“চলচ্চিত্র, বাস্তব চিন্তাকে বদলে দেওয়ার এবং তার উপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। আশেপাশের পরিবেশ হতে যেসকল ধারণা মানবমনে জন্ম নেয়, সেসবের বিরুদ্ধাচরণেরও ক্ষমতা রাখে চলচ্চিত্র।”
কথাখানা জাপানের অ্যানিমেশন সিনেমার পরিচালক সাতোশি কনের। তার নিজের কাজগুলোতেও ঠিক সে কথাটিই প্রতিফলিত হয়েছে। জাপানের অ্যানিমেশন সিনেমার শ্রেষ্ঠ ক’জন পরিচালকের নাম করলে হায়াও মিয়াজাকি, ইসাও তাকাহাতার নামের পাশাপাশি সাতোশি কনের নামটা হয়তো ক্ষীণস্বরেই উচ্চারিত হবে এই মুল্লুকে। তেমনটাই স্বাভাবিক। কারণ সাতোশি কনের কাজগুলোর গূঢ় এবং জটিল প্রকৃতি কোনোভাবেই সার্বজনীন নয়। সে কথার পিঠেই বলতে হয়, অ্যানিমেশন সিনেমায় এমন জটিল ন্যারেটিভের প্রতিষ্ঠা করে এই ধারার সিনেমাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন, কন। শৈল্পিক এবং নান্দনিক; দুই বিচারেই নিখুঁত কিছু কাজ উপহার দিয়ে গেছেন তিনি, যার শুরুটাই হয়েছে ‘পারফেক্ট ব্লু’ দিয়ে।
একদম প্রারম্ভিক দৃশ্যটি থেকেই পারফেক্ট ব্লু তার জটিল ন্যারেটিভের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় দর্শককে। গোটা সময়টায় যে ভ্রমের মধ্যে থাকার মতো একটা অভিজ্ঞতা দর্শকের মাঝে জাগাতে যাচ্ছে এই সিনেমা, তা এই দৃশ্যটিতেই সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, পপ শিল্পী মিমা এবং তার মিউজিক্যাল গ্রুপ ‘চ্যাম’ একটি লাইভ শো করছে। আবার গানের ছন্দের সাথে দৃশ্যপট বদলে এই সঙ্গীতজীবনের বাইরে তার একঘেয়ে, সাধারণ জীবনটাও দেখানো হচ্ছে। অনুক্রমগুলো আগুপিছু করে চলতে থাকে এ দৃশ্যে। ফলে, এই কেন্দ্রীয় চরিত্রটির দু’টি ভিন্ন জীবন, তার ভিন্ন দু’টি সত্ত্বা একদম সমান্তরালভাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়। এই ওভারল্যাপিং ন্যারেটিভ বা ননলিনিয়ার ন্যারেটিভের কারণেই প্রধান চরিত্র মিমা’র বাস্তব এবং কাল্পনিক দুনিয়া অভিঘাতী রূপ ধারণ করে।
প্রথম দৃশ্যের শেষভাগে গিয়ে জানতে পারা যায়, পপশিল্পী মিমা’র লাস্ট শো এটি। গায়িকা হয়ে আর নয়, বরং অভিনেত্রী হয়ে এবার ক্যারিয়ার গড়তে চায় সে। নিজের ‘বালিকাসুলভ’ ইমেজটা থেকে বেরিয়ে অভিনয় ক্যারিয়ারে একজন পরিণত শিল্পী হতে চায় সে। এ ঘোষণায় স্বভাবতই নাখোশ হয় তার অনেক ভক্ত। তবে আশংকার বিষয় হলো, একদল খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাদের প্রিয় পপশিল্পীর এই সিদ্ধান্তে। সেই দলেরই একজন হলো, মি-মানিয়া। ভয়ানক একজন স্টকার সে।
পরিচয় গোপন করে মিমার সাথে যোগাযোগ করে মি-মানিয়া। হুমকি দিতে থাকে গানের জগত ছেড়ে যাওয়াতে। এরইমধ্যে আবার, মিমা আবিষ্কার করে, ইন্টারনেটে একটা ব্লগে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি কাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণ প্রকাশ করা হচ্ছে, যেসব তার ছাড়া আর কারো জানার কথা না; তবে এরচেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হলো, ব্লগে বলা হচ্ছে, এই বিবরণগুলো সে নিজেই পোস্ট করে। গোটা ঘটনাটাই মিমাকে আতঙ্কিত করে তোলে। বাস্তবের উপর তার জোরটা কমতে থাকে। নিজের পুরোনো গায়িকা সত্ত্বাটা তাকে দেখা দেয় তখন। তার এই নতুন সত্ত্বার উপর হাসাহাসি করে, খেদ প্রকাশ করে। মিমা ক্রমশই বাস্তব আর কল্পনার মধ্যকার পার্থক্যরেখা ভুলে কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। সমস্তটা আরো জটিল করতে তখন উদয় ঘটে একজন অদৃশ্য খুনির, যে কিনা মিমার অভিনয় ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা লোকজনদের এক এক করে খুন করতে থাকে। পরবর্তী শিকার তবে কে?
বাস্তব এবং কল্পনার দ্বন্দ্বের উপর ভর করে এগোয় সাতোশি কনের এই সিনেমাটি। তবে শুধু এটিই নয়, তার পরবর্তী সিনেমাগুলোও বাস্তব আর কল্পনার দ্বন্দ্বটা উপস্থাপন করে, যার অন্যতম বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে ‘পাপরিকা’ (২০০৬), যে সিনেমা আবার বড় অনুপ্রেরণা রেখেছে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইনসেপশন’ (২০১০)-এর উপর।
বাস্তব আর কল্পনার দ্বন্দ্ব এবং ধূসর জায়গাটা, তার কাজগুলোর একটি সাধারণ বিষয়। এর ভেতর দিয়েই আরো গূঢ় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা রাখেন, কন। পরিচিতির জটিলতা, খণ্ডিত সত্ত্বা, মানুষ এবং মিডিয়ার ভয়ারিস্টিক দিক- এই বিষয়গুলোই মোটাদাগে তার সিনেমাগুলোর প্রতিপাদ্য বিষয়, যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে এই অভিষেক সিনেমাতেই। এছাড়া যে কথাটি বলাই বাহুল্য, তা হলো, সাতোশির প্রত্যেকটি কাজই নারীকেন্দ্রিক। নারী মনস্তত্ত্বের গভীরে দেখতে চেয়েছে তার চারটি সিনেমাই। তবে সাতোশির সিনেমার সমাজবাস্তবতার দিকটিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার সর্বশেষ সিনেমা ‘পাপরিকা’ তো এক অর্থে গোটা জাপানি সমাজের চিত্রটা প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেছে। এ সিনেমায়ও সাতোশি ৯০ দশকের জাপানের ভোগবাদী সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।
মিমার দ্বৈত সত্ত্বার বিষয়টি আসলে বাস্তবিকই। জাপানের পপশিল্পীরা সত্যিকার অর্থেই দু’টি ভিন্ন জীবনযাপন করে। ভক্ত, দর্শকদের সামনে তারা পুরোপুরি বানানো একটি ব্যক্তিত্ব বহন করে। খুব রংচঙাভাবে তারা ভক্তকূলের সামনে আসে, যা পুরোপুরিই স্ক্রিপ্টেড। এই নকল ব্যক্তিত্ব তাদের ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করাটা অনেকক্ষেত্রেই দুরূহ। তারকাদের এই দ্বৈত ব্যক্তিত্ব নিয়ে জীবনযাপনের বিষয়টি শুধু জাপানেরই চিত্র নয়, বড় বড় সকল সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের চিত্রটাও কমবেশি এমনই। সেদিক থেকে কনের এই বক্তব্যটি হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। তারকাদের এই বানানো ব্যক্তিত্বে সাধারণ মানুষ কতটা বুঁদ হয়ে থাকে, তা মি-মানিয়ার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলেই লব্ধ করা যায়। সেইসাথে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির দিকটাও মুখ্য হয়ে উঠে সিনেমায়, যা আজকের এই সময়ে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সাতোশি কনের দূরদর্শিতা সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায় তখন।
‘পারফেক্ট ব্লু’ গোটা সিনেমাটি বর্ণিত হয়েছে মিমার দৃষ্টিকোণ থেকে। সেটি উল্লেখ করার কারণ এই, সিনেমা যখন শেষ অংকে পৌঁছায়, তখন মিমার দৃষ্টিকোণ হয়ে ওঠে ভরসার অযোগ্য। বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারায় বেশ কয়েকটি ব্রেকডাউনের মুখোমুখি হয় মিমা। এবং তখনই তার বয়ানের উপর ভরসা হারায় দর্শক। তবে নিজের ধারণার জায়গাটায়ও স্থির থাকতে পারে না দর্শক। কোনটা সত্যিই ঘটছে, আর কোনটি হতে পারে মিমার মস্তিষ্কপ্রসূত, তা নিয়ে বেশ ধাঁধায় পড়ে যায় দর্শক। আর এর মাঝেই নিহিত আছে সাতোশি কনের চমৎকার চাতুরি এবং দক্ষতার বিষয়টি। তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই দর্শকের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করেন, তাদের ধাঁধায় ফেলেন, ধোঁকা দেন।
এই কাজটা সম্ভব হয় অসাধারণ সম্পাদনার জোরে। তার সম্পাদনার স্টাইল খুবই চতুর এবং গতিশীল। দৃশ্যগুলোকে নিপুণ বুননে সাজান তিনি। কাটগুলোতে থাকে না বিজড়িত ভাব। প্রতিটি কাটকেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন তিনি। এ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “ক্ষণস্থায়ী কিছুকে কংক্রিট কিছু হতে যখন তুমি জোর দেবে, তখনই সত্যিকার অর্থে জিনিসগুলো জটিল হয়ে উঠবে।” এবং সেই জটিলতাকেই ধরেছেন তিনি তার সম্পাদনায়। ‘পারফেক্ট ব্লু’তে দেখা যায়, খুন কিংবা মিমার ব্রেকডাউনের প্রতিটি দৃশ্যের পরের দৃশ্যেই শান্ত, অবিচল এক মিমাকে দেখা যায়, ‘কিছুই হয়নি’ মতো অবস্থায়। এখানে ট্রানজিশনগুলো এতটাই তড়িৎ আর নিখুঁত যে ধাঁধাতে পড়তেই হয়।
সম্পাদনার সাথে সাথে ভিজ্যুয়ালেও মাস্টার, সাতোশি। অন্যান্য অ্যানিম সিনেমা থেকে ভিজ্যুয়ালি বেশ আলাদা কনের সিনেমাগুলো। এর অন্যতম প্রধান কারণ তার ইমেজারিগুলোতে ছড়িয়ে থাকা বাস্তবিক বিবরণ এবং চরিত্রগুলো নিজে। তার সিনেমার চরিত্রগুলো বরাবরই স্বকীয়। এরা বাস্তবের অনেক কাছাকাছি। ইমেজারিতে চাকচিক্য থাকলেও চরিত্রগুলো সাদামাটা। তাদের দ্বন্দ্ব এবং আচরণগুলো অনেক বেশি বাস্তবিক হওয়াতেই তাদের মানুষের মতো মনে হয়। তার সিনেমার এই ‘লাইভ অ্যাকশান’ কোয়ালিটিতে হাইপার রিয়ালিজমের অনুভূতিটা বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে থাকে।
তার কাজের একটা বৈশিষ্ট্যই হয়ে উঠেছে এই হাইপার রিয়ালিজম। সে কারণেই কনের ইমেজারিগুলোতে একটা সুরিয়ালিস্টিক ভাব পাওয়া যায়। গাঢ় এবং স্যাচুরেটেড কালারের ব্যবহার ইমেজারির ওই ভাবটাকে আরো অমোঘ করে তুলেছে এই সিনেমায়। ২ডি অ্যানিমেশনে স্পেস এবং গ্র্যাভিটি কীভাবে ব্যবহার করলে নিখুঁত ফলাফল পাওয়া যাবে, তা যে সাতোশির নখদর্পণে ছিল, এ সিনেমা দেখলে ভালোভাবেই সেটুকু আন্দাজ করতে পারা যায়। পরের সিনেমাগুলোয়ও ঠিক এই স্টাইলগুলো অনুসরণ করেছেন কন।
শেষত বলতে হয়; জটিল বিষয়াদিকে জটিল ন্যারেটিভ ভাষায় উপস্থাপন যে অ্যানিমেশন মাধ্যমটায়ও সম্ভব, সে অপার সম্ভাবনা দেখিয়েছে এই পারফেক্ট ব্লু। যে সম্ভাবনা দলিলরূপে স্পষ্ট হয়েছে সাতোশির পরের কাজগুলোতে। মাত্র চারটা সিনেমা দিয়েই চমৎকার লেগ্যাসি তৈরি করে রেখে গেছেন অ্যানিমেশন মাস্টার সাতোশি কন।