বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে দারুণ সময় কাটছে সাকিব আল হাসানের। তিন ম্যাচে ৮৬.৬৬ গড়ে তুলেছেন ২৬০ রান, যা তাকে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের তালিকায় চার নম্বর অবস্থানে রেখেছে। যদিও ম্যাচের হিসেবে তিনি এগিয়ে সবার চেয়ে। বল হাতে অবশ্য এখনও সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। নিয়েছেন ৩ উইকেট। ইনজুরি, মাঠের বাইরে থাকা- সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে ভালো সময় কাটেনি সাকিবের। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচের পর ছিলেন দলের বাইরে। সেই সময়েই নিজের ক্রিকেট ‘গুরু’ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে উড়িয়ে নিয়ে যান ভারতে। তারপর চলে একক অনুশীলন। সেই ফল এখন পাচ্ছেন বিশ্বকাপের মাঠে। তিন ম্যাচে দুটি হাফ সেঞ্চুরি আর একটি সেঞ্চুরি প্রমাণ করে, পরিশ্রমটা বৃথা যায়নি সাকিবদের। কেমন ছিল সেই সময়টা? এক সাক্ষাতকারে বর্ণনা দিয়েছেন কোচ। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য-
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ লাইনআপে নিয়মিত হতে না পারার সময়টাতে আইপিএলে সাকিবের সাথে ছিলেন আপনি। সেই সময়ে তার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল?
আগের মৌসুমে সুযোগ পেয়েও এবারের আসরে প্রথম ম্যাচের পর একাদশে জায়গা হচ্ছিল না সাকিবের। তার সময়টা খারাপ ছিল। আমি যেটা টের পাচ্ছিলাম তা হলো আইপিএলে সে ভালো করার জন্য মুখিয়ে ছিল। একে তো ইনজুরির কারণে ও অনেকটা দিন প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের বাইরে ছিল, তাই নিয়মিত ম্যাচ খেলাটা তার জন্য খুব দরকারি হয়ে উঠেছিল। আবার একইসাথে আপনাকে এটাও মানতে হবে যে, ওই সময়ে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ খুবই শক্তিশালী ছিল সাকিবকে ছাড়ায়। দলের কম্বিনেশনের সাথে সাকিব মিলছিল না সেটাও সত্যি। কিন্তু সে খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল।
যারা মাঠে সুযোগ পাচ্ছেন তাদের কারণে অনুশীলনটাও নিজের মতো করে করা হচ্ছিল না। কিন্তু যারা দলের বাইরে ছিল তাদের জন্য একা অনুশীলন করার সুযোগ দল থেকে সাকিবদের দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই ও আমাকে ডাকে। যতটা বুঝতে পেরেছিলাম, তার মানসিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না, কিন্তু মাঠে নেমে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সে মুখিয়ে ছিল।
আপনার কি মনে হয় শেষ দুই বিশ্বকাপের চেয়ে এবার সাকিব নিজের প্রস্তুতি নিয়ে আরও বেশি সতর্ক?
হ্যাঁ, আমি মনে করি অন্যান্য আসরের চেয়ে সাকিব এবার নিজেকে ফিজিক্যালি এবং টেকনিক্যালি আরও ভালোভাবে তৈরি করেছে।
নিজেকে দিয়ে কোনকিছু প্রমাণ করতে চায়, সাকিব কি এমনকিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইছে?
আমি তা মনে করি না। দেখুন, ও এতদিনে যা কিছু অর্জন করেছে; ক্যারিয়ারের এই অবস্থানে এসে ওর আসলে কারো কাছে কোনোকিছু প্রমাণ করার নেই। ও আসলে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটার হিসেবে নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের হয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো পার করাটাই এখন ওর মূল কাজ। আমি মনে করি ও এখন যেখানে আছে সেখান থেকে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ায় অনুপ্রাণিত হয়েছে।
ব্যাটিংয়ে কোন কোন জায়গা নিয়ে সে কাজ করেছে? এবারের বিশ্বকাপে ইংলিশ কন্ডিশনে অতীতের চেয়ে তাকে বেশ অনুদ্বিগ্নও মনে হচ্ছে।
আমার মনে হয়েছিল ইংলিশ কন্ডিশনে ওর কিছু শট নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন ছিল। আমরা দুজন মিলে সেই কাজটা করার চেষ্টা করেছি। সে যখন ফ্রন্টফুটে খেলে; তখন ফ্লিক করুক বা ঘুরিয়ে মারুক তার ব্যাট থেকে আসা বল বারবার নির্দিষ্ট জোনে যাচ্ছে। আমি চেষ্টা করেছি এই পরিধিটা আরও বাড়ানো যায় কি না। যেমন স্কয়ার লেগ, মিড-উইকেট এবং ফাইন লেগ। সে চেষ্টা করেছে এই জায়গায় নিজের উন্নতি করার। আমরা ব্যাকফুটে গিয়ে ছক্কা হাঁকানোর অনুশীলন করেছি, স্পিনারদের বিপক্ষে পুল শট খেলার অনুশীলন করেছি।
আপনি যদি ইংলিশ ওপেনার জনি বেয়ারস্টো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নারকে দেখেন, তাহলে টের পাবেন কত দ্রুত স্পিনের সামনে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে তারা নিজেদের জায়গা বদলে ফেলছে। এটা আসলে একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আপনি যদি বিশ্বাস করেন আপনি বোলারদের উপর চড়ে বসতে পারবেন, তাহলে আপনি অবশ্যই পারবেন। আমরা (বাংলাদেশে) সাধারণত এভাবে খেলি না, কিন্তু সাকিব এই জায়গায় নিজের সামর্থ্যের উন্নতি করে চেয়েছিল।
সে আমার কাছে স্পিনারদের বিপক্ষে এক-দুই রান নেওয়ার ছোট ছোট কিছু দক্ষতা নিয়েও কাজ করেছে। আমার মনে হয় বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে তার এই কাজগুলো খুব করে সামনে এসেছে।
ইনিংসের শুরুর দিকে সাকিবের আগে ‘স্ল্যাশ’ খেলার অভ্যেস ছিল, যদিও তার হাতে অন্যান্য শট আছে। এবার সে এই অভ্যেসটা কিছুটা কমিয়েছে বলে মনে হয়…
ও খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে। এমনিতে অফ সাইডে ও বেশ শক্তিশালী, কিন্তু আমরা দুজনে কিছু ড্রিলস নিয়ে কাজ করেছি যেন ও পাওয়ার হিটের গতি বাড়াতে পারে, শট খেলতে গিয়ে বেশি সময় পেতে পারে। আমার মনে হয় এটা ওর খুব কাজে দিয়েছে।
আইপিএলের সময়ে অন্ততপক্ষে ৬-৭ কেজি ওজন কমিয়েছেন সাকিব। ব্যস্ত সূচির মধ্যে কিংবা যে ক্রিকেটার জিমের ব্যাপারে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন, তার এমন পরিবর্তন আপনি কীভাবে দেখছেন?
আমার মনে হয় আইপিএলে ও নিজের ওজন কমানোর ব্যাপারে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ সে জানতো ওজন কমানোর মাধ্যমে তার কাজের গতি বাড়বে, যেটা তার পারফরম্যান্সের জন্য দরকারি। সে একজন ট্রেনারের সাথে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করেছে, নিয়মিত নিজের ফিটনেসের অবস্থার প্রতি খেয়াল রেখেছে। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ সাকিব এটাই করতে চেয়েছে। এমন নয় যে কেউ তাকে করতে বলেছে। নিজের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারেও সাকিব খুবই সচেতন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তার যতটা প্রয়োজন তার বেশি সে একটুও খায় না।
তার মতো একজন ভোজনরসিকের কাছ থেকে এমন উদ্যোগ কি আপনার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে? নাকি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির ইঙ্গিত?
হ্যাঁ, একটা সময় ছিল যখন আমি খাবার খেতাম, সাকিব শুধু পাশে বসে থাকতো। আমার জন্য এটা একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। সেদিক থেকে বলতে গেলে, বিশ্বকাপের জন্য সাকিব নিজের পারফরম্যান্সে উন্নতির জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। বিশেষ করে খাবারের প্রতি ভালোবাসা।
আপনি কি তার বোলিং নিয়ে কোনো কাজ করেছেন?
আমার মনে হয় সাকিবের বোলিংটা ঈশ্বর প্রদত্ত। তাকে আপনার অনেক কিছু বলতে হবে না, যেহেতু বোলিংয়ের ব্যাপারটা সে খুব সাধারণ রাখতে চায়। আমাদের কিছু সাধারণ তত্ত্ব আছে, আমরা সেগুলো নিয়েই কাজ করেছি। যখনই আমাদের মনে হয় আমরা সেই প্রক্রিয়াটা সঠিকভাবে অনুসরণ করছি না, তখনই আমরা কথা বলি আলোচনা করি। আমি কেবল তার বোলিংয়ের দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখি- সাকিবের বল ডেলিভারির ল্যান্ডিংয়ের সময় তার সামনের পা ঠিক আছে কি না আর তার হাতের পজিশন দেখে ডেলিভারি সঠিক আছে কি না সেটা। আমার মনে হয় একজন বোলার হিসেবে তার সবচেয়ে শক্তির জায়গা হলো সে ব্যাটসম্যানের পরিকল্পনাটা ধরতে পারে।
সময়ের সাথে সাকিবের বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তন হয়েছে। আবার চাইলেই দ্রুত সে নিজের পুরনো অ্যাকশনেও ফিরে যেতে পারে। আর তার যে বোলিং অ্যাকশন, তাতে অনেক বৈচিত্র্য আনা কঠিন। তাই সে যেটা করে ‘ফ্লাইট’ আর ‘গতি’র স্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে বল করে। সবচেয়ে বড় কথা বোলার হিসেবে ও নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানে। একইভাবে জানে নিজের সামর্থ্যের কথা।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির পর সাকিব উল্লেখ করেছিলেন, তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করার জন্য তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তিনি জানেন, যদি তিনি ব্যর্থ হন তাহলে জায়গাটা তাকে হারাতে হবে। আপনার কি মনে হয় এই অনিশ্চয়তায় সাকিবের সেরাটা বের করতে সাহায্য করেছে?
সত্যি বলতে আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি ছোট ফরম্যাটে সাকিবের তিন নম্বরে ব্যাট করার সামর্থ্য আছে। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, তার তিনে ব্যাট করার সামর্থ্য আছে এটা বোঝানোর সাথে সাথে যারা তাকে নিয়ে সন্দিহান ছিল সেঞ্চুরির মাধ্যমে সাকিব তাদের কাছেও নিজেকে প্রমাণ করেছে। অনিশ্চয়তার চেয়েও আমি যেটা মনে করি তা হলো নিজেকে তিন নম্বরে রাখার জন্য নিজের সেরা চেষ্টা। সাকিব এমন কিছুই দেখাতে চায় না যাতে লোকে ভাবে তিন নম্বর পজিশন তার জন্য নয়।