবে সে বছরের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ফেস্টিভাল হলে কাহু মাহানগাকে হারিয়ে তিনি কমনওলেথ টাইটেল ঠিকই ধরে রাখেন। আসলে প্রথম কমনওয়েলথ জয়ের পর স্টার্লিংয়ের ক্যারিয়ারের যাত্রা একদম বদলে যায়। ওয়েম্বলিতে জেতার পর, তাকে পরবর্তী ১৮ মাসে তিনবার তার টাইটেল ধরে রাখতে প্যারিস, জ্যামাইকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মত ভিন্ন ভিন্ন জায়গার রিংয়ে নামতে হয়েছে এবং প্রত্যেকবারই তিনি সফল হয়েছেন। যদিও ব্রিটেনে স্টার্লিংকে একজন বক্সার হিসেবে সামনে এনে খেলানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না। কারও সমর্থকরা একজন বহিরাগত কালো চামড়ার খেলোয়াড়ের লড়াই দেখার জন্য টিকেট কিনতেও আগ্রহী ছিলো না। যদি না স্টার্লিংয়ের বিপরীতে একজন শ্বেতাঙ্গ থাকত!
২ বছরে ১১ ম্যাচ খেলে স্টার্লিং তার সকল টাইটেল ধরে রেখেছিলেন। ১৯৭৩ সালে রৌর বিপক্ষে খেলার জন্য রয়্যাল আলবার্ট হলে আরও একটি ম্যাচের আয়োজন করা হয়। এখানেও স্টার্লিং ১৫ তম রাউন্ডে জিতে তার টাইটেল ধরে রাখেন। স্টার্লিং ভালো বক্সারদের বিপক্ষে ম্যাচ হেরেছেন, আবার জিতেও তার টাইটেল ফেরত এনেছেন বারবার। কিন্তু এসব হারজিত কখনোই তাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ লড়ার দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারেনি।
১৯৭২ সালের এপ্রিলে ব্রিসবেনের ফাইনাল রাউন্ডে টনি মুনদিনের কাছে হেরে স্টার্লিং তার কমনওয়েলথ টাইটেল হারান। তবে সেপ্টেম্বরে ফিল ম্যাথিউসকে হারিয়ে তার ব্রিটিশ টাইটেল ঠিকই ধরে রাখেন। এরপর, ১৯৭৩ সালে ইউরোপিয়ান টাইটেল হারানোর পর চতুর্থ ডিফেন্সে কেভিন ফিনেগানের কাছে চলে যায় ব্রিটিশ টাইটেলও। কিন্তু পরের বছর মাওরিচ হোপকে অষ্টম রাউন্ডে হারিয়ে ব্রিটিশ টাইটেল উদ্ধার করার পাশাপাশি ১৯৭৬ সালে ফিরে পান ইউরোপিয়ান টাইটেলও।
স্টার্লিয়ের অঙ্গীকার ছিল লড়াই করার, একজন প্রতিশ্রুতিময় বক্সার হবার। কিন্তু ‘৭০-এর দশকের সেই কালো চামড়া বনাম সাদা চামড়ার প্রথা তাকে পদে পদে পিছিয়ে দিয়েছে। একটা সময় তার নামে ওয়ারেন্টও ছিল। তার ব্যবহার ও গাড়ি জোরে চালানোর কারণে তৈরি হওয়া সেই পুলিশি ঝামেলার চক্কর থেকে বের হতে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
কোনোরকম সহায়তা ছাড়াই স্টার্লিং ইউরোপিয়ান কমনওয়েলথ খেলতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লড়েছেন ছয়বার এবং জিতেছেনও। তার এমন পারফরম্যান্স ওয়াল্ড টাইটেলে অংশগ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি ছিলেন সবসময় দ্বিতীয় পছন্দ, কারণ একজন কৃষ্ণাঙ্গ কখনও ব্রিটিশদের হয়ে বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। তবে এতে তার আক্ষেপ নেই, তার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ টাইটেল; যা তিনি পাঁচবার আগলে রেখেছেন। বক্সিং দুনিয়ার সব থেকে সম্মানজনক বেল্ট ‘দ্য লন্সডেইল বেল্ট’ জিতেছেন। তার এই ইতিহাস কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
শুধুমাত্র বিশ্বমঞ্চ থেকে থেকেই নয়, প্রতি ম্যাচের সম্মানিতেও বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। কেভিন ফিনেগানের কাছে স্টার্লিং যে বছর তার ব্রিটিশ টাইটেল হারান। বদ্ধ দরজার পেছনে সেটি ছিল দীর্ঘ ১৫ রাউন্ডের এক দমবন্ধ করা ম্যাচ। এ ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা স্টার্লিং সেদিন মাত্র পেয়েছিলেন ১৫০০ ইউরো। বিপরীতে যেখানে যেকোনো ব্রিটিশ বক্সার পেতেন প্রায় ২০,০০০ ইউরো।
এভাবেই পদে পদে বঞ্চিত থেকেও স্টার্লিং খুশি ছিলেন। তিনি অর্থ হয়তো কম কামিয়েছেন, তাকে বঞ্চিতও করা হয়েছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মঞ্চে খেলার যোগ্যতা থাকার পরও তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। এরপরও স্টার্লিং সফল ছিলেন। ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে গিয়ে কালো চামড়ার একজন বক্সার ব্রিটিশদের প্রথা ভেঙেছেন। তাদের হারিয়ে জিতেছেন ব্রিটিশ টাইটেল, এরপর জিতেছেন ইউরোপ টাইটেলও। আবার প্রায় দুই বছরের মতো সময় ধরে একের অধিক ম্যাচ খেলে সেসব নিজের কাছে আগলে রাখার মত সাফল্য কতজন পায়?
মুস্তাফা ওয়াসাজ্জিয়ার সাথে ১৯৭৭ সালে শেষ ম্যাচ খেলে ১৯৭৮ সালে বানি স্টার্লিং তার বক্সিং ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৭০ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান ব্রিটিশ-জ্যামাইকান বংশভূত এই বক্সার।
বানি স্টার্লিং হয়তো আজ পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই। তবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের মানুষদের কাছে তিনি একজন নায়ক। ব্রিটিশদের বক্সিং-রাজ্যে প্রথা ভাঙার বীরত্বের গল্প আজ অনেক কালো চামড়ার মানুষদের দিয়েছে নিজের প্রতিভাকে যেকোনো স্থানে বিকশিত করার মতো অমূল্য সাহস।