নিত্যনতুন মুভি, সিরিজ আর বইয়ের কল্যাণে আমরা প্রতিনিয়ত কত শত চরিত্রের সাথেই না পরিচিত হচ্ছি। অনেক চরিত্রের গুরুত্ব বিস্মৃতির অন্তরালে মিলিয়ে গেলেও, কিছু কিছু চরিত্রের আবেশ দাগ কেটে যায় মনে, স্থায়ী হয় মস্তিষ্কের কোনে। তেমনই এক মহীয়ান চরিত্রের নাম হলো অ্যালবাস ডাম্বলডোর। মুখ ভর্তি তুষারশুভ্র দাড়ি, মাথায় লম্বা ঝলমলে সোনালি চুল, পরনে লম্বা ঢিলেঢালা দুই পাল্লার আলখাল্লা, হাতে রহস্যময় এক কাঠি- প্রথম দেখাতেই তাকে বিখ্যাত জাদুকর বলে চিহ্নিত করাটা তেমন কঠিন কিছু নয়।
লম্বা-খাড়া টুপির বদলে, শিরে স্থান করে নিয়েছে ছোট্ট এক টুপি; অন্যান্য প্রবীণ জাদুকরদের অবয়বের সাথে পার্থক্য শুধু সে জায়গাটাতেই। বৈচিত্র্যে ভিন্নতর, কিন্তু আকর্ষণে অনন্য এই জাদুকরের চাহনির বিস্ময়কর এক গাম্ভীর্য পুরো চরিত্রতে যোগ করেছে নিগূঢ় এক রহস্য, যা দেখে ঈর্ষণীয় এক মোহময় শৈশব কেটেছে আমাদের। হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির নিউক্লিয়াসখ্যাত শ্রদ্ধাভাজন ও মহান জাদুকর অ্যালবাস ডাম্বলডোর। তার নানা দিক নিয়েই এখানের আলোচনা।
শেষ বিদায়ে অ্যালবাস ডাম্বলডোর
হ্যারি পটার মুভি সিরিজের ষষ্ঠ কিস্তিতে সেভেরাস স্নেইপের হাতে প্রয়াণ ঘটে মহামতি অ্যালবাস ডাম্বলডোরের। তবে দুঃখের বিষয়, প্রত্যক্ষ মর্মপীড়ার অনুভূতি জাগানো এই দৃশ্যের পরবর্তী অংশটুকু সেলুলয়েডের ফিতায় ধারণ করা হয়নি, তাই মুভি ভক্তরা হৃদয়বিদারক এক উপাখ্যানের সমাপ্তি দেখতে পারেনি।
হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স বইয়ে এর বিস্তারিত বর্ণনা হয়েছে ধাপে ধাপে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এ যশস্বী জাদুকরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিল অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স, হগওয়ার্টস, জাদু মন্ত্রণালয়ের সকল কলাকুশলী। এমনকি দর্শক ও পাঠকের ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকা দুই চরিত্র, ডলোরেস আমব্রেজ ও রিটা স্কিটারের মতো মানুষও তার শেষ যাত্রায় নীরবতা পালন করেছিল।
অভিঘাতী ডাম্বলডোর?
হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস বইয়ের দরুন পটারহেডরা বিচিত্রকর্মা ডাম্বলডোরের পূর্বকাহিনী জানার অনেক সুযোগ পেয়েছে। সুদক্ষ একজন জাদুকর হবার পাশাপাশি তিনি ছিলেন অসীম দয়ার অধিকারী। কিন্তু যুবক বয়সে তিনি এক গুরুতর ভুল করে বসেন, যার অনুশোচনার আগুনে তিনি তপ্ত হয়েছেন জীবনের বাকিটা সময়। তখন তার গভীর সম্পর্ক ছিল আরেক বিখ্যাত জাদুকর গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের সাথে।
হঠাৎ একদিন অ্যালবাস, তার ভাই অ্যাবারফোর্থ, এবং গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ বেঁধে যায়। অসতর্কতা হোক বা অনিচ্ছাকৃত ভুল, এক মৃত্যুশাপে প্রাণ হারায় তার বোন অ্যারিয়ানা ডাম্বলডোর। তিনজনের মধ্যে কে মূলত হত্যার জন্য দায়ী, সেটা কেউ সঠিকভাবে জানত না। পুরো ব্যাপারটাই সারাজীবন ধোঁয়াশায় থেকে গেছে। এর ফলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অ্যালবাস বুকে গুমরে থাকা অসন্তোষ ও অনুশোচনা নিয়ে জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন।
প্রিফেক্ট ও হেড বয় হিসেবে ডাম্বলডোর
ডাম্বলডোরের মতিগতি বোঝা দায়। শিক্ষার্থীদের মেধার কদর করতেন খুব, যা দেখে বোঝা যায় তিনি নিজেও এককালে হগওয়ার্টসের আনাচে-কানাচে ছড়িয়েছেন মেধার বিচ্ছুরিত প্রতিফলন। সপ্রতিভ ডাম্বলডোরকে হ্যারি পটারের আমলের কারো সাথে তুলনা দেওয়া হলে, তা দেওয়া যাবে শুধু প্রত্যুৎপন্নমতি হারমায়োনি গ্রেঞ্জারকে দিয়েই।
ডেথলি হ্যালোস বই থেকে জানা গিয়েছে, ছাত্রাবস্থায় গ্রিফিন্ডরের প্রিফেক্ট ও হেডবয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিরলস ও কর্মনিষ্ঠ ডাম্বলডোর। প্রিফেক্ট হলো হগওয়ার্টসের এমন একটি পদ, যাতে দায়িত্বরত শিক্ষার্থীরা হাউজের প্রধান (হাউজ হেড) ও প্রধান শিক্ষককে হাউজ সম্পর্কে সকল হালনাগাদ তথ্য জানাবে, এবং হাউজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেকোনো অনুশাসন প্রয়োগ করবে।
কর্তব্যের প্রতি কতটুকু নিবেদিত ও স্বভাব-চরিত্রে কেমন চালাক-চতুর হলে এই দুই পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় হয়ে যে তিনি জাদু দুনিয়া কাঁপিয়ে-দাপিয়ে বেড়াবেন, এর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে সেই ছোটবেলাতেই। এছাড়াও তিনি ড্রাগনের রক্তের বারোটি ব্যবহার উদ্ভব করে নিজ প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বন্ধু নিকোলাস ফ্লামেলের সাথে হাত লাগিয়ে বিখ্যাত পরশপাথর তৈরিতেও তার অবদান অপরিসীম।
বোগার্ট ও ডাম্বলডোর
হগওয়ার্টসে বোগার্ট নামে একপ্রকার আকৃতি পরিবর্তনকারী ভূত আছে, যাকে শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত করানো হয় ‘ডিফেন্স অ্যাগেইনস্ট ডার্ক আর্টস’ কোর্সে। যে জিনিসে মানুষের অধিক ভয়, বোগার্ট সে ভয়কে পুঁজি করেই তার সামনে সে জিনিসের রূপ ধারণ করবে। মনে হচ্ছে, রন উইজলির সামনে ভেসে উঠা মাকড়সারূপী বোগার্টই আপনার দেখা সবচেয়ে জঘন্য বোগার্ট? তাহলে বলে রাখছি, ডাম্বলডোরের কাছে সেই বোগার্ট দেখা দিত তার বোন আরিয়ানার লাশের আকৃতিতে!
ডাম্বলডোরের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী
প্রফেসর সিবিল ট্রিলনির করা সবচেয়ে বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণী হলো ‘দ্য চোজেন ওয়ান’, যার ফলে পতন ঘটেছিল লর্ড ভলডেমর্টের। প্রফেসর ডাম্বলডোরের মৃত্যু সম্পর্কিত তার করা কঠোর ভবিষ্যদ্বাণীও কাঁটায় কাঁটায় মিলে গিয়েছিল। ক্রিসমাসের সময় তাকে একটি টেবিলে বসে ভোজনে যোগ দেয়ার অনুরোধ করা হলে, তিনি সেটি অগ্রাহ্য করে বলেন,
“যখন তেরোজন একসাথে খায়, প্রথমে উঠা ব্যক্তিই প্রথম মারা যায়!”
সবার দৃষ্টির অগোচরেই পিটার পেটিগ্রু সহ ঐ টেবিলে মোট তেরোজন উপস্থিত ছিল। আর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টেবিল থেকে উঠে যাওয়ায় অ্যালবাস ডাম্বলডোর ঠিকই মৃত্যুমুখে পতিত হন।
স্মৃতি সংরক্ষণ
হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স সিনেমায় দর্শকরা স্মৃতিপাত্র থেকে শুধুমাত্র দুটি স্মৃতির কথা জানতে পেরেছে। একটি হলো, এতিমখানায় বালক টম রিডলের সাথে অ্যালবাস ডাম্বলডোরের সাক্ষাৎ, অপরটি হরক্রাক্স সম্পর্কে ছাত্র রিডল ও প্রফেসর স্লাগহর্নের কথোপকথন।
কিন্তু বইয়ে স্মৃতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জিনিস খোলাসা করা হয়েছে। ডাম্বলডোরের কাছে আরও বিখ্যাত ও দুষ্প্রাপ্য কিছু স্মৃতি সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল, যেগুলো সিনেমায় দেখানো হলে ভক্তদের কাছে তা হয়ে থাকত হাতের মুঠোয় আবদ্ধ নস্টালজিয়ার মতো। যেমন, জাদু মন্ত্রণালয়ের পুরনো কর্মী বব ওগডেন তার কর্মজীবনে টম রিডলের পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন, এমন স্মৃতি সংরক্ষণে ছিল তার। আরেকটি ছিল হঙ্কি দ্য হাউজ এলভ করুণ বর্ণনা- কীভাবে চশমখোর ভলডেমর্ট হেপজিবাহ স্মিতকে মেরে তার জিনিসগুলো ছিনিয়ে নিয়েছিল, তা নিয়ে। এ রকম অসংখ্য স্মৃতি ডাম্বলডোরের নিকট সংরক্ষিত ছিল, যা হ্যারি পটার সিনেমায় চিত্রায়িত করা হয়নি।
ভলডেমর্টকে প্রত্যাখ্যান
টম রিডলের মনে কালো জাদুর অসীম ক্ষমতা আয়ত্তে রাখার খায়েশ জন্মানোর পর, সে দশ বছরের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এ সময়েই সে কালো জাদুর খুঁটিনাটি রপ্ত করার পাশাপাশি, হরক্রাক্স তৈরিতে মন দিয়েছিল। দশ বছর পর সে যখন হগওয়ার্টসে ফিরে এল, ডাম্বলডোর তখন হগওয়ার্টসের প্রধান শিক্ষক। তখন রিডল ‘ডিফেন্স অ্যাগেইনস্ট ডার্ক আর্টস’ বিষয়ের প্রফেসর হতে চাইলে, ডাম্বলডোর তাকে বাধা দেন। কারণ, ডাম্বলডোর রিডলের অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আঁচ করার পাশাপাশি, অশুভ কিছুর আভাস পেয়েছিলেন। রিডল তখন রেগে মেগে অভিশাপ দেয়, এক বছরের বেশি কোনো শিক্ষক হগওয়ার্টসে এ বিষয় পড়াতে পারবে না। সেই থেকে হগওয়ার্টসে ডিফেন্স অ্যাগেইনস্ট ডার্ক আর্টস পদে এক বছরের বেশি কোনো শিক্ষক স্থায়ী হতে পারেননি।
পরিবার প্রীতি
ডাম্বলডোরের সৎ ব্যক্তিত্বের গুণ সকলের কাছেই সমবণ্টনে সমাদৃত। বাকনিষ্ঠ এই মানুষটিকে কারো সাথে কখনো মিথ্যা বলতে দেখা যায়নি, আর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র হ্যারি পটারের সাথে তো মিথ্যা বলার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু এখানটায় কাহিনী একটু বাঁক নিয়েছে। এরিসেডের আয়না নিয়ে একটি বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন অ্যালবাস ডাম্বলডোর।
তিনি হ্যারিকে বলেছিলেন, এরিসেডের আয়নায় তিনি নিজেকে সহ একজোড়া ঝকঝকে নতুন মোজা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু সে সময় এরিসেডের আয়নায় ডাম্বলডোর তার পরিবারকে (বোন অ্যারিয়ানা, ভাই অ্যাবারফোর্থ, মা কেন্ড্রা, বাবা পারসিভাল) জীবিত, হাসি-খুশি, ও প্রাণবন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। ২০০৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে জে. কে. রোলিং এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।
গোপন উদ্দেশ্য
হগওয়ার্টস থেকে গ্রাজুয়েশনের পর ডাম্বলডোরের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ‘ডিফেন্স অ্যাগেইনস্ট ডার্ক আর্টস’ বিষয়ের প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হওয়া। কারণ, তার প্রিয় বন্ধু গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ড তখন কালো জাদুর অভিশপ্ত পথে পা বাড়িয়েছেন। সে যেকোনো সময় মাথা চাড়া দিয়ে জাদু জগতে সৃষ্টি করতে পারে ভয়াবহ ত্রাস। জাদু জগতের জন্য যে সেটা অসামান্য দুর্গতি বয়ে আনবে, ডাম্বলডোর তা ভালো করেই জানতেন। হগওয়ার্টসে ঐ পদে প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হবার পর, তরুণ জাদুকরদের কালো যাদুর বিপক্ষে আত্মরক্ষার কৌশল শিখিয়ে পাকাপোক্ত করতে লাগলেন, শান দিলেন তাদের দক্ষতার কাঁচিতে, যাতে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের কাছে জাদু জগৎকে মাথা নত না করতে হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সাল থেকে ১৯৩০, টানা ২০ বছর যাবত এ পদে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।
বিষাদময় অধ্যায়
আঠারো বছর বয়সী ডাম্বলডোর যখন তার বন্ধু এলফিয়াস ডজের সাথে পুরো দুনিয়া জুড়ে গ্রাজুয়েশন পরবর্তী সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই ঘটে বসে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। একবার ডাম্বলডোরের বোন অ্যারিয়ানার উপর একদল মাগল যুবক আক্রমণ করায় ক্রোধের বশে তাদের উপর জাদু প্রয়োগ করেছিলেন অ্যালবাসের বাবা পারসিভ্যাল।
জাদু নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করার দরুন, তার বাবাকে আজীবনের জন্য আজকাবান কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। সেখানে থাকা অন্ধকারকে নিত্যসঙ্গী বানিয়ে, নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ধুঁকতে ধুঁকতে একেবারে ভগ্নদশার দ্বারপ্রান্তে ঠেকেছেন তিনি। নিজ জাদুবিদ্যার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায়, অ্যারিয়ানার হাতে দুর্ঘটনাবশত প্রাণ খুইয়ে বসেন তার মা কেন্ড্রা। একদিকে কারাগারে বন্দি বাবা, অপরদিকে মাতৃবিয়োগে সর্বহারা হয়ে পড়েছিলেন যুবক বয়সী অ্যালবাস ডাম্বলডোর।
ডাম্বলডোর চরিত্রের কুশীলব
সিরিজের প্রথম দুই সিনেমায় ডাম্বলডোর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আইরিশ অভিনেতা রিচার্ড হ্যারিস। বয়সের ভারে স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়ায় প্রথম প্রস্তাবে অভিনয় করতে রাজি হননি তিনি। কিন্তু যখন তার ১১ বছরের নাতনী নানাকে বিশ্বখ্যাত জাদুকরের ভূমিকায় দেখার ইচ্ছা পোষণ করল, তখন তিনি স্টুডিওকে দিয়ে দিলেন গ্রিন সিগন্যাল। সিরিজের তৃতীয় মুভির নির্মাণ নিয়ে যখন কথাবার্তা চলছিল, তখন রিচার্ড হ্যারিস প্রযোজক ড্যাভিড হেইম্যানকে জানান, তাকে যেন আর ডাম্বলডোর চরিত্রে কাস্ট না করা হয়। দুঃখের বিষয়, প্রিজনার অভ আজকাবান সিনেমা তৈরির আয়োজন শুরু করার কিছুদিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন রিচার্ড হ্যারিস।
অ্যালবাস ডাম্বলডোর চরিত্রে তখন নতুন একজন অভিনেতা দরকার। শুরুতে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল খ্যাতিমান অভিনেতা স্যার ইয়ান ম্যাককেলেনকে। কিন্তু দুটো কারণে তিনি প্রস্তাবটি না করে দিয়েছিলেন। প্রথমত, তিনি কালজয়ী ফ্যান্টাসি ‘লর্ড অভ দ্য রিংস’- এর জাদুকর গ্যান্ডালফ হিসেবে অভিনয় করেছেন। তাই, একই ধাঁচের চরিত্রে দ্বিতীয়বার অভিনয় করার মাঝে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাননি। দ্বিতীয়ত, হ্যারিস একবার ম্যাককেলেনকে ‘বিরক্তিকর’ অভিনেতা বলে খোঁটা দিয়েছিলেন। তাই চরিত্রটি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন তিনি।
তারপর লোভনীয় সেই জাদুকরী চরিত্রের লটারি লেগে যায় মাইকেল গ্যামবনের ভাগ্যে। যিনি একাধারে ফ্র্যাঞ্চাইজির তৃতীয় থেকে অষ্টম সিনেমা পর্যন্ত দক্ষতার সাথে নিরবচ্ছিন্ন অভিনয় করে গেছেন। ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস: দ্য ক্রাইমস অভ গ্রিন্ডেলওয়াল্ড’ সিনেমায় নওজোয়ান ডাম্বলডোরের অবতারে ভূমিকা পালন করেছেন ইংরেজ অভিনেতা জুড ল।
সবজান্তা সমীপেষু
জে. কে. রোলিং তার কল্পনাপ্রসূত ‘উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড’ তথা ‘জাদু জগৎ’কে নিজ ভাষায় বর্ণনার জন্য এত এত চরিত্রের মাঝ থেকে বেছে নিয়েছেন অ্যালবাস ডাম্বলডোরকে। ধরে নিতে পারেন, ডাম্বলডোরের মুখনিঃসৃত বাণীই রোলিংয়ের অব্যক্ত মনোভাব। জে. কে. রোলিং যেমন জাদু জগতের আদ্যোপান্ত সব জানেন, তেমনি উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের খুঁটিনাটি ডাম্বলডোরের নখদর্পণে। জ্ঞান উৎসের উন্মোচনে, অ্যালবাস সর্বদাই ছিলেন তৃষ্ণার্ত।
নামকরণ
কখনো কি মাথায় এসেছে, ‘ডাম্বলডোর’ নামের উৎপত্তি কোথায় থেকে? বিষয়টা খুলে বলা যাক। জে. কে. রোলিং হগওয়ার্টসের প্রধান শিক্ষককে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত করার উদ্দেশ্যে কল্পনার ডানা মেলে ধীরচিত্তে ভাবনার সাগরে তলিয়ে গেলেন। তিনি চাইছিলেন, তার প্রধান শিক্ষক হবেন সঙ্গীতপ্রেমী। তখনই তার কল্পনায় এমন চিত্র ভেসে উঠল, যেখানে তিনি দেখলেন তার প্রধান শিক্ষক ভ্রমরের মতো গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এদিক-ওদিক পায়চারি করছেন। তাই তিনি ওই সুরেলা পতঙ্গের প্রাচীন এক ইংরেজি খুঁজে বের করলেন, যে শব্দটি ছিল, ‘ডাম্বলডোর’। সামান্য এক পোকা থেকে বিশ্বখ্যাত জাদুকরের নাম আসনে ঠাঁই পাওয়ার সৌভাগ্য কয়টি জীবের কপালে মেলে?
সর্প-ভাষা
ডাম্বলডোর সর্প-ভাষা বুঝতেন। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স’ বইয়ে উল্লেখ করা আছে, ডাম্বলডোর হ্যারিকে স্মৃতিপাত্রে জাদু মন্ত্রণালয়ের এক পুরনো কর্মকর্তা বব ওগডেনের একটা স্মৃতি দেখাচ্ছিলেন। সেখানে ওগডেন গন্ট পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করার সময়, টম রিডলের সকল আত্মীয়-স্বজন তখন একে অপরের সাথে সর্প-ভাষায় কথা বলছিল। সেসময় ডাম্বলডোর অনেকের কথার মর্মার্থই উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। বিষয়টি জে. কে. রোলিং ২০০৭ সালে ব্লুমসবেরি কর্তৃক আয়োজিত এক লাইভ চ্যাটে নিশ্চিত করেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি মারমিশ (হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পানির নিচের জীবেরা যে ভাষা ব্যবহার করে) এবং গবলিনের ভাষায়ও ছিলেন সমান পারদর্শী।
সর্প-ভাষা মূলত সালাজার স্লিদারিনের উত্তরসূরীদের একটি বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ডাম্বলডোর স্লিদারিন পরিবারের সাথে কোনোভাবে যুক্ত- এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত উঠে আসেনি। কীভাবে তিনি এ ভাষা রপ্ত করেছেন, তা এক বিস্ময়!
ডেথলি হ্যালোস
জাদু জগতে ডাম্বলডোরই প্রথম জাদুকর, যিনি তিনটি ডেথলি হ্যালোস বাগাতে পেরেছেন। হয়ত তিনটি একসাথে পাননি, কিন্তু তিনি ছাড়া আর কেউ জীবদ্দশায় এই তিন বস্তু স্পর্শ করতে পারেননি। হ্যারির মা-বাবা মারা যাওয়ার পর অদৃশ্য আলখাল্লা, গন্ট পরিবারের আংটি (হরক্রাক্স) থেকে পাওয়া পুনর্জন্মী পাথর, আর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে পরাজিত করার মাধ্যমে হাসিল করেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুর ছড়ি এল্ডার ওয়ান্ড। এই তিনটি বস্তুই মূলত ডেথলি হ্যালোসের উপাদান, যা দিয়ে মৃত্যুকে পর্যন্ত ধোঁকা দেয়া যায়।
সমাধিসৌধ
পুরো হগওয়ার্টসে শুধুমাত্র একজন জাদুকরের সমাধি রয়েছে, আর তিনি হলেন অ্যালবাস ডাম্বলডোর। তার এই সমাধিক্ষেত্র ‘দ্য হোয়াইট টম্ব’ নামে পরিচিত, যেখানে এই মহান জাদুকর চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। হগওয়ার্টসকে নিজের একমাত্র ঠিকানা বলে বিবেচনা করায়, তার শেষ ইচ্ছা ছিল, তাকে যেন এখানেই সমাধিস্থ করা হয়।
দীর্ঘ এক জীবন
বুড়ো ও বিজ্ঞ এই জাদুকর তার জীবনে পার করেছেন মোট ১১৫টি বসন্ত, এমনটিই বলছে জে. কে. রোলিংয়ের জাদু জগৎ সম্পর্কিত ওয়েবসাইট পটারমোর। রোলিং ওয়েবসাইটে ডাম্বলডোরের জন্মসাল নিয়ে কিছু বলেননি, শুধু বলেছেন, তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৫ বছর বয়স পর্যন্ত। সিধে গাণিতিক হিসেব কষে বয়সটা নিমেষেই বের করে ফেলা যায়। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বা ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসে মৃত্যু হয় ডাম্বলডোরের। যা থেকে স্পষ্ট, তার জন্ম ১৮৮১ সালে। এই সালের আড়ালে জে. কে. রোলিং অবশ্য চমৎকার এক রূপকের আভাস দিয়ে গেছেন।
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন ১৮৭৯ সালে, এবং ব্রিটেনে প্রথম শহর ও প্রথম থিয়েটার বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আসে ১৮৮১ সালে। মজার ব্যাপার হলো, ডাম্বলডোর ডেলুমিনেটর নামে এক যন্ত্রের আবিষ্কার করেছিলেন, যেটি রাস্তায় প্রজ্বলিত সকল বাতিকে মুহূর্তেই নিভিয়ে ফেলতে পারত। হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন বইয়ের প্রথম দিকেই এই জাদুকরী যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্ডার অভ মার্লিন
জাদু জগতে অর্ডার অভ মার্লিন একেবারে প্রথম সারির এক পুরস্কার, যা দেওয়া হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা জাদুকর মার্লিনের সম্মানার্থে। যে সকল জাদুকর খ্যাতির চূড়ায় আহরণ করে, মেধা, সাহসিকতা ও সৃজনশীলতা দ্বারা অভাবনীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারে, তাদেরকে ‘দ্য অর্ডার অভ মার্লিন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মার্লিন হয়তো কখনো পটারভার্সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তাকে সর্বকালের সেরা জাদুকরদের একজন ধরা হয়। তিনি ছিলেন সালাজার স্লিদারিনের একেবারে নিজ হাতে গড়া ছাত্র, অর্থাৎ স্লিদারিনের আমলেই তিনি হগওয়ার্টসে ভর্তি হয়েছিলেন।
ডাম্বলডোর এ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার প্রিয় বন্ধু, বিপথগামী, ও ১৯৪০ এর দশকে জাদু জগতে ত্রাস সৃষ্টি করা জাদুকর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে পরাভূত করার মাধ্যমে। ১৯৪৫ সালের শেষ দিকে, ডাম্বলডোর ও গ্রিন্ডেলওয়াল্ড এক মল্লযুদ্ধে অংশ নেয়, যাতে পরাজয় ঘটে দুর্ধর্ষ জাদুকর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের হাতে জাদু জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুর ছড়ি এল্ডার ওয়ান্ড থাকা সত্ত্বেও, জয় পান ডাম্বলডোর।
অদৃশ্য হবার অলৌকিক ক্ষমতা
অন্যান্য জাদুকরদের যেখানে অদৃশ্য হবার জন্য ‘অদৃশ্য আলখাল্লা’ পরতে হতো, সেখানে ডাম্বলডোর তৎক্ষণাৎ শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারতেন কোনো আলখাল্লা, পোশাক, বা জাদু ছড়ির সাহায্য ছাড়াই। এজন্য ডাম্বলডোরকে উচ্চারণ করতে হতো ‘ডিসইল্যুশনমেন্ট চার্ম’ নামক বিশেষ এক মন্ত্রের, যা পাঠে ব্যক্তির চারপাশে থাকা বিভিন্ন বস্তু খানিক সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেত। জিনিসগুলো সেখান থেকে গায়েব হতো না ঠিকই, এর অস্তিত্ব থাকত। মন্ত্র-প্রভাবে শুধু এর উপস্থিতি ঢাকা পড়ত লোকচক্ষুর আড়ালে। ঠিক একই ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিল গ্রিন্ডেলওয়াল্ড নিজেও। তাই ধারণা করা হয়, যুবক বয়সেই দুই বন্ধু জাদু কেরামতির এই দুর্বোধ্য কৌশল নিপুণভাবে রপ্ত করেছিলেন।
ছড়িবিহীন যাদু ও সাইলেন্ট ম্যাজিক
জাদুর ছড়ি ছাড়া জাদু এবং মুখ দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ ব্যতীত নীরবে জাদু প্রয়োগ করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য রপ্ত করতে হয় নিগুঢ় সকল জাদুবিদ্যা, পাড়ি দিতে হয় কঠোর সাধনার পথ। পৌঁছুতে হয় জাদু কৌশলের স্বর্ণশিখরে।
গ্রেট হলের উৎসবে ডাম্বলডোরকে ছড়িবিহীন যাদু ও সাইলেন্ট ম্যাজিক ব্যবহার করতে দেখা যেত। তার হাতের এক তুড়িতেই লোভনীয় ও সুস্বাদু সকল খাবারে উপচে উঠত শিক্ষার্থীদের টেবিল, জ্বলে উঠত সহস্রাধিক মোমবাতি, বিজয়ী হাউজের নিশানায় ছেয়ে যেত পুরো গ্রেট হল। এমনকি কেউ অদৃশ্য আলখাল্লা পরিধান করেও ডাম্বলডোরের হাত থেকে বাঁচতে পারত না। কারণ, তিনি নীরবে ‘হোমেনাম রেভেলিও’ মন্ত্র ব্যবহার করেই আলখাল্লা পরিধানকারীর গোপন পর্দা ফাঁস করে দিতে পারতেন।
ছড়িবিহীন জাদু প্রয়োগ করে তিনি অনেকবার বাঁচিয়েছেন হ্যারি পটারের জীবন। হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অভ আজকাবানে উল্লেখিত এক কুইডিচ ম্যাচে ডিমেন্টরদের হামলায় জাদুর ঝাড়ু থেকে পড়ে গিয়েছিল হ্যারি। কয়েকশো ফুট উঁচু থেকে মাটিতে পড়লে হাড়গোড় একটাও আস্ত না থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সে যাত্রায় ডাম্বলডোরের জাদুর দরুন প্রাণে বেঁচে ফিরে হ্যারি পটার। জাদু মন্ত্রণালয়ে ভলডেমর্ট যখন হ্যারি পটারের সাথে মল্লযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে দায়িত্বশীল অভিভাবকের উপস্থিত হন অ্যালবাস ডাম্বলডোর। সেখানেও তিনি ছড়ি ছাড়াই রক্ষা করেন হ্যারি পটারের প্রাণ।
রাশভারি কিন্তু বন্ধুসুলভ, মানবিক, নিষ্ঠাবান, ও অসীম সাহসের অধিকারী অ্যালবাস ডাম্বলডোর জাদু জগৎকে কালো জাদুর আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে সর্বদা শুভশক্তির গলায় বিজয়মালা পরাতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। এজন্য তিনি নিজের জীবন বলি দিতেও পিছপা হননি। একরাশ মুগ্ধতা ছড়ানো বুড়ো এই কাল্পনিক চরিত্রটি আমাদের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছে এখনো।
যতদিন ফ্যান্টাসি টিকে আছে, তার অবিনশ্বর কীর্তি পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে স্ব-মহিমায়।