প্রাইভেসি, বাংলা করলে দাঁড়ায় গোপনীয়তা। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এর আগে তথ্য শব্দটি যোগ করলে “তথ্যের গোপনীয়তা” বিশেষভাবে অর্থবহ হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিজগতে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ‘প্রাইভেসি’ শব্দকে শীর্ষে রাখলে একেবারেই অত্যুক্তি হবে না।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এর ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি বিতর্ক। এই প্রাইভেসিকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছে প্রযুক্তিজগতের অ্যাপ, ওয়েবাসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এক ভিন্ন ধারার ‘ইকোসিস্টেম’, আরও পরিষ্কার করে বললে ‘বিজনেস মডেল‘। যেখানে একদল, ব্যবহারকারীদের তথাকথিত প্রাইভেসি নিয়ে গুরুত্বের সাথে মাথা ঘামায়, সেখানে অন্যদলের ব্যবহাকারীদের কাছে প্রাইভেসি একরকম ডিজিটাল মরিচীকা। বেশ প্রচলিত একটি কথা হয়তো শুনে থাকবেন, “If you are not paying for the product, then you are the product”। শুধু তা-ই না, এক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবহারকারীর গোপনীয়তাকে কীভাবে দেখছে তার উপরেও প্রভাব পড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিজনেস মডেলে।
সম্প্রতি এই বিতর্কে এবার যুক্ত হয়েছে দুই টেক জায়ান্ট অ্যাপল এবং ফেসবুক। তবে আশার কথা হলো পূর্বের বিতর্কগুলোর সাথে এবারের পার্থক্য হলো ব্যবহারকারীদের জন্য শঙ্কার থেকে স্বস্তির মাত্রাটা হয়তো কিছুটা বেশি।
অ্যাপলের অন্যতম কিংবদন্তী স্টিভ জবসের দেখানো পথে এবার হাঁটছেন সিইও টিম কুক। গ্রাহকদের তথ্যের গোপনীয়তাকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়েছে আইওএস(iOS) এর সর্বশেষ সংস্করণে, যা ফেসবুকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবছেন দুই টেক জায়ান্টের ক্ষেত্র তো ভিন্ন, যেখানে এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে স্মার্ট ডিভাইস সেখানে অন্য প্রতিষ্ঠান কাজ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে। তাহলে দ্বন্দ্বের জায়গাটা কোথায়?
গত সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে আইওএস ১৪.৫ (iOS 14.5)। সর্বশেষ এই সংস্করণে এয়ারট্যাগের মতো অনন্য ফিচারের পাশাপাশি যে ফিচারটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তা হলো এটিটি (ATT), অ্যাপ ট্র্যাকিং ট্রান্সপারেসি।
অ্যাপ ট্র্যাকিং ট্রান্সপারেসি
সোজাভাবে বললে এই ফিচারের কাজ ব্যবহারকারীর থেকে তথ্য সংগ্রহের আগে অনুমতি চাওয়া। ফেসবুকের ব্যবসায়িক মডেলের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে পারসোনালাইজড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। ফেসবুক চালানোর জন্য আপনার থেকে কোনো অর্থ না নিয়ে আপনার পছন্দের বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের থেকে অর্থ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। আর এ জন্য প্রয়োজন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ জানা বা প্রযুক্তির ভাষায় ব্যবহারকারীকে ট্র্যাক করা, যা এতদিন ফেসবুকের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিনা বাধায়, ব্যবহারকারীর অগোচরে করে এসেছে, আর এখানেই বাধ সেধে বসেছে অ্যাপল।
তো মোটামুটি ধারণা যখন পেয়ে গিয়েছেন, এবারে আরেকটু বিস্তারিত জানা যাক। অ্যাপল বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য প্রত্যেক আইফোন বা আইপ্যাড ব্যবহারকারীর একটা নির্দিষ্ট আইডি নাম্বার বরাদ্দ রাখে, প্রতিষ্ঠানটি যেটিকে বলে আইডিএফএ (IDFA) বা আডেন্টিফায়ার ফর অ্যাডভারটাইজার্স। আর ডিভাইসের সেই বিশেষ নাম্বারটিতে অ্যাক্সেস থাকে ইন্সটল থাকা সব অ্যাপেরই, যার মাধ্যমে সব অ্যাপ আপনাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারে ট্র্যাক করার জন্য। ধরা যাক আপনার অ্যাপল ডিভাইসের আইডিএফএ নাম্বারটি 6602117। আপনি Bookstore নামের একটি বইয়ের অ্যাপ থেকে কিছু বই সার্চ করলেন, এবার ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলেন সেই বই কেনার জন্য আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে।
এর পেছনে যা ঘটছে তা হলো Bookstore আপনার আইডি নাম্বারটি সংগ্রহ করে আপনার কার্যক্রম ট্র্যাক করে তার রেকর্ড রেখে দিয়েছে। এরপর সেটি ফেসবুকের কাছে গিয়ে আবেদন করছে এই আইডি নম্বরের ব্যবহারকারীকে সার্চ করা বইগুলোর বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য। যেহেতু আপনার ফোনে ফেসবুক ইন্সটল আছে তাই ফেসবুকও সেই আইডি নাম্বারটি জানে এবং দুটো আইডি নাম্বার মিলিয়ে দেখার পর আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। আইডিএফএ কেবল অ্যাপেই নয় ওয়েবেও আপনাকে ট্র্যাক করতে ব্যবহার করা হয়, সেটার পেছনে কাজ করে আরও একটি প্রযুক্তি, ব্রাউজার কুকিজ।
যা-ই হোক, অ্যাপলের নতুন ফিচার ‘এটিটি ‘ এর কর্তৃত্ব মূলত এই জায়গাতেই। এতদিন পর্যন্ত ব্যবহারকারীকে ট্র্যাক করার জন্য কোনো অনুমতির দরকার পড়তো না, তবে এই ফিচারের বদৌলতে যেই অ্যাপই আপনাকে ট্র্যাক করতে চাইবে সেই অ্যাপের জন্যই আপনার কাছে আলাদা করে অনুমতি চাওয়া হবে আপনি ট্র্যাক করতে দিতে ইচ্ছুক কিনা। শুধু এটুকুই না, কী কী তথ্য ট্র্যাক করা হবে এবং কোন কাজে ব্যবহার হবে তা-ও জানাবে এই ফিচারটি। গত বছর থেকে অ্যাপল তাদের অ্যাপ স্টোরে অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানদের ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে বলে।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই প্রাইভেসির বিষয়ে জোর দিয়ে এসেছে অ্যাপল, নিজেদের প্রাইভেসি-ফার্স্ট কোম্পানি হিসেবে দাবি করেন তারা। এর অন্যতম একটি কারণ হলো অ্যাপল হার্ডওয়্যার নির্ভর এবং ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা খুব সামান্যই। কারণ এই টেক জায়ান্টের লভ্যাংশ বিজ্ঞাপন বিক্রি থেকে আসে না, আসে চড়া মূল্যের ডিভাইস এবং ইন-অ্যাপ পার্চেস বা অন্যান্য সাবস্ক্রিপশন ফি থেকে।
মজার বিষয় হলো, ফেসবুক যতটা নিজেদের বিজনেস মডেল নিয়ে মনোক্ষুণ্ণ, তার থেকে বেশি চিন্তিত ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে। সে কথায় আসছি একটু পরেই।
২০১০ সালে এক সাক্ষাতকারে অ্যাপলের কো-ফাউন্ডার স্টিভ জবস বলেছিলেন,
“প্রাইভেসি মানে হলো ব্যবহারকারী যার জন্য সাইন আপ করছে সে বিষয়ে পরিপূর্ণ অবগত থাকবে। এমন অনেকেই আছেন যারা অন্যদের থেকে বেশি তথ্য শেয়ার করতে চান। সেক্ষেত্রে তাদের অনুমতি চান, প্রতিবার তাদের থেকে অনুমতি চান।”
তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে সম্প্রতি সিইও টিম কুক বলেছেন
“যদি একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর ব্যবহারকারীদের ভ্রান্ত ধারায় চালনা করে, অবাধে তথ্য সংগ্রহ চালায়, পছন্দ-ইচ্ছা থেকেও না থাকা হয়, তবে এটা আর প্রশংসার যোগ্য না, বরং সেটার সংশোধন প্রয়োজন। আপ ট্র্যাকিং ট্রান্সপারেসি ব্যবহারকারীদের তাদের তথ্যের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেবে। আমরা বিশ্বাস করি ব্যবহারকারীদের নিজস্ব তথ্য শেয়ার করার বিষয়ে পূর্ণ অধিকার আছে।“
ফেসবুকের অভিমান
এবারে একটু নজর দেয়া যাক ফেসবুকের দিকে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে সার্ভে অনুযায়ী ফেসবুক স্বীকার করেছে ৮০ শতাংশ ব্যবহারকারীই ট্র্যাক করার অনুমতি নাকচ করে দিবে। ফেসবুকের ভাষ্যমতে অ্যাপলের অ্যাড নেটওয়ার্ক থেকে প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত অর্থ অর্ধেকে নেমে আসবে। তবে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ফেসবুকের এক মুখপাত্রের মতে, যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফেসবুকের বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গ্রাহক খুঁজে পেত, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এমনকি যারা ফ্রি সেবা দিয়ে গিয়েছে এতদিন, অ্যাপল তাদের বাধ্য করছে অর্থের বিনিমিয়ে সেবা বা অ্যাপ সাবস্ক্রিপশন ফি-তে ফিরে যেতে। যা থেকে অ্যাপল একটা অংশ নিজেদের ঝুলিতে পুরবে। অ্যাপলের এরূপ সিদ্ধান্তকে হিপোক্রেসি এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বলেও মন্তব্য করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স আরও সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়, অ্যাপলের এই সিদ্ধান্তে তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হবে।
চাপের মুখে পড়লে স্বভাবসুলভ পিআর বা পাবলিক রিলেশনশিপ অফিসিয়ালদের কাজে লাগানোর চেষ্টা এক্ষেত্রেও করেছে ফেসবুক। ঘটনাকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে এই উপায় অনেক সময়ই কাজে আসে। গত ডিসেম্বরে সংবাদ মাধ্যমে কীভাবে পারসোনালাইজড অ্যাড ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই করোনাকালীন সময়ে টিকে থাকার একমাত্র উপকরণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে তা ফলাও করে প্রচার করেছে।
তবে দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে স্বয়ং মার্ক জাকারবার্গের কণ্ঠে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাপলকে ফেসবুকের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাবের জন্য দুষেছেন।
আমি একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমরা অ্যাপলকে আমাদের একটা বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই দেখি। শুরু থেকেই অ্যাপলের স্বভাব তাদের প্রভাবশালী প্লাটফর্মের মাধ্যমে আমাদের বা অন্যান্য অ্যাপ যেভাবে কাজ করে তার মধ্যে হস্তক্ষেপ করে বসা, যা তারা প্রতিনিয়ত করে আসছে।
তবে সম্প্রতি এক ব্লগ পোস্টে ফেসবুক এই পরিবর্তন গ্রহণ করে নেয়ার কথা জানিয়েছে। একই সাথে ফেসবুক তাদের বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভিন্ন পথ বাতলে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যদিও তা আগের মতো এতটা সুবিধাজনক হবে না। ব্লগ পোস্টে তারা উল্লেখ করেছেন প্রযুক্তি যেমন পরিবর্তনশীল বর্তমান তথ্য সংগ্রহের ধরনও পরিবর্তন হওয়া উচিত, যাতে কম পরিমাণ তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন দেখানো সম্ভব হয়।
প্রাইভেসির নতুন অধ্যায়
আর এ থেকে মনে আশার আলো উঁকি দেয়াটাই স্বাভাবিক, প্রযুক্তিজগতে কি শেষ পর্যন্ত ব্যবহারকারীর প্রাইভেসির গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে?
অ্যাপলের এই ফিচারটি আপনি কীভাবে দেখবেন তা নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে অ্যাপলের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম তার উপর। অ্যাপলের এখানেও ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। বর্তমান সময়ে ব্যবহারকারীর প্রাইভেসিকে যে যত গুরুত্ব দেবে, ব্যবহারকারী তার প্রতি তত বেশি আকৃষ্ট হবে। তবে প্রাইভেসি কেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার নতুন এই অধ্যায়ের সূচনা যে অ্যাপলের হাত ধরেই হতে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যদিও ব্যবহারকারীর উপর নজরদারীর কেবল একটা অংশকে সামনে আনা হয়েছে। অগোচরে আরও অনেকভাবেই তথ্য সংগ্রহ সম্ভব। ব্যবহারকারীর অপারেটিং সিস্টেম, আইপি অ্যাড্রেস, ব্রাউজিং হিস্টোরি বিভিন্নভাবেই চিহ্নিত করা সম্ভব প্রত্যেককে আলাদাভাবে। আর এই তালিকায় শীর্ষে আছে গুগল, একটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রোডাক্ট যত বেশি ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ ততটাই সহজ। সম্প্রতি এই টেক জায়ান্টও প্রাইভেসিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন একধরনের তথ্য সংগ্রহের উপায় বাতলে দিয়েছে। তবে মজিলার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সেই প্রস্তাবনাকে ‘ভয়ঙ্কর’ আখ্যা দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য নয়, ব্যবহারকারীর জন্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
অন্তর্জালের জগতের ব্যবহারকারীরা সবাই কম-বেশি সচেতন তাদের গোপনীয়তার বিষয়ে। বেশিরভাগই অবগত তাদের অগোচরে চলছে তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি। শুধু বিজ্ঞাপন সেবা বা ইউজার এক্সপেরিয়েন্স সমৃদ্ধ করাই নয়, অতীতে এবং অদূর ভবিষ্যতেও এসব তথ্য একটি দেশের সরকার ব্যবস্থার হাতে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে সে অন্য আরেক দিনের আলোচনা। বর্তমান এই ট্র্যাকিং প্রক্রিয়া যে নতুনভাবে ভাবা প্রয়োজন, সংশোধন প্রয়োজন এবং অদূর ভবিষ্যতে তা কতটুকু কার্যকর হবে নাকি আবারও সেই ডিজিটাল মরীচিকাই দেখানো হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।