“বিজ্ঞান তো কোনো দেশের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এর প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে সমগ্র মানবসমাজের অধিকার।”
বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের এই চিন্তা-ভাবনার মতো করে কতজন ভাবতে পারেন? বিজ্ঞানের বিজয় আজ মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছে- সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও, বিজ্ঞান যে দৈনন্দিন জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে- এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন। বিজ্ঞানীদের একেকটি আবিষ্কার পৃথিবীকে দিয়েছে অনন্য গতিশীলতা, সভ্যতার বিনির্মাণে রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। এই বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? কিংবা বিজ্ঞানের ভাষাকে কতটা সহজ মনে হয় আমাদের কাছে?
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের এই সহজীকরণে কিংবা জনপ্রিয়করণে আমাদের দেশে যে ক’জন ব্যক্তি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আবদুল্লাহ আল-মুতী তাঁর ‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইয়ে একইসাথে বিজ্ঞানীদের বিখ্যাত সব আবিষ্কারের কথা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এর পেছনের বিজ্ঞানও। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তুমুল জনপ্রিয় এ বইটি সে বছরেই ইউনেস্কো পুরষ্কারে ভূষিত হয়।
১৪টি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের মহাগুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কারের সময়ে, দেখিয়েছেন একেকজন বিজ্ঞানীর অজানাকে জানার কতই না অদম্য ইচ্ছা! একটি মানুষ আর একটি বাহিনী, ব্যাঙ নাচানো বিজ্ঞানী, বিজলী এলো হাতের মুঠোয়, লাস্ট বয় থেকে সেরা বিজ্ঞানী, সাদা চাল লাল চাল— এমন সব চমকপ্রদ শিরোনামে লেখক আবদুল্লাহ আল-মুতী গল্পচ্ছলে আমাদের একেকটি আবিষ্কারের গল্পই শুধু বলেননি, সেই আবিষ্কারের পেছনের নায়কের সংগ্রামও অক্ষরে এঁকেছেন পাঠকের কাছে।
এমনিভাবে ধীরে ধীরে লেখক তুলে ধরেছেন থেলিস, আর্কিমিডিস, লিউয়েন হুক, নিউটন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, গ্যালভানি, ভোল্টা, ডারউইন, পাস্তুর, রন্টজেন, আইকম্যান, পিয়েরে কুরি, মেরি কুরি, আইনস্টাইন, রবার্ট উইলিয়ামসের মতো খ্যাতনামা সব বিজ্ঞানীর গল্প।
বিজ্ঞানীদের গল্প, বিজ্ঞানের গল্প বলার আগে শুরুতেই লেখক ‘আবিষ্কারের নেশায়’ শিরোনামে আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন, অজানাকে জানার কৌতূহলকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। তিনি বলেন,
“কোনো ছোট প্রশ্নই আসলে ছোট নয়। ছোট জিনিসের মধ্যেও জানবার আছে অনেক কথা, বহু বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে অতি তুচ্ছ সূত্র থেকে, অতি সামান্য জিজ্ঞাসা থেকে।”
লেখক আমাদের শুনিয়েছেন এক অদম্য মানুষের গল্প, যিনি কিনা সে যুগের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ রোমান বাহিনীর সাথে একা লড়াই করেছেন তিন তিনটি বছর। না, এখানে লেখক কোনো যোদ্ধার কথা বলেননি, বলেছেন আর্কিমিডিস নামের এক বিজ্ঞানপাগল মানুষের কথা। যোদ্ধা না হয়েও হাজার হাজার যোদ্ধাকে কাবু করার বুদ্ধি মাথায় আছে যার। কপিকলের সমাবেশ দিয়ে ভারী ভারী সব জাহাজকে নড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, ‘লিভার’ আর স্প্রিং-এর কৌশল ব্যবহার করে বড় বড় পাথর দিয়ে শত্রু শিবিরে আঘাত হানতেও পারেন। গোলীয় দর্পণের কৌশল দিয়ে শত্রুপক্ষের জাহাজের মাস্তুলে আগুন ধরিয়ে দিতে পারেন অনায়াসেই। অথচ কতই না আত্মভোলা তার জীবনযাপন। চৌবাচ্চায় গোসল করার সময়ই ধারণা পেয়ে গেলেন বিজ্ঞানের বিখ্যাত এক কৌশলের, পোশাক পরা বাদ দিয়েই দৌড় দিলেন, “ইউরেকা,ইউরেকা! আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি” বলে।
এরপরে পাঠক দেখবেন, ‘পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে’ এ কথা বলায় গ্যালিলিওকে গির্জার কর্তাদের কতই না রোষানলে পড়তে হয়। বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতকে অগ্রাহ্য করে গ্যালিলিও যখন পিসার সুউচ্চ এক হেলানো স্তম্ভে পড়ন্ত বস্তুর গুরুত্বপূর্ণ এক নীতির ধারণা দেন, তখন সবার অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে দেখা ছাড়া আর যে কোনো উপায় থাকে না।
বইটির পরতে পরতে আবদুল্লাহ আল-মুতীর সুললিত গদ্যের মোহে আবিষ্ট হয়ে একজন পাঠক আবিষ্কার করবেন- কতই না সাবলীলভাবে বিজ্ঞানের কথা বলা যায়। বিজ্ঞানের খটমট শব্দগুলো যাদের বিজ্ঞানের ভয়ে কাবু করে তারাও এ নির্মেদ, প্রাঞ্জল গদ্যের ফাঁদে পড়ে হয়তো জানতে চাইবেন— এর পরে কী হলো! বইটির ফ্ল্যাপ থেকে,
“বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল-মুতী নিজস্ব একটি ভুবন তৈরি করেছিলেন। বিজ্ঞানের নানা বিষয় জনবোধ্য ও সরস করে পরিবেশনের যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন আবদুল্লাহ আল-মুতীর লাবণ্যময় রচনায় আমরা তার বাস্তবরূপ দেখতে পাই। বিজ্ঞানসাহিত্য রচনার জগতে তাই তাঁর অনন্য একটি ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করি।”
বিজ্ঞানের গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে, তাদের গভীর জীবনবোধ আমাদের ভাবায়। বিজ্ঞানী নিউটনের সময়ে প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দমে যাননি নিউটন। গ্রামে ফিরে গবেষণায় মনোযোগ দেন। বলাই বাহুল্য, এই গ্রামে বসেই নিউটন তার যুগান্তকারী সব আবিষ্কারের ভিত দাঁড় করান। ক্লাসের লাস্ট বয় থেকে তিনি হয়ে গেলেন একজন সেরা বিজ্ঞানী। জগৎজুড়ে খ্যাতি লাভ করার পরেও নিজের কাছে তাঁর নিজের মূল্যায়ন ছিল,
“লোকে আমার সম্পর্কে কী ভাবে তা আমি জানিনে। কিন্তু নিজের কাছে মনে হয় যেন আমি ছোট শিশুর মতো সাগরের তীরে শুধু নুড়িই কুড়িয়ে বেড়ালাম— কোথাও একটু মসৃণ নুড়ি অথবা একটু সুন্দর ঝিনুক। বিশাল জ্ঞানের সমুদ্র আমার সামনে অজানাই পড়ে রইল।”
‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে এভাবে একজন পাঠক খুঁজে পাবেন, কী করে অ্যান্টনি ভন লিউয়েন হুক অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেললেন, যার মধ্য দিয়ে এক ফোঁটা পানির মধ্যেও যে রয়েছে জন্তু জানোয়ারের এক বিশাল সমাহার তা অনায়াসেই জানা যায়। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা সাদরে গ্রহণ করলেন তাঁকে এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য। পাঠক জানতে পারবেন কী করে মানুষ আকাশের বিজলিকে হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হলো, পরবর্তীতে এই বিজলিকে ব্যবহার করল মানুষের সভ্যতাকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে। কিংবা একজন ডাক্তার গ্যালভানি কীভাবে ব্যাঙের নাচন থেকে আবিষ্কার করে ফেললেন মানুষের তৈরি প্রথম বিদ্যুতের প্রবাহ আর ব্যাটারি— এই ঘটনাও প্রত্যক্ষ করতে পারবেন।
‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইটি মূলত কিশোর পাঠকদের জন্য হলেও ছেলে-বুড়ো-বিজ্ঞানপ্রিয় লোকমাত্রই লেখকের ঋজু-সাবলীল বর্ণনার ঢঙে আবদ্ধ হতে বাধ্য! কোনোরূপ দুর্বোধ্যতাহীন লেখার ভঙ্গিমায় পাঠক হয়তো হারিয়ে যেতে চাইবেন রোমাঞ্চকর বিজ্ঞানের রাজ্যে। ডারউইনের সাথে জাহাজে করে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে বেরিয়ে পড়তে চাইবেন কেউ কেউ! পৃথিবীর রহস্যের বাইরে মহাশূন্যে, গ্রহ-উপগ্রহে পদচারণার যে রোমাঞ্চ তার স্বাদ নিতেও চাইতে পারেন! দেশে-বিদেশে চালের রঙের ভিন্নতা কীভাবে বিজ্ঞানীদের দরকারি ভিটামিন খুঁজে পেতে সাহায্য করে তা-ও জানতে পারবেন পাঠক।
নিরলসভাবে এই সকল বিজ্ঞানীরা কাজ করে গেছেন মানবতার কল্যাণে। টানাটানির সংসারে কুরি দম্পতি চার বছর ধরে তিরিশ মণ পিচব্লেন্ড আকরিক থেকে পৃথক করতে পেরেছেন এক রতিরও কম রেডিয়াম। জিতে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কার। বিজ্ঞানের এই অনিন্দ্য সাধনা দেখে লেখকের দেওয়া শিরোনামে হয়তো পাঠকও বলতে চাইবেন, “সুন্দর, হে সুন্দর!”
বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে রন্টজেনের আকস্মিক এক্স রে আবিষ্কার বদলে দিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাগ্য। আত্মভোলা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যুগের সব ধারণাকে ওলটপালট করে দিতে চেয়েছেন যেন! আপেক্ষিক তত্ত্ব ঘোষণা করে বনে গেলেন সব বিজ্ঞানীর সেরা বিজ্ঞানী, সব ওস্তাদের বড় ওস্তাদ! অথচ তার জীবনযাপন কতই না অনাড়ম্বর!
বেলজিয়ামের রানীর মেহমান হয়ে এসেছিলেন একবার তিনি। রেলস্টেশনে রানীর লোক তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান! বেহালা হাতে এক পাগলাটে বুড়ো ছাড়া তো কেউই নেই এখানে! শেষমেশ নিরাশ হয়ে প্রাসাদে ফিরে রানীর লোকজন দেখল, এখানে হাজির সেই বুড়ো। তিনিই যে মহামতি আইনস্টাইন! পায়ে হেঁটেই চলে এসেছেন প্রাসাদে!
‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইয়ে পাঠক দেখবেন লুই পাস্তুর জীবাণুকে দিয়ে জীবাণু ধ্বংসের যে ‘বিষে বিষক্ষয়’ পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন তা আজও বিশ্বজোড়া স্বীকৃত। একপর্যায়ে পাস্তুর আবিষ্কার করলেন মরণব্যাধি জলাতঙ্কের ভ্যাক্সিন। পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি আবিষ্কার করে নেতৃত্ব দিলেন নিজ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে।
বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন পোশাকি ডিগ্রীহীন তরুণ ইয়েফ্রেমভ নিজের চেষ্টায় প্রকৃতিকে কীভাবে বাগে আনলেন, কৃষিক্ষেত্রে আনলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তখন হয়তো লেখকের সুরে পাঠকও বলতে চাইবেন, প্রকৃতি তো পোশাকি ডিগ্রী দেখে ভোলে না। প্রকৃতির রহস্য জানার জন্য যে দরদ দিয়ে প্রকৃতির সাথে মেশে, একাগ্র মনে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করে, তার কাছেই প্রকৃতি তার রহস্যের ঝাঁপি খুলে রাখে।
লেখক আবদুল্লাহ আল-মুতী বইটি শেষ করেছেন ‘আমি হতে চাই একজন বিজ্ঞানী’ শিরোনামে। বলতে চেয়েছেন বিজ্ঞানী হওয়ার মূলমন্ত্র। তরুণদের কাছে বিশ্বচরাচরের সত্যকে উন্মোচনের অবারিত বার্তা দিতে চেয়েছেন। সর্বোপরি, বইটি বিজ্ঞানের দর্শনের প্রতি একজন পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে, বিজ্ঞানীদের প্রতি জাগিয়ে তুলবে পরম শ্রদ্ধাবোধ।
ছোটবেলা থেকেই পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করা ড. আবদুল্লাহ আল-মুতীর লেখার ভাষা প্রাঞ্জল। ‘আবিষ্কারের নেশায়’ বই লিখে তিনি বিজ্ঞানপ্রিয় জাতি গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছেন তারই বাস্তবায়ন করেছেন যেন তার পরের বইগুলোতে। ‘সাগরের রহস্যপুরী’, ‘মহাকাশে কী ঘটছে’, ‘পরমাণুর রাজ্যে’ বইগুলোর মতো বিচিত্র বিষয়ের আরো অনেক জনপ্রিয় বইয়ের রচয়িতা তিনি।
বিজ্ঞান প্রসারের জন্য ইউনেস্কো কলিঙ্গ পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক, অমর একুশে পদক, শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
বইয়ের নাম: আবিষ্কারের নেশায়
লেখক: আবদুল্লাহ আল-মুতী
প্রকাশনী: অনুপম প্রকাশনী
পৃষ্ঠা: ৮৭
প্রচ্ছদ মূল্য: ১৩৫ টাকা মাত্র