সময়টা ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চের মাঝামাঝি। গৃহযুদ্ধের তাণ্ডবলীলায় রিচমন্ড শহরের মধ্যেই বন্দি হয়ে আছেন জেনারেল গ্র্যান্টের কয়েকজন ঝানু অফিসার। এদের মধ্যে রয়েছেন ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং, গিডিয়ন স্পিলেট, নেবুশ্যাডজার এবং পেনক্র্যাফট। ওদিকে ফুঁসলে ওঠা গৃহযুদ্ধ নিয়ে এক মহাবিপদে পড়লেন রিচমন্ডের শাসনকর্তা জেনারেল লি। আদেশ প্রেরণ করতে পারছেন না অন্যান্য সেনাপতির কাছে। বুদ্ধির ধারে তৈরি করে ফেললেন বড়সড় এক বেলুন। উদ্দেশ্য, কয়েকজন প্রতিনিধি দ্বারা সন্দেশ প্রেরণ করবেন নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে।
বেলুন ওড়ানোর সকল আয়োজন প্রস্তুত থাকলেও, তাতে বাগড়া দিল আকাশে ভেসে ওঠা দুর্যোগের ঘনঘটা। যা স্পষ্টতই আভাস দিচ্ছে প্রচণ্ড এক ঝড়ের। তাই বেঁধে রাখার বিশাল বেলুনটা পেন্ডুলামের মতো বাতাসের সাথে দোল খাওয়ায় মত্ত হয়ে গেল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সাদৃশ্য প্রকট হওয়ায়, সেদিন আপাতত বেলুন আকাশে ওড়ানোর চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন জেনারেল লি। বন্দি থাকা ঝানু অফিসাররা কিন্তু জেনারেলের অধীনস্থতার খোলস ভেঙে বের হবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার ফায়দা লুটলেন তারা। রাতের অন্ধকারে একে একে সবাই চেপে বসলেন বেলুনে।
কিন্তু ঝড়ের কবলে বেলুনের গায়ে হয়ে গেছে ইয়া বড় ফুটো। নিচে ফুঁসছে অশান্ত সাগর। গ্যাস বেরিয়ে ক্রমশ নিচে পড়তে লাগল বেলুনটি। একে একে বেলুনে থাকা সকল জিনিসই সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেয়া হলো। এক লাফে খানিকটা উঁচুতে উঠলেও, সমুদ্রের সাথে তাদের উচ্চতার ব্যবধান বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। উথাল-পাতাল ঢেউয়ের উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছে বেলুনের আরোহীরা। ধারেকাছে ডাঙা আছে কিনা, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
একসময় বেলুন পানি ছুঁয়ে গেলে কোনোক্রমে সাঁতরে-হাতড়ে ডাঙায় ঠাঁই পায় যাত্রীগণ। কিছুক্ষণ পর তারা লক্ষ্য করল, ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং ও কুকুর টপ তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। সেখান থেকে একটা দ্বীপে আশ্রয় নেবার পর একের পর ঘটতে থাকে রহস্যময় কাণ্ডকারখানা। এভাবে সমান্তরাল গতিতে চলতে থাকে কাহিনী।
চরিত্র বিশ্লেষণ
ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং
চটপটে ব্যক্তিত্বের অধিকারী। দৈনন্দিন বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। ইঞ্জিনিয়ার কোরের এই ক্যাপ্টেনের বয়স ৪৫ ছুঁইছুঁই। পাথর খোদাই করা চেহারা। প্রখর বুদ্ধি আর তীব্র মনের জোর। কদমছাট চুল, ধূসর পুরো গোঁফ, অদম্য মনোবল ও তীব্র ইচ্ছাশক্তি। শুধু কাগজে-কলমে নয়, গাঁইতি আর হাতুড়ি চালিয়ে হাতেখড়ি নিয়েছেন প্রকৌশল বিদ্যায়।
গিডিয়ন স্পিলেট
নিউইয়র্ক হেরাল্ডের চিফ রিপোর্টার গিডিয়ন স্পিলেট। বিশাল শরীরের অধিকারী এই সাংবাদিকের বয়স চল্লিশ। ঠাণ্ডা মাথা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রচণ্ড সাহস, অপরিসীম উদ্যোগ আর উৎসাহ তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে উন্নতির শিখরে। যুদ্ধক্ষেত্রে এক হাতে পিস্তল ধরে অন্য হাতে খবর লেখায় অভ্যস্ত বলে খ্যাতি আছে তার।
পেনক্র্যাফট
পেশায় নাবিক। ক্যাপ্টেনের সাথে অনেকদিন আগে থেকেই পরিচয়।
নেব
ক্যাপ্টেন হার্ডিংয়ের পুরনো ভৃত্য এই নেব। ভূতপূর্ব মনিব শত্রুদের হাতে পড়েছেন শুনে জান বাজি রেখে ছুটে এসেছে সে। সাথে এনেছে হার্ডিংয়ের প্রিয় কুকুর টপকে।
হার্বার্ট
নেবের প্রাক্তন মনিবের ছেলে হার্বার্ট। ব্যবসার উদ্দেশ্যে দুজনই এসেছিল রিচমন্ডে।
লেখক পরিচিতি
‘জুল ভার্ন’ আর ‘রহস্য’, শব্দ দুটি যেন একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ততার মোড়কে আবদ্ধ। ১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি উড়োজাহাজ, রকেট কিংবা সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগের অনেক আগেই মহাকাশ ও সমুদ্র তলদেশ ভ্রমণের কাহিনী সাজিয়ে গিয়েছেন। কল্পনাশক্তির ধারায় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো এই লেখকের মতে, তার কল্পনাশক্তির বিস্তর পরিস্ফুটন ঘটিয়েছিল নদীতে জলযান চলাচলের দৃশ্য। আগাথা ক্রিস্টির পরেই তার লেখা বই সবচেয়ে বেশি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি জন্মেছিলেন ফ্রান্সের পশ্চিমে অবস্থিত নঁত নামক এক বন্দর শহরে। বাবার ইচ্ছায় আইনজীবী হয়ে, এ পেশায় ভালো খ্যাতি অর্জন করেন।
কিন্তু যার মন প্রকৃতির দস্যিপনা ও প্রাকৃতিক মহীরূহে অভিব্যক্ত, তিনি কি আর ছকবাঁধা নিয়মে জীবন অতিবাহিত করতে চান? তাই, সব ছেড়ে ভ্রমণ ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির জাদুতে এই পৃথিবী উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর যাত্রায় যে সকল যান তৈরি করা হয়েছে, তার ইঙ্গিত তিনি দিয়ে গেছেন দুইশ বছর আগেই। অথচ, তার লেখা কল্পবিজ্ঞান তৎকালীন অনেকের কাছেই ছিল হাসিঠাট্টার খোরাক। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড ঘরকুনো সৃজনশীল এই মানুষটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসেই লিখে গেছেন জগদ্বিখ্যাত সব কল্পবিজ্ঞানের আখ্যান।
তার লেখা ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি, ‘আ জার্নি টু দ্য সেন্টার অভ দ্য আর্থ’, ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’, ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’, ‘ডিক স্যান্ড’, ‘আ ক্যাপ্টেন অ্যাট ফিফটিন’ বইগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ বইটি তিনি প্রকাশ করেন ১৮৭৫ সালে। সায়েন্স ফিকশন ঘরানার এই কিংবদন্তি ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ তারিখ আমেরিকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অনুবাদক পরিচিতি
বাংলাদেশী পাঠকমহলে শামসুদ্দীন নওয়াব এক সুপরিচিত নাম। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক এক গুপ্তচর চরিত্র সৃষ্টি করেন। মৌলিক লেখা, অনুবাদ, প্রকাশনা- সবক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন নিজ প্রতিভার সু-স্বাক্ষর। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, সাজেদা খাতুনের কোল আলো করে ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্ম নেওয়া প্রতিভাবান মানুষটির ডাকনাম ছিল ‘নবাব’। ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন তিনি। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করে বের হন।
তার উল্লেখযোগ্য অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলারের মধ্যে রয়েছে ‘বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ’, ‘নোঙর ছেঁড়া’, ‘মাইকেল স্ট্রগফ’, ‘আশি-দিনে বিশ্ব-ভ্রমণ’, ‘মরু-শহর’, ‘পাতাল অভিযান’, ‘সাগর তলে’, ‘গুপ্তরহস্য’, ‘কার্পেথিয়ান দুর্গ’, ‘ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস’ ইত্যাদি। অর্জন ঝুলিতে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে বাচসাস, সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, ইত্যাদি পুরস্কার পুরে নিয়েছেন।
পুরো অনুবাদেই ছিল ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সাবলীলতার স্পষ্ট ছাপ। অনুবাদক এখানে তার দক্ষতাশৈলীর মুন্সিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন পুরোপুরি। বইয়ের প্রতিটি ঘটনাবিন্দু এমনভাবে মোড় নিয়েছে, এবং অনুবাদক প্রাঞ্জলতার সাথে তা উপস্থাপন করেছেন যে বইয়ের শুরু থেকে একধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হয়, যা পুরো বই শেষ না করলে তৃপ্ত হয় না। তিনি তার অনুবাদের অবারিত সৌন্দর্যভেলায় মগ্নতার কোনো কমতি রাখেননি। প্রায় শত পৃষ্ঠার কাছাকাছি এই বই পরিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলে ঠাসা। যথার্থ শব্দচয়ন, মসৃণ অনুবাদ পুরো বইটিকে করেছে জীবনদান, যার ফলে পাঠকের চাহিদা পূরণ হয়ে উঠবে।
আঠারো শতকে বসে জুল ভার্ন কীভাবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবার থেকে এগিয়ে চিন্তা করেছেন, সেটা ভাবাই দুরূহ। জনমানবহীন এক দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন অভিযাত্রীর দৈনন্দিন সংগ্রামই এ কাহিনীর মূল প্রতিপাদ্য। বইটি যে শুধু রহস্যের খোরাক, তা বলাটাও অনুচিত। কারণ, দ্বীপে আটকা পড়ার পর থেকে ওই পঞ্চপাণ্ডব যে বিজ্ঞানের সাহায্যে কত অসাধ্য যে সাধন করেছে, তা গুনে শেষ করা দায়। ঘড়ির কাঁচ দিয়ে আগুন জ্বালানোই হোক, মৌলিক পদ্ধতিতে দ্বীপের অক্ষাংশ নির্ণয় বা দ্বীপের অশোধিত খনিজ দিয়ে কার্তুজওলা বন্দুক, বা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য অভিনব সকল কৌশল, টিকে থাকার সকল রসদ নিজ প্রয়োজনে তৈরি করে নেওয়া, সবখানেই রয়েছে বিজ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
বিজ্ঞান জানা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই বেঁচে থাকা সম্ভব, তা আবারও প্রমাণ করে দিল এই বই। সামুদ্রিক গুল্ম পুড়িয়ে সোডা সমৃদ্ধ ক্ষার ও গ্লিসারিন, পাইরাইটস পুড়িয়ে সালফিউরিক এসিড, তা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে নাইট্রোগ্লিসারিন নামক বিস্ফোরক তৈরি, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্জন জনমানবহীন দ্বীপে সবকিছুর আয়োজন করা ছিল ক্যাপ্টেনের কাছে ছেলেখেলা মাত্র।
প্রশান্ত মহাসাগরের এক নির্জন দ্বীপে ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয় ওদের টিকে থাকার কঠোর সংগ্রাম। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা জীবনে বিপদে সবসময়ই একজন ত্রাণকর্তা যেন তাদের জন্য নেমে আসেন দেবদূত হয়। কিন্তু পরছায়ার মতো সবার অলক্ষ্যেই থাকে সে সত্ত্বা। একসময় ওরা আঁচ করতে পারে, নির্জন এই দ্বীপে তারা পাঁচজন ছাড়াও আরেকজন বসবাস করছে। রহস্যময় দ্বীপের সেই রহস্যময় ত্রাণকর্তার একগাদা রোমাঞ্চে নিজেকে আচ্ছাদন করতে চাইলে বইটি সে বৈশিষ্ট্যে এককাঠি সরেস।
বই: রহস্যের দ্বীপ
লেখক: জুল ভার্ন
অনুবাদক: শামসুদ্দিন নওয়াব
প্রকাশনা সংস্থা: প্রজাপতি প্রকাশন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৯৬ পৃষ্ঠা
মূল্য: ১৭৪ টাকা