তার বোলিং থেকেও হাসি নিয়ে সবার মধ্যে আলোচনাটা যেন বেশি ছিল। সতীর্থ আকাশ সিং তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “ও তো সবসময় হাসতেই থাকে।” তার হাসিকে স্বনামধন্য ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে বলেছেন, ‘The most heartwarming smile’। দলীয় বা ব্যক্তিগত সাফল্যে সদাহাস্য মুখে হাসিটা আরও চওড়া হয়ে যায়। কিন্তু চেতন সাকারিয়ার এই হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আড়ালে রয়েছে বিষণ্নতার কালো মেঘ, যা সময়ের সাথে কেটে যাওয়ার বদলে হয়েছে আরও ঘনীভূত। এই হাসির আড়ালে রয়েছে নীরবতার গল্প।
সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার ও জনপ্রিয় বিশ্লেষক আকাশ চোপড়ার মতে আইপিএলের ২০২১ সংস্করণের সেরা তিন আবিষ্কারের একজন এই তরুণ বাঁহাতি পেসার। সাত ম্যাচে ওভারপ্রতি ৮.২২ রান খরচায় সাত উইকেট নিয়েছেন, সহজাত সুইংয়ের প্রদর্শনী দেখিয়ে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে।
বয়সটা তার খুব বেশি নয়। কিন্তু তেইশ বছর বয়সেই চেতন সাকারিয়া জীবনে যত ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, তার মুখোমুখি বোধ করি পুরো জীবনেও অনেকের হতে হয় না।
সৌরাষ্ট্রের ভাবনগরের লরিচালক কাঞ্জিভাই। লরি চালিয়েই পরিবারের দেখভাল করতে হয়, অভাব-অনটন যেন পরিবারের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যেই ছেলে চেতনের মাথায় চেপেছে ক্রিকেটের নেশা। ক্রিকেট ছেড়ে পড়াশোনায় মন দিয়ে বড় হয়ে সরকারি চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে – এমনটাই চেয়েছিলেন কাঞ্জিভাই। ছেলের ক্রিকেটপ্রেম তাই বিন্দুমাত্র পছন্দ করেননি, বলতেন,
“ক্রিকেট তো বড়লোকের খেলা। এখানে টাকা থাকতে হয়, যোগাযোগ থাকতে হয়। নইলে এই খেলায় ভবিষ্যৎ নেই।”
চেতনকে তাই ক্রিকেট খেলতে আশ্রয় নিতে হতো মিথ্যের। তবে এমন সময় তার এক মামা পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, যদি চেতন তার মুদি দোকানে কাজ করেন, তাহলে তিনি তার পড়াশোনার ভারবহন করবেন৷ সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেটটাও খেলতে পারবেন৷
চেতন সাকারিয়ার জন্য এর থেকে ভালো প্রস্তাব আর হতে পারত না। লুফে নিলেন সেই প্রস্তাব। পাশাপাশি চলতে থাকলো দুটোই। তরতর করেই এগিয়ে গেলেন, পৌঁছে গেলেন জেলা পর্যায় অবধি।
জেলা পর্যায়ে যখন খেলছিলেন, তখন স্যার ভাবসিংজি ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ রাজেন্দ্র গোহিলের চোখে পড়েন সাকারিয়া। কিছুদিনের মাঝেই সৌরাষ্ট্র অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পেলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি তার। পরের এক বছর কঠোর পরিশ্রম করে যখন চেষ্টা করছিলেন জায়গা করে নেয়ার, তখনই বাদ সাধে নিতম্বের চোট।
সাকারিয়ার বয়স তখন ১৭। বুঝতেও পারছিলেন না, ঠিক কোথায় কী সমস্যা হয়েছে। অনুশীলন ঠিকই চালিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু ব্যথাটা যাচ্ছিল না৷ তখনও চোট, পুনর্বাসন – এসব ব্যাপারে ধারণা ছিল না সাকারিয়ার।
চোটটা আপনাআপনি সারতে লেগে গেছিল প্রায় ৭-৮ মাস। যখন ক্রিকেটে ফিরলেন, গতিটা আগের চেয়ে কমে গিয়েছিল। গতি কমে গেলেও পরিশ্রম কমিয়ে দেননি সাকারিয়া। দ্বিগুণ উদ্যম নিয়ে নিজের কাজটা চালিয়ে গেলেন তিনি।
অবশেষে পরিশ্রমের ফল পেলেন তিনি। সৌরাষ্ট্র অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে গেলেন কুচবিহার ট্রফিতে। সেখানে ছয় ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে নজর কাড়েন, এবং তরুণ এই পেসারকে সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন পাঠায় পেসারদের আঁতুড়ঘর এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে।
সেখানে সহজাত সুইং দিয়ে কিংবদন্তি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রার নজর কাড়েন সাকারিয়া। ম্যাকগ্রা তাকে বলেন,
“তুমি যদি অ্যাকশন আর ফিটনেস নিয়ে কাজ করে গতিটা আরেকটু বাড়াতে পারো, তাহলে অন্তত রঞ্জি ট্রফি খেলতে পারবে।”
এই এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে যাবার আগে সাকারিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ – তার যে স্পাইক নেই! কুচবিহার ট্রফিতেও অন্য একজনের স্পাইক ধার করে খেলেছিলেন। এমন সময় তার ডাক পড়ল সৌরাষ্ট্রের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান শেলডন জ্যাকসনের কাছ থেকে।
সাকারিয়া বলছিলেন,
“তিনি (জ্যাকসন) আইপিএলে খেলেন৷ আমার কাছে তিনি তাই ছিলেন একজন বড় খেলোয়াড়। আমাকে ডেকে বললেন, তাকে যদি আউট করতে পারি, তবে একজোড়া নতুন স্পাইক উপহার দেবেন।”
সাকারিয়া নেটে জ্যাকসনকে বোল্ড করে জিতে নিলেন নতুন একজোড়া স্পাইক।
২০১৮-১৯ মৌসুমে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে (টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট) সুযোগ মিললেও একাদশে জায়গা হয়নি সাকারিয়ার। বিজয় হাজারে ট্রফিতে লিস্ট-এ অভিষেক হলেও সেবার এক ম্যাচেই সুযোগ হয়েছিল।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সুযোগটা আসে সৌরাষ্ট্রের জয়দেব উনাদকাটের চোটের ‘সুবাদে’। গুজরাটের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকেই পাঁচ উইকেট শিকার করেন সাকারিয়া। আট ম্যাচে সেবার সাকারিয়া তুলে নেন ২৯ উইকেট।
সাকারিয়া এরপর আবার ফিরে যান এমআরএফ পেস অ্যাকাডেমিতে। দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ করে তিনি যখন আরও পরিণত হবার প্রয়াসে লিপ্ত, তখনই আরও একটা ধাক্কা।
স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের কারণে সাড়ে চার মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান এই পেসার। ফিরে এসে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি ও রঞ্জি ট্রফি – কোথাও প্রত্যাশামতো পারফর্ম করতে পারেননি সাকারিয়া।
তবে পরেরবার সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নজর কাড়েন আইপিএল দলগুলোর ট্যালেন্ট স্কাউটের। সেই আসরে ৫ ম্যাচে ৪.৯০ ইকোনমিতে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন এই বাঁহাতি পেসার।
গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের নেট বোলার ছিলেন সাকারিয়া৷ মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ও রাজস্থান রয়্যালস দলে ট্রায়াল দেন তিনি৷ অবশেষে এবারের আইপিএলের নিলামে ১.২০ কোটি রুপিতে তাকে দলে ভেড়ায় রাজস্থান রয়্যালস।
কিন্তু আইপিএলে দল পাবার আগে সাকারিয়ার জীবনে আসে আরেকটি ধাক্কা, সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে আঘাত।
সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি খেলতে তখন ইন্দোরে ছিলেন সাকারিয়া। এমন সময় আত্মহত্যা করেন তার ছোট ভাই। পিঠেপিঠি দু’ভাইয়ের মাঝে সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। তার পরিবারের লোকেরা ঠিক করলেন, এখনই কিছু জানাবেন না। তার মায়ের সাথে যখন ফোনে কথা হতো, তখন বারবার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন সাকারিয়া। কিন্তু কিছু না কিছু একটা বাহানা করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন তার মা।
কিন্তু একদিন আর চেপে রাখতে পারলেন না। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সাকারিয়া শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। দশ দিন পর্যন্ত কথা বলেননি কারো সঙ্গে। এমন অবস্থায়ই সাকারিয়ার আইপিএলে দল পাওয়াটা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিলো তার পরিবারকে।
আইপিএল অভিষেকেই দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখান ২৩ বছর বয়সী এই পেসার। যে ম্যাচে দু’দল মিলিয়ে রান উঠেছিল চারশোরও বেশি, সেখানে ৪ ওভারে ৩১ রান খরচ করে তুলে নিয়েছিলেন মায়াঙ্ক আগারওয়াল, লোকেশ রাহুল ও ঝাই রিচার্ডসনের উইকেট।
করোনাভাইরাসের জন্য মাঝপথে স্থগিত হয়ে যাওয়ার আগে আইপিএলে তরুণ এই পেসারের শিকারের খাতায় যোগ হয়েছে আম্বাতি রাইডু, মহেন্দ্র সিং ধোনি, সুরেশ রায়না, নীতিশ রানার মতো ব্যাটসম্যানের নাম।
আইপিএল স্থগিত হবার কয়েকদিন আগে রাজস্থান রয়্যালসের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থের কিছু অংশ বুঝে পান সাকারিয়া। সাথে সাথে বাবার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন পরিবারের কাছে। কারণ, এতদিনে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রায় শয্যাশায়ী তিনি, তার উপর আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে।
সাকারিয়া বলছিলেন,
“সবাই বলছে আইপিএল বন্ধ করে দাও, আইপিএল বন্ধ করে দাও। কিন্তু আমি তো আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি৷ ক্রিকেটই আমার উপার্জনের মাধ্যম৷ আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান৷ এই টাকার মাধ্যমে আমি আমার বাবার চিকিৎসা করাতে পারছি।”
যখনই সাকারিয়া পরিবারে আনন্দ ফিরে আসছিল, সেই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে হার মানলেন কাঞ্জিভাই। ভাইয়ের পর বাবার মৃত্যু – এই ক’দিনের ব্যবধানে চেতন সাকারিয়ার পৃথিবীটা উলট-পালট হয়ে গেল।
রাজকোটে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে ৪৫ রান করে অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানের ভুলে রান আউট হন সাকারিয়া। সন্ধ্যায় শুনলেন বাবার ভর্ৎসনা –
“কে বলেছিল দৌঁড়াতে? না দৌঁড়ালেই তো পারতে। এখন কাল কীভাবে পাঁচ উইকেট নেয়া যায়, সে চিন্তা করো।”
কাঞ্জিভাই সবসময় চাইতেন তার ছেলে যেন একই ম্যাচে অর্ধশতক করে ও পাঁচ উইকেট পায়। আফসোস, ছেলের সেই কীর্তি দেখে যেতে পারলেন না তিনি৷
আবারও নিশ্চয়ই আইপিএল খেলবেন সাকারিয়া। কখনো হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সুযোগ মিলবে। উইকেট পাবেন, সতীর্থরা উল্লাস করবে, হাস্যোজ্জ্বল সাকারিয়াও উল্লাস করবেন। কিন্তু ঠিকই রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাগুলোর মাঝে খুঁজে নেবেন প্রিয় বাবা ও ভাইকে।