“এমন কোনো তরুণের কথা যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, যে ক্রিকেট খায়, ক্রিকেট পরে এবং ক্রিকেটেই ঘুমায়, নিঃসন্দেহে সেই নামটা হবে বব উলমার।”
কথাটা লেখা হয়েছিলো উইজডেন ম্যাগাজিনে, সাল ছিলো ১৯৭৬। সেবার বব উলমার উইজডেনের বিচারে ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার হয়েছিলেন। যার শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে আছে ক্রিকেট, মাঠ থেকে অবসর নিলেও তিনি কি আর অত সহজে ক্রিকেট ছাড়তে পারেন? জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্রিকেট ছাড়েননি তিনি, কোনোদিন ক্রিকেটের সাথে আপোষ করেননি। সেই আপোষহীন মনোভাবই কি পরে জীবন সংহারের কারণ হয়ে এসেছিলো উলমারের জন্য?
২০০১ সালের দিকের কথা। উলমার তখন চাকুরিবিহীন অবস্থায় বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কাউন্টি ক্রিকেটে একটানা এতগুলো বছর ধরে কোচিং করানোর পর সেই সময়েরকার অন্যতম সেরা এবং সবচেয়ে সৃষ্টিশীল কোচ উলমার তখন নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে ফিরছেন। চ্যালেঞ্জ খুঁজে পেয়েও গেলেন অদ্ভুত এক জায়গায়, আইসিসিতে হাই পারফরম্যান্স ম্যানেজার হিসেবে! কাজটা ছিলো উঠতি সহযোগী সদস্য দেশগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকি করা।
উলমারের মতো একজন ক্রিকেট কোচের জন্য ছিলো সেটা নেহায়েত সাধারণ একটা কাজ, এমন কিছু যাতে সীমাবদ্ধতা ছিলো। এতদিন উচ্চ পর্যায়ের কোচিংয়ে তিনি যে মানের ক্রিকেটারদের কোচিং করিয়েছেন, সে তুলনায় নেহায়েত সাধারণ মানের ক্রিকেটারদের তদারকি করতে হবে সেখানে। তবে আকর্ষণও ছিলো বটে সেখানে, আইসিসি তখন মাত্রই মন দিয়েছে ক্রিকেটের বিশ্বায়নে। আর তাঁর পদ থেকে সেই বিশ্বায়নের পথে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারার সুযোগ দেখতে পেলেন উলমার, ফলে তিনি চাকরিটা লুফে নিলেন। উলমারের বন্ধুবৎসল সহযোগী কোচ নীল বার্নসের মতে, “বব কখনো বিশ্রাম নেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলো না, তবে কখনও কখনও দৃশ্যপটের পরিবর্তনটা দারুণ কাজে দেয়।” উলমারের জন্য দারুণভাবে কাজে এসেছিলো এই পরিবর্তন।
তাঁকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে মনে রাখতে পারেন; খেলোয়াড়, কোচ কিংবা সংগঠক, সব রকমের ভূমিকাতেই দারুণভাবে সফল হয়েছেন তিনি। কিন্তু ক্রিকেট তাঁকে মনে রাখবে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে, কোচিংকেও যে এতটা স্মার্টলি তুলে ধরা যায় সেটা উলমার না থাকলে কি আদৌ জানতে পারতো ক্রিকেটবিশ্ব? তিনিই প্রথম কোচ, যিনি কোচিংয়ে সম্পৃক্ত করেছেন কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তি। সারাদিন হাতে একটা ল্যাপটপ লেগেই থাকতো বলে দুষ্টুমি করে তাঁকে নাম দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ‘ল্যাপটপ কোচ’, নামটা শুনে তিনি নিজেও বেশ আমোদিত হতেন।
অথচ বিশ্বের সেই অন্যতম সেরা এবং উদ্ভাবনী ক্রিকেট কোচকে কিনা শেষমেষ মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল জ্যামাইকার একটি চার-তারকা হোটেলের বাথরুমে, সেটাও বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে! কিন্তু কিভাবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, কেন?
২০০৪ সালে উলমার আইসিসির চাকরি শেষ করে যোগ দিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে। জাভেদ মিয়াঁদাদের অধীনে সর্বশেষ সিরিজেই ঘরের মাটিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে হেরে গেছে পাকিস্তান। এতে নাখোশ পিসিবি চাকরিচ্যুত করেছে জাভেদ মিয়াঁদাদকে, আর সেখানে নিয়োগ পেয়েছেন উলমার। দলটাকে পেয়েই যেন কোন এক জাদুর ছোঁয়ায় বদলে দিলেন রাতারাতি, জিততে শুরু করলো দলটি। মাঝেমধ্যে অপ্রত্যাশিত ফলাফল আসতো ঠিকই, তবে প্রাপ্তির পাল্লাই ছিলো ভারী। পিসিবিও সেটারই অবদান দিলো, উলমারের চুক্তি নবায়ন করে বাড়ানো হলো বিশ্বকাপ পর্যন্ত। সেটাই বুঝি কাল হলো উলমারের জন্য।
১৮ মার্চ, ২০০৭
৪৭ বছর বয়স্ক বার্নিস রবিনসন সেদিন যখন কিংস্টনের ছোট্ট শহরতলীর বাড়িটা থেকে ভোরবেলা বেরোলেন, দিনটাকে অন্য দিনগুলো থেকে সেভাবে আলাদা ভেবে উঠতে পারেননি। সেই একঘেয়ে কাজে নিমগ্ন একটা দিন হতে যাচ্ছে ভেবেই বেরিয়েছিলেন কাজে, জ্যামাইকার পেগাসাস হোটেলে যখন পৌঁছালেন তখনও বুঝতে পারেননি কি হতে চলেছে।
৭টার সময় তাঁর শিফট শুরু হওয়ার কথা, কিছুটা দেরি করে ফেলেছিলেন বলে তড়িঘড়ি করে কাজে নেমে পড়লেন বার্নিস। কাজ করতে করতে বেজে গেছে ৯.৩০টা, এমন সময় পৌঁছালেন দ্বাদশ ফ্লোরের ৩৭৪ নম্বর রুমে। অন্যগুলোর মতোই একদম সাধারণ একটা রুম, বিশেষ কিছুই নেই। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করলেন, কোনো সাড়া এলো না। আবারও নক করলেন বার্নিস, নাহ, কোনো সাড়াশব্দ নেই!
কিছুটা অবাক হলেন, সম্ভবত শঙ্কাও লুকিয়েছিলো মনে। তাই সকালে তাঁর নামে ইস্যু করা কী-কার্ড ব্যবহার করে রুমে ঢুকলেন বার্নিস। ঢুকেই অন্ধকার কক্ষে খুব সামান্য একটা শব্দ শুনতে পেলেন, ভাবলেন রুমের বাসিন্দা তখনও ঘুমে নিমগ্ন। তাই ওই রুম থেকে বেরিয়ে আরো তিনটা রুমে কাজ করলেন।
এরপর আবার ফিরে এলেন ওই রুমে, ঘড়িতে তখন ১০.৫০ বাজে। আবারও নক করলেন, নাহ, এবারও আর কোনো উত্তর এলো না। এবার খেয়াল করলেন, রুমের বেডটা ফাঁকা। কিছুটা কৌতুহলী হয়ে আরেকটু ভিতরে ঢুকে চারপাশটায় নজর দিলেন। হঠাৎ করে খেয়াল করলেন, বালিশের এক কোণে রক্তের ছোপ, চেয়ারটা উল্টানো এবং উটকো একটা বমির গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে নক করলেন বাথরুমে, দেখতে চাইলেন সেখানে কেউ আছেন কিনা।
নাহ, সেখানেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। এবার জোরপূর্বক দরজা খোলার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু কোনো এক অমানুষিক শক্তিতে যেন কেউ একজন সেই দরজা খুলতে বাধা দিচ্ছে! এবার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করলেন বাথরুমের দরজায়, দেখতে পেলেন ছয় ফুট লম্বা একজন মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে দরজার সামনে। বব উলমার!
“স্যার! স্যার!! আপনি ঠিক আছেন তো?” চিৎকার করে উঠলেন বার্নিস। কোনো সাড়া নেই উলমারের নিথর শরীরটা থেকে, বরং অ্যালকোহল-মেশানো বমির উর্দ্রেককারী উটকো একটা গন্ধ নাকে এলো বার্নিসের। ভয় পেয়ে গেলেন বার্নিস, সাথে সাথে অ্যালার্ম বাজিয়ে জানান দিলেন পরিস্থিতির কথা। ড. অ্যাশার কুপার এবং নোভেলেট রবিনসনের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেদিন ১২.১৪ তে কিংস্টন হাসপাতালে ড. কুপার এবং ড. সিমিওন ফ্রেঞ্চ কর্তৃক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
আজীবন ক্রিকেটে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ একজন কোচ, একজন সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, একজন বাবা, একজন স্বামী, সর্বোপরি দারুণ রঙিন এক জীবনের অধিকারী বব উলমারের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো কিংস্টনের ছোট্ট একটা হোটেল রুমে, সকলের দৃষ্টির অগোচরে, নিঃসঙ্গভাবে। কিন্তু কীভাবে মৃত্যু হলো উলমারের?
২২ মার্চ এলো সেই ঘোষণা, প্রাথমিকভাবে উলমারের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হলো, বাহ্যিক কোনো শক্তির মাধ্যমে শ্বাসরোধের ফলে মৃত্যু ঘটেছে উলমারের। চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো বিশ্বের, তবে কি খুন হলেন উলমার? কিন্তু তাঁকে কেনই বা খুন করতে চাইবেন কেউ?
উলমারের মারা যাওয়ার ঠিক আগেরদিনই বাজির দান উল্টে দিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে নবাগত আয়ারল্যান্ড। তবে কি উলমার বাজিকরদের ক্ষোভের শিকার হলেন? অসম্ভব নয় সেটা, এর আগে উলমারের অধীনেই অধিনায়কত্ব করা দক্ষিণ আফ্রিকান সাবেক অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ের পরিণতি দেখেছে গোটা বিশ্বই। তাই বাজিকরদের ক্ষোভের মুখে পড়াটা নেহায়েত অমূলক কোনো সন্দেহ ছিলো না।
আয়ারল্যান্ডের সাথে পরাজয়টা সেভাবে মেনে নিতে পারেননি উলমার, নিজের হোটেল রুমে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসে ছিলেন আর ‘স্ট্রেস ইটিং’ চালাচ্ছিলেন। আর সাথে সাথে ল্যাপটপে টাইপ করেছিলেন একটা মেইলঃ
“বুঝতেই পারছো, কিছুটা হতাশাগ্রস্থ একটা সময় পার করছি এখন। আমি ঠিক নিশ্চিত নই কোনটা বেশি বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা, এজবাস্টনে সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়া নাকি বিশ্বকাপের ফার্স্ট রাউন্ড থেকেই বাদ পড়া। অন্তত আমাদের আর গায়ানাতে যেতে হচ্ছে না! আমাদের ব্যাটিং পারফরম্যান্স জঘন্য ছিলো, আমার সবচেয়ে বেশি ভয়ের দিকগুলোই হয়েছে এদিন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এদিন কোনো একটা কারণে আমার খেলোয়াড়েরা যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হয়নি (কিংবা হতে পারেনি), সবগুলো উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে। আইরিশদের আমি কৃতিত্ব দিচ্ছি, ওরা দারুণ করেছে, মাঠে অনেক চেষ্টা করেছি আমরা ; কিন্তু কি দুঃসহ এক অনুভূতি! জানি না কবে বাড়িতে ফিরতে পারবো, আমার আর তর সইছে না ডেল, পিপ্পাদের দেখার জন্য। কাল চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলবো, দেখি কি বলেন উনি। আশা করি, তোমার দিনটা ভালো কেটেছে ; অবশ্য যদি খেলা দেখে থাকো, তাহলে না কাটারই কথা! আর বলার তেমন কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না আসলে, কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসি।
তোমারই, বব।”
মেসেজটা তিনি করেছিলেন নিজের স্ত্রীকে, সেটাই ছিলো তাঁর করা শেষ মেইল। এর পরের দিন সকালেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় উলমারকে। খুব দ্রুতই উলমারের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে যায় সর্বত্র, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও উলমারের এ মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে প্রচার করতে শুরু করলো।
কিন্তু হঠাৎ পাশার দান উলটে গেলো ২০০৭ সালেরই নভেম্বর মাসে। ২৬ দিন ধরে ৫৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখার পর কেসটিকে ‘ওপেন ভারডিক্ট’ হিসেবে ঘোষণা করে ক্লোজড বলে ঘোষণা করে দিলো জুরি বোর্ড! পরিষ্কার করে বলে দিলো, এই কেস চালিয়ে যেতে তাঁরা আর আগ্রহী নয়! কারণ হিসেবে দেখানো হলো, খুন হয়েছে সেটা নিশ্চিত করার মতো যথাযোগ্য আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি! তবে কি ধামাচাপাই দিয়ে দেওয়া হলো উলমারের মৃত্যুর ব্যাপারটা? সত্যটা জানার জন্য কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, কিছুটা বলতে একদম তদন্তের শুরুতে।
উলমারের মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করেন ড. এরি শেশাইয়া, জ্যামাইকার স্টেট প্যাথোলজিস্ট। এই তদন্তের মধ্য দিয়ে তিনি জ্যামাইকার সবচেয়ে বিতর্কিত মানুষদের একজনে পরিণত হন। তাঁর এই অনুমানের পিছনে মূল কারণ হিসেবে তিনি দেখান দুটি যুক্তিঃ
- উলমারের কাঁধের হাইঅয়েড অস্থিটি ছিলো ভাঙা, যা ম্যানুয়াল স্ট্র্যাঙ্গুলেশনের অন্যতম প্রধান পরিচায়ক।
- তাঁর কাঁধে কালশিরাও পাওয়া যায়, যেটা শ্বাসরোধে মৃত্যুতে প্রায়ই দেখা যায়।
এরপর বারবাডোজের এক ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া টক্সিকোলজি রিপোর্ট অনুযায়ী, শেশাইয়া পরে তাঁর রিপোর্ট সংশোধন করে লেখেন যে ‘সাইপারমেথ্রিন’ নামক এক ধরণের পদার্থ দ্বারা বিষক্রিয়ার কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন উলমার।
কিন্তু শুরু থেকেই এ রিপোর্টের সাথে সবাই একমত হতে পারেননি, প্রাক্তন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ চিফ সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং আইসিসির অ্যান্টি-করাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিটের তৎকালীন প্রধান জেফ রীজ শুরু থেকেই একান্তে তাঁর কাছের মানুষদেরকে বলে আসছিলেন, “কিছু একটা মিলছে না, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না যে এটা হত্যাকান্ড।” তিনি বারবার জ্যামাইকা কনস্টাবুলারি ফোর্সের ডেপুটি কমিশনার মার্ক শিল্ডসকে বলেছিলেন, যেন শুরুতেই হত্যাকান্ড বলে চারিদিকে প্রচার করা না হয়, কিন্তু শিল্ডস সে কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না।
শিল্ডস তখন জ্যামাইকার ছোটখাটো সেলেব্রিটি, বেশ কিছু সাফল্যমন্ডিত হাইভোল্টেজ কেসের সুবাদে মিডিয়াতেও বেশ নামডাক হয়ে গেছে তাঁর। এমনকি ‘দ্য গ্লিনার’ নামের একটি ম্যাগাজিন তাঁকে ‘থার্টি মোস্ট এলিজিবল মেন’ তালিকায়ও রেখেছিলো। উলমারের মৃত্যুর পর সেটার তদন্তের ভার এসে পড়লো তাঁর উপরে, আর শিল্ডসও সেটা লুফে নিলেন। দারুণ মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখেই কিনা কে জানে, মাঝেমধ্যেই সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ফেলতেন তিনি। অন্যদিকে জেফ রীজের মতো ক্যামেরা দেখলেই লুকিয়ে যাওয়া একজন ডিটেকটিভের কথা কে-ই বা শুনবে?
কিছুদিনের মধ্যেই উলমারের তদন্তের ইতি টেনে দিয়ে অন্যদিকে মন দিলেন শিল্ডস। তবে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পুরো কেসটা আরেকবার রিভিউ করার দায়িত্ব দিলেন তিনজনকে; ড. নাথানিয়েল ক্যারি, প্রফেসর লর্না মার্টিন এবং ড. মাইকেল পলানেন। এবার বেরিয়ে এলো থলের বিড়াল, জানা গেল উলমারের কাঁধের হাইঅয়েড অস্থিটি নাকি ভাঙেনি! উপরন্তু তাঁরা শেশাইয়ার তদন্তে বেশ কিছু ভুল লক্ষ্য করলেন।
একটা তো ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছি, হাইঅয়েড অস্থিটি বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, হয়তো শেশাইয়া নিজেই উলমারের কাঁধে অহেতুক অস্ত্রোপচার করার ফলে ময়নাতদন্তের পর সেখানে কালশিরা বেঁধে যায়, যেটাকে তিনি শ্বাসরোধে হত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তৃতীয়ত, তাঁরা আরো প্রমাণ করেন, সাইপারমেথ্রিন নামক উপাদানটি আদৌ উলমারকে হত্যায় ব্যবহৃত হয়নি। কেননা যে পরিমাণ সাইপারমেথ্রিন পাওয়া গিয়েছিলো স্যাম্পলে, সেটা একজন মানুষের বিষক্রিয়া ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া, কাউকে খুন করার জন্য এই বিষই বা কেন ব্যবহার করতে যাবেন কেউ?
তবে দারুণ রোমাঞ্চকর গল্প ফাঁদা ছাড়াও উলমারের মৃত্যুকে হত্যাকান্ড ভাবার আরো বেশ কিছু কারণ ছিলো মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের।
উলমারেরই শিষ্য ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ে। ক্রনিয়ে ক্যারিয়ারের যখন তুঙ্গে আছেন, হঠাৎই সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি স্বীকার করেন, তিনি ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত ছিলেন এবং সেটার জন্য তিনি অনুতপ্ত। এরপর ২০০২ সালে বিমান দুর্ঘটনায় যখন ক্রনিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, বলা হয়ে থাকে সে দুর্ঘটনার পিছনেও হয়তো বাজিকরদের যোগসাজশ ছিলো। যদিও এ ব্যাপারে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না।
ফলে এমন ধারণাও অমূলক নয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের অপ্রত্যাশিত জয়ে বাজিকরদের প্রবল আক্রোশের মুখে পড়েই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন উলমার। তাছাড়া ওই সময়টাতে উলমার পাকিস্তানের দূর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে অনেকটাই সোচ্চার ছিলেন, সেটাও কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সবরকম সম্ভাবনাই জ্বালানি যোগাচ্ছিলো উলমারের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণটি স্বাভাবিক না হওয়ার। তবে যতই অন্যদের শত শত মোটিভ পাওয়া যাক না কেন, উলমারের মৃত্যুরহস্যের কুলকিনারা হয়নি তাতে।
বারবার দেখা হয়েছে সেদিনের সিসি ক্যামেরা রেকর্ড, নাহ, কোনোরকম অনিয়ম কিংবা অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন চেম্বারমেইড বার্নিস রবিনসনের আগে শেষ ওই রুমে ঢুকেছিলেন এর আগেরদিন রাত সাড়ে নয়’টা নাগাদ ডেইড্রে হার্ভি, একজন রুম সার্ভিস ওয়েট্রেস। একটা উলটানো চেয়ার ছাড়া সেভাবে কোনো ধ্বস্তাধস্তির আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি, কোনোরকম আঘাতের আলামত পাওয়া যায়নি তাঁর শরীরে; এমনকি বাথরুমে যদি খুন হয়ে থাকেন তিনি, তাহলে যেভাবে তিনি পড়ে ছিলেন, সেভাবে পড়ে থাকলে যে কারো পক্ষে বাথরুম থেকে বেরোনোই ছিলো কষ্টসাধ্য!
ফলে একটা সিদ্ধান্তই ছিল, যেটা উলমারের মৃত্যুর পিছনে সত্যিকারের যুক্তি-প্রমাণ দেয়। আর সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যু, খুব সম্ভবত উলমারের হৃদযন্ত্রসম্পর্কিত জটিলতা। কিন্তু কিভাবে হলো সেটা? কেনই বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন তিনি?
বব উলমার আগে থেকেই টাইপ-টু ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন, আর আইরিশদের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে মুষড়ে পড়েছিলেন ভিতরে ভিতরে। বিষাদ থেকে মুক্তি পেতে বেছে নিয়েছিলেন মদ্যপানকেই, আর সেটাই কাল হয়ে এসেছিলো তাঁর জন্য। ডায়াবেটিস আর অ্যালকোহল- নেভার অ্যা গুড কম্বিনেশন। আরো একটু গভীরে গিয়ে ময়নাতদন্ত তাই করাটা প্রয়োজন হয়েই পড়লো।
জানা গেলো, উলমারের হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক আকার থেকে কিছুটা বড়, এছাড়া এর আগে কয়েকটি মাইনর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টও হয়েছিলো তাঁর। তাঁর স্লিপ অ্যাপনোইয়া ছিলো, ঘুমোনোর আগে একটা ডিভাইস পরে ঘুমাতেন যাতে করে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ না হয়ে যায়। এছাড়া সেটিরিজিন ডাইহাইড্রোক্লোরাইডে তাঁর অ্যালার্জিও ছিলো।
টিম বাসের ড্রাইভার বারট্রাম কার বলেন, স্যাবাইনা পার্ক থেকে পেগাসাস হোটেলে ফেরার পথে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই উলমারকে উচ্চঃস্বরে কাশতে দেখেছেন তিনি। তাছাড়া পেশাগতভাবেই তিনি ওই ম্যাচের পরাজয়ে মানসিক দিক থেকে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন, পরে অ্যালকোহলটা আর নিতে পারেনি তাঁর শরীর।
তবে আশ্চর্য ব্যাপার, এত এত প্রমাণও ডিরেক্টর অফ পাবলিক প্রসিকিউশন কেন্ট প্যান্ট্রিকে কনভিন্স করতে পারেনি যে এটা হত্যাকান্ড নয়। তিনি দাবি করে বসলেন, ড. পলানেন কেস রিভিউয়ের সময়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ড. শেশাইয়াকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তিনি বলেন, ড. ক্যারি আসলে একজন ফটকাবাজ। তাঁর হাতে এমন কোনো প্রমাণ না থাকলেও নিজস্ব ক্ষমতাবলে তিনি ড. ক্যারিকে শুনানিতে ডাকেন, এবং মুহুর্মুহু বিভিন্ন প্রশ্নে জর্জরিত করতে থাকেন। বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ড. ক্যারি বলে ওঠেন, “আমি শপথ নিয়েছি সত্যি কথা বলার, অথচ আপনি আমাকে সেই সুযোগটাই দিচ্ছেন না!” প্যান্ট্রি এর প্রত্যুত্তরে বলেন, “আপনি জ্যামাইকাতে এসেই যা খুশি করতে পারেন না। আপনাকে যেটা প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁর উত্তর দিন!”
সম্প্রতি বিবিসিকে ড. ক্যারি বলেন, “একদমই একতরফা একটা জিজ্ঞাসাবাদ চলছিলো, খুবই হতাশাজনক একটা অভিজ্ঞতা সেটা। আমি এবং আমার সহযোগী প্যাথোলজিস্টরা জ্যামাইকান স্টেটকে জটিল একটি কেসের সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, যেখানে ব্যক্তিগত ক্রোশ দেখানোর কোনো সুযোগ ছিলো না। অথচ শুনানিটা অনেকটা ক্রিমিনাল ট্রায়ালের মতোই মনে হচ্ছিলো আমার কাছে, যেন আমি খুব বড় কোনো অন্যায় করে ফেলেছি! আর এমন শুনানিতে ডিরেক্টর অফ পাবলিক প্রসিকিউশনের উপস্থিত থাকাটাও ছিলো আনইউজুয়াল, তিনি যেভাবে প্রশ্ন করছিলেন, সেটাও ছিলো… উম… অসঙ্গত।”
তবে দিনশেষে প্রায় ৫৭জন সাক্ষীর শুনানি শেষে রায় দেওয়া হলো, উলমারের মৃত্যুর পিছনে কোনো ম্যানুয়াল স্ট্র্যাঙ্গুলেশন বা হত্যাচেষ্টার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে প্যান্ট্রি কিংবা পাবলিক প্রসিকিউশনের এমন অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো পদক্ষেপ পরে নেওয়া হয়নি।
উলমারের পরিবারও এই রায় মেনে নেয়; উলমারের বড় ছেলে ডেল উলমার বলেন, “আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই, আমরা এখন শতভাগ নিশ্চিত যে টাইপ-টু ডায়াবেটিস এবং হৃৎযন্ত্রজনিত কারণেই বাবা মারা গেছেন। আমাদের পরিবার এছাড়া অন্য কোনো কারণের কথাও আর ভাবতে পারছে না, কিংবা চাইছে না।”
ফলে বব উলমারের ময়নাতদন্তের ইতি ঘটে এখানেই। সেদিন রাতে কি হয়েছিলো আসলে? সত্যিই কি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো উলমারের, নাকি তাঁকে কেউ সত্যিই খুন করেছিলো? যদি খুন করেই থাকে, সেটা কীভাবে? বাথরুমেই বা কীভাবে গেলেন তিনি? আর বাথরুমেই যদি খুন হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে ওইভাবে দরজার সাথে হেলান দিয়ে রেখে কীভাবে বাথরুম থেকে বেরোলেন খুনী? জবাব মেলেনি অনেক প্রশ্নেরই, তবে সেটার উত্তর খুঁজে পাওয়ারও আর উপায় নেই। তাই আমাদের সামনে এখন কোর্টের দেওয়া একটা দৃশ্যপটই ভাসছে।
সেদিন হতাশাগ্রস্থ কোচ উলমার রুমে ফিরে মদ্যপ অবস্থায় শুয়ে পড়েছিলেন বিছানায়, কিছুটা হয়তো উপুড় হয়েই। তাঁর শ্বাসকষ্টজনিত কারণে ডিভাইসটি আর লাগানোর কথাটা মনে ছিলো না তাঁর, এছাড়া অ্যালকোহলের সাথেও হয়তো খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি তাঁর হৃৎপিন্ড। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে থাকে উলমারের, সেটা থেকে বাঁচার জন্য হাত পা ছুড়তে থাকেন উলমার, বাথরুমে যান কোনো এক কারণে। এরপর আর সেখান থেকে বেরোতে পারেননি, সেখানেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন উলমার।
এটাই শেষ পর্যন্ত উলমার-রহস্যের উপসংহার, আর সেটা নিয়েই বেঁচে থাকতে শিখে গেছেন ববের স্ত্রী গিল উলমার। আর আমরাও মানিয়ে নিয়েছি আস্তে আস্তে, বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ক্রিকেট কোচের মৃত্যুরহস্যের সাথে বেঁচে থাকতে। আচ্ছা, এখনও কি উলমার ক্রিকেটের সাথেই আছেন? কোনো এক আলাদা ডাইমেনশনে, কোনো এক আলাদা ভূমিকাতে নিশ্চয়ই ক্রিকেটের সাথেই আছেন। ক্রিকেট ছাড়া যে মানুষটা জীবদ্দশায় কোনোদিন নিজের অস্তিত্বের কথা ভাবতে পারেননি, তিনি মৃত্যুপরবর্তী জীবনেও ক্রিকেট ছাড়তে পারবেন কি?